এক. জিহাদ
প্রশ্ন: ইসলাম কেন মুসলিমদেরকে ‘জিহাদে’র নামে অন্যকে হত্যা করার অনুমতি প্রদান করে?
জবাব:
১. সবচেয়ে ভুল বোঝানো শব্দ — ‘জিহাদ’
একেবারে শুরুতে, ইসলাম সম্পর্কে এক নম্বর ভুল ধারণা, তালিকার শীর্ষে রয়েছে জিহাদ। বর্তমানে জিহাদ ইসলাম সম্পর্কে সবচেয়ে ভুল বোঝানো শব্দ। এই ভুল বোঝাবুঝি শুধু অমুসলিমদের মধ্যেই নয়, আমাদের অনেক মুসলমানেরও মাঝেও রয়েছে। অমুসলিম এবং অনেক মুসলমানও মনে করেন যে, জিহাদ মানে যে কোন মুসলমান দ্বারা যে কোন কারণে সংঘটিত যে কোন যুদ্ধ; তা ক্ষমতার জন্যই হোক, সম্পদের জন্যই হোক, দেশের জন্যই হোক, ভাষার জন্যই হোক, ইত্যাদি যে কোন যুদ্ধ। যেকোনো কারণে যে কোনো মুসলমানকে জিহাদ বলা হয়। যেকোন মুসলমান, যেকোন কারণে যুদ্ধ করলেই বলে ‘জিহাদ’। ‘জিহাদ’ মানে যেকোন মুসলমান দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধ নয়, তা হোক অর্থের জন্য, হোক ক্ষমতার জন্য, হোক দেশের জন্য, হোক ভাষার জন্য।
২. জিহাদের অর্থ
‘জিহাদ’ একটি আরবি শব্দ যা ‘জাহাদা’ শব্দ থেকে এসেছে; এর অর্থ রুখে দাঁড়ানো, যার অর্থ প্রতিকূল অবস্থার সাথে কঠোর লড়াই করা। তাই জিহাদ মূলত রুখে দাঁড়ানো ও প্রচেষ্টাকে বোঝায়। ইসলামী পরিভাষায়,
জিহাদ মানে নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ও সফল না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা করা।
জিহাদের অর্থ সমাজকে উন্নত করার জন্য বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ও সফল না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা করা।
জিহাদের অর্থ অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করাও।
জিহাদের অর্থ যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করাও।
তাই জিহাদ মূলত রুখে দাঁড়ানো ও প্রচেষ্টাকে বোঝায়। উদাহরণ স্বরূপ যদি কোন ছাত্র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য মনস্থির করে ও কঠোর প্রচেষ্টা চালায়, আরবীতে আমরা বলি ছাত্রটি জিহাদ করছে। তিনি চেষ্টা করছেন এবং বারবার চেষ্টা করছেন।
৩. জিহাদ অমুসলিমরাও করতে পারে
অনেকের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে এবং তারা মনে করে যে জিহাদ শুধুমাত্র একজন মুসলমানই করতে পারে। কোরআনে অনধিক দুটি আয়াত রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে এমনকি অমুসলিমরাও জিহাদ করে।
৪. কৌরাণিক উদ্ধৃতি
ক. সূরাহ লোকমান, একত্রিশ অধ্যায়, আয়াত ১৪—
وَوَصَّيْنَا ٱلْإِنسَـٰنَ بِوَٰلِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُۥ وَهْنًا عَلَىٰ وَهْنٍۢ وَفِصَـٰلُهُۥ فِى عَامَيْنِ أَنِ ٱشْكُرْ لِى وَلِوَٰلِدَيْكَ إِلَىَّ ٱلْمَصِيرُ ١٤
“আর আমরা মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভ ধারণ করে, আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। কাজেই আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। ফিরে আসা তো আমারই কাছে।”
পিতামাতার, বিশেষ করে মায়ের প্রশংসা করার অব্যবহিত পরে, আয়াতটি চলতে থাকে…
খ. সূরাহ লোকমান, একত্রিশ অধ্যায়, আয়াত ১৫, যাতে বলা হয়েছে—
وَإِن جَـٰهَدَاكَ عَلَىٰٓ أَن تُشْرِكَ بِى مَا لَيْسَ لَكَ بِهِۦ عِلْمٌۭ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِى ٱلدُّنْيَا مَعْرُوفًۭا ۖ … ١٥
“আর তোমার পিতামাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি (জিহাদ) করে আমার অংশীদার স্থির করার জন্য যার জ্ঞান তোমার নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। কিন্তু পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে। যে আমার অভিমুখী হয় তার পথ অনুসরণ করবে।…”
এখানে কুরআন অমুসলিম মাতা-পিতার কথা বলছে, তারা জিহাদ করছে, তারা তাদের সন্তানকে শির্ক করার জন্য, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) পরিবর্তে অন্য উপাস্যের ইবাদত করার জন্য পীড়াপীড়ি ও চাপাচাপি করছে।
গ. একই বার্তা প্রদান করা হয়েছে সুরাহ আনকাবুতে, ঊনত্রিশ অধ্যায়, আয়াত ৮, যা হচ্ছে—
وَوَصَّيْنَا ٱلْإِنسَـٰنَ بِوَٰلِدَيْهِ حُسْنًۭا ۖ وَإِن جَـٰهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِى مَا لَيْسَ لَكَ بِهِۦ عِلْمٌۭ فَلَا تُطِعْهُمَآ ۚ إِلَىَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ ٨
“আর আমরা মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তবে তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ (জিহাদ) করে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদেরকে মেনো না। আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসা। অতঃপর তোমরা কি করেছিলে তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব।”
অতএব, কুরআন অমুসলিম মাতা-পিতার জিহাদ করার আলোচনা করছে।
৫. শয়তানের পথে জিহাদ ও আল্লাহ পথে জিহাদ
কুরআনে অমুসলিমদের জিহাদ করার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে ‘জিহাদ ফি সাবিলিশ শয়তান’, শয়তানের পথে জিহাদের উদাহরণ। আমাদের মুসলমানদের যা করা উচিত তা হল ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’, আল্লাহর পথে জিহাদ। আর যখনই ‘জিহাদ’ শব্দটি পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়, তখনই ইসলামী প্রেক্ষাপটে বোঝা যায় ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’।
৬. জিহাদ পবিত্র যুদ্ধ নয়
অনেক তথাকথিত ‘মুসলিম আলীম’সহ বেশিরভাগ অমুসলিম জিহাদকে ‘পবিত্র যুদ্ধ’ হিসাবে অনুবাদ করে। আপনি যদি ‘পবিত্র যুদ্ধ’ আরবীতে অনুবাদ করেন তবে এর অর্থ ‘হারবুম মুকাদ্দাসাহ’। আপনি যদি কুরআন বা হাদিস পড়েন, সেখানে একটিও কুরআনের আয়াত বা হাদিস নেই, যেখানে ‘হারবুম মুকাদ্দাসাহ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘পবিত্র যুদ্ধ’ শব্দটি কুরআনেও নেই, হাদিসেও নেই।
৭. কিতাল
আমি উল্লেখ করেছি জিহাদ মূলত চেষ্টা ও প্রচেষ্টা। এক প্রকার জিহাদ হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রাস্তায় জিহাদ, তা হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রাস্তায় কিতাল। কিন্তু জিহাদ মানেই মূলত যুদ্ধ নয়। জিহাদের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে যেমন জিহাদ বিন নাফস— আমাদের নিজেদের খারাপ প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং প্রচেষ্টা করা, এছাড়াও এক প্রকার জিহাদ হল আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তায়ালার) পথে আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করা।
৮. ‘জিহাদ’ শব্দটি মক্কায় একাধিকবার নাযিল হয়েছে, কিন্তু মক্কায় যুদ্ধ হয়নি
আমরা যদি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন দেখি, তাঁর নবুওয়াতের প্রথম তেরো বছর যে তিনি মক্কায় বসবাস করেছিলেন, কুরআনের অনেকগুলো আয়াত মক্কায় নাযিল হয়েছিল এবং এই আয়াতগুলিতে বহুবার ‘জিহাদ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল এবং মুসলমানেরা কখনো শারীরিকভাবে যুদ্ধ করেনি। তারা মদীনায় হিজরত করার পরেই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু তারপরও আপনি মক্কায় অবতীর্ণ কুরআনের কয়েকটি আয়াতে ‘জিহাদ’ শব্দটি খুঁজে পাবেন।
৯. কুরআনের উদ্ধৃতি
উদাহরণত, কোরানে বলা হয়েছে,
ক. সূরা আল আনকাবুত, ঊনত্রিশ অধ্যায়, আয়াত ৬৯, যাতে আছে—
وَٱلَّذِينَ جَـٰهَدُوا۟ فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلْمُحْسِنِينَ ٦٩
“আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় (জিহাদ করে) তাদেরকে আমি অবশ্য অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন।”
যখন এই আয়াত নাযিল হয় তখন কোন যুদ্ধ ছিল না।
খ. কুরআনের সুরাহ ফোরকান, পঁচিশ অধ্যায়, আয়াত ৫২-তে বর্ণিত হয়েছে যে—
فَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَجَـٰهِدْهُم بِهِۦ جِهَادًۭا كَبِيرًۭا ٥٢
“কাজেই আপনি কাফিরদের আনুগত্য করবেন না: আর কুরআনের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন— কঠোর জিহাদ।”
তার মানে আপনি কুরআন দ্বারা জিহাদ করুন। কুরআন দ্বারা জিহাদের অর্থ আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তায়ালার) বাণী পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা। আপনি কি মনে করেন আপনি কুরআনের দ্বারা যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন?
১০. যেকোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা ইসলামে হারাম
যেকোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ প্রমাণ করার জন্য কুরআনের একটি আয়াতই যথেষ্ট। আয়াতটি মহিমান্বিত কুরআন বর্ণিত হয়েছে—সূরা আল মায়েদাহ, পঞ্চম অধ্যায়, আয়াত ৩২; আল্লাহ বলেন,—
“…যদি কেউ কোন মানুষকে হত্যা করে,— যদি সে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা যমীনে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ না হয়— তবে সে যেন তামাম মানুষকেই হত্যা করল। আর যে মানুষের প্রাণ বাঁচালো, সে যেন তামাম মানুষকে বাঁচালো…”
আপনি যদি অন্যান্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলি পড়েন তবে আপনি কুরআনের উল্লেখিত আয়াতের অনুরূপ বা কাছাকাছি কোন আয়াত পাবেন না, যেখানে বলা হয়েছে, “আপনি যদি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেন তবে আপনি সমগ্র মানবতাকে হত্যা করেছেন এবং আপনি যদি একজন মানুষকে বাঁচান তাহলে যেন আপনি সমগ্র মানবতাকে বাঁচিয়েছেন।”
১১. আরও বিস্তারিত জানতে ড. জাকির নায়েকের ‘সন্ত্রাস ও জিহাদ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ’ বিষয়ক বই বা বক্তৃতাটি পড়ুন।
১৩. মিডিয়া বিদ্বেষ ছড়ায়, মগজ ধোলাই করে এবং মানব মন প্রভাবিত করে
‘জিহাদ’ শব্দটি নিয়ে ভুল ধারণা তৈরি করেছে মিডিয়া। এই ‘জিহাদ’ শব্দটি কয়েক দশক আগেও কোনো সমস্যা ছিল না। ৯/১১ এরপর এটি তালিকার শীর্ষে উঠে আসে, একেবারে এক নম্বরে। আগে এটা ছিল না। তাই মিডিয়া কিভাবে ইসলামকে চিত্রিত করে তার উপর নির্ভর করে, অমুসলিমদের মনে এই ভুল ধারণাগুলি তৈরি হয়।