ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
প্রত্যাগমন
এদিকে মনিরুদ্দীন সুস্থ শরীরে বাড়ী ফিরিয়া আসিতে গনির মার আনন্দ ধরে না। সে মনিরুদ্দীনকে কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছে; মনিরুদ্দীনের উপরে তাহার খুব একটা স্নেহ পড়িয়া গিয়াছিল। কাল অনেক রাত্রিতে মনিরুদ্দীন বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, রেলপথে আসায় অনেকটা অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। গনির মা তাহার সহিত ভাল করিয়া কথা কহিবার অবসর পায় নাই। বেলা দশটার পর নিদ্রাভঙ্গে উঠিয়া যখন মনিরুদ্দীন দ্বিতলের বৈঠকখানা গৃহে বসিয়া আল্বোলায় নল-সংযোগে ধূমপানে মনোনিবেশ করিয়াছেন, বৃদ্ধা গনির মা একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হইয়া, একখানি ধপ্ধপে কাপড় পরিয়া তাঁহার সম্মুখে গিয়া বসিল। গত রাত্রিতে মনিরুদ্দীন গনির মার সহিত ভাল করিয়া কথা কহে নাই বলিয়া, গনির মা মুখখানা একটু ভারি করিয়া বসিল।
মনিরুদ্দীন মৃদুহাস্যে তাহাকে পরিহাস করিয়া বলিলেন, “আর তোমার এ বিরহ-যন্ত্রণা দেখিতে পারি না—গনির মা, একটা নিকা করিবার চেষ্টা দেখ। চেষ্টা বা দেখিতে হইবে কেন—তুমি একবার মত কর, কত বাদশাহ ওমরাও এখনি তোমার দ্বারস্থ হয়। আমি এখানে ছিলাম না— বোধ হয়, ইহার মধ্যে কোন বাদশাহ তোমার কাছে এক-আধখানা দরখাস্ত পেস করিয়া থাকিবে। তোমার মুখের ভাব দেখিয়া আমার ত তাহাই বিবেচনা হয়।”
গনির মা বলিল, “ওমরাও বাদাশাহে আর দরকার কি? আর দুইদিন বাদে একেবারে গোরের মাটির সঙ্গে নিকা হবে।”
মনিরুদ্দীন বলিল, “তাই বা মন্দ কি! কোন খবর এসেছে না কি?”
গনির মা বলিলেন, “খবর ত হ’য়েই আছে—পা বাড়ালেই হয়। এখন তামাসা থাক্, কাজের কথা শোন, তুমি এখান থেকে চ’লে গেলে একজন থানার লোক আমার কাছে তোমার সন্ধান নিতে এসেছিল।”
মনিরুদ্দীন চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “থানার লোক? সে কি, কি হইয়াছে? সে কে?”
গনির মা বলিল, “কি নাম বাপু তার—ঠিক মনে পড়ছে না, কি দেবিন্দর না ফেবিন্দর—লোকটা বড় নাছোড়বান্দা।”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “ওঃ! ঠিক হয়েছে, দেবেন্দ্রবিজয়—ডিটেক্টিভ-ইন্সপেক্টর। তিনিই ত এখন আমাদের মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন।”
গনির মা জিজ্ঞাস করিল, “এ সকল কথা তুমি কোথায় শুনলে বাপ্?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “আমি কাল বাড়ীতে ঢুকিবার আগেই সব শুনিয়াছি। মেহেদী-বাগানে কে একটা মাগী খুন হইয়াছে—পুলিসের লোক তাহাকে দিলজান মনে করিয়াছে—কি পাগল!”
গনির মা ব্যগ্রভাবে বলিল, “তবে কি দিলজান সত্যি সত্যি খুন হয় নি?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “না, সৃজান বিবি খুন হইয়াছে।”
গনির মা সংশয়িতচিত্তে বলিয়া উঠিল, “সে কি! তবে শুনেছিলুম, তুমি না কি সৃজানকে কোথায় নিয়ে গিয়ে রেখেছ; পাড়ার লোকের কাছে একেবারে কান-পাতা যায় না—ছেলে বুড়ো আদি ক’রে কেবল তোমার নিন্দা। দেখ দেখি কোথায় কিছু নাই—একজনের নামে অমনি এত বড় একটা অপবাদ কেমন করে রটিয়া দিলে গো!”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, “তুমি কি আমাকে এমনই মনে কর? যাহা হউক, পুলিস এখন সৃজানের হত্যাকাণ্ডে আমাকে বোধ হয়, জড়াইতে চেষ্টা করিবে। আজ সকালেও একবার দেবেন্দ্রবিজয়ের এখানে আসিবার কথা ছিল। এখনও যে তাঁর কোন দেখা নাই, তাহাই ভাবিতেছি।”
গনির মা বলিল, “কেন, এখানে আবার তোমার কাছে আসবে কেন?”
মনিরুদ্দীন বলিলেন, ‘খুন সম্বন্ধে আমি কিছু জানি কি না, তাহাই জিজ্ঞাসা করিতে আসিবেন!”
গনির মা জিজ্ঞাসা করিল, “মজিদ খাঁ কি সত্য-সত্যই খুন করিয়াছে?”
মনিরুদ্দীন বলিল, “কি আশ্চর্য্য! মজিদ খাঁকেই খুনী বলিয়া তোমার বিশ্বাস হইল? তুমি আমাদের সংসারে থাকিয়া চুল পাকাইয়া ফেলিলে—আমাদের দুইজনকে জন্মাবধি দেখিয়া আসিতেছ—নিজের হাতে মানুষ করিয়াছ, তবু তুমি আমাদের এখনও চিনিতে পারিলে না?”
এমন সময়ে কক্ষদ্বারে কে মৃদু শব্দ করিল। মনিরুদ্দীন বলিলেন, “কে ওখানে?”
ধীরে ধীরে দ্বার ঠেলিয়া একটী বালক ভৃত্য কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। এবং মনিরুদ্দীনের হাতে একখানি কার্ড দিল।
মনিরুদ্দীন কার্ডের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গনির মাকে বলিলেন, “দেবেন্দ্রবিজয় উপস্থিত। আমি ত তোমাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, তিনি খুনের তদন্তে আজ আমার কাছেও আসিবেন। (ভৃত্যের প্রতি) যাও, তাঁহাকে এইখানেই লইয়া এস।”
ভৃত্য চলিয়া গেল। গনির মা-ও উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিল। মনিরুদ্দীন তাহাকে বসিতে বলিলেন। ক্ষণপরে তথায় দেবেন্দ্রবিজয় প্রবেশ করিলেন।