» » » অমুসলিমদের সচরাচর জিজ্ঞাসার জবাব

বর্ণাকার

চার. ইসলাম কি তরবারির জোরে বিস্তার লাভ করেছিল?

প্রশ্ন:

ইসলামকে কিভাবে শান্তির ধর্ম বলা যায় যখন তা তরবারির জোরে বিস্তৃতি লাভ করেছে?

উত্তর:

অমুসলিমদের মধ্যে কারও কারও একটি সাধারণ অভিযোগ আছে যে ইসলাম যদি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়ত তবে সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ অনুসারী থাকত না। নিম্নলিখিত বিষয়গুলি স্পষ্ট করবে যে, শুধু তরবারির জোরেই নয়, ইসলামের দ্রুত প্রসারের জন্য দায়ী ছিল সত্য, ন্যায়সঙ্গত আচরণ ও যুক্তির অন্তর্নিহিত শক্তি।

১. ইসলাম অর্থ শান্তি

ইসলাম শব্দটি এসেছে ‘সাল্‌ম’ বা ‘সালাম’ শব্দমূল থেকে যার অর্থ শান্তি। এটিও এসেছে ‘সিল্‌ম’ শব্দমূল থেকে যার অর্থ আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা)-র নিকট নিজের ইচ্ছাকে সোপর্দ করা। সুতরাং ইসলাম হল শান্তির ধর্ম, যা পরম স্রষ্ট্রা আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা)-র ইচ্ছার নিকট নিজের ইচ্ছাকে সোপর্দ করে অর্জিত হয়।

২. কখনও কখনও শান্তির জন্য শক্তির প্রয়োগ করতে হয়

বিশ্বচরাচরের প্রতিটি মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার পক্ষে নয়। অনেকে আছেন, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এটিকে ব্যবহার করে। কখনও কখনও শান্তি বজায় রাখতে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। ঠিক এই কারণেই আমাদের পুলিশ আছে যারা দেশে শান্তি বজায় রাখতে অপরাধী ও অসামাজিকদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে। ইসলাম শান্তি প্রচার করে। একই সাথে ইসলাম তার অনুসারীদের যেখানে নিপীড়ন সেখানে লড়াই করার উপদেশ দেয়। নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শক্তির প্রয়োজন হতে পারে। ইসলামে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই বল প্রয়োগ করা যেতে পারে।

৩. ইতিহাসবিদ ডি লেসি ও’লিয়ারির অভিমত

ইসলাম তরবারির মাধ্যমে ছড়িয়েছে, এই ভুল ধারণার সর্বোত্তম উত্তর দিয়েছেন প্রখ্যাত ঐতিহাসবিদ ডি ল্যাসি ও’লিয়ারি “ইসলাম অ্যাট দ্য ক্রসরোডস” বইয়ে (পৃষ্ঠা ৮):

“History makes it clear however, that the legend of fanatical Muslims sweeping through the world and forcing Islam at the point of the sword upon conquered races is one of the most fantastically absurd myths that historians have ever repeated.”

৪. মুসলমানেরা ৮০০ বছর স্পেন শাসন করেছিল

মুসলমানেরা প্রায় ৮০০ বছর স্পেন শাসন করেছিল। মুসলমানেরা কখনো অধিবাসীদের ধর্মান্তরের জন্য তলোয়ার ব্যবহার করেনি। পরবর্তীতে খৃষ্টান ক্রুসেডারেরা স্পেনে আসে এবং মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়। প্রকাশ্যে সালাতের আযান দেওয়ার জন্য একজন মুসলিমও স্পেনে অবশিষ্ট ছিল না।

৫. ৯ মিলিয়ন আরব কপটিক খৃষ্টান

মুসলমানরা চৌদ্দশত বছর ধরে আরবের প্রভু ছিল। কয়েক বছর ব্রিটিশরা শাসন করেছে, আর কয়েক বছর ফরাসিরা শাসন করেছে। সামগ্রিকভাবে, মুসলমানরা চৌদ্দশত বছর ধরে আরব শাসন করেছে। তবুও আজ, নয় মিলিয়ন আরব রয়েছে যারা কপ্টিক খ্রিস্টান অর্থাৎ প্রজন্ম থেকে খ্রিস্টান। মুসলমানরা যদি তরবারি ব্যবহার করত তাহলে একজন আরবও থাকত না যে খ্রিস্টান থাকত।

৬. ভারতে ৮০ শতাংশের বেশি অমুসলিম

প্রায় হাজার বছর মুসলমানেরা ভারত শাসন করেছে। যদি তারা চাইত, ভারতের প্রত্যেক অমুসলমানকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ক্ষমতা তাদের ছিল। বর্তমানে ভারতের আশি শতাংশ মানুষ অমুসলিম। সেই সকল অমুসলমানেরা সাক্ষ্য বহন করছে যে ইসলাম তলোয়ারের জোরে প্রচারিত হয়নি।

৭. ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া

ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক মুসলমানের দেশ। মালয়েশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ট মানুষও মুসলমান। কেউ কি বলতে পারবে, “কোন মুসলিম সেনাবাহিনী ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় গিয়েছিল?”

৮. আফ্রিকার পূর্ব উপকূল

একই ভাবে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। যদি তলোয়ারের জোরে ইসলাম প্রচারিত হয়ে থাকে, কেউ কি বলতে পারবে, “কোন মুসলিম বাহিনী আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে গিয়েছিল?”

৯. টমাস কার্লাইল

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ টমাস কার্লাইল তাঁর “Heroes and Hero worship” গ্রন্থে তরবারির মাধ্যমে ইসলামের ছড়িয়ে পড়ার এই ভ্রান্ত ধারণার কথা উল্লেখ করেছেন: “The sword indeed, but where will you get your sword? Every new opinion, at its starting is precisely in a minority of one. In one man’s head alone. There it dwells as yet. One man alone of the whole world believes it, there is one man against all men. That he takes a sword and tries to propagate with that, will do little for him. You must get your sword! On the whole, a thing will propagate itself as it can.”

১০. ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই

কোন তরবারি দ্বারা ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল? মুসলমানদের কাছে থাকলেও তারা ইসলাম প্রচারের জন্য তরবারির ব্যবহার করতে পারে না, কেননা, কুরআন নিম্নের আয়াতে বলে—

لَآ إِكْرَاهَ فِى ٱلدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ ٱلرُّشْدُ مِنَ ٱلْغَىِّ ۚ فَمَن يَكْفُرْ بِٱلطَّـٰغُوتِ وَيُؤْمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسْتَمْسَكَ بِٱلْعُرْوَةِ ٱلْوُثْقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَا ۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ٢٥٦

“দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ সুস্পষ্ট হয়েছে ভ্রান্ত থেকে। অতএব, যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর উপর ঈমান আনবে সে এমন এক দৃঢ়তর রজ্জু ধারণ করল যা কখনো ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।”  —সূরাতুল বাকারাহ, আয়াত ২৫৬।

১১. প্রজ্ঞার তলোয়ার

এটি প্রজ্ঞার তলোয়ার, যে তলোয়ার মানুষের হৃদয় ও মন জয় করে। সূরাহ আল-নাহল, ষোড়শ অধ্যায়, আয়াত ১২৫-এ কুরআন বলে—

ٱدْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلْحِكْمَةِ وَٱلْمَوْعِظَةِ ٱلْحَسَنَةِ ۖ وَجَـٰدِلْهُم بِٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ ۚ … ١٢٥

“জ্ঞান-বুদ্ধি আর উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আপনি (মানুষকে) আপনার প্রতিপালকের পথে আহবান জানান আর লোকেদের সাথে বিতর্ক করুন অত্যুৎত্তম পন্থায়।”

১২. ১৯৩৪ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত বিশ্ব ধর্মের বৃদ্ধি

রিডার্স ডাইজেস্ট ‘অ্যালমানাক’, ১৯৮৪ বার্ষিক সংখ্যার এক নিবন্ধে ১৯৩৪ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত অর্থ শতাব্দীতে বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলোর শতকরা বৃদ্ধির পরিংখ্যান প্রকাশিত হয়েছিল। এই নিবন্ধটি ‘দ্য প্লেইন ট্রুথ’ ম্যাগাজিনেও প্রকাশিত হয়েছিল। বৃদ্ধির শীর্ষে ছিল ইসলাম, যার বৃদ্ধির হার ২৩৫ শতাংশ এবং খৃষ্টান ধর্মের বৃদ্ধির হার ছিল ৪৭ শতাংশ। কেউ কি বলতে পারবেন, বিংশ শতাব্দীতে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্যা করেছিল?

১৩. আমেরিকা ও ইউরোপে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম ইসলাম

বর্তমানে আমেরিকার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। ইউরোপেও সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম ইসলাম। কোন তরবারি পাশ্চাত্যের মানুষকে এত বেশি সংখ্যায় ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করছে? আজ মিডিয়া ইসলামকে আক্রমণ করছে এই বরে যে, এটা নারীদের পরাধীন করে। আপনি জানেন কি, আমেরিকা ও ইউরোপের ইসলাম গ্রহণকারীদের দুই তৃতীয়াংশই নারী। ইসলাম যদি নারীদের অবরোধবাসিনী করে রাখত, তাহলে কেন আমেরিকা ও ইউরোপের নারীরা ইসলাম গ্রহণ করছে? কে তাদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করছে?

১৪. ডা. যোসেফ অ্যাডাম পিয়ারসন

ডা. যোসেফ অ্যাডাম পিয়ারসন যথার্থই বলেছেন, “People who worry that nuclear weaponry will one day fall in the hands of the Arabs, fail to realize that the Islamic bomb (the bomb of Peace) has been dropped already, it fell the day MUHAMMAD (pbuh) was born.”

“যারা চিন্তিত যে পারমানবিক অস্ত্র একদিন আরবদের হাতে পড়বে, তারা বুঝতে পারে না যে ইসলামী বোমা (শান্তির বোমা) ইতিমধ্যেই নিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, যেদিন মুহম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন।”