চারটে নাগাদ ট্যুরিস্ট বাসগুলো সাধারণত ফিরে আসে। আজ দুপুরের পর থেকেই এখানে ঠাণ্ডাটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। ঠাণ্ডা বাড়লে রাস্তায় লোক কমে যায়। প্রদীপ আর লিটন বাইক নিয়ে স্ট্যাণ্ডে অপেক্ষা করছিল। একটার পর একটা বাস ফিরছে। প্রদীপ যাত্রীদের লক্ষ করছিল। লোকটাকে দেখেই বোঝা যাবে যে মিলিটারিতে ছিল একসময়। মুখগুলো খুঁটিয়ে দেখে হতাশ হচ্ছিল সে।
কিছুক্ষণ আগে দার্জিলিং-এ টেলিফোন করেছে সে। একটা ব্যাপার তাকে কিছুটা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। রণতুঙ্গার খুন হওয়ার খবরটা পেয়ে ভদ্রলোক কোনও প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। শুধু বললেন, ‘তোমার এখনও অনেক কাজ বাকি। ওই হোটেলের কাছাকাছি যেও না। আমি চাই না কোনও ঝামেলায় তুমি জড়িয়ে পড়।’
প্রদীপ বলেছিল, ‘মনে হচ্ছে আমার কোনও অ্যাণ্টি পার্টি এখানে কাজ করছে।’
‘হতে পারে। এখনও একজন ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বের করতে হবে তোমাকে।’
‘তাহলে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা?’
‘তুমি পাবে।’
খটকা লাগছে দুটো জায়গায়। রণতুঙ্গার ছবি অন্য লোক নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে কথার খেলাপ করছেন না ভদ্রলোক। উনি ইচ্ছে করলে টাকার অঙ্ক কমিয়ে দিতে পারতেন। হঠাৎ এই উদারতার মানে কী? দ্বিতীয়ত, এসো. কে. শর্মা এখন শিলিগুড়িতে। আজ রাত্রে দার্জিলিং মেল ধরবে লোকটা। তার কাছে ছবি আছে। তাকে ধরলে দুজন ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বের করা বাকি! আর উনি বললেন একজনের কথা। শর্মার দায়িত্ব কি উনি অন্য কাউকে দিচ্ছেন? দিয়ে থাকলে তো তাকে ওঁর পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা নয়। প্রদীপ কিছুই বুঝতে পারছিল না।
এইসময় এভারেস্ট ট্যুরিজমের একটা বাস ফিরে এল। যাত্রীরা নামছে। হঠাৎ প্রদীপের নজর পড়ল একজনের ওপর। লম্বা, মেদহীন শরীর। পরনে গরম স্যুট। বয়স হলেও সেটা বোঝা যায় না। গোঁফ বলে দিচ্ছে মানুষটি সাধারণ কাজকর্ম কখনও করেননি। কাঁধ থেকে চামড়ার স্ট্র্যাপে ক্যামেরা ঝুলছে। বাস থেকে নেমে গটগট করে হাঁটতে লাগলেন ভদ্রলোক।
প্রদীপ লিটনকে বলল, ‘আমি এখন যার সঙ্গে কথা বলব তুই তাকে ফলো করে দেখে আসবি কোন হোটেলে উঠেছে এবং কতদিন সেখানে থাকার কথা। কাজটা সাবধানে করবি।’ লিটনের জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করেই প্রদীপ এগিয়ে গেল।
পিছন থেকেই বোঝা গেল এই বয়সেও ভদ্রলোক ভাল শক্তি রাখেন। প্রদীপ একেবারে কাছে পৌঁছে বিনীত স্বরে বলল, ‘এক্সকিউজ মি।’
ভদ্রলোক দাঁড়ালেন, গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ইয়েস।’
‘আমার নাম প্রদীপ গুরুং। কলকাতার একটা সংবাদপত্রের লোকাল করেসপণ্ডেণ্ট।’
‘আচ্ছা।’
‘আমি বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত। আপনি গতকাল সিকিম-টিবেট বর্ডারে গিয়েছিলেন। আবার আজও সেখানে গেলেন। এই ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।’
ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘আমি গতকাল গিয়েছিলাম আপনি কী করে জানলেন?’
‘এটা আমি জেনেছি। আসলে আমি ওই ব্ল্যাক লেপার্ডের সম্পর্কে কৌতূহলী।’
‘ব্ল্যাক লেপার্ড?’
‘হ্যাঁ। গতকাল তো আপনারা ওখানে ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছেন।’
‘কে দেখেছে জানি না, কিন্তু আমি তো দেখিনি।’
‘স্যার, আমি শুনেছি গতকাল একটা ট্যুরিস্টবাসের যাত্রীরা ওখানে ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং দৃশ্য দেখেছেন। ওই অঞ্চলে ব্ল্যাক লেপার্ড আছে বলে কেউ কখনও শোনেনি। বুঝতেই পারছেন খবরটা খুব চাঞ্চল্য তৈরি করবে।’
‘ইয়ং ম্যান! আপনাকে ওই ব্ল্যাক লেপার্ডের গল্পটা যে শুনিয়েছে তার বাসে আমি ছিলাম না এটুকুই শুধু বলতে পারি।’
‘গতকাল আপনি যে বাসে ছিলেন তাতে আরও দুজন ফটোগ্রাফার ছিলেন?’
‘হ্যাঁ। এই খবরটা ঠিক। কারণ ওই দুজন ছাড়া কারও হাতে ক্যামেরা দেখিনি।’
‘একজন বয়স্কা বিদেশিনী ছিলেন?’
‘হ্যাঁ। বর্ডারে যাওয়ার জন্যে তার কথা চেকপোস্টে বলতে হয়েছিল।’
‘আর আপনি বলছেন ওখানে কোনও ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেননি?’
‘না।’
‘আপনি কোনও ছবি তোলেননি?’
‘হ্যাঁ। ছবি তুলেছি। সেই ছবির রোল শেষ করতে আজ আবার ওই স্পটে গিয়েছিলাম। ওটা প্রিণ্ট না করা পর্যন্ত আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় কী ছবি তুলেছি। শুধু আপনাকে বলতে পারি, গতকাল ওখানে একটা মার্ডার হয়েছিল।’
‘মার্ডার?’
‘হ্যাঁ। ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না।’
সঙ্গে-সঙ্গে প্রদীপের দুটো পা কনকন করে উঠল। তার মনে পড়ল রণতুঙ্গা তাকে দেখে পুলিশ কি না জানতে চেয়েছিল। সেই মেমসাহেব পুলিশ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন। সে দেখল ভদ্রলোক রাস্তার বাঁকে চলে গেছেন এবং তার কিছুটা পেছনে লিটন হাঁটছে।
মোটরবাইকের কাছে ফিরে এসে সমস্ত ব্যাপারটা নতুন করে ভাবতে চাইল প্রদীপ। সে প্রথমে চন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিল যে ওই ট্যুরিস্ট বাস চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে। লোকটা একবারও তাকে বলেনি যে ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছে। বরং ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ওর কাছ থেকে খবর পেয়ে সে গিয়েছিল বিদেশিনী মহিলা লিসার কাছে। লিসাও একবারও বলেননি ব্ল্যাক লেপার্ডের কথা। কিন্তু তিনি খুব উত্তেজিত ছিলেন। ওঁর কাছ থেকে যায় রণতুঙ্গার কাছে। রণতুঙ্গা পুলিশের ভয়ে ভীত ছিল কিন্তু ব্ল্যাক লেপার্ড শব্দ দুটো ওর মুখ থেকেও শুনতে পায়নি সে। বরং রণতুঙ্গা এমন কিছুর ছবি তুলেছিল যা সে নিজে খবরের কাগজে ছাপতে চায়। আর এই সব মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রদীপ ধরেই নিয়েছিল এঁরা ব্ল্যাক লেপার্ড দেখে এসেছেন। ওঁদের ওই ব্যাপারে সরাসরি প্রশ্ন করার কথা একবারও তার মাথায় আসেনি।
মোটরবাইক চালু করে ট্যুরিস্ট লজে চলে এল প্রদীপ। গিয়ে শুনল লিসা দুপুরে বেড়াতে বেরিয়েছেন, একাই। ভদ্রমহিলার দেখা পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হল অনেকক্ষণ। লিসা যখন ফিরছেন তখন তার হাতে একটা বড় প্যাকেট। প্রদীপ হাসল, ‘গুড আফটারনুন ম্যাডাম।’
‘হ্যালো! তুমি আবার এখানে?’
‘আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল।’
‘আমি তো তোমাকে বলেছি এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি বিদেশি। আগামীকাল চলে যাব। কোনও ঝামেলায় জড়াতে চাই না আমি।’
‘আপনাকে আমি কোনও ঝামেলায় ফেলতে চাই না ম্যাডাম।’
লিসা একটু আশ্বস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পুলিশ কী বলেছে?’
‘পুলিশের সঙ্গে আমার কথা হয়নি ম্যাডাম। আচ্ছা, আপনি ঠিক কী দেখেছিলেন? অনুগ্রহ করে ব্যাপারটা খুলে বলুন।’
ভদ্রমহিলাকে একটু চিন্তিত দেখাল। তারপর বললেন, ‘যখন খুন করা হয় তখন আমি নিচু হয়ে আমার জুতোর ফিতে বাঁধছিলাম বাসে বসে। গুলির শব্দ শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি একটা লোক মাটিতে পড়ে আছে আর একজন অস্ত্র উঁচিয়ে একটি মেয়েকে জিপে তুলছে। আমাদের বাসটা দাঁড়িয়ে যাওয়ায় লোকটা এমন চিৎকার করে ওঠে যে ড্রাইভার আবার স্পিড তুলে বেরিয়ে যায়। জিপের মুখ আমাদের বিপরীত দিকে ছিল।’
‘লোকটা অথবা মেয়েটিকে আপনার মনে আছে?’
‘না। লোকটার মাথায় টুপি ছিল, মুখে মাফলার। মেয়েটির মাথা নিচু থাকায় দেখতে পাইনি তবে ওর চুলে অনেক কিছু জড়ানো ছিল।’
‘কী সেগুলো?’
‘সম্ভবত সাদা পুঁতি। মুক্তোও হতে পারে। দূর থেকে দেখা।’
‘তারপর আপনারা কী করলেন?’
ড্রাইভার চিৎকার করে বলল, ‘এসোব অঞ্চলে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে তাই কেউ যেন উত্তেজিত হবেন না। কিন্তু লোকটা নিজেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল।’
‘কী কারণে মনে হল?’
‘লোকটা অত্যন্ত দ্রুত বাসটাকে নিয়ে গেল পরের পুলিশ ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে রিপোর্ট করে তবে যেন ঠাণ্ডা হল।’
‘আপনাদের বাসের কেউ-কেউ যে ওই ঘটনার ছবি তুলেছিল তা আপনি জানতেন?’
‘পুলিশ ক্যাম্পে যাওয়ার পরে ফটোগ্রাফাররা এ নিয়ে কথা বলছিল।’
‘আপনি কবে ফিরে যাচ্ছেন ম্যাডাম?’
‘আগামীকাল সকালে।’
‘অনেক ধন্যবাদ।’
ট্যুরিস্ট লজ থেকে বেরিয়ে প্রদীপ সোজা ভাটিখানায় চলে এল। এসে দেখল ভাটিখানা বন্ধ। কিন্তু বেশ কয়েকজন ভাটিখানা খোলার জন্যে হইচই করছে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ঘণ্টাখানেক আগে ভাটিখানার ভেতরে একটা খুন হয়ে গেছে। আততায়ীকে ধরা যায়নি। পুলিশ এসে মৃতদেহ সরিয়ে ভাটিখানা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছে আজকের মত।
প্রদীপের বুকের ভেতর কেউ যেন ড্রাম বাজাতে লাগল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘লোকটা কে?’
‘মানে?’
‘যে খুন হয়েছে সে কি ড্রাইভার?’
‘হ্যাঁ। ওর নাম চন্দ্রনাথ। আজ এখানে মাতাল হয়ে গিয়ে কী সব বলছিল। অনেকে বলছে ওই কথাগুলো বলার জন্যেই নাকি ওকে প্রাণটা দিতে হল।’