» » » দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : পথান্তরে

বর্ণাকার

“যে মাটিতে পড়ে লোকে উঠে তাই ধরে

বারেক নিরাশ হয়ে কে কোথায় মরে॥

তুফানে পতিত কিন্তু ছাড়িব না হাল।

আজিকে বিফলা হলো, হতে পারে কাল॥”

নবীন তপস্বিনী

যে দিন নবকুমারকে বিদায় করিয়া মতিবিবি বা লুৎফ-উন্নিসা বর্ধমানাভিমুখে যাত্রা করিলেন, সে দিন তিনি বর্ধমান পর্যন্ত যাইতে পারিলেন না। অন্য চটিতে রহিলেন। সন্ধ্যার সময়ে পেষমনের সহিত একত্রে বসিয়া কথোপকথন হইতেছিল, এমতকালে মতি সহসা পেষমনকে জিজ্ঞাসা করিলেন,

“পেষমন্! আমার স্বামীকে কেমন দেখিলে?”

পেষমন্ কিছু বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেমন আর দেখিব?” মতি কহিলেন, “সুন্দর পুরুষ বটে কি না?”

নবকুমারের প্রতি পেষমনের বিরাগ জন্মিয়াছিল। যে অলঙ্কারগুলি মতি কপালকুণ্ডলাকে দিয়াছিলেন, তৎপ্রতি পেষ্মেনের বিশেষ লোভ ছিল; মনে মনে ভরসা ছিল, একদিন চাহিয়া লইবেন। সেই আশা নির্মুল হইয়াছিল, সুতরাং কপালকুণ্ডলা এবং তাঁহার স্বামী, উভয়ের প্রতি তাঁহার দারুণ বিরক্তি। অতএব স্বামিনীর প্রশ্নে উত্তর করিলেন,

“দরিদ্র ব্রাহ্মণ আবার সুন্দর কুৎসিৎ কি?”

সহচরীর মনের ভাব বুঝিয়া মতি হাস্য করিয়া কহিলেন, “দরিদ্র ব্রাহ্মণ যদি ওমরাহ হয়, তবে সুন্দর পুরুষ হইবে কি না?”

পে। সে আবার কি?

ম। কেন, তুমি জান না যে, বেগম স্বীকার করিয়াছেন যে, খস্রু বাদশাহ হইলে আমার স্বামী ওমরাহ হইবে?

পে। তা ত জানি। কিন্তু তোমার পূর্বস্বামী ওমরাহ হইবেন কেন?

ম। তবে আমার আর কোন্ স্বামী আছে?

পে। যিনি নুতন হইবেন।

মতি ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমার ন্যায় সতীর দুই স্বামী, বড় অন্যায় কথা–ও কে যাইতেছে?”

যাহাকে দেখিয়া মতি কহিলেন, “ও কে যাইতেছে?” পেষমন্ তাহাকে চিনিল; সে আগ্রানিবাসী, খাঁ আজিমের আশ্রিত ব্যক্তি। উভয়ে ব্যস্ত হইলেন। পেষমন্ তাহাকে ডাকিলেন। সে ব্যক্তি আসিয়া লুৎফ-উন্নিসাকে অভাবাদনপূর্বক একখানি পত্র দান করিল; কহিল,

“পত্র লইয়া উড়িষ্যা যাইতেছিলাম। পত্র জরুরি।”

পত্র পড়িয়া মতিবিবির আশা ভরসা সকল অন্তর্হিত হইল। পত্রের মর্ম এই,

“আমাদিগের যত্ন বিফল হইয়াছে। মৃত্যুকালেও আকবরশাহ আপন বুদ্ধিবলে আমাদিগকে পরাভূত করিয়াছেন। তাঁহার পরলোকে গতি হইয়াছে। তাঁহার আজ্ঞাবলে, কুমার সেলিম এক্ষণে জাহাঁগীর শাহ হইয়াছেন। তুমি খস্রুর জন্য ব্যস্ত হইবে না। এই উপলক্ষে কেহ তোমার শত্রুতা সাধিতে না পারে, এমত চেষ্টার জন্য তুমি শীঘ্র আগ্রায় ফিরিয়া আসিবে।”

আকবরশাহ যে প্রকারে এ ষড়্য ন্ত্র নিষ্ফল করেন, তাহা ইতিহাসে বর্ণিত আছে; এ স্থলে সে বিবরণের আবশ্যকতা নাই।

পুরস্কারপূর্বক দূতকে বিদায় করিয়া, মতি পেষমনকে পত্র শুনাইলেন। পেষমন্ কহিল, “এক্ষণে উপায়?”

ম। এখন আর উপায় নাই।

পে। (ক্ষণেক চিন্তা করিয়া) ভাল, ক্ষতিই বা কি? যেমন ছিলে, তেমনই থাকিবে মোগল বাদশাহের পুরস্ত্রীমাত্রই অন্য রাজ্যের পাটরাণী অপেক্ষাও বড়।

ম। (ঈষৎ হাসিয়া) তাহা আর হয় না। আর সে রাজপুরে থাকিতে পারিব না। শীঘ্রই মেহের-উন্নিসার সহিত জাহাঁগীরের বিবাহ হইবে। মেহের-উন্নিসাকে আমি কিশোর বয়োবধি ভাল জানি; একবার সে পুরবাসিনী হইলে সেই বাদশাহ হইবে; জাহাঁগীর বাদশাহ নামমাত্র থাকিবে। আমি যে তাহার সিংহাসনারোহণের পথরোধের চেষ্টা পাইয়াছিলাম; ইহা তাহার অবিদিত থাকিবে না। তখন আমার দশা কি হইবে?

পেষমন্ প্রায় রোদনোণ্মুখী হইয়া কহিল, “তবে কি হইবে?”

মতি কহিলেন, “এক ভরসা আছে। মেহের-উন্নিসার চিত্ত জাহাঁগীরের প্রতি কিরূপ? তাহার যেরূপ দার্ঢ্য, তাহাতে যদি সে জাহাঁগীরের প্রতি অনুরাগিণী না হইয়া স্বামীর প্রতি যথার্থ স্নেহশালিনী হইয়া থাকে, তবে জাহাঁগীর শত শের আফগন বধ করিলেও মেহের-উন্নিসাকে পাইবেন না। আর যদি মেহের-উন্নিসা জাহাঁগীরের যথার্থ অভিলাষিণী হয়, তবে আর কোন ভরসা নাই।”

পে। মেহরর-উন্নিসার মন কি প্রকারে জানিবে? মতি হাসিয়া কহিলেন, “লুৎফ-উন্নিসার অসাধ্য কি? মেহের-উন্নিসা আমার বাল্যসখী,–কালি বর্ধমানে গিয়া তাহার নিকট দুই দিন অবস্হিতি করিব।“

পে। যদি মেহের-উন্নিসা বাদশাহের অনুরাগিণী হন, তাহা হইলে কি করিবে?

ম। পিতা কহিয়া থাকেন, “ক্ষেত্রে কর্ম বিধীয়তে।”

উভয়ে ক্ষণেক নীরব হইয়া রহিলেন। ঈষৎ হাসিতে মতির ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত হইতে লাগিল। পেষমন্ জিজ্ঞাসা করিল, “হাসিতেছ কেন?”

মতি কহিলেন, “কোন নূতন ভাব উদয় হইতেছে।”

পে। কি নূতন ভাব?

মতি তাহা পেষমনিকে বলিলেন না। আমরাও পাঠককে বলিব না। পশ্চাৎ প্রকাশ পাইবে।