» » প্রথম খণ্ড : নিয়তি—লীলাক্ষেত্র

বর্ণাকার

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

দেবেন্দ্রবিজয়

আমরা যখনকার কথা লিপিবদ্ধ করিতেছি, তখন সুদক্ষ ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের নাম-ডাক খুব। সর্ব্বাপেক্ষা তাঁহারই প্রাধান্য। যে সকল বড় বড় কেসে অপরের নিকটে কোন সুফলের আশা করা যায় না, তাহা দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতেই আসে; সুতরাং মেহেদী-বাগানের সেই অত্যাশ্চর্য্য নারী-হত্যার কেস্‌টা তাঁহারই হাতে পড়িল।

কেস্‌টা হাতে লইয়া দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমে একটু বিব্রত হইয়া পড়িলেন। কিরূপে হত্যাকারীর সন্ধান হইবে এবং কিরূপে সেই অপরিচিতার মৃতদেহ সনাক্ত করিবেন, এমন কোন সূত্র পাইলেন না। মৃতাকে দেখিয়া বোধ হয় না, সে বারাঙ্গনা কিম্বা কোন ইতর-বংশীয়া। রাত্রি-জাগরণ, অতিরিক্ত মদ্যপান ও অপরিমিত ইন্দ্রিয়-পরিচালনায় বেশ্যাদিগের চোখে-মুখে যে একটা কালিমা পড়ে, তাহা তাহার মুখে আদৌ নাই– মৃতার মুখ কেবল মৃত্যুবিবর্ণীকৃত। মুখ দেখিয়া সহজে বুঝিতে পারা যায়, সে কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্তর্গতা হইবে; কিন্তু এরূপ নির্জ্জন পথিমধ্যে, গভীর রাত্রে কোন্ সম্ভ্রান্ত গৃহস্থের কন্যা কাহার দ্বারা খুন হইল? দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে স্থির করিলেন, ভদ্রকন্যা হইলেও এই রমণী চরিত্রহীনা; নতুবা সদভিপ্রায়ে কোন্ ভদ্রমহিলা অরক্ষিত অবস্থায় গভীর রাত্রে গৃহের বাহির হইয়া থাকে? এরূপ স্থলে কে ইহাকে হত্যা করিয়াছে বলিয়া সম্ভব হয়? যাহার জন্য এই সুন্দরী গভীর রাত্রে গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছিল, সেই ব্যক্তি কি ইহাকে হত্যা করিয়াছে? এমন কোন কারণ থাকিতে পারে, যাহাতে ইহাও অসম্ভব নহে। হয়ত কোন কারণ বশতঃ সেই ব্যক্তি ইহাকে খুন করিয়া থাকিবে; অথবা এই রমণীর স্বামী, স্ত্রীর চরিত্রহীনতার কথা কোন রকমে জানিতে পারিয়া থাকিবে; তাহার পর সংগোপনে স্ত্রীর অনুসরণে আসিয়া সকলেই স্বচক্ষে দেখিয়াছিল, এবং পাপিষ্ঠার পাপের এইরূপ প্রায়শ্চিত্ত বিধান করিয়াছে; অথবা এমনও হইতে পারে, এই রমণী যাহার জন্য গোপনে রাত্রে গৃহত্যাগ করিত, তাহার আর কোন প্রণয়পাত্রী কিম্বা প্রণয়াকাঙ্ক্ষিণীর দ্বারা খুন হইয়াছে; কিন্তু পথিমধ্যে এরূপ একটা ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সমাধা করা অল্প সাহসের পরিচয় নহে। স্ত্রীলোক সহসা কি এতটা সাহস করিতে পারে? দেবেন্দ্রবিজয় ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিলেন না। বুঝিতে পারিলেন– যতক্ষণ না মৃতকে সনাক্ত করিতে পারা যায়, ততক্ষণ এইরূপ গাঢ়তর অন্ধকারের মধ্যেই তাঁহাকে থাকিতে হইবে। প্রথমে অনুসন্ধান করিয়া ঠিক করতে হইবে, যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে,– সে কে— কোথায় থাকিত, এবং তাহার চরিত্র কিরূপ ছিল; এইগুলি যদি প্রথমে সন্ধান করিয়া ঠিক করিতে পারা যায়, তাহা হইলে তখন হত্যার কারণ এবং হত্যাকারীকে ঠিক করিতে বিশেষ শ্রমস্বীকারের আবশ্যকতা হইবে না।

দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, এমন কোন সূত্র নাই, যাহা অবলম্বন করিয়া তিনি প্রথমতঃ সেই মৃতাকে সনাক্ত করিতে পারেন। পরিহিত বস্ত্রাদিতে যে রজকের চিহ্ন থাকে, তাহার দ্বারাও অনেক সময় অনেক কাজ হয়, তাহা থাকিলে দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমতঃ কাজে হস্তক্ষেপ করিবার একটা সুবিধা পাইতেন; কিন্তু মৃতার পরিহিত কাপড়, জামা, ওড়না প্রভৃতি সকলেই সিল্কের। তাহাতে রজকের কোন চিহ্ন ছিল না, সুতরাং সে সুবিধাও দেবেন্দ্রবিজয়ের অদৃষ্টে ঘটিল না।

স্থানীয় থানায় মৃতার পরিহিত বস্ত্রাদি রক্ষিত হইয়াছিল। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন তন্মধ্যে ওড়নাখানি তাঁহার কিছু উপকারে আসিতে পারে। সেইখানির চতুষ্প্রান্তে রেশমের ফুল-লতার সূক্ষ কারুকার্য্য ছিল। রেশমী বস্ত্রের উপরে রেশমের এইরূপ সুন্দর সূচী-কার্য্যে করিমের মা খুব নিপুণা। ইহাতে বৃদ্ধা করিমের মা সুনামের সহিত যথেষ্ট অর্থোপার্জ্জনও করিয়াছে। অনেকেই তাহাকে জানে, এবং দেবেন্দ্রবিজয়েরও সহিত তাহার পরিচয় আছে। বৃদ্ধা এখন বয়োদোষে নিজের হাতে কাজ করিতে না পারিলেও, তাহার কন্যাকে এই শিল্পকার্য্যে এমন সুশিক্ষিতা ও সুনিপুণা করিয়া তুলিয়াছে যে, সেই কন্যা হইতে তাহার সুনাম সম্পূর্ণরূপে অব্যাহত আছে। করিমের পিতা একজন নামজাদা চিকন্‌দার জরদ্-দর্জ্জি ছিল; কিন্তু অদৃষ্টক্রমে সে নিজের অর্থাগমের বড় কিছু সুবিধা করিতে পারে নাই। মৃত্যুপূর্ব্বে সে স্ত্রীর জন্য অর্থাদি তেমন কিছু রাখিয়া যাইতে পারে নাই; কিন্তু সে স্ত্রীকে যে বহুবিধ সূচি-শিল্প শিক্ষা দিয়াছিল, তাহাতেই স্ত্রীকে স্বামীর মৃত্যুর পরে অর্থাভাবে কিছুমাত্র কষ্ট পাইতে হয় নাই। এক্ষণে বৃদ্ধা করিমের মার দুই-তিনখানা ভাড়াটিয়া বাড়ী, হাতে নগদ টাকাও আট-দশ হাজার। করিমের মা সেই টাকায় গহনা, বাড়ী জমি ইত্যাদি বন্ধক রাখিয়া সুদে খাটাইতেছে– সকল রকমে এখন তাহার মাসিক আড়াই শত টাকা আয়; কিন্তু বুড়ী নিজে বড় কৃপণ; এত টাকার আয়– তথাপি বুড়ী বালিগঞ্জের নিকটে পেয়ারা-বাগানে একখানা একতলা বাড়ীতে থাকে। বাড়ীতে একটি মাত্র ঘর, সেই এক ঘরেই মা ও মেয়ে থাকে। ঘরখানির সম্মুখে অনেকটা খালি জমি রাংচিতা গাছের বেড়াতে ঘেরা। সেখানে সময়ে সময়ে লাউ, কুম্‌ড়া, শশা, বেগুন, পটল প্রভৃতি অনেক রকমের গাছ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাতে করিমের মার একটা আয় আছে, বৃদ্ধা সেই সকল লাউ, কুম্‌ড়া, শশা, বেগুন এক আনা রকম নিজের জন্য রাখে, বাকী পনের আনা বিক্রয় করিয়া ফেলে।

দেবেন্দ্রবিজয় সেই রেশমের ফুল-লতার কাজ করা ওড়নাখানি একখানি কাগজে জড়াইয়া লইয়া একবারে করিমের মার বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন।

করিমের মা দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়া বলিল, “এই যে গো, তুমি নিজেই এসে হাজির হয়েছ! আমি এখনই তোমার কাছে যাব, মনে করছিলাম।”

দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, ব্যাপার কি?”

করিমের মা বলিল, “মুন্সী জোহিরুদ্দীনের স্ত্রী সৃজান বিবিকে এক রাশ টাকা ধার দিয়ে ব’সে আছি; এখন শুন্‌ছি, মনিরুদ্দীনের সঙ্গে সে কোথায় স’রে গেছে– কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আমার টাকাগুলোর যে কি কিনারা হবে, ভেবে কিছু ঠিক করতে পারছি না।”

দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুধু হাতে টাকা ধার দিয়েছিলে না কি?”

“সুধু হাতে টাকা!” বৃদ্ধা চক্ষুর্দ্বয় ললাটে তুলিল। তাহার পর হাসিতে হাসিতে বলিল, “আমাকে কি তেম্‌নি ন্যাকাহাবা পেয়েছ? একছড়া জড়োয়া কণ্ঠহার বাঁধা রেখে টাকা দিয়েছি। তা’ কণ্ঠহার ছড়াটা মুন্সী সাহেবরই হবে– খুব দামী। সেই কণ্ঠহার নিয়ে একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে হয় না?”

দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তবে আর ভাবনা কি? এখন একবার মুন্সী সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেই ত সকল গোল মিটে যায়।”

করিমের মা বলিল, “দিন-কতক সবুর ক’রে দেখি; ইহার মধ্যে সৃজান বিবির যদি কোন খবর পাই, তা’ হলে আর আমার এ সব গোলযোগে দরকার নাই। যার জিনিষ সে নিজে এসেই খালাস ক’রে নিয়ে যাবে। আমার বোধ হয়, সৃজান বিবি ফারখৎ দিয়ে মনিরুদ্দীনকে নিকে কর্‌বে; তখন সে এই কণ্ঠহার খালাসের জন্য আমার কাছে আবার আস্‌তে পারে। কবে আস্‌বে, কোথায় গেছে কতদিন পরে খবর পাব, কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারছি না– বড়ই মুস্কিল হ’ল আমার দেখ্‌ছি।”

দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “যখন কণ্ঠহার তোমার লোহার সিন্দুকে আছে, তখন এ মুস্কিল একদিন-না-একদিন আসান্ হয়ে যাবে—তার জন্য এত ভাবনা কেন? এখন সে কথা থাক, আমি একটা বিশেষ কাজের জন্য তোমার কাছে এসেছি। দেখ দেখি, এই রেশমের কাজ তোমার হাতের কি না?” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় কাগজের মোড়া খুলিয়া সেই ওড়নাখানি করিমের মার হাতে দিলেন।