» » ওঙ্কার

বর্ণাকার

ছয়

দুচারদিন পর শরীর খারাপের নাম করে একটানা দুই মাসের ছুটির দরখাস্ত দিলাম। আমাকে ছুটি নিতে দেখে অফিসের সমস্ত মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। চোখের ওপর দিয়ে প্রতি বছর শীত বসন্ত গড়িয়ে গেছে, গ্রীষ্ম বর্ষা অতীত হয়েছে। শরৎ হেমন্তে দেখেছি কখনো বা অফিসের নুলো পিয়নটিও যথারীতি ছুটি ভোগ করে অপরিমিত প্রাণোচ্ছ্বাস নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। আমার যে কি করে চলত, কি করে যে আমি এই ছোট্ট অফিস কামরার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতাম, তা বলতে পারব না।

সে যাক দুমাসের ছুটি নিলাম। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক একরকম চুকিয়ে দিয়ে বাসায় এসে ডেরা পাতলাম। এ দুটি মাসই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। সকাল সন্ধ্যে ঘরে থাকি। খুঁটিনাটি কাজে মন দেই। আমরা স্বামী-স্ত্রী বিয়ে হওয়ার বহু বছর পর আবার নব বিবাহিত দম্পতির মতো জীবন শুরু করলাম। প্রতিটি দিনকেই যেন আমরা দুজনে অস্তিত্বের ভেতর থেকেই সৃষ্টি করে নিচ্ছিলাম। প্রতিটি উষা রাঙা নিমন্ত্রণলিপি মেলে ধরে। দিনগুলো ঝকঝকে নতুন প্রাণবন্ত। অফুরন্ত স্বাদ-গন্ধে সারা মন প্রাণ ভরিয়ে দিয়ে যায়। রাতগুলো বিধাতার আশীর্বাদের মতো সন্ধ্যের স্বর্ণতেরণ দিয়ে কেমন কান্তিমান ভঙ্গিতে নেমে আসে।

আমি আজকাল ফুর্তিবাজ হয়ে উঠেছি। স্ত্রীটিও বেশ সুন্দরী হয়ে উঠেছে। জীবনের জল তার সারা শরীরে ঝলকাতে লেগেছে।

অঙ্গে লাবণ্যের স্রোত নতুন গাঙের মতো ঢলঢল করে। আজকাল সাজ পোশাকের দিকে তার নজর বহুগুণে বেড়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে । মাথা ভর্তি কালো চুল ছেড়ে দিলে পিঠ ঝেপে যায়। ইচ্ছে হলে গোল করে খোঁপা বাঁধে। ইদানীং দুয়েকটা ফুল খুঁজতেও শিখেছে। মৌসুমী ফুলের চারা লাগিয়েছি কটি। পরনের শাড়ি শক্ত করে কোমরে পেঁচিয়ে সকাল দুপুর জল ঢালে। তরু শিশুদের পুত্র-কন্যার স্নেহে লালন করে তখন তাকে ঠিক আশ্রম কন্যার মতো মনে হয়। সমস্ত শরীরে সরল সৌন্দর্য ফুলের গর্বে ফুটে থাকে।

বোনের গানের রেয়াজ করার সময়টিতে ইচ্ছে করে আমি ঘরে থাকিনে। স্ত্রী স্বরগ্রাম অনুকরণ করার প্রয়াসটি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি। হাত-পায়ের খিল ধরা অবস্থাটিকে এখন আকার পাওয়া সুন্দর সুমিত একটি পিপাসার মতো লাগে। এমনি করেই বুঝি প্রাচীনকালে সাধনাকে অপ্সরারা মুণি ঋষির ধ্যান ভাঙাতো। তার এই নীরব একমুখী সাধনাকে মনে মনে প্রকৃতির হলাদিনী শক্তির সঙ্গে তুলনা করে কৌতুক বোধ করতাম। আমার বোনের গানের চেয়ে মধুর, পৃথিবীর সেরা নর্তকীর নাচের মুদ্রার চাইতে দৃষ্টিহারী অনুপম তুলনাবিহীন। বোধহয় এই সুন্দরের সাধনার বলেই দিনে দিনে সে সুন্দরী হয়ে উঠছে। আমার চোখে তার বোবাত্ব ঘুচে গেছে । প্রতিটি ভঙ্গিই এখন আমার মনে শ্রেষ্ঠ কবিতার আমেজ জাগিয়ে তোলে। তার এই প্রচেষ্টা ফাল্গুনের ফুল ফোঁটাবার জন্য শীতে সাধনার মতো গোপন এবং কঠিন। যখন-তখন তাকে আমি চুমো খাই। তার মুখমণ্ডলে একটা অসহায় ভাব জলছবির মতো আপনাআপনি ভেসে উঠে- দেখলে মনের ভেতর কি যে দুঃখস্রোত বয়ে যায়। মানুষ কেন বোবা হয়ে জন্মায়? বোবারও বা কথা বলার অত সাধ জাগে কেন?

একদিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখি সে বিছানায় নেই। বাথরুমে খুঁজলাম, বারান্দা খুঁজলাম। এঘর ওঘর তালাশ করে, বোনের গানের প্র্যাকটিস করার ঘরে দেখি হারমোনিয়ামটাকে বাচ্চা শিশুর মতো কোলে নিয়ে বসে। খুব সন্তর্পণে একেকটা রীড টিপছে। একবার টিপে একবার ওদিক তাকায়। বড় ভয়, পাছে কেউ দেখে ফেলে। হারমোনিয়াম থেকে মিহি স্থূল আওয়াজ বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখে রঙের বদল ঘটছে। জানালার পাশ ধরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ এ দৃশ্য দেখলাম। শেষে ঘরে ঢুকি। তার চোখে মুখে একটা অপরাধীর ভাব । হাত ধরতেই সে সঙ্গে সঙ্গে ঘরে চলে এল। এই আগুনের মতো প্রয়াসের বিফলতার কথা চিন্তা করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বুকের ভেতর জমিয়ে ফেললাম।

আরো একদিন এমন হলো। আধারাতে উঠে দেখি সে বিছানায় নেই। বোনের ঘর, হেঁশেল, বাথরুম সবখানে তন্ন-তন্ন করে দেখি। আচমকা একটা সন্দেহের ছায়া মনের ভেতর দুলে উঠে। তবে কি—। কোথায় গেল সে?

নিঃশব্দে দরজা খুলে পেছনের পুকুরের দিকে যাই। দেখি সে ঘাটলার ওপর বসে। গলা দিয়ে বিনা প্রযত্নেই গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। তা’হলে প্রক্রিয়াটি এই অল্প সময়ের মধ্যে সে আত্মস্থ করে ফেলেছে। আকাশে থালার মতো একখানা চাঁদ জেগে। কুয়োতে গাছের বাকা নারকেল গাছের চিরল পাতাগুলো কাঁপছে। রাতের শিশিরে সিক্ত পাতাগুলো চাঁদের আলোর স্পর্শে চিকচিক জ্বলছে। এক ঝাঁক নক্ষত্র ফুলের মতো ফুটে আছে। প্রস্ফুটিত নক্ষত্রের ভারে প্রণত হয়ে পড়েছে আকাশ। শহর নীরব। মাঝে মাঝে মৃদু অতি মৃদু শব্দ শোনা যায়। মনে হয় গভীর ঘুমে চন্দ্রালোকিত নিশিরাতে পাশ ফিরে নিশ্বাস নিচ্ছে। এরই মধ্যে বাক্যপ্রার্থিনী রমণীর গলায় গোঁ গোঁ আওয়াজ রাতের ছন্দিত হৃৎপিণ্ডের মতো একটানা শব্দ করে যাচ্ছে। গোটা শহর মৃত-ঘুমন্ত । আমি গিয়ে সামনে হাজির হলাম। সে নজরও দিল না। আমিও যেন সারবন্দী নারকেল গাছের একটি। আপন মনে তার কাজ করে যায়। কি করে বুঝে গেছে তার এ কাজ আমি অপছন্দ করছিনে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটার পাশে গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। এক সময় আওয়াজ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এল। মনে হলো প্রবল বেগে চলার পর একটি পাম্পিং মেশিন থামল। ঘাটলার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কালা মাছের মতো শ্বাস টানল। আরো কিছুক্ষণ পর নিজেই আমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে এল। আমার বড় ভাল লাগল। এমনি করে বিস্ময় পরিস্ফুরিত দৃষ্টিতে প্রতিদিন স্ত্রীকে দেখছিলাম। প্রতিদিনই মনে হয় নতুন। যতই দেখি আশ মেটে না। ইচ্ছে হয় আরো দেখি— আরো ।

একদিন ছোট বোনটি স্কুল থেকে এসে বলল, জানো দাদা এক ব্যাপার হয়ে গেছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিরে? পয়লা সে মুখ টিপে হাসল। তারপর বলল, স্কুল থেকে ফিরে দেখি ভাবী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে। তারপর মুখে আঁচল দিয়ে হাসি চাপতে অদৃশ্য হয়ে গেল। বোনটিকে সেদিন বড় ফাজিল এবং নিষ্ঠুর মনে হল। কয়েকদিন পরই বাজারে রাষ্ট্র হয়ে গেল আমার বোবা বৌ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়। দাসী চাকরদেরও এ কথা বলাবলি করতে শুনলাম। লজ্জা শরমে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলাম। সে তো নিজে কথা বলে না, তাই লোকের কথায়ও তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমি তো কথা বলা সামাজিক জীব। লোকমুখের রটনা আমি অগ্রাহ্য করব কেমন করে! অথচ মুখ ফুটে কিছু বলব তার উপায় নেই। স্ত্রীর এই প্রচেষ্টাটি ছিল আমাদের দুজনেরই গোপন কঠিন সাধনা। সেটি প্রচার হয়ে গেছে। তাকে উলঙ্গ করে রাস্তায় ছেড়ে দিলেও বোধহয় এ রকম ব্যথা পেতাম না।