চন্দন
সকাল সাড়ে সাতটার মেচেদা লোকাল ফাঁকা থাকে। ওই ট্রেনটা ধরতে হবে। সকালের দিকে মহাত্মা গাঁধী রোড শুনশান। হাওড়া ময়দান—শিয়ালদা রুটের সরকারি বাস কুড়ি মিনিটের মধ্যে শিয়ালদা থেকে হাওড়া পৌঁছে যায়। সেই হিসেব মতো পৌনে সাতটার সময় বয়েজ হোস্টেল থেকে বেরিয়েছে চন্দন। স্টেশানে পৌঁছে টিকিট কাটতে খানিকটা সময় যাবে।
মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল সকাল ছ’টায়। অ্যালার্ম বাজার পরে কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়ে চন্দন। পাশের খাটে রিপু ঘুমোচ্ছে। অর্ধেক শরীর খাটের বাইরে। কাল রাত্তিরে অনেকটা রাম খেয়েছিল।
হাওড়ার স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে গতকাল রাতের গ্র্যান্ড ফিস্টের কথা ভেবে মনমরা একটা হাসি ফুটে ওঠে চন্দনের মুখে। হোস্টেলে বোর্ডাস কমিটির অর্গানাইজ করা গ্র্যান্ড ফিস্টে অনেক নতুন নতুন দিক জানা গেল…
অতীতে হোস্টেলে একাধিক মিনি মেস ছিল। মিনি মেসের অর্থ হল, হোস্টেলের প্রতি তলায় একাধিক মেস, সেই ফ্লোরের নির্দিষ্ট কয়েকজন বোর্ডারের জন্য। একতলার জেনারেল মেসের খাওয়ার কোয়ালিটি যাচ্ছেতাই। ডেলা ডেলা আধসেদ্ধ ভাত, ট্যালটেলে জলের মতো ডাল, ঘাসভাজার মতো সবজি, মাছের ঝোলে মাছ নেই। নোংরা স্টিলের থালায় আর নোংরা বাটিতে যখন খাবার আসে, দেখে গা গুলিয়ে ওঠে। প্রতিবেশী রাজ্যের বাসিন্দা, একদল পাচক এই মেস চালায়। কলকাতার অন্যান্য হোস্টেলের মেসের পাচকদের সঙ্গে তাদের জোট বা ঘোঁট অত্যন্ত শক্তিশালী। থেকে থেকেই তারা সরকারি চাকরির দাবিতে আন্দোলন করে। তখন মেস বন্ধ হয়ে যায়।
চাহিদা আছে। জোগান নেই। ছাত্রদের চারবেলা খাবারের বাজার ধরতে প্রতি ফ্লোরে শুরু হল মিনি মেস। বিজনেস মডেল অতিশয় সরল। মেসেরই একজন পাচক হোস্টেলের করিডোরের এক কোণে একটি বা দুটি হিটার বসিয়ে রান্না শুরু করল। জোগাড় করল একটি বড় টেবিল ও দুটি বড় বেঞ্চি। রান্নার বাসনপত্র আর কাঁচা বাজার তার ইনভেস্টমেন্ট। চার বেলার খাওয়ার কোয়ালিটি বেশ ভালো। দাম বেশি। তবে দিতে কেউ আপত্তি করে না। পনেরো থেকে তিরিশজন সদস্য বিশিষ্ট এই মিনি মেসের কারণে একতলার মেস উঠে যাওয়ার জোগাড়। এ দিকে হিটার জ্বালানোর কারণে হোস্টেলের ইলেকট্রিসিটি বিল উঠল লাখ টাকার ওপরে। অনাদায়ী টাকা চেয়ে ইলেকট্রিক সাপ্লাই থেকে বহুবার চিঠি পাঠিয়েছে। লাইন কেটে দেওয়ার গুজবও রটেছে।
অ্যানেক্স ব্লকের মিনি মেসের কোয়ালিটি সব থেকে ভালো। অধিকাংশ অবাঙালি ছেলেরা এই ব্লকের মিনি মেসে খায়। মছলি একদম চলে না। বাঙালি রান্নাও হয় না। অনেক মিনি মেসেই ফ্রিজ আছে। বিয়ার বা অন্যান্য হার্ড ড্রিংক সহজলভ্য। কোনও কোনও মিনি মেস চরস বা কোকেন সাপ্লাই করে।
দময়ন্তী এবং সুরজের ঘটনাটা মিডিয়ার থিতোতে না থিতোতে একদিন স্কুপ টিভি দেখিয়ে দিল, এই সব মিনি মেসের কারণে সরকারের ব্যয় কী পরিমাণ বাড়ছে। ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের এক কর্তা ক্যামেরার দিকে কাগজ নেড়ে জানালেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের বয়েজ হোস্টেল থেকে তাঁদের প্রাপ্য এক কোটি টাকা। অথচ রাজনৈতিক দাদাগিরির জন্য তিনি লাইন কাটতে পারছেন না। তারপরই টিভিতে বাইট দিল পিএমএফের সব্যসাচী। সে প্রথমেই স্বীকার করল, নিজেও মিনি মেসে খায়। তারপর সমস্যাটা সুন্দর ব্যাখ্যা করে বলল, এর একমাত্র সমাধান, একতলার মেসের মানোন্নয়ন করা ও প্রতিটি ফ্লোরের মিনি মেস ভেঙে দেওয়া। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবে?
টিভিতে খবরটি সম্প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিপুর ফোন ঝনঝনিয়ে উঠল। ‘অধীরদা কলিং,’ হতাশ গলায় চন্দনকে বলল রিপু। তারপর ফোন ধরল।
‘ডাক্তারবাবু, একবার আমার সঙ্গে দেখা করে যাও।’ হালকা চালে বলেন অধীর।
‘কাল গেলে হবে না?’ জানতে চায় রিপু।
‘এখনই। এই মুহূর্তে।’ ধমক দেন অধীর।
‘আসছি।’ ফোন কেটে বারমুডার ওপরে প্যান্ট গলায় রিপু। তার চোখমুখের অবস্থা ভালো নয়। দেখে মায়া হয় চন্দনের। সে বলে, ‘চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’
‘তুই? পার্টি অফিসে?’ ভুরু কুঁচকে সামান্য ভাবে রিপু। বলে, ‘আচ্ছা, চল।’
রিপুর বাইকে চেপে মৌলালি আর এন্টালি পেরিয়ে আনসারুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসে পৌঁছতে সময় লাগল মিনিট কুড়ি। এতদিন চারতলা এই বাড়িটার ছবি কাগজ আর টিভিতে দেখেছে চন্দন। আজ সামনা সামনি দেখে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।
গেট টপকে গাড়ি রাখার প্রশস্ত এলাকা। এক কোণে বাইক পার্ক করে কোলাপসিবল গেট টপকে পার্টি অফিসে ঢোকে রিপু। টপাটপ সিঁড়ি টপকে দোতলায় ওঠে। সিড়ির ল্যান্ডিং-এ কিছুদিন আগে প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও পলিটব্যুরোর সদস্যর ছবি। তেলরঙে আঁকা ছবিটা দেখে নমষ্কার করে চন্দন। তার বাবা-মা এই লোকটাকে ভগবানের মতো ভক্তি করে। পারিবারিক নিয়ম মেনে সেও ভক্তি করতে বাধ্য।
দোতলার ঘরে বসে লিকার চা খাচ্ছিলেন অধীর। রিপুকে দেখে বললেন, ‘সঙ্গে এটা কাকে নিয়ে এলে? নতুন চ্যালা? টিনটিন কোথায়?’
‘চ্যালা নয়। এ আমার রুমমেট। নাম চন্দন সরকার। উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছিল। নিজেই আসতে চাইল।’ কাটা কাটা উত্তর দেয় রিপু।
‘উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট?’ রিপুকে ছেড়ে চন্দনকে নিয়ে পড়েন অধীর, ‘বাড়ি কোথায়?’
‘নতুনগ্রাম।’ সংক্ষিপ্ত জবাব চন্দনের।
নতুনগ্রামের নাম শুনে অধীরের মুখে অস্বস্তিকর অভিব্যক্তি তৈরি হয়েছিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘এখানে দুটো চা দিয়ো।’
হাওড়া স্টেশানের টিকিট কাউন্টারে পৌঁছে খুপরি দিয়ে কুড়ি টাকার নোট গলিয়ে দেয় চন্দন। খুচরো টাকা আর মেচেদার টিকিট নিয়ে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে। মেচেদা লোকাল পনেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। অনেকটা হাঁটতে হবে। সাতটা কুড়ি বাজে। ভাগ্যিস সময় হাতে নিয়ে বেরিয়েছিল।
চন্দনকে ছেড়ে রিপুকে নিয়ে পড়েছিলেন অধীর। বলেছিলেন, ‘তোমাদের জ্বালায় কি একদিনও শান্তিতে থাকা যাবে না? ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ রোজ নিউজে আসছে কেন?’
‘দেখুন অধীরদা, মিনি মেস আছে আমার আইএমসিতে ঢোকার আগে থেকে। জেনারেল মেসের বারোটা কীভাবে বাজল, তা আমি জানি না। হাসপাতাল অথরিটির জানা উচিৎ। মিনি মেস একটা রিয়্যালিটি। এখন মিডিয়া যদি চায় যে এই ইস্যুতে সরকারের পিছনে কাঠি করবে, তা হলে তার দায় আমি নেব কেন?’ শান্তভাবে নিজের যুক্তি পেশ করে রিপু।
রিপুর কথার উত্তরে অধীরদা উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগে চন্দন বলল, ‘আমার একটা সাজেশান আছে।’
‘তোর?’ ভুরু কুঁচকে বলে রিপু।
‘বলে ফেলো।’ বলেন অধীর।
‘ইস্যুটা যখন উঠেছে, তখন ছেড়ে দেওয়া উচিৎ না। একে কাজে লাগানো উচিত। এক সপ্তাহের নোটিস দিয়ে সবকটা মিনি মেস বন্ধ করে দেওয়া হোক। হোস্টেলের মেস কোনও প্রাইভেট পার্টিকে কনট্র্যাক্টের ভিত্তিতে দেওয়া হোক। তারা মেস চালাক। ছেলেদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হোক। এতে সমস্যা মিটবে।’
‘মিনি মেস তুলে দিলে একদিকে ছেলেরা খচবে, অন্যদিকে ঠাকুরগুলো খচবে। তারা আন্দোলন শুরু করলে একূল-ওকূল দুকূল যাবে। সে কথা ভেবেছিস?’ দাঁত খিচোয় রিপু।
‘ভেবেছি। বেশিরভাগ ছেলে খাওয়ার কোয়ালিটি নিয়ে বদারড। সে খাবার মিনি মেস থেকে না ম্যাক্সি মেস থেকে আসছে, তা নিয়ে বদারড নয়। আর একটা জিনিস আমরা ভুলে যাচ্ছি। সেটা হল, মিনি মেস তুলে দেওয়ার ফলে কেউ কাজ খোওয়াচ্ছে না। কেন না মিনি মেস যারা চালায় তারা সবাই জেনারেল মেসের স্টাফ। ওরা জানে যে ওরা বেআইনি হুকিং করে। মিনি মেস বন্ধ করলে ওরা আপত্তি করবে না। আপত্তি করবে অ্যানেক্স ব্লকে যারা খায়, তারা। সে আর কী করা যাবে! মেজরিটির সিদ্ধান্ত মাইনরিটিকে মানতে হবে।’
রিপু অবাক হয়ে অধীরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কালকের ছোঁড়ার সাহস দেখলেন অধীরদা?’
‘একটু র্যাডিকাল, কিন্তু ভুল কিছু বলেনি। কাজটা কীভাবে করা সম্ভব বলে মনে হয় চন্দন?’ অধীর জানতে চান।
‘খুব সহজ। হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি একটা রেজলিউশন করুক যে, ”মিনি মেস তুলে দেওয়া হোক।” সেটা হোস্টেলের সুপার এবং কলেজের প্রিন্সিপাল অ্যাপ্রূভ করুক। পাশাপাশি হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির ফ্লোর রিপ্রেজেনটেটিভরা মিটিং ডেকে সমস্ত বোর্ডারকে জানিয়ে দিক যে মার্চ মাসের এক তারিখ থেকে সমস্ত মিনি মেস উঠে যাবে। মিনি মেসের মালিক বা ঠাকুরদেরও এই কথা জানিয়ে দেওয়া হোক। আজ ফেব্রুয়ারি মাসের সাত তারিখ। হাতে অনেক সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে কোনও ক্যাটারিং কোম্পানি খুঁজে বার করতে হবে, যে মেস চালানোর দায়িত্ব নেবে। প্রাথমিকভাবে এক মাসের এগ্রিমেন্ট হোক। খাবারের কোয়ালিটি পছন্দ হলে এক বছরের।’
‘টেন্ডার ডাকতে হবে নাকি? তার তো অনেক হ্যাপা।’ রিপু বলে।
‘কিসসু ডাকতে হবে না। শুরু করাটা জরুরি। আগে শুরু করে দাও। টেন্ডার-ফেন্ডার পরের বছর থেকে হবে।’
‘পরে এই নিয়ে গন্ডগোল হলে?’
‘কেন গন্ডগোল হবে? সত্যি কথাটা প্রথমেই জানিয়ে দাও। যে, সময়ের অভাবের জন্য টেন্ডার ডাকা যায়নি। এবং কেউ কাটমানি খায়নি। প্রসেসটা স্বচ্ছ রাখো। পাবলিক বোকা নয়। তারা আমাদের ইনটেনশান বুঝবে।’
‘পাবলিক বোকা নয়। তারা আমাদের ইনটেনশান বুঝবে…’ চন্দনের বলা কথাগুলো নিজে একবার বলেন অধীর। যেন নিজেকে বোঝান। কিছুটা অন্যমনস্ক লাগে তাঁকে। নিমেষেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে রিপুকে বলেন, ‘চন্দন যা বলল, তা করে ফেলো। আর ছোকরাকে এজি দিয়ে দাও। আমাদের পার্টির ‘কর্মসূচী ও কর্মনীতি’ পড়াও। এর মধ্যে মেটিরিয়াল আছে।’
‘জনমোর্চার ”কর্মসূচী ও কর্মনীতি” আমার পড়া। কিন্তু এজি-টা কী বস্তু?’ অধীরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল চন্দন। রিপু ফিচেল হেসে চন্দনের হাত ধরে টানতে টানতে আনসারুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিল।
সাড়ে সাতটার মেচেদা লোকাল ফাঁকা। মাঝামাঝি একটা কামরায় উঠে আরাম করে বসল চন্দন। ফাঁকা কামরায় জনা পাঁচেক লোক। ব্যাকপ্যাককে বালিশ করে, বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ল। গতকাল গ্র্যান্ড ফিস্টের খাওয়াটা জম্পেস হয়েছিল।
মিনি মেস উঠে যাওয়া নিয়ে হোস্টেলে কোনও সমস্যা হয়নি। পুরো হোস্টেলে ছাব্বিশটা মিনি মেস চলত। সুপার ও প্রিন্সিপালের নোটিস পাওয়ার একদিনের মধ্যে কুড়িখানা সুড়সুড় করে উঠে গেল। বাকি ছ’টার মধ্যে চারটে অ্যানেক্স ব্লকে। আর দুটো ন্যাবারা চালায়। এগুলো তুলতে বাধা এসেছিল। অবাঙালি ছেলেরা সুরজ আর সঞ্জয়ের নেতৃত্বে লাঠিসোটা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চন্দন সঞ্জয়ের হাত থেকে লাঠি কেড়ে তাকে দু’ঘা দিতেই বাকিরা লেজ গুটিয়ে হাওয়া। সুরজের মিনি মেসের ফ্রিজে কয়েক বোতল বিয়ার রাখা ছিল। সেগুলো তিনতলার থেকে ছুঁড়ে নীচে ফেলে দিয়ে চন্দন বলল, ‘এই ফ্রিজের মালিক কে?’
ছয়ফুটিয়া সুরজ বলল, ‘আমি।’
‘নিজের ঘরে রাখ। করিডোরে যেন না দেখি।’
‘করিডোরে থাকলে কী করবি?’
‘বিয়ারের বোতলের মতো তিনতলা থেকে নীচে ফেলে দেব।’
আর কথা বাড়ায়নি সুরজ। হোস্টেল মেসে কাজ করার জন্য শিয়ালদার নামকরা ক্যাটারিং কোম্পানি পেটপুজো-র মালিক উৎপল বারিককে দেওয়া হল। চন্দন আর রিপুর সঙ্গে উৎপলের আগে থেকেই আলাপ ছিল। ওপিয়াম ফেস্টের সময় যাবতীয় খাবারের বরাত উৎপল পেয়েছিল।
উৎপল কাজ শুরু করল পয়লা মার্চ থেকে। প্রথম সাতদিন খাওয়াদাওয়া করে সবাই খুব খুশি। রান্নাঘরে রঙের পোঁচ পড়েছে, তেলচিটে কড়া-গামলা-ডেগচি উধাও, উনুন ভেঙে দিয়ে অনেকগুলো গ্যাস সিলিন্ডার এল, থালা-বাটি-গ্লাস স্টিল থেকে ডিসপোজেবল হয়ে গেল। দুর্দান্ত ব্যবস্থা। ডাইনিং হলেও নতুন রঙের পোঁচ, ঢকঢকে কাঠের বেঞ্চি আর নড়বড়ে টেবিলের বদলে সানমাইকা বসানো টেবিল চেয়ার। ‘পেটপুজো’-র মালিক উৎপল পনেরো দিনের মাথায় তিনজন ঠাকুরকে বরখাস্ত করল। তারা চুরি করছিল। তাদের বদলে নিজের লোক ঢোকাল তিনজন। একমাসের মাথায় রুম নাম্বার একশো পঁচিশে এসে উৎপল রিপুকে বলল, ‘ব্যাবসা আমি দাঁড় করিয়ে দেব। কিন্তু ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট তুলতে হলে আমাকে অন্তত তিন বছর সুযোগ দিতে হবে।’
‘দেখুন উৎপলদা, আপনার সঙ্গে যতই বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাক না কেন, এখানে আপনি ব্যবসা করতে এসেছেন,’ রিপুকে বলতে না দিয়ে চন্দন বলে, ‘কাগজে লেখাপড়া করা আছে, আপনার মেয়াদ এক বছর। বছর শেষ হলে টেন্ডার ডাকা হবে। এই শর্ত মেনেই আপনি এখানে এসেছেন। এখন অন্য কথা বলা যাবে না।’
‘এক মাসের মাথায় একটা গ্র্যান্ড ফিস্ট দিই?’ চন্দনকে পাত্তা না দিয়ে রিপুকে প্রশ্ন করে উৎপল। ‘নতুন বছরে একপ্রস্থ খ্যাঁটন হয়ে যাক। চিলি চিকেন, মাটন কষা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, আমসত্ব-খেজুরের চাটনি…’
‘আপনাকে মেনুকার্ড মুখস্ত বলতে হবে না।’ উৎপলকে এক ধমকে থামিয়ে দেয় চন্দন, ‘এখন গ্র্যান্ড ফিস্ট করার প্রয়োজন নেই। মেসটা ঠিকঠাক পরের বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত চালান। তারপর ওসব হবে। একদিন ভালো খাইয়ে বাকি দিনগুলো জেলখানার লপসি সাপ্লাই করছেন কি না, আগে দেখে নিই।’
রিপু কিছু বলেনি। বিমর্ষ হয়ে উৎপল ফেরত গিয়েছিল। চন্দন বলেছিল, ‘তোমাকে কদিন হল চুপচাপ দেখছি। কী ব্যাপার বল তো?’
‘কিছু না।’ খাটে আধশোয়া বলে রিপু।
‘অধীরদা এজি না হেঁজিপেঁজি কী একটা বলেছিল। সেটা কী বললে না তো?’ সিগারেট ধরিয়ে বলে চন্দন। রিপু আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে বলল, ‘তুই রাজনীতি করতে আগ্রহী?’
‘রাজনীতি করা মানে কী? আমাদের জীবনটাই তো রাজনীতি।’
‘পাকাপাকা কথা বলিস না। গোদাভাবে কথাটার মানে হল পার্টিকর্মী হিসেবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা। সমর্থক হিসেবে নয়।’
‘দেখো রিপুদা, আমাদের বাড়ি রাজনীতির বাড়ি। বাবা মোচাপার্টির সদস্য না হলেও সক্রিয় কর্মী। মা-ও মিটিং মিছিলে যায়। আমি এই পরিবেশেই বড় হয়েছি।’
‘পার্টির সদস্যপদ সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে?’
‘জনমোর্চা পার্টির স্ট্রাকচারটা পিরামিডের মতো। একদম শীর্ষে পলিট ব্যুরো। তার নীচে রাজ্য কমিটি, তার নীচে জেলা কমিটি, লোকাল কমিটি, ব্রাঞ্চ কমিটি। এটা পার্টি সংগঠনের চেহারা। গণসংগঠনের চেহারাটাও একইরকম। আমাদের ছাত্র সংগঠনেও একই স্ট্রাকচার। শাখা, অঞ্চল, জেলা, রাজ্য, সর্বভারতীয় কমিটি।’
‘এত জানিস আর এজি জানিস না?’
‘জানি না কথাটা ঠিক নয়। আমার বাবাকে এজি অফার করেছিল মোর্চা পার্টির থেকে। বাবা কয়েক দিন মিটিং অ্যাটেন্ড করে আর যায়নি। হাওড়া কোর্টে চাকরি করে, সাংবাদিকতা করে, চাষবাস করে পার্টির জন্য সময় বার করতে পারেনি। পার্টি থেকে অনেক বই পড়তে দিয়েছিল। বাবার সঙ্গে ওইসব বই আমিও পড়ে ফেলেছি।’
‘সবই তো জানিস। তাহলে প্রশ্নটা কী?’
‘এজি পুরো কথাটা কী?’
‘ওহ! এই ব্যাপার। এজি মানে অক্সিলিয়ারি গ্রুপ। কাউকে পার্টি মেম্বারশিপ অফার করার আগে আমরা বাজিয়ে নিই। জনমোর্চার মতাদর্শ সে ব্যক্তিগত জীবনেও পালন করছে কি? না ধান্দাবাজির জন্য পার্টিতে আসছে, তা দেখে নিতে হয়। আমাদের সরকার এসেছে ঊনত্রিশ বছর আগে। তখন যারা পার্টিতে এসেছিল, আর এখন যারা আসছে, তাদের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। সরকারে থেকে থেকে পার্টির গায়ে চর্বি জমেছে। চর্বির ভাগ নিতে অনেকে আসছে। তুই সেইরকম বেনোজল কি না, তা দেখতে হবে। তাছাড়া, মার্কসবাদী পত্রপত্রিকা পড়ার কালচার আমাদের পার্টিতে আছে। নিয়মিত লেভি দিতে হয়।’
‘লেভি কী?’
‘উপার্জনের একটা অংশ পার্টিকে দিতে হবে।’
‘এখন আমার কোনও উপার্জন নেই।’
‘সে আমারও নেই। আমাদের লেভি নামমাত্র। কিন্তু পাস করার পর যখন রোজগার করবি তখন পার্টিকে টাকা দিতে গা কটকট করবে না তো? এই সব ভেবে দেখিস। অধীরদা বলেছেন বলেই স্রোতে গা ভাসানোর জন্য ”হ্যাঁ” বলে দিস না। নেই নেই করেও পার্টিতে সততা, নিয়মানুবর্তিতা, গরিব মানুষের জন্য সিরিয়াসলি ভাবা, তাদের জন্য কিছু করা—এগুলোর মূল্য আছে। জনমোর্চায় এসে কিছু পাবি না। স্যাক্রিফাইস করতে হবে প্রচুর।’
‘আমজনতার কাছে মোচাপার্টির চেহারাটা একরকম নয়। নেতাগুলো মহাখচ্চর। এমনকী তোমার ওই অধীরদাও। ও শিয়ালদার এমএলএ। ওর নামে বদনাম প্রচুর। তোলাবাজি, গুন্ডামি, প্রোমোটারি, হাড়কাটার মেয়েদের কাছ থেকে টাকা তোলা—কী নয়?’
‘জানি। ওই জন্যই তোকে ভাবতে বলছি। আমি পার্টিতে এসেছিলাম আদর্শ নিয়ে। তিন বছরের মধ্যে ফ্রাস্ট্রেটেড। কলেজে তিনটে ‘প’ একসঙ্গে হয় না। পড়াশুনো, পলিটিকস আর প্রেম। আমি তিনটে নিয়েই ঘেঁটে আছি। কোনওটাকে ছাড়তে পারছি না। ওই জন্যই বলছি, অধীরদা বললেন বলে নাচতে নাচতে ”হ্যাঁ” বলিস না। ”ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপোঃ” কথাটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি।’
রিপুর জ্ঞানের মধ্যে আসল কথাটা পিকআপ করে নিয়েছে চন্দন। উত্তেজিত হয়ে সে বলল, ‘তুমি প্রেম করো? কার সঙ্গে? রুমমেট হয়েও বুঝতে পারলাম না। আমার আইকিউ এত কমে গেল কী করে?’
‘আপ্পু! ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। ক্লাস টুয়েলভ থেকে প্রেম। ওসব নিয়ে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে। আর কাউকে বলেছিস জানতে পারলে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব।’
‘আমি বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। যাই হোক, আমার ডিশিসন নেওয়া হয়ে গেছে। আমি এজি হতে রাজি।’ রিপুকে বলেছিল চন্দন।
এখন চলন্ত ট্রেনে শুয়ে সেইসব কথা মনে করতে করতে পাতলা হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। হকারের কাছ থেকে এক ভাঁড় চা কেনে।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে জনমোর্চার শাখা ছোট্ট। রিপু শাখা সম্পাদক। শাখার সদস্যরা হল আপ্পু, টিনটিন, বান্টি এবং সুব্রত। ফার্স্ট ইয়ার থেকে এজিতে নেওয়া হয়েছে মোট তিনজনকে। চন্দন ছাড়া প্রবাল এবং দীপ। মেয়েদের কয়েকজনকে আপ্পু অ্যাপ্রোচ করেছিল। কেউ রাজি হয়নি।
প্রথমদিন একশো পঁচিশ নম্বর ঘরেই পার্টির ক্লাস নিয়েছিল রিপু। দরজা বন্ধ করে চন্দন, প্রবাল এবং দীপকে বুঝিয়েছিল জনমোর্চা পার্টির ইতিহাস। হাতে ধরিয়েছিল পার্টি পুস্তিকা, পার্টি চিঠি, কর্মসূচী ও কর্মনীতি। গ্রাহক করেছিল পার্টির সংবাদপত্র জনমতের। পার্টি পুস্তিকাটিতে জনমোর্চার আদর্শগত রূপরেখা সংক্ষেপে ব্যক্ত করা আছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বইটি চন্দনের সঙ্গী।
পার্টি সংগঠনের পাশাপাশি, গণসংগঠনের কাজেও চন্দন যথেষ্ট দড়। তারই প্রমাণ গতকালের গ্র্যান্ডফিস্ট। ফার্স্ট সেমিস্টার শেষ হওয়ার ঠিক পরদিন হোস্টেলে গ্র্যান্ড ফিস্ট অর্গানাইজ করে হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি হোস্টেলের সমস্ত বোর্ডারদের মন জয় করে নিয়েছে। উৎপল এবং তার পেটপুজো ক্যাটারিং গতরাতে অসাধারণ এক মেনু উপহার দিয়েছে।
উৎপল গোড়ায় যে মেনু বলেছিল, তাতে কাঁটছাঁট করেছে চন্দন। গতরাতে মেনু ছিল লুচি, বেগুন ভাজা, ছোলার ডাল, পাঁঠার মাংস, রাবড়ি। যত খুশি তত খাও। একগাদা আইটেম বাবদ যে খরচা হতো তা বাদ দিয়ে ভালো কোয়ালিটি এবং অফুরন্ত কোয়ান্টিটির দিকে উৎপলকে নজর দিতে বলা হয়েছিল।
ছেলেরা খেয়েছেও সেই রকম। সন্ধে নামতে না নামতে বিভিন্ন ঘরে বোতল খুলে মোচ্ছব শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাত ন’টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত মাতাল এবং পেটুক ছেলের দল সমস্ত খাবার শেষ করে দিল। শেষ পাতে পান এবং মুখশুদ্ধিও ছিল। হোস্টেলের সবাই খুশি। হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি খুশ। উৎপল খুশ। রিপু, বান্টি, সুব্রত—সবাই খুশ। টিনটিনকে গতরাতে দেখা যায়নি।
হঠাৎ চন্দন খেয়াল করল, গমগম ঝমঝম শব্দ করে কোলাঘাট ব্রিজ পেরোচ্ছে মেচেদা লোকাল। সিট থেকে উঠে সে ব্যাগ কাঁধে নেয়। স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই এক লাফে ফ্লাইওভারের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ে। ন’টা নাগাদ কতগুলো দূরপাল্লার বাস আছে। ওগুলোয় উঠলে আধঘণ্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছানো যাবে।
তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাসস্ট্যান্ডে এসে চন্দনের চক্ষু স্থির। বাসস্ট্যান্ডে একটাও বাস নেই। বাসহীন স্ট্যান্ডে একটা জনসভা হচ্ছে। হাজার পাঁচেক লোক ভাষণ শুনছে। প্যান্টশার্ট পরা অফিস বাবু থেকে ধুতি-লুঙ্গি পরা চাষাভুসো মানুষ—সবাই রয়েছে। সবার হাতে নবযুগ পার্টির ফ্ল্যাগ। অনেকের হাতে মৃন্ময় চ্যাটার্জির ফোটোওয়ালা পোস্টার। জমায়েতের কেন্দ্রে মাইক হাতে ভাষণ দিচ্ছে ধবধবে কুর্তা-পাজামা পরা এক ভদ্রলোক।
‘বন্ধুগণ, এতদিন আমরা যা সন্দেহ করেছিলাম, গতকাল সন্ধেবেলা তা সত্যি হল। বর্তমান সরকার চোরের মতো রাতের অন্ধকারে এসে আমার আপনার বাড়ির গায়ে, গাছের গুঁড়িতে, খেতের আলপথের ওপরে নোটিশ মেরে গেছে যে সরকার কর্তৃক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হল। ইংল্যান্ডের কোন কোম্পানি এখানে এসে হেলথ হাব খুলবে। সেই জন্য আমাদের বাড়ি, ঘর, চাষের জমি খোয়াতে হবে। হেলথ হাব কাকে বলে আপনারা জানেন?’
‘না-আ-আ-আ!’ সমবেত চিৎকার করে ক্রুদ্ধ জনতা।
‘আমিও জানি না। এটুকু বুঝেছি যে আপনার আমার জমি লালমুখো সাহেবকে বেচে দিতে হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আবার ফেরত আসছে। আর তার দালালি করছে জনমোর্চার লাল কুত্তাগুলো।’
শক্তিধর মাইতি! বক্তাকে চিনতে এক মিনিটও লাগল না চন্দনের। মাইতি জুয়েলার্সের মালিক। কোটিপতি। এতদিন জাতীয়তাবাদী পার্টি করত। সময় বুঝে নবযুগ পার্টিতে ভিড়েছে। শক্তিধরের বক্তব্য শুনতে মঞ্চের কাছাকাছি যায় চন্দন। তার মনে প্রবল উৎকন্ঠা। সত্যি এই সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে? জমি কেড়ে নিলে লোকগুলো যাবে কোথায়?
‘এই সেই নোটিশ!’ এ-ফোর সাইজের কাগজ নাড়ে শক্তিধর। ‘আমরা জানি সংবিধানগত ভাবে ভারতবর্ষের যাবতীয় জমির মালিক রাষ্ট্র। আমার, আপনার—সবার বাড়ি বা জমির আসল মালিক সরকার। আমাদের তাই প্রপার্টি ট্যাক্স দিতে হয়। দরকারে সরকার জমি নিতে চাইলে নেবে। আমার তা নিয়ে কোনও বক্তব্য নেই। আমি যতদূর বুঝি, হেলথ হাব মানে হাসপাতাল। দক্ষিণে যেমন ভেলোর, পশ্চিমে যেমন মুম্বইয়ের টাটা মেমোরিয়াল বা পুনের এএফএমসি, এখানেও সেরকম কিছু হওয়া উচিৎ। আমাদের বাড়ির লোক সেখানে চিকিৎসা পাবে। তাছাড়া এখানকার বাজার বাড়বে। রাস্তাঘাট উন্নত হবে, ইলেকট্রিসিটি আসবে, রেললাইন বসবে। সরকার অধিগ্রহণ করেছে বাঁজাপলাশ গ্রামের পুরোটা। এমনকী ওখানকার হেলথ সেন্টারও উঠে যাবে। বাঁজাপলাশ গ্রামে পাকা বাড়ি বলতে স্যামিলটন ইশকুলের প্রধান শিক্ষক গোপাল নস্করের দোতলা বাড়ি। ওই গ্রামে নোনাজমি আর বালির কারণে চাষাবাদ হয় না। ওই গ্রামে জোয়াকিম জনজাতির বাস। তারা বামন। এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করার ফলে দু’হাজার জোয়াকিম বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এ আমরা মেনে নেব?’
পাঁচ হাজার লোক গর্জে উঠল, ‘কখনওই না! নবযুগ পার্টি জিন্দাবাদ। মৃন্ময় চ্যাটার্জি জিন্দাবাদ।’
চন্দন অবাক হয়ে ভাবল, রাজ্য সরকার দু’হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে জমি অধিগ্রহণ করতে চলেছে। যে পার্টি এই সরকার চালায় চন্দন সেই পার্টির খাতায় নাম লিখিয়েছে। এবার কী হবে?