» » দ্বিতীয় খণ্ড

বর্ণাকার

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

আনন্দমঠ : দ্বিতীয় খণ্ড

অষ্টম পরিচ্ছেদ

সে রাত্রি শান্তি মঠে থাকিবার অনুমতি পাইয়াছিলেন। অতএব ঘর খুঁজিতে লাগিলেন। অনেক ঘর খালি পড়িয়া আছে। গোবর্ধন নামে এক জন পরিচারক – সেও ক্ষুদ্রদরের সন্তান – প্রদীপ হাতে করিয়া ঘর দেখাইয়া বেড়াইতে লাগিল। কোনটাই শান্তির পছন্দ হইল না। হতাশ হইয়া গোবর্ধন ফিরিয়া সত্যানন্দের কাছে শান্তিকে লইয়া চলিল।

শান্তি বলিল, “ভাই সন্তান, এই দিকে যে কয়টা ঘর রহিল, এ ত দেখা হইল না?”

গোবর্ধন বলিল, “ও সব খুব ভাল ঘর বটে, কিন্তু ও সকলে লোক আছে”।

শা। কারা আছে?

গো। বড় বড় সেনাপতি আছে।

শা। বড় বড় সেনাপতি কে?

গো। ভবানন্দ, জীবানন্দ, ধীরানন্দ, জ্ঞানানন্দ। আনন্দমঠ আনন্দময়।

শা। ঘরগুলো দেখি চল না।

গোবর্ধন শান্তিকে প্রথমে ধীরানন্দের ঘরে লইয়া গেল। ধীরানন্দ মহাভারতের দ্রোণপর্ব পড়িতেছিলেন। অভিমন্যু কি প্রকারে সপ্ত রথীর সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছিল, তাহাতেই মন নিবিষ্ট – তিনি কথা কহিলেন না। শান্তি সেখান হইতে বিনা বাক্যব্যয়ে চলিয়া গেল। শান্তি পরে ভবানন্দের ঘরে প্রবেশ করিল। ভবানন্দ ঊর্ধ্ব দৃষ্টি হইয়া, একখানা মুখ ভাবিতে‎ছিলেন। কাহার মুখ, তাহা জানি না, কিন্তু মুখখানা বড় সুন্দর, কৃষ্ণ কুঞ্চিত সুগন্ধি অলকরাশি আকর্ণপ্রসারি ভ্রূযুগের উপর পড়িয়া আছে। মধ্যে অনিন্দ্য ত্রিকোণ ললাটদেশ মৃত্যুর করাল কাল ছায়ায় গাহমান হইয়াছে। যেন সেখানে মৃত্যু ও মৃত্যুঞ্জয় দ্বন্দ্ব করিতেছে। নয়ন মুদ্রিত, ভ্রূযুগ স্থির, ওষ্ঠ নীল, গণ্ড পাণ্ডুর, নাসা শীতল, বক্ষ উন্নত, বায়ু বসন বিক্ষিপ্ত করিতেছে। তার পর যেমন করিয়া শরন্মেঘ-বিলুপ্ত চন্দ্রমা ক্রমে ক্রমে মেঘদল উদ্ভাসিত করিয়া, আপনার সৌন্দর্য বিকশিত করে, যেমন করিয়া প্রভাতসূর্য তরঙ্গাকৃত মেঘমালাকে ক্রমে ক্রমে সুবর্ণীকৃত করিয়া আপনি প্রদীপ্ত হয়, দিঙ্মণ্ডল আলোকিত করে, স্থল জল কীটপতঙ্গ প্রফুল্ল করে, তেমনি সেই শবদেহে জীবনের শোভার সঞ্চার হইতেছিল। আহা কি শোভা! ভবানন্দ তাই ভাবিতেছিল, সেও কথা কহিল না। কল্যাণীর রূপে তাহার হৃদয় কাতর হইয়াছিল, শান্তির রূপের উপর সে দৃষ্টিপাত করিল না।

শান্তি তখন গৃহান্তরে গেল। জিজ্ঞাসা করিল, “এটা কার ঘর?”

গোবর্ধন বলিল, “জীবানন্দ ঠাকুরের।”

শা। সে আবার কে? কৈ কেউ ত এখানে নেই।

গো। কোথায় গিয়াছেন, এখনি আসিবেন।

শা। এই ঘরটি সকলের ভাল।

গো। তা এ ঘরটা ত হবে না।

শা। কেন?

গো। জীবানন্দ ঠাকুর এখানে থাকেন।

শা। তিনি না হয় আর একটা ঘর খুঁজে নিন।

গো। তা কি হয়? যিনি এ ঘরে আছেন, তিনি কর্তা বললেই হয়, যা করেন তাই হয়।

শা। আচ্ছা তুমি যাও, আমি স্থান না পাই, গাছতলায় থাকিব।

এই বলিয়া গোবর্ধনকে বিদায় দিয়া শান্তি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। প্রবেশ করিয়া জীবানন্দের অধিকৃত কৃষ্ণাজিন বিস্তারণপূর্বক, প্রদীপটি উজ্জ্বল করিয়া লইয়া, জীবানন্দের একখানি পুথি লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিলেন।

কিছুক্ষণ পরে জীবানন্দ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শান্তির পুরুষবেশ, তথাপি দেখিবামাত্র জীবানন্দ তাঁহাকে চিনিতে পারিলেন। বলিলেন, “এ কি এ? শান্তি?”

শান্তি ধীরে ধীরে পুথিখানি রাখিয়া, জীবানন্দের মুখপানে চাহিয়া বলিল, “শান্তি কে মহাশয়?”

জীবানন্দ অবাক – শেষ বলিলেন, “শান্তি কে মহাশয়? কেন, তুমি শান্তি নও?”

শান্তি ঘৃণার সহিত বলিল, “আমি নবীনানন্দ গোস্বামী।” এই কথা বলিয়া সে আবার পুথি পড়িতে মন দিল।

জীবানন্দ উচ্চহাস্য করিলেন, বলিলেন, “এ নূতন রঙ্গ বটে। তার পর নবীনানন্দ, এখানে কি মনে করে এসেছ?”

শান্তি বলিল, “ভদ্রলোকের মধ্যে এই রীতি প্রচলিত আছে যে, প্রথম আলাপে ‘আপনি’ ‘মহাশয়’ ইত্যাদি সম্বোধন করিতে হয়। আমিও আপনাকে অসম্মান করিয়া কথা কহিতেছি না,- তবে আপনি কেন আমাকে তুমি তুমি করিতেছেন?”

“যে আজ্ঞে” বলিয়া জীবানন্দ গলায় কাপড় দিয়া জোড়হাত করিয়া বলিল, “এক্ষণে বিনীতভাবে ভৃত্যের নিবেদন, কি জন্য ভরুইপুর হইতে, এ দীনভবনে মহাশয়ের শুভাগমন হইয়াছে, আজ্ঞা করুন।”

শান্তি অতি গম্ভীরভাবে বলিল, “ব্যঙ্গেরও প্রয়োজন দেখিতেছি না। ভরুইপুর আমি চিনি না। আমি সন্তানধর্ম গ্রহণ করিতে আসিয়া, আজ দীক্ষিত হইয়াছি।”

জী। আ সর্বনাশ! সত্য না কি?

শা। সর্বনাশ কেন? আপনিও দীক্ষিত।

জী। তুমি যে স্ত্রীলোক!

শা। সে কি? এমন কথা কোথা পাইলেন?

জী। আমার বিশ্বাস ছিল, আমার ব্রাহ্মণী স্ত্রীজাতীয়।

শা। ব্রাহ্মণী? আছে না কি?

জী। ছিল ত জানি।

শা। আপনার বিশ্বাস যে, আমি আপনার ব্রাহ্মণী?

জীবানন্দ আবার জোড়হাত করিয়া গলায় কাপড় দিয়া অতি বিনীতভাবে বলিল, “আজ্ঞে হাঁ মহাশয়!”

শা। যদি এমন হাসির কথা আপনার মনে উদয় হইয়া থাকে, তবে আপনার কর্তব্য কি বলুন দেখি?

জী। আপনার গাত্রাবরণখানি বলপূর্বক গ্রহণান্তর অধরসুধা পান।

শা। এ আপনার দুষ্টবুদ্ধি অথবা গঞ্জিকার প্রতি অসাধরণ ভক্তির পরিচয় মাত্র। আপনি দীক্ষাকালে শপথ করিয়াছেন যে, স্ত্রীলোকের সঙ্গে একাসনে উপবেশন করিবেন না। যদি আমাকে স্ত্রীলোক বলিয়া আপনার বিশ্বাস হইয়া থাকে – এমন সর্পে রজ্জু ভ্রম অনেকেরই হয় – তবে আপনার উচিত যে, পৃথক আসনে উপবেশন করেন। আমার সঙ্গে আপনার আলাপও অকর্তব্য।

এই বলিয়া শান্তি পুনরপি পুস্তকে মন দিল। পরাস্ত হইয়া জীবানন্দ পৃথক শয্যা রচনা করিয়া শয়ন করিলেন।