» » চতুর্থ খণ্ড : নিয়তি—ছদ্মবেশা

বর্ণাকার

পাঁচকড়ি দে

নীলবসনা সুন্দরী

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

ভ্রম-সংশোধন

দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন, এবার অরিন্দম বাবুর প্রতি নহে—নিজের প্রতি। নিজের এতবড় একটা নির্ব্বুদ্ধিতার জন্য তাঁহার মনে অত্যন্ত ক্ষোভ উপস্থিত হইল। তিনি নিজের জানুদেশে সশব্দে এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত করিয়া বলিলেন “কি আপদ্! আমার মত হস্তিমূর্খ কি আর আছে! এমন একটা সহজ উপায় থাকিতে আমি নিজের ক্ষেপ্ হারাইয়া বসিলাম! যতদিন বাঁচিব, সেদিনকার সেই নির্ব্বুদ্ধিতার কথা আমার মনে চির-জাগরুক থাকিবে। কখনই ভুলিতে পারিব না।”

অরিন্দম বাবু বলিলেন, “এতটা কুণ্ঠিত হইবার কোন আবশ্যকতা নাই। তুমি যাহাকে নির্ব্বুদ্ধিতা বলিতেছ, তাহা ঠিক নির্ব্বুদ্ধিতা নয়; বরং অমনোযোগিতা ও অবিমৃষ্যকারিতা বলিতে পার। সে যাহা হউক, তাহার পর তৃতীয়তঃ তুমি সেই হত্যাকারীকে ধরিবার জন্য গোলদীঘির নিকটে কয়েকজন অনুচরকেও ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলে।”

একান্ত নিরাশভাবে দেবেন্দ্রবিজয় অস্পষ্টকণ্ঠে বলিলেন, “ইহাতেও কি আমার দোষ হইয়াছে?”

হঠাৎ একটা টক্ কুলে কামড় দিয়ে ফেলিলে মুখখানা সহসা যেরূপ বিকৃতভাব ধারণ করে, সেইরূপ বিকৃত মুখভঙ্গি করিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “কি বিপদ্! এখনও তুমি নিজে সেটা বুঝিতে পার নাই? খুবই দোষ হইয়াছে—ইহার নাম ডিটেক্টিভগিরি নয়—পেয়াদাগিরি!”

কথাটায় দেবেন্দ্রবিজয় তীব্র কশাঘাতের জ্বালা অনুভব করিলেন। গুরুমহাশয়ের নিকটে কানমলা খাইয়া নিরুপায় সুবোধ বালক যেমন অপ্রতিভভাবে মুখ নত করে, দেবেন্দ্রবিজয় তাহাই করিলেন। ক্ষণপরে নতমুখে মহাপরাধীর ন্যায় মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, “আপনি কি বলেন, হাতে পাইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়াই ঠিক?”

দেবেন্দ্রবিজয়ের কথায় একান্ত ক্ষুব্ধভাবে অরিন্দম বাবু সবেগে উঠিয়া বলিতে গেলেন—পারিলেন না। পায়ের যেখানটা বাতে ফুলিয়া উঠিয়াছিল, সহসা নাড়া পাইয়া সেখানটা ঝন্ ঝন্ করিয়া উঠিল। যন্ত্রণাসূচক একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া তিনি তখনই আবার শুইয়া পড়িলেন। মহা গরম হইয়া বলিলেন, “কি মুস্কিল! আগে তুমি তাহাকে হাতে পাও, তাহার পর তাহাকে ধরিবার বন্দোবস্ত কর। এখন কোথায় তোমার হাত– আর কোথায় তোমার হত্যাকারী! গোলদীঘিতে নিজে ছদ্মবেশে গিয়া আগে সেই ধড়ীবাজ লোকটাকে চিনিয়া লইতে হয়। তাহার পর ধীরে ধীরে যেমন রহস্য উদ্ভেদ হইতে থাকিত—তেমনই ধীরে ধীরে ক্রমশঃ তাহার নিকটস্থ হইয়া যথাসময়ে—ঠিক যথা-মুহুর্ত্তে তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে হয়। হাত পাতিয়া বসিয়া থাকিলে কি হাতে পাখী আসিয়া বসে, না পাখীর পশ্চাৎদিকে থাকিয়া দূর হইতে ধীরে ধীরে নিঃশব্দপদসঞ্চারে অলক্ষ্যে গিয়া তাহাকে সহসা ধরিয়া ফেলিতে হয়?”

দেবেন্দ্রবিজয় বিবর্ণ হইয়া বলিলেনম “হাঁ, আপনার কথায় এখন আমি সব বুঝিতে পারিতেছি।”

অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তুমি তাহা না করিয়া বাগানের চারিদিকে ঘাটী বসাইয়া, কথাটা পাঁচ-কান করিয়া ফেলিয়াছ; নিজে সাধ করিয়া এমন একটা মহাসুযোগ ছাড়িয়া দিয়াছ! যাহাতে মাছে শীঘ্র টোপ ধরে, সেজন্য টোপের চরিদিকে চার ফেলিতে হয়। তুমি তাহা না করিয়া, একটা লাঠী লইয়া জল ঠেঙাইয়া চারিদিক্ হইতে মাছ তাড়াইয়া টোপের নিকটে আনিতে চেষ্টা করিয়াছ।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাড়াতাড়ি করিয়া আমি অনেকগুলি ভুল করিয়াছি সত্য, কিন্তু এখন আর উপায় নাই—বিশেষ বিবেচনার সহিত কোন কাজ না করিলে এইরূপ ঠকিতে হয়। তা’ যাহাই হউক, আমার ত খুবই মনে হয়, এতগুলো ভুলভ্রান্তি করিয়াও আমি অনেকটা অগ্রসর হইতে পারিয়াছি। রহস্যোদ্ভদের আর বড় বিলম্ব নাই।”

অরিন্দম বাবু বলিলেন, “কথাটা বুদ্ধিমানের মত হইল না, অন্ধকারে পথ হাতড়াইয়া অগ্রসর হওয়া অপেক্ষা একটা আলোক সংগ্রহ করাই ঠিক—আর তাহাই বুদ্ধিমানের কাজ; নতুবা অগ্রসর হইতে হইতে এমন একটা বিপথে গিয়া পড়িতে পার যে, গন্তব্য স্থান হইতে তাহা আরও অনেক দূরে। এমন কি সেখান হইতে ফিরিয়া পুনরায় পূর্ব্বস্থানে আসিতেই তোমার দম ছুটিয়া যাইবে, তা’ গন্তব্য স্থানে তখন উপস্থিত হওয়া ত বহু দূরের কথা।”

দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “আমার ঠিক তাহা ঘটে নাই, আমি বিপথে চালিত হইয়া দূরে গিয়া পড়ি নাই; সোজা পথ ধরিতে না পারিয়া বাঁকা পথে অগ্রসর হইতেছি, ইহাই আমার বিশ্বাস। আশা করি, এইবার আমি প্রকৃত হত্যাকারীকে ধরিতে পারিব। আমি এখন একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করিব, মনে করিতেছি।”

অরিন্দম বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাঁহার কাছে কেন?”

দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “সন্ধান করিয়া জানিতে পারিয়াছি, মোবারক এখন জোহেরার পাণিপ্রার্থী। এখন সে মুন্সী সাহেবের সহায়তা করিতে গিয়া সত্য গোপন করিতে পারে।”

অরি। তাহা হইলে তুমি আবার মুন্সী সাহেবকে সন্দেহ করিতেছ, দেখিতেছি।

দে। কতকটা তাহাই বটে; আপনি কি বলেন? আপনার অনুমান-শক্তি যেরূপ তীক্ষ্ণ, বোধ করি, আপনি প্রকৃত হত্যাকারীকে জানিতে পারিয়াছেন।

অ। জানিতে পারিয়াছি। ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়া মৃত্যুর কিরূপ সময় স্থির করিয়াছিলেন?

দে। রাত বারটার সময়।

অ। তাহাই ঠিক—ঠিক হইয়াছে।

দে। কে হত্যাকারী?

অ। আমি এখন কিছু বলিব না। যাহা কিছু বলিবার, তাহা বলিয়াছি। তুমি নিজে তদন্ত করিয়া নিজের বুদ্ধিতে যদি কাজ হাঁসিল করিতে পার, তাহাতে তোমার মনে আনন্দ হইবে, আমিও শুনিয়া সন্তুষ্ট হইতে পারিব। এখন আমি হত্যাকারীর নাম প্রকাশ করিয়া তোমাকে নিরুদ্যম করিতে চাহি না।

এই বলিয়া অরিন্দমবাবু ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিলেন। পার্শ্বস্থ টেবিলের উপরে একটা ষ্টিলের ছোট ক্যাস-বাক্স ছিল, তাহা উঠাইয়া শয্যার উপরে লইলেন, এবং চাবী লাগাইয়া খুলিয়া ফেলিলেন। তন্মধ্যে উপস্থিত খরচের জন্য দশটাকার পাঁচ-সাত কেতা নোট, কয়েকটা খুচরা টাকা-পয়সা, কতকগুলা সিকি, দুয়ানি ছিল, সেগুলি বাহির করিয়া বালিসের নীচে রাখিয়া দিলেন। তাহার পর টেবিলের উপর হইতে একখানি কাগজ ও কলম কালি লইয়া অন্যদিকে ফিরিয়া কি লিখিলেন। লিখিলেন—কালি শুকাইবার বিলম্ব রহিল না—কাগজখানি ভাঁজ করিয়া বাক্সের মধ্যে ফেলিয়া দিলেন, এবং চাবি লাগাইয়া, বাক্স বন্ধ করিয়া, চাবিটা যেখানে নোট, টাকা, পয়সা রাখিয়াছিলেন, সেইখানে রাখিয়া দিলেন। তাহার পর বাক্সটি দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে দিয়া বলিলেন, “ইহার ভিতরে হত্যাকারীর নাম লেখা রহিল। এখন তুমি এই বাক্সটি লইয়া যাও। যখন কৃতকার্য্য হইবে, আমার কাছে লইয়া আসিয়ো; আমি তোমার মুখে গল্পমাত্র শুনিয়া কিরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি, তখন এই বাক্স খুলিয়া তোমাকে দেখাইয়া দিব; এখন নয়—এখন আর কোন কথা আমার কাছে পাইবে না। আমি ইঙ্গিতে তোমাকে পূর্ব্বে অনেক কথাই বলিয়া দিয়াছি—তোমার পক্ষে তাহাই যথেষ্ট। দুই-একটি কঠিন কথা বলিয়াছি; দেখো দাদা, সেজন্য যেন বুড়োটার উপরে রাগ করিয়ো না, তাহা হইলে বড় অন্যায় হইবে। আমি তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করিতে পারিব না; তোমার উপরে এই অপদার্থ বুড়োটার অনেকখানি জোর খাটে—মনে থাকে যেন।”