- গ্রন্থপরিচয়
- প্রথম পরিচ্ছেদ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
- সপ্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টম পরিচ্ছেদ
- নবম পরিচ্ছেদ
- দশম পরিচ্ছেদ
- একাদশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
- চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
- বিংশ পরিচ্ছেদ
- একবিংশতিতম পরিচ্ছেদ
- দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ
কালির বোতল
মা—সুভাষিণীর শাশুড়ী। তাঁহাকে বশ করিতে হইবে—সুতরাং গিয়াই তাঁহাকে প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইলাম, তার পর এক নজর দেখিয়া লইলাম, মানুষটা কি রকম। তিনি তখন ছাদের উপর অন্ধকারে, একটা পাটী পাতিয়া, তাকিয়া মাথায় দিয়া শুইয়া পড়িয়া আছেন, একটা ঝি পা টিপিয়া দিতেছে। আমার বোধ হইল, একটা লম্বা কালির বোতল গলায় গলায় কালি ভরা, পাটীর উপর কাত হইয়া পড়িয়া গিয়াছে। পাকা চুলগুলি বোতলটির টিনের ঢাকনির1 মত শোভা পাইতেছে। অন্ধকারটা বাড়াইয়া তুলিয়াছে।
আমাকে গৃহিণী ঠাকুরাণী বধূকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এটি কে?”
বধূ বলিল, “তুমি একটি রাঁধুনী খুঁজিতেছিলে, তাই একে নিয়ে এসেছি।”
গৃহিণী। কোথায় পেলে?
বধূ। মাসীমা দিয়াছেন।
গৃ। বামন না কায়েৎ?
ব। কায়েৎ।
গৃ। আঃ, তোমার মাসীমার পোড়া কপাল। কায়েতের মেয়ে নিয়ে কি হবে? এক দিন বামনকে ভাত দিতে হলে কি দিব?
ব। রোজ ত আর বামনকে ভাত দিতে হবে না—যে কয় দিন চলে চলুক—তার পর বামনী পেলে রাখা যাব—তা বামনের মেয়ের ঠ্যাকার ব—আমরা তাঁদের রান্নাঘরে গেলে হাঁড়িকুড়ি ফেলিয়া দেন—আবার পাতের প্রসাদ দিতে আসেন! কেন, আমরা কি মুচি?
আমি মনে মনে সুভাষিণীকে ভূয়সী প্রশংসা করিলাম—কালিভরা লম্বা বোতলটাকে সে মুঠোর ভিতর আনিতে জানে দেখিলাম। গৃহিণী বলিলেন, “তা সত্যি বটে মা—ছোট লোকের এত অহঙ্কার সওয়া যায় না। তা এখন দিন কতক কায়েতের মেয়েই রেখে দেখি। মাইনে কত বলেছে?”
ব। তা আমার সঙ্গে কোন কথা হয় নাই।
গৃ। হায় রে, কলিকালের মেয়ে! লোক রাখতে নিয়ে এসেছ, তার মাইনের কথা কও নাই?
আমাকে গৃহিণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি নেবে তুমি?”
আমি বলিলাম, “যখন আপনাদের আশ্রয় নিতে এসেছি, তখন যা দিবেন তাই নিব।”
গৃ। তা বামনের মেয়েকে কিছু বেশী দিতে হয় বটে, কিন্তু তুমি কায়েতের মেয়ে—মায় তিন টাকা মাসে আর খোরাকপোষাক দিব।
আমার একটু পাইলেই যথেষ্ট—সুতরাং তাহাতে সম্মত হইলাম। বলা বাহুল্য যে, মাহিয়ানা লইতে হইবে শুনিয়াই প্রাণ কাঁদিয়া উঠিল। আমি বলিলাম, “তাই দিবেন।”
মনে করিলাম, গোল মিটিল—কিন্তু তাহা নহে। লম্বা বোতলটায় কালি অনেক। তিনি বলিলেন, “তোমার বয়স কি গা? অন্ধকারে বয়স ঠাওর পাইতেছি না—কিন্তু গলাটা ছেলেমানুষের মত বোধ হইতেছে।”
আমি বলিলাম, “বয়স এই ঊনিশ কুড়ি।”
গৃ। তবে বাছা, অন্যত্র কাজের চেষ্টা দেখ গিয়া যাও। আমি সমত্ত লোক রাখি না।
সুভাষিণী মাঝে হইতে বলিল, “কেন মা, সমত্ত লোকে কি কাজ কর্ম পারে না?”
গৃ। দূর বেটী পাগলের মেয়ে। সমত্ত লোক কি লোক ভাল হয়?
সু। সে কি মা! দেশসুদ্ধ সব সমত্ত লোক কি মন্দ?
গৃ। তা নাই হলো—তবে ছোট লোক যারা খেটে খায় তারা কি ভাল?
এবার কান্না রাখিতে পারিলাম না। কাঁদিয়া উঠিয়া গেলাম। কালির বোতলটা পুত্রবধূকে জিজ্ঞাসা করিল, “ছুঁড়ী চলল না কি?”
সুভাষিণী বলিল, “বোধ হয়।”
গৃ। তা যাক গে।
সু। কিন্তু গৃহস্থ বাড়ী থেকে না খেয়ে যাবে? উহাকে কিছু খাওয়াইয়া বিদায় করিতেছি।
এই বলিয়া সুভাষিণী আমার পিছু পিছু উঠিয়া আসিল। আমাকে ধরিয়া আপনার শয়নগৃহে লইয়া গেল। আমি বলিলাম, “আর আমায় ধরিয়া রাখিতেছ কেন? পেটের দায়ে, কি প্রাণের দায়ে, আমি এমন সব কথা শুনিবার জন্য থাকিতে পারিব না।”
সুভাষিণী বলিল, “থাকিয়া কাজ নাই। কিন্তু আমার অনুরোধে আজিকার রাত্রিটা থাক।”
কোথায় যাইব? কাজেই চক্ষু মুছিয়া সে রাত্রিটা থাকিতে সম্মত হইলাম। একথা ওকথার পর সুভাষিণী জিজ্ঞাসা করিল, “এখানে যদি না থাক, তবে যাবে কোথায়?”
আমি বলিলাম, “গঙ্গায়।”
এবার সুভাষিণীও একটু চক্ষু মুছিল। বলিল, “গঙ্গায় যাইতে হইবে না, আমি কি করি তা একটুখানি বসিয়া দেখ। গোলযোগ উপস্থিত করিও না—আমার কথা শুনিও।”
এই বলিয়া সুভাষিণী হারাণী বলিয়া ঝিকে ডাকিল। হারাণী সুভাষিণীর খাস ঝি। হারাণী আসিল। মোটাসোটা, কালো কুচকুকচে, চল্লিশ পার, হাসি মুখে ধরে না, সকলটাতেই হাসি। একটু তিরবিরে। সুভাষিণী বলিল, “একবার তাঁকে ডেকে পাঠা।”
হারাণী বলিল, “এখন অসময়ে আসিবেন কি? আমি ডাকিয়া পাঠাই বা কি করিয়া?”
সুভাষিণী ভ্রূভঙ্গ করিল, “যেমন করে পারিস—ডাক গে যা।”
হারাণী হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল। আমি সুভাষিণীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ডাকিতে পাঠাইলে কাকে? তোমার স্বামীকে?”
সু। না ত কি পাড়ার মুদি মিন্িসেকে এই রাত্রে ডাকিতে পাঠাইব?
আমি বলিলাম, “বলি, আমায় উঠিয়া যাইতে হইবে কি না, তাই জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম।”
সুভাষিণী বলিল, “না। এইখানে বসিয়া থাক।”
সুভাষিণীর স্বামী আসিলেন। বেশ সুন্দর পুরুষ। তিনি আসিয়াই বলিলেন, “তলব কেন?” তার পর আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “ইনি কে?”
সুভাষিণী বলিল, “ওঁর জন্যই তোমাকে ডেকেছি। আমাদের রাঁধুনী বাড়ী যাবে, তাই ওঁকে তার জায়গায় রাখিবার জন্য আমি মাসীর কাছ হইতে এনেছি। কিন্তু মা ওঁকে রাখিতে চান না।”
তাঁর স্বামী বলিলেন, “কেন চান না?”
সু। সমত্ত বয়স।
সুভার স্বামী একটু হাসিলেন। বলিলেন, “তা আমায় কি করিতে হইবে?”
সু। ওঁকে রাখিয়ে দিতে হইবে।
স্বামী। কেন?
সুভাষিণী, তাঁহার নিকট গিয়া, আমি না শুনিতে পাই, এমন স্বরে বলিলেন, “আমার হুকুম।” কিন্তু আমি শুনিতে পাইলাম। তাঁর স্বামীও তেমনই স্বরে বলিলেন, “যে আজ্ঞা।”
সু। কখন পারিবে।
স্বামী। খাওয়ার সময়।
তিনি গেলে আমি বলিলাম, “উনি যেন রাখাইলেন, কিন্তু এমন কটু কথা সয়ে আমি থাকি কি প্রকারে?”
সু। সে পরের কথা পরে হবে। গঙ্গা ত আর এক দিনে বুজিয়ে যাইবে না।
রাত্রি নয়টার সময়, সুভাষিণীর স্বামী (তাঁর নাম রমণ বাবু) আহার করিতে আসিলেন। তাঁর মা কাছে গিয়া বসিল। সুভাষিণী আমাকে টানিয়া লইয়া চলিল, বলিল, “কি হয় দেখি গে চল।”
আমরা আড়াল হইতে দেখিলাম, নানাবিধ ব্যঞ্জন রান্না হইয়াছে, কিন্তু রমণ বাবু একবার একটু করিয়া মুখে দিলেন, আর সরাইয়া রাখিলেন। কিছুই খাইলেন না। তাঁর মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছুই ত খেলি না বাবা!”
পুত্র বলিল, “ও রান্না ভূতপ্রেতে খেতে পারে না। বামন ঠাকুরাণীর রান্না খেয়ে খেয়ে অরুচি জন্মে গেছে। মনে করেছি কাল থেকে পিসীমার বাড়ী গিয়ে খেয়ে আসব।”
তখন গৃহিণী ছোট হয়ে গেলেন। বলিলেন, “তা করিতে হবে না যাদু! আমি আর রাঁধুনী আনাইতেছি।”
বাবু হাত ধুইয়া উঠিয়া গেলেন। দেখিয়া সুভাষিণী বলিলেন, “আমাদের জন্য ভাই ওঁর খাওয়া হইল না। তা না হোক—কাজটা হইলে হয়।”
আমি অপ্রতিভ হইয়া কি বলিতেছিলাম, এমন সময়ে হারাণী আসিয়া সুভাষিণীকে বলিল, “তোমার শাশুড়ী ডাকিতেছেন।” এই বলিয়া সে খামখা আমার দিকে চাহিয়া একটু হাসিল। আমি বুঝিয়াছিলাম, হাসি তার রোগ, সুভাষিণী শাশুড়ীর কাছে গেল, আমি আড়াল হইতে শুনিতে লাগিলাম।
সুভাষিণীর শাশুড়ী বলিতে লাগিল, “সে কায়েৎ ছুঁড়ীটে চলে গেছে কি?”
সু। না—তার এখনও খাওয়া হয় নাই বলিয়া, যাইতে দিই নাই।
গৃহিণী বলিলেন, “সে রাঁধে কেমন?”
সুভা। তা জানি না।
গৃ। আজ না হয় সে নাই গেল। কাল তাকে দিয়া দুই একখানা রাঁধিয়ে দেখিতে হইবে।
সু। তবে তাকে রাখি গে।
এই বলিয়া সুভাষিণী আমার কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ভাই, তুমি রাঁধিতে জান ত?”
আমি বলিলাম, “জানি। তা ত বলেছি।”
সু। ভাল রাঁধিতে পার ত?
আমি। কাল খেয়ে দেখে বুঝিতে পারিবে।
সু। যদি অভ্যাস না থাকে তবে বল, আমি কাছে বসিয়া শিখিয়ে দিব।
আমি হাসিলাম। বলিলাম, “পরের কথা পরে হবে।”