২১

বুধবার। সময় রাত আটটা একুশ।

মিসির আলি ভেবেছিলেন পিতা, কন্যা এবং মাতার মিলনদৃশ্যটি চিরদিন মনে রাখার মতো একটি দৃশ্য হবে। কিন্তু বাস্তবে সে-রকম হল না। কোনো হৈচৈ, কোনো কান্নাকাটি—কিছুই না। ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলেন হানিফার দিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু ছিল না। হানিফা দেখতে অবিকল তার মা’র মতো। নাকের ডগায় তার মা’র মতো একটি তিল পর্যন্ত আছে। ভদ্রলোক বললেন, ‘আমরা তোমার বাবা-মা, তুমি খুব ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল। এখন আমরা তোমাকে নিতে এসেছি।’

হানিফা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল মিসির আলি দিকে। মিসির আলি হাসলেন। সাহস দিতে চেষ্টা করলেন। এ-রকম একটি নাটকীয় মুহূর্তের জন্যে তিনি হানিফাকে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। তাকে বলেছিলেন যে, তার বাবা-মা’র খোঁজ করবার চেষ্টা করা হচ্ছে, এবং খোঁজ পাওয়া যাবে।

ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে হানিফার হাত ধরলেন। মিসির আলি ভেবেছিলেন, এই মহিলাটি হয়তো কিছুটা আবেগ দেখাবেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। হয়তো আবেগকে সংযত করলেন। ভদ্রমহিলার গলার স্বর ভারি মিষ্টি। তিনি মিষ্টি গলায় বললেন, ‘মা, আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখ আয়নায় তাকিয়ে দেখ—আমি অবিকল তোমার মতো দেখতে।’

মিসির আলি ওদের সামনে থেকে সরে গেলেন। বাইরের এক জনের উপস্থিতি হয়তো এদের কাছে ভালো লাগবে না।

তাঁরা চলে গেলেন পনের মিনিটের মধ্যে। যাবার আগে মিসির আলি বললেন, ‘ওর জিনিসপত্রগুলি নিয়ে যান।’ ভদ্রমহিলা কঠিন স্বরে বললেন, ‘কোনোকিছুই নেবার প্রয়োজন নেই।’

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যাবার আগে এস. আকন্দ সাহেব অত্যন্ত শুকনো গলায় এক বার শুধু বললেন, ‘আমাকে কষ্ট করে খুঁজে বের করবার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।’ ব্যস, এইটুকুই।

মিসির আলি ভেবে পেলেন না, এরা তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ কেন করলেন। তাঁদের মেয়েটি তার বাসায় গৃহভৃত্য ছিল, এইটিই কি তাঁদের মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে? এত বিচিত্র কেন মানুষের মন!

অবশ্যি তাঁদের বিচিত্র আচরণের অন্য একটি ব্যাখ্যাও দাঁড় করানো যেতে পারে। হয়তো আজকের এই ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁরা হকচকিয়ে গেছেন। আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা এসে পড়েছে এ-কারণেই।

মিসির আলি হঠাৎ লক্ষ করলেন, তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। হানিফা নামের মেয়েটির জন্যে খারাপ লাগছে। বেশ খারাপ লাগছে। মেয়ে জাতটাই হচ্ছে মায়াবতীর জাত। কখন যে এই মেয়েটি মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে, নিজেই বুঝতে পারেন নি।

হানিফার সঙ্গে তাঁর আর কোনোদিন দেখা হবে না। ওঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের মেয়েকে নিয়ে এখানে আসবেন না। তিনি নিজেও যাবেন না। কারণ তিনি কোনো পিছুটান রাখতে চান না কিংবা কে জানে, একদিন হয়তো যাবেন। দেখবেন, ঝড়ের রাতে পাওয়া ভিখিরি মেয়েটিকে রাজরানীবেশে কেমন লাগছে। সে কি মনে রাখবে তার দুঃসহ শৈশব? যদি রাখে, তবেই সে জীবনে অনেক বড় হবে। এবং তার ধারণা, এই মেয়েটি তা মনে রাখবে।

মিসির আলি চোখ মুছে নিজের ঘরে ঢুকলেন। বারবার চোখ ভিজে উঠছে কেন? তাঁর মতো এক জন শুকনো ধরনের মানুষের হৃদয়ে এত ভালবাসা কোত্থেকে এল?

দরজায় নক হচ্ছে। কে এল এত রাতে?

মিসির আলি দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখলেন—আকন্দ সাহেব। তাদের গাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে। তিনি শুধু একা নেমে এসেছেন। মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার!’

‘বাসার কাছাকাছি পৌঁছার পর মনে হল, আপনাকে আমি যথাযথ ধন্যবাদ দিই নি।’

‘ধন্যবাদের কোনো প্রয়োজন নেই।’

‘আপনার নেই। আপনি সাধারণ মানুষের ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ।’

ভদ্রলোক জড়িয়ে ধরলেন মিসির আলিকে এবং ছেলেমানুষের মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী হানিফাকে নিয়ে নেমে এসেছেন গাড়ি থেকে। তিনি শক্ত করে হানিফার হাত ধরে রেখেছেন, যেন হাত ছেড়ে দিলেই মেয়েটি পালিয়ে যাবে।

মিসির আলি কোমল স্বরে বললেন, ‘শান্ত হোন। আপনি শান্ত হোন। আসুন, ভেতরে গিয়ে বসি।’

ভদ্রলোক ধরা গলায় বললেন, ‘প্লীজ, আরো কিছুক্ষণ আপনাকে জড়িয়ে রাখার সুযোগ দিন। প্লীজ।’