আট
মিছিল আমি দু-চোখে দেখতে পারিনে। স্লোগানের আওয়াজ শুনলেই আমার কানে খিল ধরে। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলি। মনে করতাম মিছিলকারীরা হাজার হাজার ধারালো বর্শা দিয়ে আমার সারা শরীর খোঁচাচ্ছে। তাই মিছিলের আনাগোনা দেখলেই দরজা জানালা বন্ধ করা আমার একটা প্রিয় অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এভাবে মনে করতে চেষ্টা করতাম ওরা ঠিক আমার সামনে নেই। অনেক দূরে রয়েছে। এ ধরনের চিন্তা করে অনেকটা স্বস্তি বোধ করতাম। তারপরেও মিছিলের আওয়াজ শোনা গেলে কানে হাত চাপা দিয়ে রাখতাম। এভাবে কালের ঝড়কে ঠেকাবার আশ্চর্য কৌশল আমি আয়ত্ত করেছিলাম। পরে জেনেছি এ ব্যাপারে স্বয়ং মরহুম আইয়ুব খানের সঙ্গে আমার মিল রয়েছে।
এই সময়ে বৌটির একটি সংশোধনের অযোগ্য ত্রুটি আমার চোখে বড় স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। মিছিলের ঘ্রাণ পেলেই সে দরজা জানালা হাট করে খুলে। রাখে। কি করে খবর পেয়ে যায় জানিনে। শুনেছি বোবারা কানে খাটো। তবু কি করে এমন ব্যাপার ঘটে আমি বলতে পারব না। মিছিল আসতে দেখলেই উনুখ হয়ে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে, ওরা কি বলছে। সূর্যমুখী যেমন সূর্যের সামনে প্রতিটি পাপড়ি মেলে ধরে আলো হতে তাপ হতে প্রাণকণা শুষে নিয়ে ফুটে ওঠে; সেও তেমনি আবেগে মিছিলের সামনে এক জোড়া উত্তীর্ণ শ্রবণ বিছিয়ে রাখে। দ্রুত পায়ে মিছিল আসে, দ্রুত পায়ে চলে যায়। কিন্তু তারপরেই অঙ্গ প্রত্যঙ্গে অবিরাম ঢেউ খেলতে থাকে। মিছিলের ধ্বনি তার অন্তর্লোকে চুম্বকের মতো ক্রিয়া করে। আপনা থেকেই চোখজোড়া ঝিকিয়ে উঠে দুহাতে শক্ত করে জানালার শিকগুলো আঁকড়ে ধরে সমস্ত চেতনা জনারণ্যে আর শব্দারণ্যে কামানের গোলার মতো ছুঁড়ে মারে। আর গলা দিয়ে আপনা থেকেই গোঁ গোঁ শব্দ নির্গত হতে থাকে। কোনোরকম প্রযত্ন প্রয়াসের প্রয়োজন হয় না। অনির্দিষ্টকাল ধরে একটা ভৌতিক প্রক্রিয়া সমস্ত শরীরে চলতে থাকে।
শরীরময় প্লেনের প্রপেলারের মতো কি একটা ভন ভন বেগে ঘুরতে থাকে। তার অভিব্যক্তিটাই শুধু বাইরে প্রকাশ পায়। কতবার তাকে ঈশারা ইঙ্গিতে অমন না করতে বলেছি। বোবাকে বোঝাবো তেমন সাধ্যি আমার কোথায়? তার আবার কথা বলার সাধ গেছে। এখন কাউকেই সে কেয়ার করে না। মিছিল এলেই কায়দা করে জানালার সামনে দাঁড়ায়। আর স্বয়ংক্রিয় ব্যাপারটা আপনা থেকেই শুরু হয়। এ যেন বৈষ্ণবদের গোঁসাই দেখে দশা পাওয়ার অবস্থা। লোকজন এটাকেও বোবাত্বের আরেকটি উপসর্গ হিসেবে ধরে নিয়েছে। এমনকি ছোট বোনটিরও তাই ধারণা। আসলে, মানুষ কত অল্প জেনে, কত অল্প বুঝে রায় দেয়। কিন্তু আমি তো জানি এই যে একটানা ক্রুদ্ধ অশান্ত গোঁ গোঁ আওয়াজ এর উৎস কোথায়। অন্তর দিয়ে জানলে অনেক জটিল বিষয়ও সরল হয়ে যায়। একবার জোর করে সরিয়ে এনে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সে আমার পা কামড়ে দিয়েছিল। কাঁচের জিনিসপত্তর আঁছড়ে আঁছড়ে ভেঙ্গেছিল। মাছ কাটার বটি নিয়ে আমাকে তাড়া করেছিল। ভয়ংকর ভয় পেয়েছিলাম। আমি আবার খুব ভীতু কিনা। তারপরে তাকে আর কোনোদিন ঘাটাবার সাহস পাইনি।
দেশে অবস্থা পাল্টাচ্ছিল। আমিও পাল্টাচ্ছিলাম। স্নায়ুর প্রসারণ ঘটিয়ে অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। জীবনটা তো আর কোথাও খুঁড়ে ফেলে দিতে পারিনে। অনিবার্যের সঙ্গে বিবাদ করব। তেমন হিম্মত আমার কোথায়! আমি তো আর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান নই।
আমি নিজের ভেতরেই ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছিলাম। চার দিক থেকে সমস্ত কিছু আমার ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করেছিল। কি করে মেরুদণ্ড সোজা রাখি। আমি ভারি দুর্বল এবং ভয়কাতুরে মানুষ। গোটা যুগটাই পাগল রেসের ঘোড়ার মতো লাফিয়ে চলছে। পরিচিত মানুষজন কাউকে একটা বিশ্বেস করতে পারতাম না। সকলেই যেন বুকের ভেতর একটা মতলব লুকিয়ে রেখেছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে প্রস্তুত। নিতান্ত ভয়ে ভয়ে পথে ঘাটে চলাফেরা করি। জটলা দেখলেই প্রাণটা দুরু দুরু করে। মনে হতো সমস্বরে এক্ষুনি চিৎকার দিয়ে বলবে ঐ যে দেখ আবুনসর মোক্তারের জামাই যায়। কোন্ আবুনসর মোক্তার চেনেন না? যে মোক্তারটি আইয়ুব খানের মস্ত একজন চেলা, যে অযোগ্য অপদার্থ জামাইকে বোবা মেয়ে গছিয়ে অফিসারের আসনে বসিয়েছে, নিরীহ ব্রাহ্মণকে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে কলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছে। চলতে ফিরতে আমার মনে হতো, এই সমস্ত ক্ষিপ্ত মানুষ যে কোনো মুহূর্তে আমার শ্বশুরের তাবৎ দুষ্কর্মের ফর্দ প্রকাশ করে আমাকে ফাঁসাবে।
এটা আমার মনের একটা দিবাস্বপ্ন মাত্র। আসলে আমার মতো সামান্য মানুষ এতগুলো মানুষের ক্ষোভ দোষের পাত্র কিছুতেই হতে পারে না। আজকাল সামন্যতেই বড় নার্ভাস হয়ে পড়ি। গ্রীষ্মের খরতাপে যেমন শীতের জমাট তুষার গলে যায়, তেমনি আইয়ুব খান সাহেবের মিলিটারি শাসনে মনে যে মেদ সৃষ্টি হয়েছিল, পাগলা যুগ তার ওপর আগুন বর্ষণ করেছিল। সেই মন গলে পুড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। আঁকড়ে ধরার মতো কোনো শক্ত খুঁটি নেই। আমার নিভৃত ঘরের বৌটিকেও মিছিলকারীদের চর বলে মনে করতে লাগলাম। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, তার মনের কতিপয় দাহ্য উপাদানে যুগের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। আমাকেও কেয়ার করে না।
হঠাৎ করে শহরে একটা তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল। কোথায় পুলিশ নাকি আসাদ নামে কোনো একজন ছাত্রকে গুলি করে মেরেছে। তারপরদিন থেকে গোটা শহরে অলক্ষুণে ব্যাপার একের পর এক ঘটে যেতে থাকে। যে দিকেই যাই, যেদিকেই তাকাই, দেখি মানুষের মিছিল। পুলিশ আসে, ক্ষিপ্ত মানুষের ওপর লাঠি চার্জ করে, কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে মারে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসা মানুষ আর ঘরে ফিরে যায় না। শেষ পর্যন্ত ঘরের মানুষদের জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য রাস্তায় গোমড়ামুখো বাঘমার্কা মিলিটারি নামে। রাস্তার ধারে ধারে উদ্যত সঙ্গীন হাতে জীবন্ত ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্যালোকে সঙ্গীনের ফলা চকচক করে। ক্ষিপ্ত মানুষ আচমকা বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়ায়। মিলিটারিরা রাস্তা-ঘাটে টহল দেয়। বুট জুতোর একটানা আওয়াজ পীচের রাস্তার বুকে গেঁথে থাকে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা মানুষ আর ঘরে ফিরে না। তারা সেনাবাহিনীর বেষ্টনী ভেদ করে রাজপথ দখল করে। সৈন্যরা রাইফেলের বেল্টে টান দেয়, ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলি বেরিয়ে আসে। মানুষের বুকে গুলি লাগে। রাজপথে লাল টাটকা খুনের প্লাবন ছুটে। রাজপথে আবার মেঘনা পদ্মার স্রোতের মতো মিছিল নামে। গর্জনে আকাশ-বাতাস কাঁপে। মিলিটারি উঠে যেতে বাধ্য হয়। এই ছিল সত্যিকারের অবস্থা।
মানুষের বোকামী দেখলে আমার মতো স্বল্প বুদ্ধির মানুষেরও হাসি পায়। মানুষ যে কেন মিছিল করে! কত মিছিল তো দেখলাম। জন্ম থেকেই দেখছি মানুষ হৈচৈ করে মিছিল করছে। এতে কি লাভ! সবকিছু ওলট-পালট লণ্ডভণ্ড করা ছাড়া মিছিল আর কি করতে পারে। সদরে আইয়ুব কেন যে গুলি করে মিছিল থামিয়ে দিচ্ছেন না, সেজন্য তার ওপর আমার মনে মনে ভারি রাগ।
আসাদের মৃত্যুর দশ বারদিন পরেই শুরু হল ঘেরাও-পোড়াও-জ্বালাও অভিযান। মিছিলকারীরা আর নিরামিষ চিৎকার করে সন্তুষ্ট থাকতে পারছিল না। তারা ভয়ানক সহিংস একটা কিছু করার জন্যে পাগল হয়ে উঠছে। যাহোক সেদিন দেখলাম মানুষে মানুষ খচিত মোটা দু’টো অজগরের মতো প্রায় স্রোতের বেগে আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। কি তীব্র গতিবেগ। সামনের সমস্ত বাধা বন্ধন চূর্ণ করে ফেলার জন্যে রেলগাড়ির মতো বেগে ছুটে আসছে। দরজা জানালা বন্ধ করে নিশ্চিন্ত হই কেমন করে! এই ধারালো ভারালো আওয়াজ মাতৃজঠরে প্রবেশ করে গর্ভস্থ সন্তানকেও সচকিত করে তোলে।
সেদিন তাকিয়ে দেখলাম মিছিলেরও দেখবার মতো একটি নয়ন ভুলানো সৌন্দর্য আছে। আছে তাতে গতির দোলা, ছন্দের দ্যোতনা। প্রতিটি মানুষ সমগ্র মিছিলের কাঠামোর সঙ্গে সন্নিবিষ্ট হলেও তারা সকলে আলাদা আলাদা মানুষ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সচেতন সবাক চলিষ্ণু ঝরনা। একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে রচনা করেছে এই গতিমান স্রোতধারা। লক্ষ প্রাণ ঐক্যের মন্ত্রে একসঙ্গে বাঁধা পড়েছে। এমনি লক্ষ লক্ষ ঝরনা প্রবল প্রাণতরঙ্গে নেচে নেচে একসঙ্গে উঠছে। মনে হলো মিছিল ভয়ংকর, আবার মিছিল সুন্দর। মিছিলে ধ্বনিত হয় ভাঙনের ধ্বংস নাদ, মিছিলে জাগে নবসৃষ্টির মহীয়ান সঙ্গীত। ভীষণে কোমলে কেমন আপস করেছে! দৃষ্টির কুয়াশা ক্রমশ কেটে যাচ্ছিল। সমস্ত বিষয় যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে পাচ্ছিলাম। চোখের ওপর থেকে আরেকটা আলগা পর্দা যেন খসে পড়ল। সেদিনের মিছিল দেখে, ঠিক মনে হলো মিছিলে এলে ভীরুতা কাপুরুষতা ঠিকই ভুলে থাকা যায়। একেবারে হতোদ্যম ক্ষণজীবী মানুষকেও এই মিছিল সামান্য সময়ের জন্য হলেও মহাজীবনের আস্বাদ পান করাতে পারে।
আমাদের বাড়ির দিকে বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো মিছিল এগিয়ে আসছিল। রাস্তায় সমুদ্র গর্জনের মতো গম্ভীর আওয়াজ উঠছে। আওয়াজে আওয়াজে তরল লাভা স্রোতের মতো ক্ষোভ যন্ত্রণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মন্দ্রিত আওয়াজ নগরীর অলিতে-গলিতে, অফিসে-আদালতে, দোকানপাটে, মানুষের মনের রুদ্ধদ্বারে বেলা ভূমিতে সমুদ্র তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়েছে। চারপাশে একটা নতুন উদ্দীপনা। এই সপ্রাণ মিছিল নগরবাসী মানুষের প্রাণ-পাতাল পর্যন্ত আলোড়িত করে তুলেছে। দেখলাম চারপাশের মানুষ মিছিলকারীদের অনুকরণ করছে।
চারদিকে একটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছে মিছিল। তা আমার স্ত্রীর মধ্যেও একটা নতুন আঙ্গিকে দেখা দিয়েছে। আজ যেন তার খুশীর শেষ নেই। লজ্জা সংকোচ, দ্বিধার অর্গল বুঝি একেবারে মনের ভেতর থেকে টুটিয়ে দিয়েছে। আমাদের বাড়ির দিকে মিছিল আসছে। আর সে তালে তালে জ্বীন পাওয়া মানুষের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। মাথার খোঁপা খুলে গেছে। দীর্ঘ কালোচুল এলোমেলো হয়ে মুখে। চিবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। গোটা শরীরে একটা অপ্রতিরোধ্য তরঙ্গবেগ।
হেঁচকা টানে সে যেন ভেঙে দুটুকরো হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণিমা চাঁদের মায়াবী আকর্ষণে সাগরের নীল নোনা জল যেমন অপরূপ তরঙ্গভঙ্গে আকাশ অভিমুখে ধাবিত হয়, তেমনি মিছিলের দুর্বার আকর্ষণ তার সমস্ত সুকুমার প্রবৃত্তিতে একটা আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছে। আমার মনে হলো তার ভেতরে পুরনো কি একটা ধসে যাচ্ছে এবং নতুন কি একটা মস্তক উত্তোলন করছে। মনে মনে শঙ্কিত হলাম। কেননা এরই মধ্যে তার গর্ভে লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল। শঙ্কায় হোক, মমতায় হোক স্ত্রীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এই উন্মত্ত আকর্ষণ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলাম না। কেমন সম্মোহিতের মতো হয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ করে উপলব্ধি আমাকে জানিয়ে দিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এই বেপরোয়া সঞ্চালনেরও একটা ছন্দ রয়েছে। তার সুন্দর পুতুলের মতো শরীরখানা ঢাকের কাঠির মতো উঠানামা করছে। মাথার চুল ফেঁসো হয়ে বাতাসে উড়ছে। মাঝে মাঝে জানালার শিক ধরে হেঁচকা টান লাগাচ্ছে। এই বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সব।
একটু অবাক হলাম। গলা দিয়ে আগে যে নুড়ি পাথরের মতো গোল-গোল শব্দাংশ নির্গত হতো সেগুলো একেবারে অন্য রকম শোনালো। স্পষ্টত লক্ষ্য করলাম গোঁ গোঁ আওয়াজের ধাচটা খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। গোল-গোল ধ্বনিগুলো এঁকেবেঁকে তেরছা তীর্যক আকার নিচ্ছে। উচ্চারণ প্রক্রিয়ার মধ্যে মাত্রার পর মাত্রা সংযোজিত হচ্ছে। শিশুর অর্থবোধক অস্পষ্ট বাক প্রয়াসের মতো কি একটা শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসার জন্য প্রবল সংগ্রাম করছে। আওয়াজটা গোঁ গোঁর স্থলে বা… …বার মতো শোনাচ্ছে পরিষ্কার। প্রাণপণ শক্তিতে চেষ্টা করছে… … কিন্তু বাকযন্ত্রটি কাজ করছে না।
আমি না ভেবে পারিনে, গোঁ গোঁ শব্দের এই যে গুণগত পরিবর্তন এর কারণ কি? হঠাৎ উদ্ভাবনের পুলকে চমকে উঠি। সেও মিছিলের মুখে উচ্চারিত বাংলাদেশ’ শব্দটি ভেতর থেকে উগরে দিতে চাইছে। অক্ষম অবাধ্য কণ্ঠনালী দিয়ে উচ্চারণ করতে পারছে না। সমস্ত শক্তি জড়ো করে বাকযন্ত্রের ওপর হুকুমজারী করছে ‘উচ্চারণ করো’ ‘উচ্চারণ করো’। বহুদিন পর একটানা গোঁ গোঁ শব্দের একটা বুদ্ধিগ্রাহ্য অর্থ পেয়ে গেলাম। বস্তুপুঞ্জকে আমরা যে সকল নামে ডাকি, আনন্দের বেদনার, ক্ষোভের, আশ্চর্যের যে সকল অনুভূতি বাক্যে প্রকাশ করি, ডাইনামোর আওয়াজের মতো একটানা গো গোঁ শব্দের মধ্য দিয়ে সে সব প্রকাশ করে এসেছে। প্রকাশ, হায়রে প্রকাশের ব্যথা। মিছিলটা একেবারে আমাদের বাড়ির সামনে এসে পড়েছে। গোটা বাংলাদেশের শিরা-উপশিরায় এক প্রসব বেদনা ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের বুকফাটা চিৎকারে ধ্বনিত হচ্ছে নবজন্মের আকুতি। আমার বুকেও তরঙ্গ ভাঙছে। কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি। চারপাশের সব কিছু প্রবল প্রাণাবেগে থরথর কাঁপছে। বাংলাদেশের আকাশ কাঁপছে, বাতাস কাঁপছে, নদী, সমুদ্র, পর্বত কাঁপছে। নরনারীর হৃদয় কাঁপছে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। আচানক বোবা বৌ জানলা-সমান লাফিয়ে বাঙলা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করল। তার মুখ দিয়ে গলগল রক্ত বেরিয়ে আসে। তারপর মেঝেয় সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে থাকে। ভেতরে কি একটা বোধহয় ছিঁড়ে গেছে। আমি মেঝের ছোপ-ধোপ টাটকা লালরক্তের দিকে তাকাই, অচেতন বৌটির দিকে তাকাই। মন ফুড়েই একটা প্রশ্ন জাগে- কোন রক্ত বেশি লাল। শহীদ আসাদের- না আমার বোবা বৌয়ের?
❀ ❀ ❀