চার
আবু নসর মোক্তার সাহেব আমাকে শুধু মেয়ে দিলেন না। হতাশা লাঞ্ছিত পূর্বপুরুষের জীর্ণ অট্টালিকা থেকে টেনে আলো-ঝলমল-করা শহরে এনে বসালেন। রাজধানী শহরে আমার চাকরি হলো। চাকরির সঙ্গে সঙ্গে আস্ত একখানা বাড়িও শ্বশুর সাহেব মোক্তারী বুদ্ধি খরচ করে জুটিয়ে দিলেন। আগে থাকত এক নিরীহ ব্রাহ্মণ। যে প্যাঁচে শ্বশুর সাহেব তার বেয়াইকে অন্তত দশ বছর আগে স্বর্গে পাঠিয়েছিলেন একই প্যাঁচে নিরীহ ব্রাহ্মণকে গ্রাম এবং শহরের সমস্ত মূল থেকে উপড়ে তুলে সীমান্তের ওধারে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
মোক্তার সাহেবকে এখন থেকে শ্বশুরই বলব। শুরু থেকে কেন সম্মানসূচক বাক্য ব্যবহার করে আসছি, আশা করি এখন তা বুঝতে পারছেন।
দেশে ত্বরিত গতিতে সময় পাল্টাচ্ছিল। পৃথিবীর গভীর গভীরতরো অসুখের খবর সংবাদপত্রের পাতায় কালো ফুলের মতো ফুটে থাকে। দেশে আইয়ুব খান সাহেব সৈন্য-সামন্ত নিয়ে গেড়ে বসেছেন। সংবাদপত্রের ব্যানারে খান সাহেবের একজোড়া গোঁফ হুংকার দিয়ে জেগে থাকে। দেখতে না দেখতেই দেশের জীবন প্রবাহের মধ্যে খান সাহেবের অপ্রতিহত প্রভাব প্রবল সামুদ্রিক তিমির মতো ছুটাছুটি করছিল। এই সুযোগে আমার শ্বশুরের মতো মানুষেরা অন্ধকার থেকে সূর্যালোক ফাঁকি দিয়ে শহরের ফ্ল্যাশ ক্যামেরার সামনে উঠে আসতে লেগেছেন। আগেই তিনি মোক্তারী ছেড়ে দিয়েছিলেন। মরা গরুর খালের নাহান আদালতের ময়লা বেটপ শামলা গা থেকে গাছের পুরনো বাকলের মতো ঝরে পড়েছে সে কবে। এখন তিনি আদ্দির গিলে করা ফিনফিনে পাঞ্জাবী পরেন। সোনার বোতাম ঝিলিক দেয়। হাতে হীরার আংটি ঝকমক করে। তিনি আইয়ুব রাজত্বের শক্ত একটা খুটি না হলেও ঠেকনা জাতীয় কিছু একটা তো বটেই। বসনে-ভূষণে অনেক সম্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছেন। একটা ব্যক্তিত্বও না জানি কোত্থেকে উড়ে এসে শরীরে আশ্রয় করেছে। একটু বয়স হলে যেমন মেয়েদের বুকে স্তনের বাঁকা রেখা আভাসিত হয়, তেমন টাকা পয়সা এবং দাপট এলেই শেয়ালের মতো চেহারায়ও সিংহের আকৃতি জাগি জাগি করে।
আমার শ্বশুরের চারদিকে জয়জয়কার। শালা-সম্বন্ধীরা ব্যবসায়ে রীতিমতো লাল হয়ে যেতে থাকল। লোকে বলাবলি করত আমার শ্বশুর ভাগ্যবান। নিজেকেও আমি কম ভাগ্যবান মনে করতাম না। এমন একজন লোকের মেয়ে বিয়ে করেছি, সে কি চাট্টিখানি কথা! নাইবা রইল একখানা হাত কিংবা পা। শ্বশুরের সৌভাগ্যের ছিটেফোঁটা আমিও পেতে থাকলাম।
ব্রাহ্মণের ভাঙা বাড়িটা নতুন করে বানিয়েছি। ঝোপেঝাপে ঢাকা কম্পাউণ্ডে একটা কুয়োর মতো ছিল। চারপাড় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছি। পুরনো ঘাট ঝালাই করেছি। আমাকে লোকে যাই বলুক শ্বশুরের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। তিনি আমার প্রকৃতি ধরতে পেরেছিলেন, তাই আমার জন্য যা যা করেছিলেন এমনভাবে করেছিলেন যেন প্রবৃত্তি এবং প্রকৃতির সঙ্গে একেবারে খাপ খেয়ে যায়। কোনো কোনো গাছ আছে কড়া আলোতে বাঁচে না, কোনো কোনো মানুষ ভিড় এবং ঠেলাঠেলি সইতে পারে না। সেদিকে লক্ষ্য রেখে শ্বশুর সাহেব আমার চাকরি ঠিক করেছেন, বাসা নির্বাচন করেছেন আর যা যা করেছেন গায়ের লাগসই পোশাকের মতো একেবারে নিখুঁতভাবে মানিয়ে গেছে।
এসব ব্যবস্থাপনার মধ্যে একখানা শিল্পী মনের দরদ খুঁজে পাই। এসব তিনি করেছেন বোবা মেয়েটির জন্যই তো। মেয়েকে তিনি ভারি ভালবাসতেন। তাঁর আরো মেয়ে আছে। কিন্তু আমার স্ত্রীর প্রতি পক্ষপাতটা কম্পাসের মতো হেলে থাকত। যখন আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতেন, মুখে কথা বলতেন না, আরেকজন বোবার মতো আভাসে ইঙ্গিতে কথা কইতেন। আসল বোবা আর নকল বোবার এই যে মাখামাখি তা আমার চোখে অত্যন্ত সুন্দর এবং পবিত্র মনে হতো। এই জন্য আমার শ্বশুরকে আমি ভালবাসি। কেননা তাঁর একখানা দরদী মন ছিল। তিনি আপনার জনদের ভালবাসতে জানতেন।
কিন্তু মানুষ তাঁকে ভাল বলত না। তাঁকে দিয়ে যাদের সর্বনাশ হয়েছে তারা তাঁকে অভিসম্পাত দিত। আমাকেও লোক মন্দ বলত। কারণ আমি তার বোবা মেয়ে বিয়ে করে অল্প-স্বল্প সৌভাগ্যের মুখ দেখেছি। তার জন্য আমি কিছুই মনে করিনে। লোকে তো কত কথাই বলে। তাছাড়া আমি নির্বিরোধ মানুষ। ঝগড়াঝাটি পরনিন্দে এড়িয়ে চলাই স্বভাব।
বাড়িতে খাই দাই এবং ঘুমাই। নিয়মিত অফিসে যাই অফিস থেকে আসি। দিন কেটে যাচ্ছে একরকম দিনের মতো। আনন্দ নেই- নিরানন্দ তাও নেই। বন্ধুরা সকলে তাদের বৌয়ের গল্প করে। তাদের নিয়ে বাজারে যায়, সিনেমা দেখে, অবসর মুহূর্তগুলো মৌচাকের মধুর মতো কথাবার্তার রসে ভরিয়ে রাখে। কোনো কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাদের বৌদের সঙ্গে গল্প করেছি, গান শুনেছি। মনের মধ্যে একটা কাঁটার তীক্ষ্ণ দংশন অনুভব করেছি। আমার বুকের ভেতরে একটা দুঃখ পাশ ফিরে ঘুমিয়েছে। জীবনে কি সব পাওয়া যায়। সকলে কি সমান ভাগ্যবান! মনকে। প্রবোধ দিতে চেষ্টা করতাম। কখনো প্রবোধ মানত কখনো মানত না। বাতাসের মতো চঞ্চল মন।
আমাদের অফিসে নৃপেন নামে এক এল-ডি ক্লার্ক আছে। সে আমার পাশের কামরায় বসে। ফাঁকিবাজ ছোঁকড়া। প্রতিদিন আড্ডা ইয়ার্কি করে দশটা থেকে পাঁচটা কাবার করে। কাজ পড়ে থাকে। চাকরি যাই যাই করেও কি কারণে জানি যায়নি।
কিছুদিন আগে সে ছোঁড়ার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকে নৃপেন এক নতুন উৎপাত শুরু করেছে। নতুন বৌ কি বলল, কিভাবে বলল- একটা কথা একশবার করে বলত। হেসে কথা বললে কি রকম দেখায়, রেগে বললে কি রকম মুখের ডৌল হয়, স্বরতরঙ্গের খাঁজগুলো উঁচুগ্রাম থেকে নিচুগ্রামে ওঠানামা করে যখন, গলাতে যে সুন্দর ভাঁজ পড়ে কি অপরূপ দেখায়- এসব কথা বয়ান করত। শুনে চাপা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম কেউ শুনতে না পায় মতো। কিন্তু নৃপেন প্রসঙ্গ পাল্টায় না। বলুক না বলুক নতুন বৌয়ের নাম করে নৃপেন কিছু একটা বানিয়ে হলেও বলবে। এটা তার একটা স্থায়ী মুদ্রাদোষে দাঁড়িয়ে গেছে।
আমার ধারণা হলো আমি বোবা মেয়ে বিয়ে করেছি বলে এবং তার কর্তা বলেই আমাকে এসব কথা শুনিয়ে শুনিয়ে বলে। তখন থেকেই আমি নৃপেনকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করলাম, মনে করতে লাগলাম, নৃপেন একটা বাজারের খানকী বিয়ে করেছে। একমাত্র খানকীরাই অত বেশি হাসে, কথা বলে এবং বিশ্রী ভঙ্গি করে। প্রতিশোধ নেবার তীব্র ইচ্ছে মনের ভেতর ফণা ধরে জেগে উঠত। কিন্তু আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কতটুকু দাম! প্রেম কিংবা ঘৃণার পক্ষে বিপক্ষে কিছু করার ক্ষমতা আমার ছিল না। যে আইয়ুব খান অঘটনঘটনপটিয়সী ক্ষমতার প্রভাবে আমার শ্বশুরের মতো
হেজী-পেজী মোক্তারকেও গণ্যমান্য সম্ভ্রান্ত মানুষে রূপান্তরিত করেছে, সম্ভব হলে সেই আইয়ুব খানকে ডেকে বলতাম : হে প্রবল প্রতাপান্বিত আইয়ুব খান, তোমার লোহার ডাণ্ডাটি নিয়ে দয়া করে একটি বার এসো। নৃপেনকে মারধর করতে যদি তোমার মতো ফিল্ড মার্শালের পৌরুষে বাধে, অন্তত চাকরিটি খেয়ে তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দাও।
হায়রে! এসব ছিল অক্ষমের কল্পনা মাত্র। বাস্তবে আমার শ্বশুর যেখানে বসিয়ে দিয়েছিলেন, তার বাইরে এক চুল হেলবার সাধ্যিও আমার ছিল না।
কয়েকদিন থেকে দেখছি নৃপেনের ভিন্ন অবস্থা। অপরিমিত যৌন সম্ভোগের ক্লান্তিতে সে একেবারে মিইয়ে গেছে। যখন-তখন নতুন বৌয়ের নাম করে আর জ্বালাতন করে না। ফাইলপত্তরের সামনে বসে বড় বড় হাই তোলে। আর সকাল বিকেল রেসের গল্প করে।
নৃপেন একটা স্কাউণ্ডেল। আমার নিস্তরঙ্গ নিথর জীবনযাত্রার মধ্যে একটা জীবন্ত অতৃপ্তি ঢুকিয়ে দিয়েছে সে। এখন স্ত্রীকে আমি দু-চোখে দেখতে পারিনে। মাঝে মাঝে পাকা জুয়োড়ীর মতো মনোভাব জাগে। ইচ্ছে হয় শ্বশুর সাহেবের কাছে গিয়ে বলি, আপনি যা দিয়েছেন ঘর বাড়ি চাকরি সব নিন। বিনিময়ে কেবল আমাকে আপনার বোবা মেয়ে রত্নটির দায় থেকে রক্ষা করুন। আমি সমগ্র জীবনের সমস্ত কিছুর বিনিময়ে এমন একজন মেয়ে মানুষকে কাছে পেতে চাই- যে কালো হোক, কুৎসিত হোক, না থাকুক তার গুণপনা সে শুধু কথা বলবে, অনবরত কথা বলবে। তার মুখ থেকে নানা রকমের শব্দমালা শরতের বিবাগী বাতাসে শিউলী ফুলের মতো ঝরে পড়বে। কল্পনায় কত মেয়েমানুষ সৃজন করি তাদের সঙ্গে কত কাল্পনিক কথোপকথন চালাই। বুকের গভীর থেকে শব্দরাজি থরে-বিথরে নীলকান্ত মণির মতো জেগে ওঠে। গানের মতো সুরের ছোঁয়া লাগা, প্রাণের লাবণীভরা কথা ঝর্নাধারার বেগে উছলে ওঠে। জীবনে নারীর সঙ্গে কথা বলার এমন তীব্র আকুতি কোনোদিন বোধ করিনি। নৃপেনের খোঁচা খেয়ে আমার ভেতরে আরো একটা আমির উদ্ভব হয়েছে। এই যে নিষ্ঠুর নির্মম ক্ষুধাবোধ এতদিন কোনো গর্ভগুহায় লুকিয়ে ছিল জানতে পারিনি।
আগেই তো বলেছি, ইচ্ছেশক্তি বলতে কোনো কিছু নেই। তাই বলে আমি যে কিছু চাইনে একথা সত্যি নয়। নানা জায়গায় আমার যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু চরণ সামনে চলতে রাজী হয় না। অনেক কিছু করার সাধ জাগে কিন্তু অবশ হাত উঠতে চায় না। নানা আনন্দ-বেদনার ধ্বনি আমার জিভের ডগায় পুঁটিমাছের মতো নাচলেও একটুকুর জন্য ঝরে পড়তে পারে না। এমন নিষ্ক্রিয় পুরুষ মানুষ আমি।
একটি সবাক সজাগ নারীর সঙ্গে কথা বলার কামনা বুকের তলায় রক্তবর্ণ বুদবুদের মতো জাগে আর ভাঙ্গে। অফিস থেকে আসা যাওয়ার পথে রিকশা বাস, পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জটলা পাকানো তরুণীদের দিকে বাক্যের ক্ষুধা নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকি। নারীকণ্ঠ নিঃসৃত কলকাকলী শোনার জন্য সন্তর্পণে কানজোড়া পেতে রাখি। দমকা বাতাসে চারাগাছ যেমন কাঁপে তেমনি নারীর সুন্দর হাসির লহরী আমার বুকের স্তরে স্তরে কি আবেগেই না সমীরিত হয়! সে কথা কেমন করে বোঝাই।
প্রতিদিন অফিস শেষ করে বাসায় আসি। বোবা স্ত্রী আমাকে দোরগোড়ায় দেখলেই অপরিসীম আগ্রহ নিয়ে ছুটে আসে। সে যেন সারাদিন আমার বাড়ি আসার ক্ষণটির অপেক্ষায় দোরগোড়ায় তৈরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জুতো মোজা খুলতে সাহায্য করে, জামা-কাপড় ছাড়তে হাত লাগায়। বাথরুমে ঢুকে হাতের কাছে সাবান তোয়ালে এগিয়ে ধরে। হাউমাউ করে চাকরানী মেয়েটিকে ঈশারায় দুধ গরম করতে বলে। হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলে নাস্তার প্লেট এবং ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এসব আদিখ্যেতা দেখে আমার বিরক্তি ধরে যায়। লাথি মারতে ইচ্ছে করে… পারিনে অভ্যেস নেই বলে। চা-টা শেষ করে অন্যদিকে মুখ ফেরাই। সে বুঝতে পারে আমার মন খারাপ। বোবাদের ঘ্রাণশক্তি বড় তীক্ষ্ম । কথা যে বলতে পারে না এ বিষয়ে পুরো সজাগ। তাই সেবা দিয়ে কথার অভাব ভরাট করতে চায়। পুরুষ মানুষের সেবায় কতদিন চলে। আমার দরকার অন্য কিছুর। আমি মনের সাধ মিটিয়ে কথা বলতে চাই। তাজা উষ্ণ, রূপরাঙা, রসরাঙা কথা আমার মনের বৃন্তে বৃন্তে বসন্তের পল্লবের মতো মুকুলিত হয়। মুকুলিত হয় আর ঝরে যায়। সমস্ত হৃদয় মনের আকুতি দুখানি কালো চোখের তারায় থরোথরো নাচে। বিশাল কালো চোখে চোখ পড়ে কখনো বা মনটা আপনা থেকেই ধক করে কেঁপে যায়।
গম্ভীর হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভেতরের তাপে চাপে ওপরের আবরণ খান-খান হয়ে ভেঙে পড়তে চায়। দুর্বলতার টুটি চেপে ক্ষেপে উঠতে চেষ্টা করি। পারিনে। এ ধরনের মানসম্মান বোধহীন মেয়েমানুষের সঙ্গে রাগ কেমন করে করতে হয়, তাও আমি জানিনে। হাবাগোবা মোমের পুতুলের মতো এমন পুরুষ মানুষ আমি। আমাকে দিয়ে জীবনের কোনো দিকের সীমা অতিক্রম হলো না। জ্বলব, পুড়ব, ব্যথা পাব অথচ কিছুই করতে পারব না, কিছুই বলতে পারব না, কোথাও যেতে পারব না।
আমার এদিকে বুকটা ভয়ে ঢিপঢিপ করে। কি জানি শ্বশুর সাহেব যদি টের পেয়ে যান তাঁর মেয়েটিকে আমি অবহেলা করছি। চাকরিটি খেয়ে মেয়েটা ফিরিয়ে নিয়ে যদি বলেন, এখন বনটির হাত ধরে যেখানে ইচ্ছে চলে যাও, তখন কোথায় কোন্ বৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়াব?
আমি আইয়ুব খান সাহেবকে কাজে খাটাতে পারিনে। তিনি শ্বশুর সাহেবের হাতে যে পরিমাণ ক্ষমতা গচ্ছিত রেখেছেন, আমি তো তিতপুঁটি, তাই দিয়ে অনেক রুই-কাতলাও ঘায়েল করা যায়। আমার মনটা বড় সন্দেহপ্রবণ। দুর্বল কিনা। দুর্বলেরা ভারি সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়। এইরকম মানসিক সন্ত্রস্ততার মধ্যে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে দিলাম। সে সময়ে আমার অর্ধেক চুল পেকে গেছে। ওজন আট পাউণ্ড কমেছিল। এখন মনে হয় নরকবাস করছিলাম।
আমার বোনটা ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভয়ানক ভয় করে। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আরো দূরে সরে গেছে। আগে এক-আধটু কাছে ঘেঁষত। এখন তাও না। নিজের মনে সব সময়ে একা থাকে। স্কুলে যায় আসে, মৃদুস্বরে পড়া মুখস্থ করে। ছোট্ট তক্তপোষখানিতে একা একা ঘুমোয়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একজন পুরুষ ছেলের কথা ভাবে কিনা আমি বলতে পারব না।
মা-মরা মেয়েটির এই নিঃসঙ্গ জীবনযাত্রা দেখে কতবার আমার মনটা হু হু করে নিঃশব্দে কেঁদেছে। অনেকবার ভেবেছি তাকে একটু আদর করব, মাথায় হাত বুলিয়ে দেব, একটা সুন্দর জামা, দুগজ চুলের ফিতা কিনে দেব। একদিন সিনেমায় নিয়ে যাব। কিন্তু অনভ্যেশবশত এসবের কিছুই করতে পারিনে। তাই বোনটি যেমন আছে তেমনি রয়েছে। চোখের কোণায়, মুখাবয়বে ভয় পাওয়ার সে প্রাচীন গ্রামীণ চিহ্নটি এখনো অক্ষয় হয়ে জেগে আছে।
মানস যন্ত্রণার এই সময়ে আমি বড় অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। ধারে কাছে কেউ নেই যে একটু গভীর কথা বলে বুকের ব্যথা লাঘব করি। ব্যথা মনে পাষাণের মতো চেপে থাকে। কি করি, কোথায় যাই। কার কাছে গিয়ে মনের এই অদ্ভুত বেদনার কথা প্রকাশ করি। মনের ভেতর যে ক্ষিপ্র স্রোতোবেগ জাগছে কোথায় আছে এমন পরম বান্ধব যার কাছে গিয়ে সব অকপটে প্রকাশ করি। এই পৃথিবীতে আমার তো আপনার জন বলতে কেউ নেই।
এই সময়ে ছোট বোনটির সঙ্গে একটু একটু করে কথা কইতে থাকি। পয়লা তো সে আমার কাছেই ঘেঁষত না। একটা কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেবার সময় পাঁচবার তোতলাতো। তিনবার মুখের দিকে করুণভাবে তাকাতো। মনে মনে আশা করতাম বোনটি এইবার কথা বলুক। ভাইজান বলে ডাকুক। অসীম উৎকণ্ঠায় প্রতিদিন প্রতীক্ষা করি। কিন্তু বোনের কণ্ঠে সে আকাঙ্ক্ষিত ধ্বনিটি শুনিনে। অনাদরে অবহেলায় তার মধ্যে যে নির্বাকতার সৃষ্টি করেছি, কিছুতেই সে দেয়াল ভাঙল না। অগত্যা নিজেই উদ্যোগী হয়ে তার সঙ্গে এটা সেটা নানা কথা কইতে থাকি। এই কথাবার্তার প্রভাবেই আমি অনুভব করলাম আমার মানসিক স্থিতিশীলতা ফিরে। আসছে।
এভাবে কিছুদিন যাবার পর আমরা অত্যন্ত সহজভাবে পরস্পরের সঙ্গে কথা কইতে থাকি। তারপর থেকে আমরা দুভাইবোনে কথা বলতাম। গ্রামের বাড়ির কথা, বাবা-মার কথা, অদ্ভুতকর্মা পূর্বপুরুষদের কথা। আমাদের পরিবারের ঘুমন্ত ইতিহাস ভাইবোনের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে চমকে চমকে জেগে উঠত। অবলীলায় কথা বলতে শুরু করার পর থেকে আমি উপলব্ধি করি যে আগের সে ভীত-সন্ত্রস্ত ভাবটি কেটে গেছে। মানসিক অভাববোধ আমাকে আর ক্ষ্যাপার মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় না। একদিন এক বন্ধুর বৌয়ের গলায় গান শুনে চট করে ধারণা করে ফেললাম বৌটিকে গান শেখাব। তাকে দিয়ে নিপ্রাণ জড় এবং শুষ্ক শব্দ সমষ্টিতে প্রাণের গতি দান করব। এলোমেলো ধ্বনিপুঞ্জ ধরে সুন্দর সুর সৃষ্টি করার সুকুমার কলা কৌশল শেখাব। এটা আমার বোবা মেয়ে বিয়ে করার প্রতিক্রিয়া কি না বলতে পারব না। অনেক খোঁজ-খবর করার পর ভাল এবং বুড়ো দেখে একজন গানের মাস্টার ঠিক করে দিলাম।