- গ্রন্থপরিচয়
- প্রথম পরিচ্ছেদ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
- সপ্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টম পরিচ্ছেদ
- নবম পরিচ্ছেদ
- দশম পরিচ্ছেদ
- একাদশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
- চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
- বিংশ পরিচ্ছেদ
- একবিংশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
- চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
- ষড়্বিংশ পরিচ্ছেদ
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
- অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
- একত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- দ্বাত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ত্রয়স্ত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- চতুস্ত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- পঞ্চত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ষট্ত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- সপ্তত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ঊনচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- চত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- একচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- দ্বিচত্বরিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ত্রিচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- চতুশ্চত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- পঞ্চচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ষট্চত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- সপ্তচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ঊনপঞ্চাশত্তম পরিচ্ছেদ
- পঞ্চাশত্তম পরিচ্ছেদ
পঞ্চচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
ছায়া
যখন নগেন্দ্রের চৈতন্যপ্রাপ্তি হইল, তখনও শয্যাগৃহে নিবিড়ান্ধকার। ক্রমে ক্রমে তাঁহার সংজ্ঞা পুনঃসঞ্চিত হইতে লাগিল। যখন মূর্ছার কথা সকল স্মরণ হইল, তখন বিস্ময়ের উপর আরও বিস্ময় জন্মিল। তিনি ভূতলে মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তবে তাঁহার শিরোদেশে উপাধান কোথা হইতে আসিল? আবার এক সন্দেহ–এ কি বালিস? বালিস স্পর্শ করিয়া দেখিলেন–এ ত বালিস নহে। কোন মনুষ্যের ঊরুদেশ। কোমলতায় বোধ হইল, স্ত্রীলোকের ঊরুদেশ। কে আসিয়া মূর্ছিত অবস্থায় তাঁহার মাথা তুলিয়া ঊরুতে রাখিয়াছে? এ কি কুন্দনন্দিনী? সন্দেহ ভঞ্জনার্থে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি?” তখন শিরোরক্ষাকারিণী কোন উত্তর দিল না–কেবল দুই তিন বিন্দু উষ্ণ বারি নগেন্দ্রের কপোলদেশে পড়িল। নগেন্দ্র বুঝিলেন, যেই হউক, সে কাঁদিতেছে। উত্তর না পাইয়া নগেন্দ্র অঙ্গস্পর্শ করিলেন। তখন অকস্মাৎ নগেন্দ্র বুদ্ধিভ্রষ্ট হইলেন, তাঁহার শরীর রোমাঞ্চিত হইল। তিনি নিশ্চেষ্ট জড়ের মত ক্ষণকাল পড়িয়া রহিলেন। পরে ধীরে ধীরে রুদ্ধনিশ্বাসে রমণীর ঊরুদেশ হইতে মাথা তুলিয়া বসিলেন।
এখন ঝড় বৃষ্টি থামিয়া গিয়াছিল। আকাশে আর মেঘ ছিল না–পূর্ব দিকে প্রভাতোদয় হইতেছিল। বাহিরে বিলক্ষণ আলোক প্রকাশ পাইয়াছিল–গৃহমধ্যেও আলোকরন্ধ্র দিয়া অল্প অল্প আলোক আসিতেছিল। নগেন্দ্র উঠিয়া বসিয়া দেখিলেন যে, রমণী গাত্রোত্থান করিল–ধীরে ধীরে দ্বারোদ্দেশে চলিল। নগেন্দ্র তখন অনুভব করিলেন, এ ত কুন্দনন্দিনী নহে। তখন এমন আলো নাই যে, মানুষ চিনিতে পারা যায়। কিন্তু আকার ও ভঙ্গী কতক কতক উপলব্ধ হইল। আকার ও ভঙ্গী নগেন্দ্র মুহূর্তকাল বিলক্ষণ করিয়া দেখিলেন। দেখিয়া, সেই দণ্ডায়মানা স্ত্রীমূর্তির পদতলে পতিত হইলেন। কাতরস্বরে অশ্রুপরিপূর্ণ লোচনে বলিলেন, “দেবীই হও, আর মানুষই হও, তোমার পায়ে পড়িতেছি, আমার সঙ্গে একবার কথা কও। নচেৎ আমি মরিব।”
রমণী কি বলিল, কপালদোষে নগেন্দ্র তাহা বুঝিতে পারিলেন না। কিন্তু কথার শব্দ যেমন নগেন্দ্রের কর্ণে প্রবেশ করিল, অমনি তিনি তীরবৎ দাঁড়াইয়া উঠিলেন। এবং দণ্ডায়মান স্ত্রীলোককে বক্ষে ধারণ করিতে গেলেন। কিন্তু তখন মন, শরীর দুই মোহে আচ্ছন্ন হইয়াছে–পুনর্বার বৃক্ষচ্যুত বল্লীবৎ সেই মোহিনীর পদপ্রান্তে পড়িয়া গেলেন। আর কথা কহিলেন না।
রমণী আবার ঊরুদেশে মস্তক তুলিয়া লইয়া বসিয়া রহিলেন। যখন নগেন্দ্র মোহ বা নিদ্রা হইতে উত্থিত হইলেন, তখন দিনোদয় হইয়াছে। গৃহমধ্যে আলো। গৃহপার্শ্বে উদ্যানমধ্যে বৃক্ষে বৃক্ষে পক্ষিগণ কলরব করিতেছে। শিরঃস্থ আলোকপন্থা হইতে বালসূর্যের কিরণ গৃহমধ্যে পতিত হইতেছে। তখনও নগেন্দ্র দেখিলেন, কাহার ঊরুদেশে তাঁহার মস্তক রহিয়াছে। চক্ষু না চাহিয়া বলিলেন, “কুন্দ, তুমি কখন আসিলে? আমি আজ সমস্ত রাত্রি সূর্যমুখীকে স্বপ্ন দেখিয়াছি। স্বপ্নে দেখিতেছিলাম, সূর্যমুখীর কোলে মাথা দিয়া আছি। তুমি যদি সূর্যমুখী হইতে পারিতে, তবে কি সুখ হইত!” রমণী বলিল, “সেই পোড়ারমুখীকে দেখিলে যদি তুমি অত সুখী হও, তবে আমি সেই পোড়ারমুখীই হইলাম।”
নগেন্দ্র চাহিয়া দেখিলেন। চমকিয়া উঠিয়া বসিলেন। চক্ষু মুছিলেন। আবার চাহিলেন। মাথা ধরিয়া বসিয়া রহিলেন। আবার চক্ষু মুছিয়া চাহিয়া দেখিলেন। তখন পুনশ্চ মুখাবনত করিয়া, মৃদু মৃদু আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন, “আমি কি পাগল হইলাম–না, সূর্যমুখী বাঁচিয়া আছেন? শেষে এই কি কপালে ছিল? আমি পাগল হইলাম!” এই বলিয়া নগেন্দ্র ধরাশায়ী হইয়া বাহুমধ্যে চক্ষু লুকাইয়া আবার কাঁদিতে লাগিলেন।
এবার রমণী তাঁহার পদযুগল ধরিলেন। তাঁহার পদযুগলে মুখাবৃত করিয়া, তাহা অশ্রুজলে অভিষিক্ত করিলেন। বলিলেন, “উঠ, উঠ! আমার জীবনসর্বস্ব! মাটি ছাড়িয়া উঠিয়া বসো। আমি যে এত দুঃখ সহিয়াছি, আজ আমার সকল দুঃখের শেষ হইল। উঠ, উঠ! আমি মরি নাই। আবার তোমার পদসেবা করিতে আসিয়াছি।”
আর কি ভ্রম থাকে? তখন নগেন্দ্র সূর্যমুখীকে গাঢ় আলিঙ্গন করিলেন। এবং তাঁহার বক্ষে মস্তক রাখিয়া, বিনা বাক্যে অবিশ্রান্ত রোদন করিতে লাগিলেন। তখন উভয়ে উভয়ের স্কন্ধে মস্তক ন্যস্ত করিয়া কত রোদন করিলেন। কেহ কোন কথা বলিলেন না–কত রোদন করিলেন। রোদনে কি সুখ!