ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা
অনুষ্ঠান পত্র
“জ্ঞানাৎ পরতরো নহি”
১। বিশ্বরাজ্যের আশ্চর্য ব্যাপার সকল স্থিরচিত্তে আলোচনা করিলে অন্তঃকরণে অদ্ভুত রসে সঞ্চার হয়, এবং কি নিয়মে এই আশ্চর্য ব্যাপার সম্পন্ন হইতেছে, তাহা জানিবার নিমিত্তে কৌতূহল জন্মে। যদ্দ্বারা এই নিয়মের বিশিষ্ট জ্ঞান হয়, তাহাকেই বিজ্ঞানশাস্ত্র কহে।
২। পূর্বকালে ভারতবর্ষে বিজ্ঞানশাস্ত্রের যথেষ্ট সমাদর ও চর্চা ছিল, তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ অদ্যাপি দেদীপ্যমান রহিয়াছে। বর্তমান কালে বিজ্ঞানশাস্ত্রের যে সকল শাখা সম্যক্ উন্নত হইয়াছে, তৎসমুদায়ের মধ্যে অনেকগুলির প্রথম বীজরোপণ প্রাচীন হিন্দু ঋষিরাই করেন। জ্যোতিষ, বীজগণিত, মিশ্রগণিত, রেখাগণিত, আয়ুর্বেদ, সামুদ্রিক, রসায়ন, উদ্ভিদতত্ত্ব, সঙ্গীত, মনোবিজ্ঞান, আত্মতত্ত্ব প্রভৃতি বহুবিধ শাখা বহুদূর বিস্তীর্ণ হইয়াছিল। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই, এক্ষণে অনেকেরই প্রায় লোপ হইয়াছে নামমাত্র অবশিষ্ট আছে।
৩। এক্ষণে ভারতবর্ষীয়দিগের পক্ষে বিজ্ঞানশাস্ত্রের অনুশীলন নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে; তন্নিমিত্ত ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান-সভা নামে একটি সভা কলিকাতায় স্থাপন করিবার প্রস্তাব হইয়াছে। এই সভা প্রধান সভারূপে গণ্য হইবে, এবং আবশ্যক মতে ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ইহার শাখা-সভ্য স্থাপিত হইবে।
৪। ভারতবর্ষীয়দিগকে আহ্বান করিয়া বিজ্ঞান অনুশীলন বিষয়ে প্রোৎসাহিত ও সক্ষম করা এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য; আর ভারতবর্ষ সম্পর্কীয় যে সকল বিষয় লুপ্তপ্রায় হইয়াছে, তাহা রক্ষা করা (মনোরম ও জ্ঞানদায়ক প্রাচীন গ্রন্থ সকল মুদ্রিত ও প্রচারিত করা) সভার আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য।
৫। সভা স্থাপন করিবার জন্য একটী গৃহ, কতকগুলি বিজ্ঞানবিষয়ক পুস্তক ও যন্ত্র এবং কতকগুলি উপযুক্ত ও অনুরক্ত ব্যক্তি বিশেষের আবশ্যক। অতএব এই প্রস্তাব হইয়াছে যে, কিছু ভূমি ক্রয় করা ও তাহার উপর একটি আবশ্যকানুরূপ গৃহ নির্মাণ করা, বিজ্ঞানবিষয়ক পুস্তক ও যন্ত্র ক্রয় করা এবং যাঁহারা এক্ষণে বিজ্ঞানানুশীলন করিতেছেন, কিম্বা যাঁহারা এক্ষণে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়াছেন, অথচ বিজ্ঞানশাস্ত্র অধ্যয়নে একান্ত অভিলাষী, কিন্তু উপায়াভাবে সে অভিলাষ পূর্ণ করিতে পারিতেছেন না, এরূপ ব্যক্তিদিগকে বিজ্ঞানচর্চা করিতে আহ্বান করা হইবে।
৬। এই সমুদায় কার্য সম্পন্ন করিতে হইলে অর্থই প্রধান আবশ্যক, অতএব ভারতবর্ষের শুভানুধ্যায়ী ও উন্নতীচ্ছু জনগণের নিকট বিনীতভাবে প্রার্থনা করিতেছি যে, তাঁহারা আপন আপন ধনের কিয়দংশ অর্পণ করিয়া উপস্থিত বিষয়ের উন্নতি সাধন করুন।
৭। যাঁহারা চাঁদা গ্রহণ করিবেন, তাঁহাদের নাম পরে প্রকাশিত হইবে, আপাততঃ যাঁহারা স্বাক্ষর করিতে কিম্বা চাঁদা দিতে ইচ্ছা করিবেন তাঁহারা নিম্ন স্বাক্ষরকারীর নিকট প্রেরণ করিলে সাদরে গৃহীত হইবে।—অনুষ্ঠাতা, শ্রীমহেন্দ্রলাল সরকার।
                                                ___________‎‎‎‎‎‎‎‎‎‎
অনুষ্ঠান পত্রের সাতটি ধারা ক্রমে গ্রহণ করিয়া প্রত্যেক ধারা সম্বন্ধে আমাদের যাহা বক্তব্য, তাহা বলিব।
১। “বিশ্বরাজ্যের আশ্চর্য ব্যাপার সকল স্থিরচিত্তে আলোচনা করিলে অন্তঃকরণে অদ্ভুত রসের সঞ্চার হয়।”
নিদাঘ ঋতুতে নিশানাথহীনা নিশাকালে উচ্চ প্রাসাদোপরি উপবিষ্ট হইয়া— একবার গ্রহ নক্ষত্র তারকা বিকীরিত মন্দাকিনী মধ্য প্রবাহিত গগনপ্রাঙ্গণে দৃষ্টি উৎক্ষিপ্ত কর। সেই অমল নীলিমা, সেই অনন্তবিস্তৃতি, সেই অসংখ্য জ্বলন্ত বিন্দুপাতোজ্জ্বলীকৃতা শোভা, সেই অস্ফুট শ্বেত কলেবরা স্বর্গ মন্দাকিনী, এই সকল শোভা শোভিত দিগ্বলয় ব্যাপী সেই মহাগর্ভ ব্রহ্মাণ্ড কটাহ দেখিলে বিস্ময় পরিপূরিত মনে আপনা আপনি জিজ্ঞাসা করিবে, এগুলি কি? কোথা হইতে আসিল? কি নিয়মে আকাশে বিচরণ করিতেছে?
আধুনিক বিখ্যাতনামা দার্শনিকেরা বলেন, তোমার প্রথম প্রশ্নের অর্থ নাই। ঈশ্বরবাদীরা বলেন, তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন আস্তিকতার মূলসূত্র। তোমার শেষ প্রশ্ন যে বিজ্ঞান প্রবৃত্তিলতার প্রথমাঙ্কুর, তদ্বিষয়ে দুইমত নাই।
তুমি ভাবিতে লাগিলে, কি নিয়মে ইহারা আকাশে বিচরণ করিতেছে। ভাবিতে ভাবিতে এক দিনে, দুই দিনে, এক মাসে, দুই মাসে দেখিতে দেখিতে জানিতে পারিলে যে, ঐ আকাশে সকল নক্ষত্রই ভ্রমণশীল, কেবল একটীই স্থির। এই স্থির তারাটি ধ্রুবনক্ষত্র। সেটি সর্বদাই উত্তরে আছে। এত দিনে তুমি একটী সামান্য জ্যোতিষ নিয়ম পরিজ্ঞাত হইলে; সামান্য নিয়মপরিজ্ঞানেই কত মহৎ উপকার দর্শিতে পারে; দিগ্‌ভ্রান্ত পথিকের পক্ষে এই সামান্য সত্যটি অন্ধকার রাত্রিতে কত উপকার সাধন করে। এক্ষণে জটিল নিয়মে সকলের বিশিষ্ট জ্ঞান হইলে কত ফল দর্শিতে পারে।
কত ফল ফলিতেছে, তাহা ত আমরা এক্ষণে অহরহ প্রত্যক্ষ করিতেছি। কোন পূজ্যপাদ ব্যক্তি বিজ্ঞানবেত্তার সহিত রাবণ রাজার তুলনা করিয়া বিজ্ঞানের ক্ষমতার পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। তিনি বলেন, মহর্ষি বাল্মীকি দোর্দণ্ড দশাননের অসীম প্রতাপ বর্ণনজন্য কবিকুশল কল্পনাবলে অমরগণকে তাহার দাসত্বে নিযুক্ত করিয়া লঙ্কাধিপতির প্রাধান্য স্থাপন করিয়াছেন, কিন্তু বিজ্ঞানবেত্তার প্রভুত্ব এই কল্পনা-প্রসূত রাবণের প্রতাপ অপেক্ষা সমধিক শ্লাঘনীয়। সত্য বটে, দশানন কোন দেবকে মালাকার কার্যে, কাহাকেও বা অশ্বসেবক কর্মে, কাহাকেও বা গৃহপরিষ্কারক দাস্যে, নানা কার্যে নানা দেবগণকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞানবেত্তা কি করিতেছেন? তিনি বাষ্পরূপী ইন্দ্রদেবকে মহায়সশকটচালনে নিযুক্ত করিয়াছেন। দেবকন্যা ক্ষণপ্রভা তাঁহার প্রভা লুকাইয়া বিদ্বানের সম্বাদবাহিনীভাবে অবিরত সম্বাদ বহন করিতেছেন। অসীমতেজা প্রভাকর অন্তরালে থাকিয়া নিজকরে সহধর্মিণী ছায়ার সাহায্যে বৈজ্ঞানিক লিপিকর কার্যে ব্যপত আছেন। পৃথিবী দেবী, দিক্‌পাল বরুণ, পবনরাজ, সকলকেই তিনি দাসত্বে আবদ্ধ রাখিয়াছেন। তাঁহারা কখন বিদ্বানের ক্ষুন্নিবৃত্তি জন্য ময়দা ভাঙ্গিতেছেন, কখন শীত নিবারণ জন্য বস্ত্র বয়ন করিতেছেন, কখন কাগজ প্রস্তুত করিতেছেন, কখন ঔষধ প্রস্তুত করিতেছেন। কভু বা বিজ্ঞানবিৎকে স্কন্ধে করিয়া স্বর্গলোকে লইয়া যাইতেছেন। কখন পুস্তক মুদ্রিত করিয়া আনিয়া বিদ্বানকে উপঢৌকন দিতেছেন। কখন বা তাঁহার প্রমোদভবনে, রাজবর্ত্মে আলো জ্বালিতেছেন। কি বিদ্যালয়ে কি গৃহকার্যে কি বিচারালয়ে কি ধর্মমন্দিরে একাকী, সজন, অমরগণ, সকল কালেই সকল অবস্থাতেই বিজ্ঞানবিতের ক্রীতদাস। হরিদ্বারসাগর প্রবাহিতা ভাগীরথীকে ভগীরথ তাঁহার জন্যই অবনীতলে আনিয়াছিলেন। সেই ভাগীরথী তাঁহার জল পরিচারিকা, তাঁহার অভ্যর্থনা জন্য অগস্ত্য মুনি বিন্ধ্যাচলকে অবনত করিয়া থাকিতে বলিয়া গিয়াছেন। হিমাচল বিদ্বানের জন্যই স্বকীয় আগারে তুষার ভাণ্ডার রক্ষা করিতেছেন। বনস্পতিগণ তাঁহার জন্য ফলভার বহন করে। খনি তাঁহারি জন্য উদরে করিয়া বহু মূল্য ধাতু ধারণ করে।
এখন “রত্নাকর হয়েছেন দাস, কুবের তাঁর আজ্ঞাকারী”—। দশানন সমরক্ষেত্রে দেবগণের সহায়তা পান নাই। বিদ্বানের সমরক্ষেত্রে স্বয়ং অগ্নিদেব লৌহগোলক বাহনে বিপক্ষদলে মহামার উৎপাদন করিতেছেন। তাহাতেই বলি কল্পিত রাবণাপেক্ষা আধুনিক বিদ্বানের প্রভুত্ব অধিকতর শ্লাঘনীয়। কবিগুরু বাল্মীকি কলিকালে পনুঃপ্রাদুর্ভূত হইয়া স্বয়ং বিদ্বানের নিকটে রামায়ণ পাঠ করিতেছেন। ভাষাবিজ্ঞান বলে বৈজ্ঞানিক মীনরূপী ভগবানের ন্যায় আবার বেদোদ্ধার করিতেছেন। বৈজ্ঞানিক ঈশ্বরের অবতার। রাবণগৌরবলোপী, প্রতাপশালী শিবিকর্ণ সদৃশ পরোপকারী পরমযোগীর ন্যায় দৃঢ় নিবিষ্ট, সর্বদাই হৃষ্ট ও সকল অবস্থাতেই সন্তুষ্ট।
এই বিজ্ঞান বলেই আধুনিক ইউরোপীয়গণ এই পৃথিবীতে একাধিপত্য স্থাপন করিয়াছেন। দেখুন, বিলাতে খাদ্য সামগ্রী অতি দুর্মূল্য, শ্রমোপজীবিগণ “আমার” বলিতে পারে, “আমার পূর্ব্বপুরুষের” বলিতে পারে, এমন বাসস্থান তাহাদের অনেকেরই নাই; বিলাতে কার্পাসতূলা এক ছটাক পরিমিত উৎপন্ন হয় না; হয় আমেরিকা; নয় ভারতবর্ষ হইতে বিলাতীয়েরা তূলা আমদানি করেন। অথচ যন্ত্র বিজ্ঞানের এমনি ক্ষমতা, মাঞ্চেষ্টরের তন্তুবায়েরা লজ্জাহীনা ভারতের লজ্জা নিবারণ করিতেছে। লাঙ্কাশ্বায়ের দুর্ভিক্ষ হইল, আর যে দেশে ঢাকা আছে, শান্তিপুর শিমলে কলমে আছে, বালুচর বাণারস আছে, মুঙ্গের পাটনা আছে, কালিকট কাশ্মীর আছে, মহীসুর অম্বর সহর আছে—সেই দেশে, যেখানে লক্ষ লক্ষ মণ তূলা প্রতি বর্ষে উৎপন্ন হয়, যেখানে তন্তুবায়কে লিপিকর ভাস্কর বা সূত্রধার অপেক্ষা অধিক শ্রদ্ধা করে, সেই দেশে, যে দেশের তন্তুজাত রোম সম্রাটের রাজপরিচ্ছদ ছিল, যে দেশের সহিত বস্ত্রবাণিজ্য ব্যবসায়ে ব্রতী থাকিয়া মধ্যকালে বিনিষনগর সমৃদ্ধিশালী হয়—সেই দেশে লাঙ্কাশায়েরে দুর্ভিক্ষ হইল বলিয়া হা বস্ত্র যো বস্ত্র শব্দে কর্ণ বধির হইয়া যাইতে লাগিল।
হা অদৃষ্ট! বিজ্ঞান অবহেলার এই ফল। বিজ্ঞানের সেবা করিলে বিজ্ঞান তোমার দাস, যে বিজ্ঞানকে ভজে, বিজ্ঞান তাহাকে ভজিবে। কিন্তু যে বিজ্ঞানের অবমাননা করে, বিজ্ঞান তাহার কঠোর শত্রু। মনে করুন, কোথাকার অন্নকষ্টে পরিচ্ছদকষ্ট হইল। ঐন্দ্রজালিক বিজ্ঞান স্বীয় অবমাননা জন্য এইরূপে বৈরসাধন করিল। এখন ভুক্তভোগী লোক শিক্ষাগ্রহণ কর।
অনেকে বলেন, ইউরোপীয়েরা কেবল বাহুবলে এই ভারতবর্ষে আধিপত্য স্থাপন করিয়াছেন। বাহুবলেই বলুন, আর যাহা বলুন, সে কথা কতক দূর সত্য, তাহার অনুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু একথাটিও অত্যুক্তি দোষে দূষিত কখনই বলা যাইতে পারে না যে ইউরোপীয়েরা বিজ্ঞানবলে এই ভারতবর্ষ জয় করিয়াছেন, বিজ্ঞান বলেই ইহা রক্ষা করিতেছেন। বিজ্ঞানেই সতত চালনা করিয়াই বিদেশীয় বণিকদিগকে ভারততীরে আনয়ন করেন, বিজ্ঞানই নানা যুদ্ধে সহায়তা করিয়াছিলেন—এখনও বিজ্ঞান মহায়সশকট বাহনে, তড়িৎতার সঞ্চালনে, কামান সন্ধানে, অয়োগোলক বর্ষণে এই বীরপ্রসূ ভারতভূমি হস্তামলকবৎ আয়ত্ত করিয়া শাসন করিতেছে। শুধু তাহাই নহে। বিদেশীয় বিজ্ঞানে আমাদিগকে ক্রমশঃই নির্জীব করিতেছে। যে বিজ্ঞান স্বদেশী হইলে আমাদের দাস হইত, বিদেশী হইয়া আমাদের প্রভু হইয়াছে। আমরা দিন দিন নিরুপায় হইতেছি। অতিথিশালায় আজীবনবাসী অতিথির ন্যায় আমরা প্রভুর আশ্রমে বাস করিতেছি। এই ভারতভূমি একটি বিস্তীর্ণ অতিথিশালা মাত্র।
দ্বিতীয় ধারার কথার প্রমাণার্থ তদুল্লিখিত শাস্ত্র সকলের কি প্রকার সমালোচনা ছিল, দেখা যাউক।
জ্যোতিষ। জ্যোতিষ বিজ্ঞানশাস্ত্র বটে, কিন্তু প্রাচীন বেদাঙ্গ। সুতরাং ইহার প্রাচীনত্বে সন্দেহ করা ধৃষ্টতা ভিন্ন আর কি বলা যাইতে পারে? ব্রহ্মদেশীয় চন্দ্র সূর্য গ্রহণ তালিকা পঞ্জিকার প্রাচীনত্ব বিষয়ে ফরাসী ও বিলাতি পণ্ডিতগণের মধ্যে নানা বাগ্‌বিতণ্ডা হইয়াছে। অনেক বিদেশীয় পণ্ডিত, হিন্দুরা অতি প্রাচীন জাতি স্বীকার করা, স্বজাতির গৌরব হানিকর বিবেচনা করেন।
হিন্দুজাতি অথবা আর্যেরাই যে জ্যোতিষ্কগণের প্রথম পর্যবেক্ষক, নিয়মানুসন্ধায়ক ও তত্ত্বোদ্ভাবক, তাহা ভাষাবিজ্ঞানবিৎগণের অবশ্য স্বীকার্য। যে সপ্তর্ষি উল্লেখ পূর্বে করিয়াছি, তাহাকে ইয়ুরোপীয়গণ উর্ষ মেজর বা বৃহৎ ভল্লুক বলেন। প্রাচীন বেদেও সপ্তর্ষি শব্দের স্থলে ঋক্ষ (ভল্লুক) শব্দ ব্যবহার আছে। কেবল সংস্কৃত ভাষায় দেখা যায় যে ঋচ্ ধাতুর অর্থ দ্যুতি। ঐ তারা কয়টি অতিশয় উজ্জ্বল। উজ্জ্বলতা দেখিয়া দ্যুতিবাচক কোন নাম দিয়া পরে সেই নামের অর্থ ক্রমে ভল্লুক বোধ করা ও আকার সাদৃশ্য উপলব্ধি করা অত্যন্ত সঙ্গত বোধ হয়। ও এইরূপ করা কেবল আর্যগণেরই সম্ভব হইতে পারে।
হিন্দুরা দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ, আলোকবীক্ষণ প্রভৃতি কাচ যন্ত্রের সাহায্য ব্যতীত জ্যোতিষ চালনা করিয়া যে সফলতা লাভ করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্ময়াপন্ন হইতে হয়। সামান্য নবদ্বীপপঞ্জিকা সেই বিজ্ঞানের ধ্বংসাবশেষ মাত্র।
দিবামান, রাত্রিমান, তিথিমান, নির্ণয়, চন্দ্রসূর্যের উদয়াস্ত নির্ধারণ—গ্রহ নক্ষত্র সঞ্চার ক্রিয়া স্থির করা, অয়ন গ্রহণ ও সংক্রমণ গণনা—সে সকল এখন অতি ভ্রমসঙ্কুল হউক না কেন, লুপ্তবিজ্ঞানের ধ্বংস চিহ্ন তাহার আর সন্দেহ নাই। এখন জীবিতবিজ্ঞান নাই, তাহার স্থানে কতকগুলি অকৃতজ্ঞ পিতৃমাতৃ শূন্য দুর্বল সঙ্কেত আছে মাত্র। বিজ্ঞান বলে আর্যভট্ট পৃথিবীর অক্ষরেখার তির্যকভাব অবধারণ করিয়াছিলেন ও তাহার পরিমাণ সার্ধ তেইশ অংশ নির্ধারণ করেন। আর এখনকার জ্যোতির্বিজ্ঞানাভিমানীরা সামান্য সূর্য গ্রহণ গণনায় এক দণ্ড বা দুই দণ্ড ভ্রম করিয়া বিজ্ঞানের পরিচয় প্রদান করিলেন। যদি বাপুদেব শাস্ত্রী না থাকিতেন, ত কি লজ্জার কথা হইত! ইচ্ছা ছিল, পূর্বোল্লিখিত বিজ্ঞানগুলি ক্রমে ক্রমে গ্রহণ করিয়া একে একে সকলগুলির বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করি, প্রবন্ধের দৈর্ঘ্যভয়ে তাহা করিতে পারিলাম না। সংক্ষেপে দুই চারি কথা লেখা যাইতেছে।
বীজগণিত। কি করা কর্তব্য, স্থির করিতে না পরিয়া লোকে সচরাচর যে বলিয়া থাকে, “আমি অস্থিরপঞ্চে পড়িয়াছি।” সেই অস্থিরপঞ্চ বীজগণিতান্তর্গত এক প্রকার অঙ্ক। যে অঙ্ক প্রাচীন বীজগণিতে অতি শীঘ্র সমাধা হইতে পারে। আর যে অঙ্ক যুনানী দেশে দ্যোফান্ত প্রথম উদ্ভাবন করেন, ও সেইজন্য যাহাকে দ্যোফান্তীন বলে, যাহা সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রথম সিদ্ধ হয়, তাহাও হিন্দুবীজগণিত মধ্যে আমরা শুনিয়াছি। যে দেশের দ্যোফান্তের বহু পূর্বে দ্যোফ্যান্তীন কূট সাধ্য হইত, সেই দেশীয় শৌভঙ্করিক বীরগণ সামান্য ভগ্নাংশে “এক পর্বতপ্রমাণ দেউল” দেখিয়া শ্লোকোক্ত বীর তাহা ভাঙ্গিতে সমর্থ হওয়া দূরে থাকুক, উদ্দেশ্য প্রমাণ করিয়া পলায়নপর হয়েন। (*) তথাপি আশা করিবার অনেক স্থল আছে, কেননা আবার সেই দেশেই দেখিতেছি যে দিল্লী কলেজে সুবিখ্যাত অধ্যাপক রামচন্দ্র স্বীয় অপূর্ব গ্রন্থ “গরিমা লঘিমা” প্রচার দ্বারা বিলাতীয় বিখ্যাতনামা ডিমরগণ বৈজ্ঞানিকেরও বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছেন। ও ভূয়ো প্রশংসাবাদ আকর্ষণ করিয়া লইয়াছেন। ভরসা এই, যদি মরুভূমি মধ্যে আমরা এরূপ বটবৃক্ষ দেখিতে পাইলাম, তাহা হইলে কর্ষিত ক্ষেত্রে উৎসাহবারি সেচনে ভারতভূমি কল্পতরু বা কল্পলতাই উৎপাদন করিবে।
   (*) আছিল দেউল এক পর্বত প্রমাণ।
      ক্রোধ করি ভাঙ্গে তাহা পবন নন্দন ||
     অর্ধেক পঙ্কেতে তার তেহাই সলিলে।
     দশম ভাগের ভাগ সেবালার দলে ||
     উপরে বায়ান্ন গজ দেখ বিদ্যমান।
     করহ সুবোধ সবে দেউল প্রমাণ ||
মিশ্রগণিত। মিশ্রগণিতে অজ্ঞতানিবন্ধন কত অনর্থ হইতেছে, তাহা কে গণনা করিতে পারে? আমরা উদাহরণের জন্য একটি সামান্য অনর্থের উল্লেখ করিতেছি। মানবদণ্ডের (পাল্লার দাঁড়ির) উভয় সীমা মধ্যরজ্জু হইতে সমান ব্যবধানে স্থিত না থাকিলে মানদণ্ড জলতলের সহিত সমানান্তরাল হইবে না, অর্থাৎ এক দিক অন্য দিক অপেক্ষা কিছু ঝোক্তা হইবে। এইরূপ স্থলে যে দিক উচ্চ হইয়াছে, সেই দিকে পাত্রে কিছু ভার দেওয়া অর্থাৎ পাষাণ ভাঙ্গিয়া ওজন দেওয়ার প্রথা আছে, কখন ফেরে ফেরে অর্থাৎ দুই সের দ্রব্য দিতে হইলে এক সের ঝোক্তা দিকে ওজন করিয়া আর এক সের উচ্চ দিকে ওজন করিয়া দ্রব্য দেওয়া হইয়া থাকে। কিন্তু এরূপ ফেরে ফের মাপে সর্বদাই বিক্রেতার ক্ষতি হইয়া থাকে, একথাটি মিশ্রগণিতের একটি সামান্য সত্য। মহাজনগণ যখন ঝরতি-পড়্‌তি শুক্তি বলিয়া মান ন্যূনতার সমাধা করিবেন, তখন বিজ্ঞান অবহেলাকে কিছু অংশ দিলে সত্যবাদীর কার্য করেন।
রেখাগণিত। লীলাবতী গ্রন্থই রেখাগণিত চর্চার প্রচুর প্রমাণ। লীলাবতী ভারতের গৌরবও বটে, ভারতের কলঙ্কও বটে। কোহিনূর হীরক মুসলমান সম্রাটগণের গৌরব চিহ্নও বটে, কলঙ্কমণিও বটে। লীলাবতী নামোল্লেখে আমাদের একটি কথা মনে পড়িয়াছে, আমরা সেইটি এই স্থানে বলিয়া পাঠককে হাসিতে বা কাঁদিতে অনুরোধ করি না। এক দিন, দীনবন্ধু বাবুর লীলাবতী নাটকের কথা হইতেছিল। বাঙ্গালি, যিনি পিরান গায়ে দেন, তিনিই সমালোচক। একজন বিজ্ঞ সমালোচক একজন আগন্তুককে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “এই খনার স্ত্রী লীলাবতী বড় (Mathematician) ছিলেন; দীনবন্ধু বাবু তাঁরি বিষয়ে নাটক লিখেছেন। এই পাঁচটা মিষ্টি কথাবার্তা আর কি?” আমরা উপস্থিত ছিলাম; হাসি কাঁদি নাই। তাহাতেই কাহাকেও হাসিতে বা কাঁদিতে বলি না। হা দীনবন্ধো! ভাস্করাচার্য! লীলাবতী! নাটক! কাব্য! সত্য! সমালোচনা! তোমাদের এই দশা হইল! কলঙ্কিনী লীলাবতী যদি না থাকিত, তাহা হইলে আমাদিগকে কখনই লজ্জাকর সমালোচন শুনিতে হইত না।
আয়ুর্বেদ, রসায়ন, উদ্ভিদ্‌তত্ত্ব। এগুলি মনুষ্যের কেবল শরীরধারণ পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয় ও প্রাচীন ভারতে এগুলির বিশেষ সমাদর ছিল। অনুষ্ঠাতা বাবু মহেন্দ্রলাল সরকারের সাময়িক আয়ুর্বেদ পত্রে তাহার প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্য প্রমাণ অনুসন্ধানের প্রয়োজন কি, এত যে অধঃপাতে গিয়াছে—ইয়ুরোপীয় অতি পারদর্শী চিকিৎসকেরা পুরাতন রোগ চিকিৎসায় বৈদ্যদিগের সমকক্ষ হইতে পারিতেছেন না। তৈল চিকিৎসা যে অতি আশ্চর্য পদ্ধতি, তাহাও স্বীকার করিতে হয়। সামান্য বণিকবিপণিতে এক পাত অষ্টাদশ মূল পাচনে দেখিবেন, কত বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন প্রদেশের মূল একত্রিত থাকে। কোন বিশেষ রোগের প্রতীকার জন্য সেইগুলি একত্রিত করিতে প্রাচীন পণ্ডিতগণের কত অধ্যবসায় এবং কত সময় লাগিয়াছে। কিন্তু যেরূপ তাড়িত গতিতে সমস্ত লোপ পাইতেছে, বোধ হয়, এইরূপে চলিলে পরে আর কিছুদিন কপিরাজ ও কবিরাজ শব্দে কেবল বর্ণগতও নয়, অর্থগতও অনেক সাদৃশ্য হইবে।
সঙ্গীত। সঙ্গীতের ক্রিয়াসিদ্ধের উৎকর্ষ দেখিয়া ও সূক্ষ্মরূপে আলোচনা করিয়া আমাদের বিশ্বাস যে, ভারতবর্ষে মুসলমানদিগের সময়ে অতি উন্নত সঙ্গীতবিজ্ঞান ছিল। সোমশ্বর, কাণামাঘ, হনূমত প্রভৃতি মতভেদ দেখিলে বিজ্ঞানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ হয় বটে, কিন্তু শ্রীরাগে ও ভৈরবে কেহই সাদৃশ্য স্থাপন করেন নাই। করেন নাই কেন? বিজ্ঞান তৎসমুদায়কে পৃথক করিয়া দিয়াছিল, বিজ্ঞানবাক্য অলঙ্ঘনীয়। বৈজ্ঞানিক ভিন্ন এই প্রশ্নের কেহই উত্তর দিতে পারেন না। আধুনিক সঙ্গীত শাস্ত্রজ্ঞানাভিমানিদিগের মধ্যে আমরা অনেককে জিজ্ঞাসা করিয়াছি যে কেন এগুলিকে বিশুদ্ধ ও অন্যগুলিকে জঙ্গলা বলেন? যাঁহারা সূক্ষ্ম জ্ঞানী তাঁহাদের উত্তরের তাৎপর্য এই যে, এরূপ ভেদনির্দেশ আপ্তোদেশমূলক মাত্র। ইহা বৈজ্ঞানিকের উত্তর নহে। বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞান ভিন্ন কাহাকেও ওস্তাদ স্বীকার করেন না। মাননীয় ওস্তাদের দোহাই দেখিয়া অত্যন্ত আক্ষেপের সহিত স্বীকার করিতে হইতেছে যে পূর্বতন অতি উন্নত সেই বিচিত্র সঙ্গীতবিজ্ঞান একেবারে লুপ্ত হইয়াছে।
আত্মতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান। বেদান্তের সূক্ষ্ম গূঢ় ঈশ্বরতত্ত্ব (Theology) ও মায়াবাদমূলক অপূর্ব সংসারতত্ত্ব (Sensational Cosmology), কাপিল সাংখ্যের বেদান্তবিরোধী প্রকৃতিবাদ (Materialism), অক্ষপাদ গোতমের আণ্বীক্ষিকী দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্র (Inductive Philosophy and Logic) এবং কণাদের পদার্থ-বিচার (Categorical analysis) এগুলি এক এক বিষয়ের চূড়ান্ত সীমা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। প্রতিনিধি ডাইরেক্‌টর উড্রো সাহেব নবদীপস্থ ন্যায়-শিষ্যগণের বিতণ্ডাস্মরণ করিয়া লিখিয়াছেন, “আহা, এই বিচারশক্তি কেবল ব্যাপ্তি অব্যাপ্তি অন্যান্যভাব বিতণ্ডার পরিচারিকা না হইয়া যেদিন বস্তুবিচারের সহধর্মিণী হইবে সেদিন কি শুভ দিন হইবে!” যে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আশীর্বাদ করিতেছেন, তাঁহাকে কে না নমস্কার করিবে? বিশেষতঃ উড্রো সাহেবকে বাঙ্গালির শুভানুধ্যায়ী বলিয়া সকলেই জানিতেন। আমরা তাঁহাকে নমস্কার করি।
এতদ্ভিন্ন আরো কত বিজ্ঞান ছিল, এখন লোপ পাইয়াছে। সামান্য ভূতের ওঝারা যে এক স্থানে শব্দ করিয়া, সেই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন স্থানাগত শব্দের ন্যায় অনুভূত করাইতে পারে, একথা প্রায় সকলেই জানেন। কতক দূর শব্দবিজ্ঞান (Acoustics) জ্ঞান ব্যতীত এই শব্দানুকরণ বিদ্যার (Ventrilocution) আলোচনা অত্যন্ত দুরূহ বলিয়া বোধ হয়। হয়ত শব্দবিজ্ঞানের কোন স্থূল সত্য উদ্ভাবিত হইয়া থাকিবে। কিন্তু এসকল ছিল, চর্চা ছিল, মহা মহা পণ্ডিত সকল ছিলেন, এখন কি? এখন আক্ষেপের বিষয় এই যে আমাদের আলস্য দোষে, পারতন্ত্র্য দোষে, নানা দোষে, অনেকগুলিরই “প্রায় লোপ হইয়াছে, নামমাত্র অবশিষ্ট আছে।” জিজ্ঞাসা করি, আর কত কাল এভাবে যাইবে?
৩। পূর্বেই বলা হইয়াছে, বিজ্ঞান অবহেলা জন্য আমরা দিন ২ বিদেশীয় জাতিগণের আয়ত্তাধীন হইতেছি; বস্তুবিচারে অক্ষম হইয়া কদন্ন ভোজনে, অপেয় পানে, অপরিশুদ্ধ বায়ু সেবনে দিন দিন দুর্বল হইতেছি। চিকিৎসাশাস্ত্রে নিতান্ত অজ্ঞ হওয়ায় বৈদেশিক প্রথাগত চিকিৎসকগণের হস্তে পতিত হইয়া সর্বদাই জ্বর জ্বালায় কাতর থাকিতে হয়। বিজ্ঞানের ক্রমেই লোপ সম্ভাবনা। “সুতরাং এক্ষণে ভারতবর্ষীয়দের পক্ষে বিজ্ঞানশাস্ত্রের অনুশীলন করা নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে। ও তন্নিমিত্ত ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা নামে একটি সভা কলিকাতায় স্থাপন করিবার প্রস্তাব হইয়াছে। এই সভা প্রধান সভারূপে গণ্য হইবে এবং আবশ্যক মতে ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ইহার শাখা-সভা স্থাপিত হইবে।” আমরা এই প্রস্তাবের কায়মনোবাক্যে অনুমোদন করিতেছি। অনুষ্ঠাতার মঙ্গল হউক, অনুষ্ঠান সফল হউক।
৪। “ভারতবর্ষীয়দিগকে আহ্বান করিয়া বিজ্ঞান অনুশীলন বিষয়ে প্রোৎসাহিত ও সক্ষম করা এই সভার প্রধান উদ্দেশ্য।” উদ্দেশ্য অতি মহৎ, তার আর সন্দেহ কি? “আর ভারতবর্ষ সম্পর্কীয় যে সকল বিষয় লুপ্তপ্রায় হইয়াছে” বা হইতেছে “তাহা রক্ষা করা” (যথা মনোরম ও জ্ঞানদায়ক প্রাচীন গ্রন্থ সকল মুদ্রিত ও প্রচারিত করা ইত্যাদি) সভার আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য।” কেবল পুস্তক মুদ্রণ ব্যতীত লুপ্তপ্রায় বিষয়ের অন্যবিধ রক্ষা করা আবশ্যক বোধে আমরা অনুষ্ঠানপত্রের অর্থাৎ শব্দের স্থানে যথা ও পরে ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করিলাম। উদাহরণ দেওয়া যাইতেছে ; যেমন বারাণসীস্থ মানমন্দিরের বৈজ্ঞানিক সংস্কার অথবা প্রাচীন যন্ত্র সকল বা যন্ত্রখণ্ড সকল সংগ্রহ করা, প্রাচীন মুদ্রা, দানফলক বা আদেশফলক সকল সংগ্রহ করা, লুপ্ত বিষয়ের রক্ষার জন্য এগুলি সকলই আবশ্যক। কিন্তু এতদ্ভিন্ন আরো অনেকগুলি আনুষঙ্গিক উদ্দেশ্য হইতে পারে, ও হওয়া উচিতও বোধ হইতেছে। ভারতবর্ষীয়দিগকে বিজ্ঞানে যত্নশীল করিতে হইবে, ও তাঁহারা যত্ন করিতেছেন কি না, তাহা সর্বদা দেখিতে হইবে। আর (কথাটা বলিতে কিন্তু লজ্জা হয়) তাঁহারা বিজ্ঞানে যত্ন করিয়া কিছু আর্থিক উপকার পাইতেছেন কি না তাহাও দেখিতে হইবে। সে বিষয়ে আমাদিগের যাহা বক্তব্য সমাজ স্থাপিত হইলে বলিব।
৫। এই সমুদায় কার্য সম্পন্ন করিতে হইলে অর্থই প্রধান আবশ্যক, অতএব ভারতবর্ষের শুভানুধ্যায়ী, ও উন্নতীচ্ছু জনগণের নিকট বিনীতভাবে প্রার্থনা যে, “তাঁহারা আপন আপন ধনের কিয়দংশ অর্পণ করিয়া উপস্থিত বিষয়ের উন্নিতসাধন করেন।”
৬। অনুষ্ঠাতা মহেন্দ্র বাবু চাঁদা বা স্বাক্ষরদিগের নাম সাদরে গ্রহণ করিতেছেন।
এই অনুষ্ঠানপত্র আজ আড়াই বৎসর হইল প্রচারিত হইয়াছে, এই আড়াই বৎসরে বঙ্গসমাজ ৪০ চল্লিশ সহস্র টাকা স্বাক্ষর করিয়াছেন। মহেন্দ্র বাবু লিখিয়াছেন যে, এই তালিকাখানি একটি আশ্চর্য দলিল। ইহাতে যেমন কতকগুলি নাম থাকাতে স্পষ্টীকৃত হইয়াছে, তেমনি কতকগুলি নাম না থাকাতে উজ্জ্বলীকৃত হইয়াছে। তিনি আর কিছু বলিতে ইচ্ছা করেন না।
আমরা উপসংহারে আর গোটা দুই কথা বলিতে ইচ্ছা করি। বঙ্গধনীগণ, আপনারা মহেন্দ্র বাবুর ঈষৎ বক্রোক্তি অবশ্যই বুঝিয়া থাকিবেন। তবে আর কলঙ্কভার শিরে কেন বহন করেন? সকলেই অগ্রসর হউন। যিনি এক দিনে লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করেন, তিনি কেন পশ্চাতে পড়েন? পুত্রকন্যার বিবাহে যাঁহারা লক্ষ লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করেন, তাঁরা কেন নিশ্চিন্ত বসিয়া থাকেন। উড্রো সাহেব ভয়ানক বিজ্ঞানগুণ-অস্বীকারদোষ বঙ্গসমাজ-মস্তকে আরোপ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। একবার মুক্ত হস্তে দান করিয়া সমাজ স্থাপন করিয়া স্বীয় ভ্রম দূর করুন। বঙ্গীয় যুবকগণের অবস্থার উন্নতি সাধন করুন; বঙ্গের শিল্পবিদ্যার পুনরুদ্ধার করুন। মহাত্মা উড্রো সাহেবকে বলি, তিনি কাম্বেল সাহেবকে চিঠিতে যা বলিয়াছেন, তাহার কথায় আমাদের কাজ নাই, তিনি কেন একবার স্বজাতীয়গণকে এই মঙ্গলকর কার্যের সাহায্য করিতে বলুন না। যদি তালিকাতে একটিও শ্বেতাঙ্গের নাম না প্রকাশিত হয়, তাহা হইলে কত আক্ষেপের বিষয় হইবে।
—‘বঙ্গদর্শন’, ভাদ্র ১২৭৯

Leave a Reply