- প্রথম পরিচ্ছেদ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
- সপ্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টম পরিচ্ছেদ
- নবম পরিচ্ছেদ
- দশম পরিচ্ছেদ
- একাদশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
- বিংশতিতম পরিচ্ছেদ
- একবিংশতিতম পরিচ্ছেদ
- দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদ
- ত্রয়োবিংশতিতম পরিচ্ছেদ
- চতুর্ব্বিংশতিতমথ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চবিংশতিতম পরিচ্ছেদ
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
- অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ
কৃষ্ণকান্তের উইল
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ঐ দিবস রাত্রি আটটার সময়ে কৃষ্ণকান্ত রায় আপন শয়নমন্দিরে পর্যঙ্কে বসিয়া উপাধানে পৃষ্ঠ রক্ষা করিয়া, সটকায় তামাক টানিতেছিলেন এবং সংসারে একমাত্র ঔষধ–মাদকমধ্যে শ্রেষ্ঠ–অহিফেন ওরফে আফিমের নেশায় মিঠে রকম ঝিমাইতেছিলেন। যেন হরলাল তিন টাকা তের আনা দু কড়া দু ক্রান্তি মূল্যে তাঁহার সমুদয় সম্পত্তি কিনিয়া লইয়াছে। আবার যেন কে বলিয়া দিল যে, না, এ দানপত্র নহে, এ তমসুক। তখনই যেন দেখলেন যে, ব্রহ্মার বেটা বিষ্ণু আসিয়া বৃষভারূঢ় মহাদেবের কাছে এক কৌটা আফিম কর্জ লইয়া, এই দলিল লিখিয়া দিয়া, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বন্ধক রাখিয়াছেন–মহাদেব গাঁজার ঝোঁকে ফোরক্লোজ করিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। এমত সময়ে, রোহিণী ধীরে ধীরে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “ঠাকুরদাদা কি ঘুমাইয়াছ?”
কৃষ্ণকান্ত ঝিমাইতে ঝিমাইতে কহিলেন, “কে নন্দী? ঠাকুরকে এই বেলা ফোরক্লোজ করিতে বল।”
রোহিণী বুঝিল যে, কৃষ্ণকান্তের আফিমের আমল হইয়াছে। হাসিয়া বলিল, “ঠাকুরদাদা, নন্দী কে?”
কৃষ্ণকান্ত ঘাড় না তুলিয়া বলিলেন, “হুম্ ঠিক বলেছ। বৃন্দাবনে গোয়ালাবাড়ী মাখন খেয়েছে–আজও তার কড়ি দেয় নাই।”
রোহিণী খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। তখন কৃষ্ণকান্তের চমক হইল, মাথা তুলিয়া দেখিয়া বলিলেন, “কে ও, অশ্বিনী ভরণী কৃত্তিকা রোহিণী?”
রোহিণী উত্তর করিল, “মৃগশিরা আর্দ্রা পুনর্বসু পুষ্যা।”
কৃষ্ণ। অশ্লেষা মঘা পূর্বফাল্গুনী।
রো। ঠাকুরদাদা, আমি কি তোমার কাছে জ্যোতিষ শিখতে এয়েছি!
কৃষ্ণ। তাই ত! তবে কি মনে করিয়া? আফিঙ্গ চাই না ত?
রো। যে সামগ্রী প্রাণ ধর্যে দিতে পারবে না, তার জন্যে কি আমি এসেছি! আমাকে কাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাই এসেছি।
কৃ। এই এই। তবে আফিঙ্গের জন্য!
রো। না, ঠাকুরদাদা না। তোমার দিব্য, আফিঙ্গ চাই না। কাকা বললেন যে, যে উইল আজ লেখাপড়া আছে, তাতে তোমার দস্তখত হয় নাই।
কৃ। সে কি! আমার বেশ মনে পড়িতেছে যে, আমি দস্তখত করিয়াছি।
রো। না, কাকা কহিলেন যে, তাঁহার যেন স্মরণ হচ্ছে, তুমি তাতে দস্তখত কর নাই; ভাল সন্দেহ রাখায় দরকার কি? তুমি কেন সেখানা খুলে একবার দেখ না।
কৃ। বটে–তবে আলোটা ধর দেখি।
বলিয়া কৃষ্ণকান্ত উঠিয়া উপাধানের নিম্ন হইতে চাবি লইলেন। রোহিণী নিকটস্থ দীপ হস্তে লইল। কৃষ্ণকান্ত প্রথমে একটি ক্ষুদ্র হাতবাক্স খুলিয়া একটি বিচিত্র চাবি লইয়া, পরে একটা চেষ্টড্রয়ারের একটি দেরাজ খুলিলেন এবং অনুসন্ধান করিয়া ঐ উইল বাহির করিলেন। পরে বাক্স হইতে চশমা বাহির করিয়া নাসিকার উপর সংস্থাপনের উদ্যোগ দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু চশমা লাগাইতে লাগাইতে দুই চারি বার আফিঙ্গের ঝিমকিনি আসিল–সুতরাং তাহাতে কিছুকাল বিলম্ব হইল। পরিশেষে চশমা সুস্থির হইলে কৃষ্ণকান্ত উইলে নেত্রপাত করিয়া দেখিয়া হাস্য করিয়া বলিলেন, “রোহিণিী আমি কি বুড় হইয়া বিহ্বল হইয়াছি? এই দেখ, আমার দস্তখত।
রোহিণী বলিল, “বালাই, বুড়ো হবে কেন? আমাদের কেবল জোর করিয়া নাতিনী বল বই ত না। তা ভাল, আমি এখন যাই, কাকাকে বলি গিয়া।”
রোহিণী তখন কৃষ্ণকান্তের শয়নমন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল।
গভীর নিশাতে কৃষ্ণকান্ত নিদ্রা যাইতেছিলেন, অকস্মাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইল। নিদ্রাভঙ্গ হইলে দেখিলেন যে, তাঁহার শয়নগৃহে দীপ জ্বলিতেছে না। সচরাচর সমস্ত রাত্রি দীপ জ্বলিত, কিন্তু সে রাত্রে দীপ নির্বণ হইয়াছে দেখিলেন, নিদ্রাভঙ্গকালে এমতও শব্দ তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল যে, যেন কে একটা চাবি কলে ফিরাইল। এমত বোধ হইল, যেন ঘরে কে মানুষ বেড়াইতেছে। মানুষ তাঁর পর্যঙ্কের শিরোদেশ পর্যন্ত আসিল–তাঁহার বালিশে হাত দিল। কৃষ্ণকান্ত আফিঙ্গের নেশায় বিভোর; না নিদ্রিত, না জাগরিত, বড় কিছু হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন না। ঘরে যে আলো নাই–তাহাও ঠিক বুঝেন নাই, কখন অর্ধনিদ্রিত–কখন অর্ধসচেতন–সচেতনও চক্ষু খুলে না। একবার দৈবাৎ চক্ষু খুলিবায় কতকটা অন্ধকার বোধ হইল বটে, কিন্তু কৃষ্ণকান্ত তখন মনে করিতেছিলেন যে, তিনি হরি ঘোষের মোকদ্দামায় জাল দলিল দাখিল করায়, জেলখানায় গিয়াছেন।জেলখানা ঘোরান্ধকার। কিছু পরে হঠাৎ যেন চাবি খোলার শব্দ অল্প কানে গেল–এ কি জেলের চাবি পড়িল? হঠাৎ একটু চমক হইল। কৃষ্ণকান্ত সটকা হাতড়াইলেন, পাইলেন না–অভ্যাসবশতঃ ডাকিলেন, “হরি!”
কৃষ্ণকান্ত অন্তঃপুরে শয়ন করিতেন না–বহির্বাটীতেও শয়ন করিতেন না। উভয়ের মধ্যে একটি ঘর ছিল। সেই ঘরে শয়ন করিতেন। সেখানে হরি নামক একজন খানসামা তাঁহার প্রহরী স্বরূপ শয়ন করিত। আর কেহ না। কৃষ্ণকান্ত তাহাকেই ডাকিলেন, “হরি!”
কৃষ্ণকান্ত বারেক মাত্র হরিকে ডাকিয়া, আবার আফিমে ভোর হইয়া ঝিমাইতে লাগিলেন। আসল উইল, তাঁহার গৃহ হইতে সেই অবসরে অন্তর্হিত হইল। জাল উইল তৎপরিবর্তে স্থাপিত হইল।