১৯

সারাটা পথ নীলু চুপ করে রইল। এক বার সে বলল, ‘কী ব্যাপার, এত চুপচাপ যে?’ নীলু তারও জবাব দিল না। তার কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সে আছে একটা ঘোরের মধ্যে।

‘গান শুনবে? গান দেব?’

নীলু মাথা নাড়ল। সেটা হাঁ কি না, তাও স্পষ্ট হল না।

‘কী গান শুনবে? কান্ট্রি মিউজিক? কান্ট্রি মিউজিকে কার গান তোমার পছন্দ?’

নীলু জবাব দিল না।

‘আমার ফেবারিট হচ্ছে জন ডেনভার। জন ডেনভারের রকি মাউন্টেন হাই গানটা শুনেছ?’

‘না।’

‘খুব সুন্দর! অপূর্ব মেলোডি!’

সে ক্যাসেট টিপে দিতেই জন ডেনবারের অপূর্ব কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ক্যালিফোর্নিয়া রকি মাউন্টেন হাই।’

‘কেমন লাগছে নীলু?’

‘ভালো।’

‘শুধু ভালো না। বেশ ভালো।’

সেও জন ডেনভারের সঙ্গে গুনগুন করতে লাগল। নীলুর মনে হল, ওর গানের গলাও তো চমৎকার! একবার ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে—গান জানেন কি না। কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গাড়ি কোন দিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে তাও সে লক্ষ করছে না। এক বার শুধু ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এক জন ভিখিরি এসে ভিক্ষা চাইল। সে ধমকে উঠল কড়া গলায়। তারপর আবার গাড়ি চলল। নীলু ফিসফিস করে বলল, ‘কটা বাজে?’

‘সাতটা পঁয়ত্রিশ। তোমাকে আটটার আগেই পৌঁছে দেব।’

‘আপনার বাড়ি মনে হয় অনেক দূর?’

‘শহর থেকে একটু দূরে বাড়ি করেছি। কোলাহল ভালো লাগে না। ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড কার লেখা জান?’

‘নাহ্।’

‘টমাস হার্ডির। পড়ে দেখবে, চমৎকার! অথচ ট্র্যাজেডি হচ্ছে, টমাস হার্ডিকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় নি। তুমি তাঁর কোনো বই পড়েছ?’

‘না।’

‘পড়ে দেখবে। খুব রোমান্টিক ধরনের রাইটিং।’

গাড়ি ছুটে চলেছে মীরপুর রোড ধরে। হঠাৎ নীলু বলল, ‘আমার ভালো লাগছে না।’

‘কী বললে?’

‘আমার ভালো লাগছে না, আমি বাসায় যাব।’

সে তাকাল নীলুর দিক। একটি হাত বাড়িয়ে ক্যাসেটের ভল্যুম বাড়িয়ে দিল। গাড়ির গতি কমল না।

‘আমি বাসায় যাব।’

‘আটটার সময় আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব।’

‘না, আজ আমি কোথাও যাব না। প্লীজ গাড়িটা থামান, আমি নেমে পড়ব।’

‘কেন?’

‘আমার ভালো লাগছে না। প্লীজ।’

সে তাকাল নীলুর দিকে। নীলু শিউরে উঠল। এ কেমন চাউনি। যেন মানুষ নয়, অন্য কিছু।’

‘প্লীজ, গাড়িটা একটু থামান।’

‘কোনো রকম ঝামেলা না-করে চুপচাপ বসে থাক। কোনো রকম শব্দ করবে না।’

‘আপনি এ-রকম করে কথা বলছেন কেন?’

গাড়ির গতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ঝড়ের গতিতে পাশ দিয়ে দুটো ট্রাক গেল। লোকটি তার একটি হাত রাখল নীলুর ঊরুতে। নীলু শিউরে উঠে দরজার দিকে সরে গেল। লোকটি হাসল। এ কেমন হাসি!

‘গাড়ি থামান। আমি চিৎকার করব।’

‘কেউ এখন তোমার চিৎকার শুনবে না।’

‘আপনি কেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’

‘আমি ভয় দেখাচ্ছি না।’

‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করে গাড়িতে উঠেছি।’

‘আরো কিছুক্ষণ থাক। বেশিক্ষণ নয়, এসে পড়েছি বলে।’

‘কী করবেন আপনি?’

‘তেমন কিছু না।’

নীলু এক হাতে দরজা খুলতে চেষ্টা করল। লোকটি তাকিয়ে দেখল কিন্তু বাধা দিল না। দরজা খোলা গেল না। নীলু প্রাণপণে বলতে চেষ্টা করল, আমাকে বাঁচাও। কিন্তু বলতে পারল না। প্রচুর ঘামতে লাগল। প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হল।