☼ হুমায়ূন আহমেদ ☼
হিমু সমগ্র
‘হিমু’ নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় চরিত্র। হিমু মূলত একজন বেকার যুবক; যার আচরণে বেখেয়ালী, জীবনযাপনে ছন্নছাড়া ও বৈষয়িক ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ভাব প্রকাশ পায়। চাকরির সুযোগ থাকলেও সে চাকরি কখনো করে না বলেই সে বেকার। তার অস্বাভাবিক চরিত্রের মধ্যে সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তাঘাটে দিন-রাত ঘুরে বেড়ায় এবং মাঝে মাঝে ভবিষ্যদ্বাণী করে মানুষকে চমকে দেয়।
‘হিমু’ ধারাবাহিকের প্রথম উপন্যাস ‘ময়ূরাক্ষী’ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে ঢাকার অন্যন্যা পাবলিকেশন থেকে। প্রাথমিক সাফল্যের পর হিমু চরিত্র বিচ্ছিন্নভাবে হুমায়ুন আহমেদের বিভিন্ন উপন্যাসে প্রকাশিত হতে থাকে। হিমু ও মিসির আলি হুমায়ুন আহমেদ সৃষ্ট সর্বাধিক জনপ্রিয় দু’টি চরিত্র। উদাসীন হিমু একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের বাঙালি তরুণদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
হিমুর প্রকৃত নাম হিমালয়। এ নামটি রেখেছিলেন তার বাবা যেন তার পুত্র হিমালয় পর্বতের ন্যায় মহত্ব প্রকাশ করে। হিমুর বাবা তাকে একজন মহাপুরুষ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি তার ছেলের এমন নাম রেখেছিলেন। পরবর্তীতে ছাত্রজীবনে এই নাম নিয়ে হিমুকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তার পিতামহ তার অন্য নাম রাখতে চেয়েছিলেন— চৌধুরী ইমতিয়াজ টুটুল। কিন্তু হিমু তার বাবার দেয়া নামই গ্রহণ করে। লেখক হিমুর বাবাকে বর্ণনা করেছেন একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ হিসেবে; যার বিশ্বাস ছিল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা যায় তবে একইভাবে মহাপুরুষও তৈরি করা সম্ভব। তিনি মহাপুরুষ তৈরির জন্য একটি বিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন যার একমাত্র ছাত্র ছিল তার সন্তান হিমু। হিমুর পোশাক হল পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী। হলুদ বৈরাগের রঙ বলেই পোশাকের রং হলুদ নির্বাচিত করা হয়েছিল। ঢাকা শহরের পথে-পথে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম। উপন্যাসে প্রায়ই তার মধ্যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায়। যদিও হিমু নিজে তার কোন আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা স্বীকার করে না। হিমুর আচার-আচরণ বিভ্রান্তিকর। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার প্রতিক্রিয়া অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করে, এবং এই বিভ্রান্ত সৃষ্টি করা হিমুর অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ। প্রেম ভালবাসা উপেক্ষা করা হিমুর ধর্মের মধ্যে পড়ে। কোন উপন্যাসেই কোন মায়া তাকে কাবু করতে পারে নি। মায়াজালে আটকা পড়তে গেলেই সে উধাও হয়ে যায়।
হিমু উপন্যাসে সাধারণত হিমুর কিছু ভক্তশ্রেণীর মানুষ থাকে যারা হিমুকে মহাপুরুষ মনে করে। এদের মধ্যে হিমুর ফুপাতো ভাই বাদল অন্যতম। মেস ম্যানেজার বা হোটেল মালিক- এরকম আরও কিছু ভক্ত চরিত্র প্রায় সব উপন্যাসেই দেখা যায়। এছাড়াও কিছু বইয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ও খুনি ব্যক্তিদের সাথেও তার সু-সম্পর্ক ঘটতে দেখা যায়। হিমুর একজন বান্ধবী রয়েছে, যার নাম রূপা; যাকে ঘিরে হিমুর প্রায় উপন্যাসে রহস্য আবর্তিত হয়। নিরপরাধী হওয়া সত্ত্বেও সন্দেহভাজন হওয়ায় হিমু অনেকবার হাজতবাস করেছে এবং বিভিন্ন থানার ওসি ও সেকেন্ড অফিসারের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে।
হিমু ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষানবিশ— উপন্যাসে এমনটিই বলা হয়েছে; পাশ করেছে কিনা তা উল্লেখ করা হয়নি। তবে তার সাধারণ জ্ঞান ভালো।
হিমুর বয়স ২৫-২৮ বছরের মধ্যে। তার পোশাক ও চাল-চলন কিছু কিছু মানুষের কাছে বিরক্তিকর। সে খুব একটা সুদর্শন না হলেও তার চোখ ও হাসি খুব সুন্দর বলা হয়েছে। সে সবসময় হলুদ রঙের পাঞ্জাবি (অধিকাংশ সময়ে যেটার পকেট থাকে না) পরে। বেশিরভাগ সময় সে খালিপায়ে চলাফেরা করে। শীতকালে সে রুপার দেওয়া কাশ্মীরি শাল ব্যবহার করে। তার চুল ও দাড়ি সবসময় বড়বড় রাখে। রাতের বেলায় রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে। তার খালাতো ভাই বাদল তার অন্ধভক্ত। যে তার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতি নিঃসন্দিহান এবং তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। হিমু মাঝে মাঝে ভবিষ্যতবাণী করে যা প্রায় সময়েই মিলে যায়। সে তার যুক্তি-বিরোধী মতানুসারে কাজ করে, এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করে দেয়। প্রায় সময়ই হিমুকে পরোপকার করতে দেখা যায় (যদিও তাতেও কিছু বিভ্রান্তি মিশ্রিত থাকে)।
হিমুর জীবন যাপন অদ্ভুত। তার জীবন বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া ধরনের। সে মেসে থাকে। মাঝে মাঝে রাস্তায় ও পার্কেও রাত কাটায়। তার প্রধান কাজ হেঁটে, খালি পায়ে রাস্তায় ঘুরে বেরানো। তার কোনো পেশা নেই। হিমুর বেশকিছু বিত্তবান আত্মীয় রয়েছে। হিমু প্রায়ই তার বিত্তবান আত্মীয়দের কাছ থেকে উপহার এবং অর্থসাহায্য পায়। তবে সে মানুষের কল্যাণের জন্য অনেক কাজ করেছে । তার জীবন যাপনে তাকে প্রায়ই আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে দেখা যায়।
হিমু স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সে প্রায়ই যুক্তি-বিরোধী মতানুসারে আচরণ করে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং তার এরকম অযৌক্তিক ব্যক্তিত্বের কারণে সে অনেক সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। তার লোভ, লালসা, ঈর্ষা, ভয় নেই। তার এরূপ আচরণ অনেক মানুষকে তাকে মহাপুরুষ ভাবতে প্রভাবিত করে। হিমু যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও রসবোধসম্পন্ন ব্যক্তি।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ‘হিমু সমগ্র’ প্রকাশিত হয়; প্রকাশক মনিরুল হক, অনন্যা, ৩৮/২ বাংলাবাজার ঢাকা। গ্রন্থস্বত্ব লেখকের। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছিলেন ধ্রুব এষ। ‘হিমু সমগ্রে’ সঙ্কলিত গ্রন্থসমূহের নাম হচ্ছে— ময়ূরাক্ষীদরজার ওপাশে ‘হিমু সমগ্রে’র উৎসর্গ পাতায় লেখা ছিল—
উৎসর্গ
এ-দেশের
হিমুদের জন্য
উপনার নগণ্য।
হুমায়ূন আহমেদ ‘হিমু সমগ্রে’র একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকাও লিখেছিলেন—
ভূমিকা
হিমুকে নিয়ে কতগুলি বই লিখেছি নিজেও জানি না। মন মেজাজ খারাপ থাকলেই হিমু লিখতে বসি। মন ঠিক হয়ে যায়। বেশি লেখার ফল সব সময় শুভ হয় না। আমার ক্ষেত্রেও হয় নি। অনেক জায়গাতেই ল্যাজে গোবরে করে ফেলেছি। হিমুর পাঞ্জাবির পকেট থাকে না অথচ একটা বই-এ লিখেছি সে পকেট থেকে টাকা বের করল। হিমুর মাজেদা খালা এক বই-এ হয়ে গেল মাজেদা ফুপু। তবে হিমু যে ঠিক আছে তাতেই আমি খুশি। হিমু ঠিক আছে, হিমুর জগৎ ঠিক আছে। তার বয়স বাড়ছে না। সে বদলাচ্ছে না। এই আনন্দ সংবাদ দিয়ে ভূমিকা শেষ করছি।
সব হিমুকে বন্দি করে যে প্রকাশক বিশাল হিমু সমগ্র বের করলেন তাঁকে (মনিরুল হক, অনন্যা) ধন্যবাদ।
হুমায়ূন আহমেদ
১৩.১১.২০০৬