☼ পাঁচকড়ি দে ☼
নীলবসনা সুন্দরী
দশম পরিচ্ছেদ
অনুসন্ধান
মেহেদী-বাগানের বাহিরে পশ্চিমাংশে মনিরুদ্দীন মল্লিকের প্রকাণ্ড ত্রিতল অট্টালিকা। সম্মুখে অনেকটা উন্মুক্ত তৃণভূমি প্রাচীর-বেষ্টিত। দেবেন্দ্রবিজয় তৃণভূমি অতিক্রম করিয়া বহির্দ্বারে করাঘাত করিলেন। অনতিবিলম্বে রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত করিয়া একজন স্থূলাঙ্গী বৃদ্ধা দেখা দিল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, সে এখানকার প্রধানা দাসী অথবা পাচিকা হইবে।
দেবেন্দ্রবিজয়ের অনুমান সত্য। সেই বৃদ্ধা মনিরুদ্দীনের প্রধানা দাসী তাহার নাম কেহ জানে না—এমন কি বোধ হয়, মনিরুদ্দীনও না। সকলে তাহাকে গনির মা বলিয়া ডাকিয়া থাকে—সে অত্যন্ত বিশ্বাসী—আজীবন এই সংসারেই আছে—মনিরুদ্দীনকে সে কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছে।
বৃদ্ধা গনির মা বলিল, “কাকে খুঁজেন, মশাই?”
দেবেন্দ্রবজোয় বলিলেন “মল্লিক সাহেবের কি এই বাড়ী?”
বৃ। হাঁ।
দে। তিনি এখন কোথায়?
বৃ। তিনি এখন এখানে নাই। তাঁকে কি দরকার?
দে। তাঁকে বিশেষ কোন দরকার নাই। তাঁর সম্বন্ধে আমি দুই একটা কথা জানিতে চাই।
মনিরুদ্দেনের নামে যে অপবাদ গ্রামের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছিল, তাহা বৃদ্ধা গনির মায়েরও কাণে উঠিয়াছিল; সুতরাং দেবেন্দ্রবিজয়ের কথায় সে বড় বিব্রত হইয়া উঠিল। বিরক্তভাবে বলিল, “তা এখানে কেন—এখানে কি জান্বেন? আপনি যান্—মশাই।” বলিয়া দ্বার রুদ্ধ করিবার উদ্যোগ করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বেগতিক দেখিয়া তাড়াতাড়ি দ্বারের ভিতরের দিকে একটা পা বাড়াইয়া দিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আমি মনিরুদ্দীনের ভালর জন্যই আসিয়াছি। যা’ বলি শোন, আমাকে তাড়াইলে ভাল কাজ করিবে না। বিশেষ একটা কথা আছে।”
বৃদ্ধার বিরক্তি অদম্য কৌতূহলে পরিণত হইল। বলিল, “তবে ভিতরে এসে বসুন; মনিরুদ্দীনের কিছু খারাপী ঘটেছে না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না-না, তিনি ভাল আছেন—সেজন্য কোন ভয় নাই। তবে একটা বেজায় গাফিলী হয়েছে—বসো—স্থির হ’য়ে সব শোন।”
বৃদ্ধা দেবেন্দ্রবিজয়কে বাহিরের বৈঠকখানা ঘরে লইয়া বসাইল।
বৈঠকখানাটি অতি সুন্দররূপে সজ্জিত। গৃহতলে মূল্যবান গালিচা বিস্তৃত; তদুপরি দুই-তিনখানি মখমলমণ্ডিত কৌচ; একপার্শ্বে একটি মর্ম্মর প্রস্তরের ছোট টেবিল। টেবিলের উপরে সুদীর্ঘলাঙ্গলবিশিষ্ট রৌপ্যনির্ম্মিত আলবোলা শোভা পাইতেছে। গবাক্ষপার্শ্বে দুইটি কারুকার্য্য-বিশিষ্ট আল্মারী। তন্মধ্যে সুন্দররূপে বাঁধান, স্বর্ণাক্ষরে শোভিত অনেকগুলি ইংরাজী ও বাঙ্গালা উপন্যাস সাজান রহিয়াছে। দেবেন্দ্রবিজয় সর্ব্বাগ্রে একখানি কৌচের উপরে নিজের দেহভার অর্পণ করিয়া দিলেন। গনির মা অদূরে দ্বার-সম্মুখে গালিচার উপরে বসিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দেখ, আমি মল্লিক সাহেবের ভালর জন্যই এসেছি। যা’ যা’ জিজ্ঞাসা করি—ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে যাবে, মিথ্যা বল্লেই মুস্কিল। আমি কে, সে পরিচায়টাও তোমাকে এখনই দিয়ে রাখ্ছি; তা’ না হলে তোমার কাছে যে, সব কথা সহজে পাওয়া যাবে না, তা আমি বেশ বুঝ্তে পেরেছি। আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়—আমি পুলিশের লোক।”
শুনিয়া বৃদ্ধার চক্ষুঃস্থির; অত্যন্ত ভীতভাবে সে উঠিয়া দাঁড়াইল, সভয়ে কম্পিতস্বরে বলিল, “কি মুস্কিল, ওমা! পুলিসের লোক এখানে কেন গো! মনিরুদ্দীন আমাদের কি করেছে!”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “না-না, মনিরুদ্দীন এমন কিছু করে নাই। তবে কি জান, তার পিছনে অনেক শত্রু লেগেছে—সেই শত্রুদের হাত থেকে তাকে রক্ষা করবার জন্য আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি।”
বৃদ্ধা বলিল, “তা আমাকে কি করতে হবে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বিশেষ কিছু করতে হবে না—আমি যা জিজ্ঞাসা করি, তোমাকে তার ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে। দিলজানকে তুমি জান?”
ক্রুদ্ধভাবে বৃদ্ধা বলিল, “না দিলজান-ফিলজানকে আমি জানি না।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “ফিলজানকে না জান, তাতে ক্ষতি নাই, দিলজানকে জানা দরকার হচ্ছে। যা জিজ্ঞাসা করি, উত্তর দাও; নতুবা তোমাকেও বড় মুস্কিলে পড়তে হবে।”
গনির মা প্রথমটা মনে করিয়াছিল, কিছু বলিবে না, কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয়ের রুষ্টভাব দেখিয়া সে নিজে একটু নরম হইয়া গেল।
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন্ দিন থেকে মনিরুদ্দীন বাড়ীতে নাই?”
বৃদ্ধা বলিল, “গত বুধবার রাত্রে কোথায় গেছেন এখনও ফিরেন নাই।”
দে। কোথায় গেছেন?
বৃ। তা’ জানি না।
দে। সঙ্গে কেহ আছে?
বৃ। কি জানি মশাই, তা’ আমি ঠিক জানি না—পাঁচজনের মুখে ত এখন পাঁচ রকম কথা শুনতে পাচ্ছি—সত্যি-মিথ্যা কি ক’রে জানব বাবু?
দে। গত বুধবারে দিলজান কি এখানে এসেছিল?
বৃ। এসেছিল।
দে। কখন?
বৃ। সন্ধ্যার আগে।
দে। কেন এসেছিল?
বৃ। মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে।
দে। দেখা হয়েছিল কি?
বৃ। না, মনিরুদ্দীন বাড়ীতে ছিল না। দিলজান রাত্রে দেখা করতে আসবে ব’লে তখনই চ’লে যায়।
দে। রাত্রে আবার এসেছিল।
বৃ। এসেছিল, কিন্তু মনিরুদ্দীনের সঙ্গে তার দেখা হয় নাই। দিলজানের আসিবার আগে মনিরুদ্দীন আবার বেরিয়ে গিয়েছিল।
দে। সেদিন রাত্রে মনিরুদ্দীন সৃজানকে নিয়ে পালাবে, তা’ দিলজান জানতে পেরেছিল?
বৃ। তা আমি ঠিক জানি না।
দে। মনিরুদ্দীনের দেখা না পাওয়ায় দিলজান তখন কি করিল?
বৃ। মজিদ তখন এখানে ছিল। উপরের একটা ঘরে ব’সে তার সঙ্গে দিলজান অনেকক্ষণ ধ’রে কি পরামর্শ করতে লাগল।
দে। মজিদ এসেছিল কেন?
বৃ। মজিদ এমন মাঝে মাঝে এখানে আসে।
দে। তাদের পরামর্শ কিছু শুনেছ?
বৃ। কিছু না। আমিই বা তা’ শুনতে যাব কেন? আমাকে কি বাপু, তেমনি ছোটলোকের মেয়ে পেয়েছ? যা হো্ক শেষকালটা তাদের মধ্যে যেন কি খুব রাগারাগির মতন হয়। দুজনেই যেন খুব জোরে জোরে কথা বলছিল।
দে। তখন রাত কত হবে?
বৃ। এগারটার কম নয়।
দে। সেই রাগারাগির পর দিলজান কি একা এখানে থেকে চ’লে যায়?
বৃ। একা; কিন্তু তার একটু পরেই মজিদও তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যায়।
দে। মজিদ যাবার সময়ে তোমাকে কিছু বলেছিল?
বৃ। কিছু-না—কিছু না।
দেবেন্দ্রবিজয় বিষম সমস্যায় পড়িলেন। তাঁহার মনে হইল, মজিদও এই খুন-রহস্যের মধ্যে অবশ্য কিছু-না কিছু জড়িত আছে। দিলজানের সহিত তাহার রাগারাগির কারণ কি? তাহার মুখে এমন কি কথা শুনিল, যাহাতে দিলজানের ক্রোধসঞ্চার হইয়াছিল? এ প্রশ্নের সদুত্তর এখন একমাত্র মজিদের নিকটে পাওয়া যাইতে পারে। সেই সময়ে সহসা আর একটা কথা দেবেন্দ্রবিজয়ের মনে পড়িয়া গেল; মোবারক-উদ্দীন দিলজানের মৃতদেহ আবিষ্কারের অনতিকাল পূর্ব্বে মেহেদী-বাগানের মোড়ে মজিদকে সেই গলির ভিতর হইতে ফিরিতে দেখিয়াছিলেন। তাহা হইলে মজিদের কি এই কাজ? মজিদই কি দিলজানের হত্যাকারী? দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, তিনি ক্রমেই এক গভীর রহস্য হইতে অন্য এক গভীরতর রহস্যে উপনীত হইতেছেন; কিন্তু সেই রহস্যোদ্ভেদের কোন পন্থা না দেখিতে পাইয়া তিনি মনের মধ্যে অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। স্থির করিলেন, এখনই তিনি একবার বালিগঞ্জে যাইয়া মোবারক-উদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিবেন। তাহার নিকটে যাহা জানিবার, তাহা জানিয়া পরে মজিদের সহিত দেখা করিবেন। এখানে গত বুধবার রাত্রে তাঁহার সহিত দিলজানের কি কি কথা হইয়াছিল, তদুভয়ের বাগ্বিতণ্ডার কারণ কি; এবং নিজেই বা তিনি তেমন সময়ে মেহেদী-বাগানে কেন গিয়াছিলেন, এই সকল প্রশ্নের সদুত্তর না দিতে পারে—তাহা হইলে সে যে এই খুনের ভিতরে জড়িত আছে, সে সম্বন্ধে আর তখন সন্দেহের কোন কারণ থাকিবে না।
গনির মা দেবেন্দ্রবিজয়কে অনেকক্ষণ নীরব থাকিতে দেখিয়া বলিল, “মশাই, যা কিছু আমি জানি, সব আপনাকে বলেছি; এখন আপনার যা’ইচ্ছে হয় করুন। আমি ত এখনও কিছু বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে?
দেবেন্দ্রবিজয় সংক্ষেপে বলিলেন, “খুন।”
বুড়ী বসিয়াছিল, খুনের কথা শুনিয়া যেন সবেগে তিন হাত লাফাইয়া উঠিল; চোখ-মুখ কপালে তুলিয়া কহিল, “কি মুস্কিল! কে খুন হয়েছে—আমাদের মনিরুদ্দীন না কি?”
“না, দিলজান।”
“দিলজান!”
“হাঁ, দিলজান মজিদের সঙ্গে রাগারাগি ক’রে যাবার পরে মেহেদী-বাগানের একটা গলি-পথে খুন হয়েছে।”
বৃদ্ধা ব্যগ্রভাবে কহিল, “তা হ’তে পারে, মজিদের কোন দোষ নাই—সে কখনই খুন করে নাই, আমি তা বেশ জানি! সে কেন দিলজানকে খুন করতে যাবে? সে ওদিকে বড় মেশে না; মদ, বাইজীর সখ তার নাই—জোহেরার সঙ্গে তার খুব আস্নাই হয়েছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তবে শুনলেম, মনিরুদ্দীনের সঙ্গেই না কি, জোহেরার সাদি হবে, ঠিক হ’য়ে গেছে?”
বৃদ্ধা বলিল, “না, না—সে কোন কাজের কথাই নয়। জোহেরা কখনই মনিরুদ্দীনকে সাদি করবে না—সে মজিদকেই সাদি করবে—মজিদের সঙ্গে তার খুব ভাব। আপনি কি মনে করেছেন, মজিদ দিলজানকে খুন করেছে? আপনি মজিদকেই খুনী ব’লে চালান দিবেন না কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “না, মজিদের বিরুদ্ধে তেমন বিশেষ কোন প্রমাণ এখনও কোন পাই নাই।”
অন্যান্য আরও দুই-একটী কথার পর দেবেন্দ্রবিজয় মনিরুদ্দীনের বাটী ত্যাগ করিলেন। বৃদ্ধা গনির মা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল।