- গ্রন্থপরিচয়
- প্রথম পরিচ্ছেদ
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
- সপ্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টম পরিচ্ছেদ
- নবম পরিচ্ছেদ
- দশম পরিচ্ছেদ
- একাদশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
- চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
- বিংশ পরিচ্ছেদ
- একবিংশ পরিচ্ছেদ
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
- চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
- ষড়্বিংশ পরিচ্ছেদ
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
- অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
- একত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- দ্বাত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ত্রয়স্ত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- চতুস্ত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- পঞ্চত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ষট্ত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- সপ্তত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ঊনচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- চত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- একচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- দ্বিচত্বরিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ত্রিচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- চতুশ্চত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- পঞ্চচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ষট্চত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- সপ্তচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- অষ্টচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
- ঊনপঞ্চাশত্তম পরিচ্ছেদ
- পঞ্চাশত্তম পরিচ্ছেদ
ত্রিচত্বারিংশত্তম পরিচ্ছেদ
প্রত্যাগমন
কলিকাতার আবশ্যকীয় কার্য সমাপ্ত হইল। দানপত্র লিখিত হইল। তাহাতে ব্রহ্মচারীর এবং অজ্ঞাতনাম ব্রাহ্মণের পুরস্কারের বিশেষ বিধি রহিল। তাহা হরিপুরে রেজেষ্ট্রী হইবে, এই কারণে দানপত্র সঙ্গে করিয়া নগেন্দ্র গোবিন্দপুরে গেলেন। শ্রীশচন্দ্রকে যথোচিত যানে অনুসরণ করিতে উপদেশ দিয়া গেলেন। শ্রীশচন্দ্র তাঁহাকে দানপত্রাদির ব্যবস্থা, এবং পদব্রজে গমন ইত্যাদি কার্য হইতে বিরত করিবার জন্য অনেক যত্ন করিলেন, কিন্তু সে যত্ন নিষ্ফল হইল। অগত্যা তিনি নদীপন্থায় তাঁহার অনুগামী হইলেন। মন্ত্রীছাড়া হইলে কমলমণির চলে না, সুতরাং তিনিও বিনা জিজ্ঞাসাবাদে সতীশকে লইয়া শ্রীশচন্দ্রের নৌকায় গিয়া উঠিলেন।
কমলমণি আগে গোবিন্দপুরে আসিলেন, দেখিয়া কুন্দনন্দিনীর বোধ হইল, আবার আকাশে একটি তারা উঠিল। যে অবধি সূর্যমুখী গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছিলেন, সেই অবধি কুন্দনন্দিনীর উপর কমলমণির দুর্জয় ক্রোধ; মুখ দেখিতেন না। কিন্তু এবার আসিয়া কুন্দনন্দিনীর শুষ্ক মূর্তি দেখিয়া কমলমণির রাগ দূর হইল–দুঃখ হইল। তিনি কুন্দনন্দিনীকে প্রফুল্লিত করিবার জন্য যত্ন করিতে লাগিলেন, নগেন্দ্র আসিতেছেন, সংবাদ দিয়া কুন্দর মুখে হাসি দেখিলেন। সূর্যমুখীর মৃত্যুসংবাদ দিতে কাজে কাজেই হইল। শুনিয়া কুন্দ কাঁদিল। এ কথা শুনিয়া, এ গ্রন্থের অনেক সুন্দরী পাঠকারিণী মনে মনে হাসিবেন; আর বলিবেন, “মাছ মরেছে, বেরাল কাঁদে।” কিন্তু কুন্দ বড় নির্বোধ। সতিন মরিলে যে হাসিতে হয়, সেটা তার মোটা বুদ্ধিতে আসে নাই। বোকা মেয়ে, সতিনের জন্যও একটু কাঁদিল। আর তুমি ঠাকুরাণি! তুমি যে হেসে হেসে বলতেছ, “মাছ মরেছে, বেরাল কাঁদে”–তোমার সতীন মরিলে তুমি যদি একটু কাঁদ, তা হইলে আমি বড় তোমার উপর খুসী হব।
কমলমণি কুন্দকে শান্ত করিলেন। কমলমণি নিজে শান্ত হইয়াছিলেন। প্রথম প্রথম কমল অনেক কাঁদিয়াছিলেন–তার পর ভাবিলেন, “কাঁদিয়া কি করিব? আমি কাঁদিলে শ্রীশচন্দ্র অসুখী হন–আমি কাঁদিলে সতীশ কাঁদে–কাঁদিলে ত সূর্যমুখী ফিরিবে না; তবে কেন এঁদের কাঁদাই? আমি কখন সূর্যমুখীকে ভুলিব না; কিন্তু আমি হাসিলে যদি সতীশ হাসে, তবে কেন হাসব না?” এই ভাবিয়া কমলমণি রোদন ত্যাগ করিয়া আবার সেই কমলমণি হইলেন।
কমলমণি শ্রীশচন্দ্রকে বলিলেন, “এ বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী ত বৈকুণ্ঠ ত্যাগ করিয়া গিয়াছে। তাই বোলে দাদা বাবু বৈকুণ্ঠে এসে কি বটপত্রে শোবেন?”
শ্রীশচন্দ্র বলিলেন, “এসো, আমরা সব পরিষ্কার করি।”
অমনি শ্রীশচন্দ্র, রাজ, মজুর, ফরাস, মালী, যেখানে যাহার প্রয়োজন, সেখানে তাহাকে নিযুক্ত করিলেন। এদিকে কমলমণির দৌরাত্ম্যে ছুঁচা, বাদুড়, চামচিকে মহলে বড় কিচি মিচি পড়িয়া গেল; পায়রাগুলা “বকম বকম” করিয়া এ কার্ণিশ ও কার্ণিশ করিয়া বেড়াইতে লাগিল, চড়ুইগুলা পলাইতে ব্যাকুল–যেখানে সার্সি বন্ধ, সেখানে দ্বার খোলা মনে করিয়া, ঠোঁটে কাচ লাগিয়া ঘুরিয়া পড়িতে লাগিল; পরিচারিকারা ঝাঁটা হাতে জনে জনে দিকে দিকে দিগ্বিজয়ে ছুটিল। অচিরাৎ অট্টালিকা আবার প্রসন্ন হইয়া হাসিতে লাগিল।
পরিশেষে নগেন্দ্র আসিয়া পঁহুছিলেন। তখন সন্ধ্যাকাল। যেমন নদী, প্রথম জলোচ্ছ্বাসকালে অত্যন্ত বেগবতী, কিন্তু জোয়ার পূরিলে গভীর জল শান্তভাব ধারণ করে, তেমনি নগেন্দ্রের সম্পূর্ণ-শোক-প্রবাহ এক্ষণে গম্ভীর শান্তিরূপে পরিণত হইয়াছিল। যে দুঃখ, তাহা কিছুই কমে নাই; কিন্তু অধৈর্যের হ্রাস হইয়া আসিয়াছিল। তিনি স্থিরভাবে পৌরবর্গের সঙ্গে কথাবার্তা কহিলেন, সকলকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন। কাহারও সাক্ষাতে তিনি সূর্যমুখীর প্রসঙ্গ করিলেন না–কিন্তু তাঁহার ধীরভাব দেখিয়া সকলেই তাঁহার দুঃখে দুঃখিত হইল। প্রাচীন ভৃত্যেরা তাঁহাকে প্রণাম করিয়া গিয়া আপনা আপনি রোদন করিল। নগেন্দ্র কেবল একজনকে মনঃপীড়া দিলেন। চিরদুঃখিনী কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন না।