☼ অদ্বৈত মল্লবর্মণ ☼
তিতাস একটি নদীর নাম
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
কিন্তু তিতাসে কত জল! কত স্রোত! কত নৌকা! সব দিক দিয়াই সে অকৃপণ।
আর বিজয় নদীর তীরে-তীরে যে-মালোরা ঘর বাঁধিয়া আছে, তাদের কত কষ্ট। নদী শুখাইয়া গেলে তাদের নৌকা-গুলি অচল হইয়া থাকে আর কাঠ-ফাটা রোদে কেবল ফাটে।
তিতাস-তীরের মালোরা যারা সেখানে বেড়াইতে গিয়াছে, চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয় দেখিয়া আসিয়াছে। রিক্ত মাঠের বুকে ঘূর্ণির বুভুক্ষা দেখিতে দেখিতে ফিরতি-পথে তারা অনেকবার ভাবিয়াছে, তিতাস যদি কোনদিন এই রকম করিয়া শুখাইয়া যায়! ভাবিয়াছে, এর আগেই হয়ত তাদের বুক শুখাইয়া যাইবে। ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ পাশের জনকে নিতান্ত খাপছাড়াভাবে বলিয়াছেঃ ‘বিজ্নার পারের মালো গুষ্টি বড় অভাগা রে ভাই, বড় অভাগা!’
যারা বিজয় নদীর দশা দেখে নাই, বছরের পর বছর কেবল তিতাসের তীরেই বাস করিয়াছে, তারা এমন করিয়া ভাবে না। তারা ভাবে তিন-কোণা ঠেলা-জাল আবার একটা জাল। তারে হাঁটু জলে ঠেলিতে হয়, উঠে চিংড়ির বাচ্চা। হাত তিনেক তো মোটে লম্বা। বিজয়ের বুকে তা-ই ডোবে না। তিতাসের জলে কত বড় বড় জাল ফেলিয়া তারা কত রকমের মাছ ধরে। এখানে যদি তিতাস নদী না থাকিত, বিজয় নদী থাকিত, তবে নাকের চারিদিক থেকে বায়ুটুকু সরাইয়া রাখিলে যা অবস্থা হয়, তাদের ঠিক সেই রকম অবস্থা হইত। ওদের মত থেলা-জাল ঘাড়ে করিয়া গ্রামগ্রামান্তরের খানা-ডোবা খুঁজিয়া মরিতে হইত দুই আনা এর দশ পয়সার মোরলা ধরিবার জন্য।
জেলেদের বউ-ঝিরা ভাবে অন্যরকম কথা— বড় নদীর কথা যারা শুনিয়াছে। যে-সব নদীর নাম মেঘনা আর পদ্মা। কি ভীষণ! পাড় ভাঙ্গে। নৌকা ডোবায়। কি ঢেউ। কি গহীন জল। চোখে না দেখিয়াই বুক কাঁপে! কত কুমীর আছে সে-সব নদীতে। তাদের পুরুষদের মাছ ধরার জীবন। রাতে-বেরাতে তারা জলের উপরে থাকে। এতবড় নদীতে তারা বাহির হইত কি করিয়া! তাদের নদীতে পাঠাইয়া মেয়েরা ঘরে থাকিতই বা কেমন করিয়া! তিতাস কত শান্ত। তিতাসের বুকে ঝড়-তুফানের রাতেও স্বামীপুত্রদের পাঠাইয়া ভয় করে না। বউরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে, মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়েরই বুকে মাথা এলাইয়া দিয়া শান্তমনে মাছ-ভরা জাল গুটাইতেছে।
বাংলার বুকে জটার মত নদীর প্যাঁচ। সাদা, ঢেউ-তোলা জটা। কোন্ মহাস্থবিরের চুম্বন-রস-সিক্ত বাংলা। তার জটাগুলি তার বুকের তারুণ্যের উপর দিয়া সাপ-খেলানো জটিলতা জাগাইয়া নিম্নাঙ্গের দিকে সরিয়া পড়িয়াছে। এ সবই নদী।
সবগুলি নদীর রূপ এক নয়। উহাদের ব্যবহার এবং উহাদের সহিত ব্যবহার তাও বিভিন্ন রকমের। সবগুলি নদীই মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের কাজে আসে। কিন্তু এ কাজে আসার নানা ব্যতিক্রম আছে। বড় নদীতে সওদাগরের নৌকা আসে পাল উড়াইয়া। উহার বিশাল বুকে জেলেরা সারাদিন নৌকা লইয়া ভাসিয়া থাকে। নৌকায় রাঁধে, খায়, ঘুমাইয়া থাকে। মাছ ধরে। সব বিষয়ে একটা কঠোর রূপ এখানে প্রকটিত। তীরে তীরে বালুচর, তাল নারিকেল সুপারির বাগ। স্রোতের খরায় তীরের মাটি কাটে, ধ্বসে। ঢেউয়ের আঘাতে তীরগুলি ভাঙিয়া খসিয়া পড়ে। গৃহস্থালি ভাঙ্গে। ক্ষেত খামার ভাঙ্গে, তাল-নারিকেল, সুপারির গাছগুলি সারি বাঁধিয়া ভাঙিয়া পড়ে। ক্ষমা নাই। ভাঙ্গাগড়ার এক রুদ্র দোলার দোলনায়— করাল এক চিত্তচঞ্চল ক্ষিপ্ত আনন্দ… সে-ই এক ধরণের শিল্প।
শিল্পের আরেকটা দিক আছে। সৌম্য শান্ত করুণ স্নিগ্ধ প্রসাদগুণের মাধুর্যে রঞ্জিত এ শিল্প। এ শিল্পের শিল্পী মহাকালের তাণ্ডবনৃত্য আঁকিতে পারে না। পিঙ্গল জটার বাঁধন খসিয়া পড়ার প্রচণ্ডতা এ শিল্পীর তুলিকায় ধরা দিবে না। এ শিল্পের শিল্পী মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করিয়াছে।
এ-শিল্পী যে-ছবি আঁকে তা বড় মনোরম। তীর-ঘেঁসিয়া সব ছোট ছোট শিল্পী। তারপর জমি। তাতে অঘ্রাণ মাসে পাকা ধানের মৌসুম। মাঘ মাসে সর্ষেফুলের অজস্র হাসি। তারপর পল্লী। ঘাটের পর ঘাট। সে ঘাটে জীবন্ত ছবি। মা তার নাদুস-নুদুস ছেলেকে ডুবাইয়া চুবাইয়া তোলে। বউ-ঝিরা সব কলসী লইয়া ডুব দেয়। পরক্ষণে ভাসিয়া উঠে। অল্প দূর দিয়া নৌকা যায়, একের পর এক। কোনটাতে ছই থাকে, কোনটাতে থাকে না। কোন কোন সময় ছইয়ের ভিতর নয়া বউ থাকে। বাপের বাড়ি থেকে স্বামী তার বাড়িতে লইয়া যায়; তখন ছইয়ের এ-পারে ও-পারে থাকে বউয়ের শাড়ি-কাপড়ের বেড়া। স্বামীর বাড়ি থেকে যখন বাপের বাড়িতে যায়, তখন কিন্তু কাপড়ের বেড়া থাকে না। থাকে না তার মাথায় ঘোমটা। ছইয়ের বাহিরে বসিয়া ঘাটগুলির দিকে চাহিয়া থাকে সে। স্বামীর বাড়ির ঘাট অদৃশ্য না হইলে কিন্তু সে ছইয়ের বাহিরে আসে না।
তারা স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আর বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যায় অনেক হাসি-কান্নার ঢেউ বুকে লইয়া। যে বউ স্বামীর বাড়ি যায়, তার এক চোখে প্রজাপতি নাচে, আরেক চোখে থাকে জল। এরা সব ভিন্ জাতের বউ। বামুন, কায়েত, নানা জাতের। জেলেদের বউরা জেলে-নৌকাতেই যায়। তারা অত সুন্দরীও নয়। অত তাদের আবরুরও দরকার হয় না। কিন্তু ওরা খুব সুন্দরী। জেলের ছেলেরা কপালের দোষ দেয়। অমন সুন্দর বউ তাদের জীবনে কোনদিন আসিবে না। ভাল করিয়া চায় তারা। ভাল করিয়া চাহিতে পারিলে প্রায়ই ছইয়ের ফাঁক দিয়া, বাতাসে শাড়িটা একটু সরিয়া গেলে, চকিতে তারই ফাঁক দিয়া, টুকটুকে একখানা মুখ আর এক জোড়া চোখ চোখে পড়িবে। বউয়ের অভিভাবক ছইয়ের দুই মুখে গুঁজিয়া দিয়াছে শাড়ির বেড়া; তাতে বউকে সকলে দেখিতে পারে না, কিন্তু বউ সকলকে দেখিতে পায়। তিতাসের জলে অনেক মাছ। মালোর ছেলের স্ফূর্তি রসাইয়া উঠে। জালের দিকে চোখ রাখিয়াই গাহিয়া উঠে, ‘আগে ছিলাম ব্রাহ্মণের মাইয়া করতাম শিবের পূজা, জালুয়ার সনে কইরা প্রেম কাটি শণের সুতা রে, নছিবে এই ছিল।’ বউ ঠিক শুনিতে পাইবে।
গ্রামের পর গ্রাম। নৌকাখানা সেখানে ঢুকিয়া পড়ে। সাপের জিহ্বার মত চকিতে সে-খাল গ্রামখানাকে ঘুরিয়া কোথায় পলাইয়া গিয়াছে। হয়ত আরো দূরে গিয়াছে। আরো কয়েকখানি গ্রামের পাশ দিয়া জের টানিতে টানিতে গিয়া, তারই কোনটাতে বউকে লইয়া যাইবে। খালের পাড়েই বাড়ি। ছোট্ট ছেলে-পিলেরা তৈরি হইয়া আছে, বউকে কি করিয়া চমকাইয়া দিবে। তৈরি হইয়া আছে হয়ত আরও কেউ। খালটা এইখানে শুখাইয়া গিয়াছে। এইখানে নৌকা হইতে উঠিয়া বউকে খানিকটা হাঁটিয়া যাইতে হইবে। শিল্পী শান্ত সবুজ সুন্দর রঙে ক্ষেতগুলির বুকে বুকে যে নক্সা আঁকিয়া রাখিয়াছে তাহারই আল দিয়া বউকে হাঁটিতে হইবে। তিতাসের তীরে না থাকার কি কষ্ট। যে-বউয়ের যাওয়ার বাড়ি একেবারে তিতাসের তীরে, কর্ম-চঞ্চল ঘাটখানাতে তার নৌকা লাগে। দশ-জোড়া নারীর চোখের দরদে স্নান করিয়া সে বউ নৌকা থেকে নামে। তারপর বাপের বাড়ি হইলে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকিয়া ছোট ছোট ভাইবোনদের বুকে চাপিয়া ধরে। আর স্বামীর বাড়ি হইলে পিঠের কাপড় সুদ্ধ টানিয়া তুলিয়া ঘোমটা বড় করে, তারপর আগে-পিছে দুই-চারিজন নারীর মাঝখানে থাকিয়া ধীরে ধীরে জড়িত পায়ে ঘাটের পথটুকু অতিক্রম করে।
পথটুকু অতিক্রম করিয়া জমিলা বাহির-বাড়ির মসজিদ-লগ্ন মক্তবের কোণে পা দিয়া একবার পিছন ফিরিয়া চাহিল। তার স্বামী মাঝির সঙ্গে তখনও কেরায়া নিয়া দরদস্তুর করিতেছে। দুই-এক আনা ফেলিয়া দিলেই মাঝি খুশি হইয়া চলিয়া যায়। বুড়া মাঝি। যা খাটিয়াছে! সঙ্গে মাত্র দুই ননদ। তাও ননদের ছোট সংস্করণ! সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিয়াছে। ভয় করে না বুঝি! লোকটা যেন কি! তাদের আসিতে বলিয়া নিজে আসিতেছে না। বাড়ির পথে বড় বড় ঘাস। সাপ বাহির হইয়াছে হইত। ব্যাঙ্ মনে করিয়া এখনই জমিলার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে যদি ছোবল দেয়!
ছমির মিয়া হিসাবী লোক। কাউকে এক পয়সা ঠকায় না। বেহুদা কাউকে এক পয়সা বেশিও দেয় না। সব কাজ ওজন করিয়া করে। মাঝি হার মানিয়া নৌকায় গিয়া উঠিলে, ছমিরের মনে অনাহূত এক ছোপ প্রসন্নতা রঙ গুলাইয়া দিল। আজ তার কিসের রাত! এ রাতে কেউ কোন দিন মাঝিকে ঠকায়! কেউ যেন না ঠকায়!
মাঝি দশ মিনিট ঝগড়া করিয়া যাহা পায় নাই, এক মিনিট চুপ করিয়া তাহার চারিগুণ পাইল! চক্চকে সিকিটা সাদা নদীর খোলসা অল্প-আলোকে ভাল করিয়া দেখিয়া লইয়া লগিতে ঠেলা দিল।
ছমির কাছে আসিলে জমিলার মনে হইল – এতক্ষণ এতগুলি সাপ তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটিকে ঘিরিয়া কিল্বিল্ করিতেছিল, এখন সব কয়টা সরিয়া পড়িয়াছে। কি ভাল তার মানুষটি!
কিন্তু তার চাইতেও ভাল একজনকে দেখিয়া আসিয়াছে সেই মালোপাড়ার ঘাটে। বড় ভাল লাগিয়াছে তার মানুষটাকে। প্রথম দৃষ্টিতেই সে তাকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে, সেও কি তেমনি ভালবাসে নাই? কেমন অনুরাগের ভরে চাহিয়াছিল। আর কেমন মানুষ গো! একবার দেখিয়াই মনে হইল যেন কতবার দেখিয়াছি। বেলা ফুরাইতেছে। একটু একটু বাতাস বহিতেছে। আর সেই বাতাসে আমার শাড়ির বেড়া খুলিয়া গেল, আর তখনই তাকে আমি দেখিতে পাইলাম। যদি না খুলিত, তবে ত দেখিতেই পাইতাম না। এমনি কত লোককে যে আমরা দেখিতে পাই না। অথচ দেখিতে পাইলে এমনি করিয়া আপন হইয়া যাইত। আমরা কি আর দেখি? যে দেখাইবার, সে-ই দেখায়! তা না হইলে সে যখন জলে ঢেউ খেলাইয়া কলসী ডুবাইল, ঠিক সেই সময়ে আমার শাড়ির বাঁধন খুলিল কেন? বর্ষায় আমার বাপ ওদের গাঁয়ে ভিজা নালিতার আঁটি-বোঝাই নৌকা লইয়া যায়, পাট ছাড়াইবার জন্য। আবার যখন বাপের বাড়ি যাইব, বাপকে বলিয়া রাখিব, এই রকম এই রকম মেয়েটি, দেখিতে ঠিক আমার মত; তার বাপকে বলিয়া দেখিও, আমার মেয়ে তোমার মেয়ের সঙ্গে সই পাতিতে চায়, তুমি রাজি আছ কিনা।
আগে যা বলিতেছিলাম।
— এ শিল্পী মহাকালের তাণ্ডব-নৃত্য আঁকিতে পারে না। পিঙ্গল জটার বাঁধন খসিয়া পড়ার প্রচণ্ডতা এ-শিল্পীর তুলিকায় ধরা দিবে না। এ শিল্পী মেঘনা-পদ্মা-ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করে।
এ শিল্পী যে ছবি আঁকে তা বড় মনোরম। তীর ঘেঁসিয়া সব ছোট ছোট গ্রাম। গ্রামের পর জমি। অগ্রহায়ণে পাকা ধানের মরসুম। আর মাঘে সর্ষেফুলের হাসি। তারপর আবার গ্রাম। লতাপাতা গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা সবুজ গ্রাম। ঘাটের পর ঘাট। সে ঘাটে সব জীবন্ত ছবি। মা তার নাদুস-নুদুস শিশু ছেলেমেয়েকে চুবাইয়া তোলে। অল্প একটু দূর দিয়া নৌকা যায় একের পর এক।…