বৃন্দা
‘আজ আমি তোদের খাওয়াব।’ একগাল হেসে বলল দময়ন্তী।
‘কেন? প্র্যাকটিকাল ভালো হয়েছে বলে?’ ব্যাজার মুখে বলল অভি।
‘তোর প্র্যাকটিকাল যে ভালো হয়নি সেটা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে,’ অভিকে মুখঝামটা দেয় বৃন্দা, ‘তবে সেটা দিঠির ট্রিট দেওয়ার কারণ নয়।’
‘কী কারণ? দূরে কোথাও হলে আমি যাব না। বাড়ি ফিরতে হবে।’ অভি এখনও ব্যাজার।
অভির কথায় পাত্তা না দিয়ে বৃন্দা চন্দনকে পাকড়েছে। ‘অ্যাই চাঁদু, কোথায় কাটছিস?’
‘তোরা খেতে যা। আমাকে নিয়ে টানাটানি করছিস কেন? আমার কাজ আছে।’ বৃন্দার দিকে না তাকিয়ে বলল চন্দন।
‘তোর কাজ মানে তো একশো পঁচিশে বসে সিগারেট ফোঁকা আর রিপুদার দালালি করা।’ চন্দনকে শুনিয়ে দেয় দময়ন্তী। কলেজ স্ট্রাইকের সময় চন্দনের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সে আদৌ খুশি নয়।
‘তাও তো কিছু একটা করি। কলেজে বাওয়াল বাঁধিয়ে তোর মতো হাওয়া হয়ে যাই না।’
‘দিস ইজ হাইলি সেক্সিস্ট কমেন্ট।’ চশমা ঠিক করে বলে দময়ন্তী। ‘কলেজে বাওয়াল আমি বাঁধাইনি। বাঁধিয়েছিল সুরজ। এবং পরে আমার ব্যাচমেটরা। আমিই একমাত্র পার্সন, যে বাওয়াল প্রিভেন্ট করতে চেয়েছিলাম। আমি এফআইআর বা জিডি করিনি বলেই সুরজ এখনও কলেজে পড়ছে। আজ পরীক্ষাও দিল। তোরাই বরং পিএমএফের পাল্লায় পড়ে আন্দোলন, বনধ আর ধর্না করে কলেজের নাম ডুবিয়েছিস। দিনের পর দিন আইএমসিকে খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজে এনেছিস ফর রং রিজনস।’
‘আমি স্ট্রাইক করিনি। স্ট্রাইকের বিরোধিতা করেছিলাম।’ গলা ফুলিয়ে বলে চন্দন।
‘সেটাও পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড ছিল। তুই আমাকে বাঁচাতে ওই অবস্থান নিসনি। নিজের পেছন বাঁচাতে নিয়েছিলি। লাইক আদার মোচা-জ।’
‘তোরা ”মোচা”, ”ছেঁদো” আর ”পিএমএফ” নিয়ে ঝগড়া কর। এদিকে কলেজে ‘ন্যাবা’রা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সেটা খেয়াল করেছিস?’ নিজের মতামত দেয় অভি।
কথাটা সত্যি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চরিত্রে একটা বড় শিফট দেখা যাচ্ছে। সুনামির মতো অমোঘ, আর্মাগেডনের মতো পূর্ব নির্দিষ্ট। নতুন একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান হচ্ছে উল্কার মতো। মৃন্ময় চ্যাটার্জির নেতৃত্বে এই ওয়ান ম্যান পার্টির একমাত্র অ্যাজেন্ডা, জনমোর্চার সরকারকে উল্টে দেওয়া। দীর্ঘ সাতাশ বছর ধরে শাসক দলের দুর্নীতি, দাদাগিরি, প্রশাসনিক ব্যর্থতায় তিতিবিরক্ত রাজ্যের মানুষ ক্ষুদ্র নবযুগ পার্টিকে আপন করে নিচ্ছে। নবযুগ পার্টিকে মিছিলের অনুমতি দেওয়া না হলেও মৃন্ময় মিছিল করেছেন। শাসকদলের ক্যাডাররা প্রকাশ্য রাজপথে তাঁকে লাঠিপেটা করেছে, নবযুগ পার্টিকে ন্যাবা পার্টি নাম দিয়েছে, দলের সমর্থক ও কর্মীবৃন্দকে ক্রমাগত বাড়ি ছাড়া করেছে। কিন্তু নবযুগ পার্টির নৌকার পাল বিরোধীতাকে হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে। রাজনৈতিক আন্দোলন ক্রমশ গতি পাচ্ছে। জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে, গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায়, অলিগলিতে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ন্যাবা পার্টির নতুন সমর্থক তৈরি হচ্ছে। বেশি করে এগিয়ে আসছে মেয়েরা। শাসকদল এখনও এই প্রবল হাওয়াকে পাত্তা দিচ্ছে না। সাতাশ বছর ক্ষমতায় থাকার গর্বে তারা অন্ধ।
নবযুগ পার্টি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজেও ছাত্র উইং খুলে ফেলেছে। সবার আগে সেই দলে যোগ দিয়েছে সুরজ। সক্রিয় সদস্য বলতে সে আর সঞ্জয়। ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রকাশ্যে সমর্থন না করলেও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সঙ্গে আছে। সুরজ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার কারণে কলেজে ছাত্র সংগঠনের ক্রেডিবিলিটি কম। কিন্তু মৃন্ময় চ্যাটার্জি এত বৃহৎ এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যে তাঁর সামনে সমস্ত প্রতিকূলতা জলের স্রোতের সামনে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে।
‘ন্যাবাদের কথা ছাড়,’ পাক্কা মোচাপার্টির নেতার মতো বলল চন্দন, ‘দিঠি কেন খাওয়াচ্ছে, এটা না জানলে আমি যাব না।’
‘খাওয়াচ্ছি, কেন না আমি আমার বাড়ির কাছে একটা দুর্দান্ত রেস্তোরাঁর সন্ধান পেয়েছি।’ গর্বের সঙ্গে বলে দময়ন্তী।
‘তোর বাড়ির কাছে তো আমাদের কী?’ বিরক্ত হয়ে বলে চন্দন।
‘তোর শালা বুদ্ধি হবে না,’ চন্দনের হাত ধরে গেটের দিকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বলে দময়ন্তী, ‘আমার বাড়ি এখান থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিট। বিনি পয়সায় খেতে পাবি, অত কৈফিয়ত চাইছিস কেন?’
অভি আর বৃন্দা হাসতে হাসতে ওদের পিছন পিছন এগোয়।
আজ ফার্স্ট সেমিস্টার শেষ হল। পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসের কুড়ি তারিখে। শেষ হল পঁচিশে মার্চ। প্রথমে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রির থিয়োরি পরীক্ষা। তারপর এক সপ্তাহ ছুটি। তারপর একদিনের ব্যবধানে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল। থিয়োরি পরীক্ষা সবাই মোটামুটি উতরে দিয়েছে। প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা কারোরই ভালো হয়নি। অভি অ্যানাটমিতে ছড়িয়েছে। চন্দন বায়োকেমিস্ট্রিতে। দময়ন্তী আর বৃন্দারও অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল ভালো হয়নি। তবে আজ পরীক্ষা শেষ। একটু আনন্দ ফুর্তি করা যেতেই পারে। কাল রোববার। কলেজে আসার তাড়া নেই।
‘দোকানটার নাম রোম্যানো স্যান্টোস,’ বলল দময়ন্তী, ‘জেম সিনেমা হলের উল্টো দিকে। হোস্টেলে থাকার সময়ে আমরা মাঝে মাঝে ওখান থেকে মোমো আনিয়ে খেতাম। কখনও ঢুকে দেখিনি। যে দিন থিয়োরি পরীক্ষা শেষ হল, বাড়ি ফেরার সময় ওদের টেক-অ্যাওয়ে কাউন্টার থেকে মিক্সড চাউমিন আর হানি চিকেন কিনেছিলাম। খুব ভালো খেতে। অনেকটা কোয়ান্টিটি দেয়। বাবা-মা খেয়ে মুগ্ধ।’
‘চাইনিজ আর টিবেটান ফুড জয়েন্টের নাম হিসেবে রোম্যানো স্যান্টোস কিন্তু বেশ অদ্ভুত,’ বলে বৃন্দা।
হিহি করে হেসে দময়ন্তী বলে, ‘ওদের কাউন্টার থেকে চাইনিজ কেনার দিন নামের ইতিহাস জানলাম। রমেন আর সন্তোষ নামে দুই বন্ধু একটা চায়ের দোকান দিয়েছিল। দোকানটা ইনিশিয়ালি ”রমেন ও সন্তোষের দোকান” বলে চলত। চা বিক্রি করে খানিকটা পয়সা হওয়ার পরে ওরা মোমোর দোকান দেয়। সেটার নাম হয়ে যায় রোম্যানো স্যান্টোস। বাকিটা, অ্যাজ দে সে, ইতিহাস।’
চন্দন মুখ গোমড়া করে হাঁটছিল। হঠাৎ বলল, ‘আজ বাড়ি গেলে ভালো হতো। তোদের পাল্লায় পড়ে যাওয়া হল না।’
‘কদ্দিন বাড়ি যাসনি?’ জিজ্ঞাসা করল অভি।
‘যাইনি অনেকদিন। এখন মাসে একবার, একদিনের জন্য যাই। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে, এই রকমটা নয়। আমাদের গ্রামে একটা গন্ডগোল বাঁধছে।’
‘কীসের গন্ডগোল?’ জানতে চায় দময়ন্তী।
‘জানি না। কাল রাতে বাবার সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। বাবা বলছিল, হেলথ হাব নামের কী একটা উৎপটাং জিনিস হবে বলে সরকার নাকি জমি অধিগ্রহণ করবে। এই নিয়ে আমাদের ওখানে জোর গুজব রটেছে। রোজই মিটিং, মিছিল, পদযাত্রা, ধর্না—এসব লেগেই আছে।’
‘ওসব ছাড়,’ চন্দনের হাত ধরে দময়ন্তী বলে, ‘এই হল রোম্যানো স্যান্টোস। এখানেই আমরা পেটপুজো করব।’
গ্লো-সাইনের নামলিপিতে ট্রাইবাল টাচ। ওয়ান-ওয়ে গ্লাসের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল চারজন। আধো অন্ধকার ঘরে মোট আটটা টেবিল। দুটো টেবিলে আটজন করে বসতে পারবে। বাকিগুলো চারজনের জন্য। কালার স্কিমে কালো আর লালের প্রাধান্য। কাঠের টেবিলগুলোও কালো রঙের। হাইব্যাক লেদার চেয়ারের রং লাল। দেওয়ালের নীচের অর্ধেক কাঠ দিয়ে প্যানেলিং করা। ওপরের অর্ধেকের রং গোলাপি। সিলিং থেকে কাগজের তৈরি চিনা লন্ঠন ঝুলছে। গোলাকৃতি ফানুসের মতো, কাগজের তৈরি লন্ঠনে ড্রাগনের মোটিফ। বিকেল পাঁচটার সময় ছ’জন কাস্টমার রয়েছে। অর্থাৎ রোম্যানো স্যান্টোসের বাজার ভালো।
কাউন্টারে বসা মাঝবয়সি ভদ্রলোক দময়ন্তীকে বললেন ‘আজ টেক অ্যাওয়ে না সিট ডাউন ডিনার?’
‘বিকেলবেলা ডিনার কী করে হবে রমেনদা?’ মুচকি হাসে দময়ন্তী, ‘জলখাবার বলতে পারো।’
চেয়ারে বসে মেনুকার্ড টেনে নেয় বৃন্দা। স্টার্টার থেকে ডেজার্ট—সব কিছু উল্টেপাল্টে দেখে। বেশ ছড়ানো মেনু। দময়ন্তীকে পরামর্শ দেয়, ‘ডেকেছিস যখন, ভালো করে খাওয়া। বাড়ি গিয়ে যেন ডিনার করতে না হয়।’
দময়ন্তী হাতের ইশারায় ওয়েটারকে ডাকল, ‘অর্ডার নিন।’ তারপর চন্দন বা অভিকে জিজ্ঞাসা না করেই অর্ডার করল। চার রকমের স্যুপ, দু’রকমের রাইস, দু’রকমের চাউ, চার রকমের চিকেন। ভ্যারাইটি থাকল। নিজেদের মধ্যে শেয়ার করা যাবে।
চন্দন আমেরিকান চপ স্যুয়ে খেয়ে এত উত্তেজিত যে রাইস ছুঁয়ে দেখল না। অভি মিক্সড ফ্রায়েড রাইস নিয়ে খুশি। বৃন্দা আর দময়ন্তী একটা হাক্কা চাউমিন ভাগাভাগি করে খেল। জিরা রাইসের প্লেটে কেউ হাত দেয়নি। চিলি চিকেন, হানি চিকেন, লেমন চিকেন আর চিকেন সুইট অ্যান্ড সাওয়ার সবাই ভাগাভাগি করে খেল। জিরা রাইসের প্লেট নষ্ট হচ্ছে দেখে বৃন্দা চন্দনকে বলল, ‘এটা শেষ কর। খাবার নষ্ট করতে নেই।’
‘আমি চাষার ছেলে। ভাত নষ্ট করব না।’ লেমন চিকেন সাঁটাতে সাঁটাতে চন্দন বলে, ‘কিন্তু তাহলে আমার স্যুপ অন্য কেউ খা। ওসব জোলো মাল আমার পছন্দ নয়।’
‘তুই এখনও স্যুপ খাসনি?’ অভি অবাক হয়ে বলে।
‘না। খাবও না।’ জিরা রাইসের প্লেট টেনে নিয়ে বলে চন্দন।
চারজনে খেয়ে বিল হল দেড় হাজার টাকা। দময়ন্তী ওয়েটারকে দেড়শো টাকা টিপ দিল। খুশি হয়ে লম্বা স্যালুট ঠুকল সে।
সন্ধে সাতটার সময় রোম্যানো স্যান্টোস থেকে বেরিয়ে বৃন্দা দেখল, এখনও সূর্যের আলো রয়েছে। এসির কারণে মার্চ মাসের লাগামছাড়া গরম এতক্ষণ বোঝা যায়নি। রেস্তোরাঁ থেকে বেরোনো মাত্র কুলকুলিয়ে ঘাম শুরু হয়ে গেল।
‘কাল থেকে কী প্ল্যান?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।
‘কাল হোস্টেলে গ্র্যান্ড ফিস্ট আছে। ওটা চুকিয়ে পরশু বাড়ি যাব।’ চন্দন নিজের রুটিন জানাল।
‘আমি এক সপ্তাহ পড়ে পড়ে ঘুমোব।’ দময়ন্তী জানাল নিজের প্ল্যান। বৃন্দা অভিকে বলল, ‘তোর কী প্ল্যান?’
‘আমার?’ মিনমিন করে অভি। তার মনে পড়ে যাচ্ছে বৃন্দার সঙ্গে ফোনালাপের কথা। সন্ধ্যার সেই কথোপকথনের পর থেকে অভি এতটাই অস্থির চিত্ত হয়ে গেছে যে পড়াশুনোয় মন দিতে পারেনি। বই খুললে বৃন্দাকে দেখতে পায়। বই বন্ধ করলেও। এভাবে পড়াশুনা হয়? সেমিস্টারে রেজাল্ট খারাপ হলে বৃন্দা দায়ী হবে। আর এখন জিজ্ঞাসা করছে কী প্ল্যান! ন্যাকা!
‘হ্যাঁ। তোর। গোরুর মতো তাকিয়ে আছিস কেন?’ বিরক্ত হয়ে বলে বৃন্দা।
‘জানি না। বাড়িতে থাকব। এই সপ্তাহটা তো ছুটি।’
‘ফোন করিস।’ অভির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে বৃন্দা। অভির হৃদয় একটা ধড়কন বেমালুম মিস করে। বৃন্দা তাকে ফোন করতে বলছে? কেন? যা বলার এখনই বলুক না! অভিকে মিছিমিছি টেনশানে ফেলার কোনও মানে হয়?
‘আমি কাটলাম বস,’ টাটা করে নিজের বাড়ির দিকে এগোয় দময়ন্তী। অভি, বৃন্দা আর চন্দন হাঁটতে হাঁটতে মৌলালি পৌঁছয়। অভি আর চন্দন শিয়ালদার দিকে চলে গেল। চন্দন হোস্টেলে ফিরবে। অভি ট্রেন ধরে বাড়ি। এসপ্ল্যানেডগামী ট্রামে উঠে বসে বৃন্দা।
ট্রাম ব্যাপারটা বৃন্দার খুব পছন্দের। কোনও তাড়াহুড়ো নেই, কোনও ওভারটেক নেই, কোনও রেষারেষি নেই। প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, ভবঘুরে ও ভ্রমণবিলাসী ছাড়া কেউ চাপে না। শিয়ালদা থেকে ধর্মতলার সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করতে আধঘণ্টা সময় নেয়। কন্ডাক্টর টিকিট কাটতে চায় না। ড্রাইভার অলসভাবে সিগন্যাল সবুজ হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।
ধর্মতলায় নেমে একটুখানি হাঁটলেই মেট্রো স্টেশন। বৃন্দার কাছে স্মার্টকার্ড আছে। লেনিন সরনির মুখ থেকে মেট্রো স্টেশান অবধি হেঁটে আসতে গেলে প্রথমে পড়ে ফুটপাথের ম্যাগাজিনের দোকান। গাদাগাদা কাগজ আর পত্রিকা নিয়ে বসে রয়েছে আশি বছরের এক বুড়ো। বই বিক্রি হল কি না তা নিয়ে তার কোনও চিন্তা নেই। রেসের বই আর পর্নো ম্যাগাজিন ছাড়া অন্য কোনও ম্যাগাজিন বিক্রি হতে দেখেনি বৃন্দা। বইয়ের দোকান পেরোনো মাত্র শুরু হয়ে গেল সস্তার জামাকাপড়ের হকারদের চিৎকার, ‘প্যাঁয়ষ্যাট, প্যাঁয়ষ্যাট!’ পঁয়ষট্টি টাকায় টি-শার্ট, হাফ আর ফুল-স্লিভ শার্ট, বারমুডা, কাপরি, সুতির জ্যাকেট—সব পাওয়া যাচ্ছে। হকারের পাশে পশরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে দুটো মাঝবয়সি মেয়ে। গোলাপি শাড়ি আর আর টিয়া রঙের ব্লাউজ এমন ভাবে পরা যে পেট ও বুকের অনেকখানি দেখা যায়। তাদের পাশে বিনি পয়সায় বাইবেল বিলি করছে শ্বেতাঙ্গ যুবক। রোল-চাউমিনের দোকান থেকে খুশবু আসছে, জুতো পালিশওয়ালারা ‘পালিশ-পালিশ’ করে চেঁচাচ্ছে, অশোকা বার থেকে বেরনো মাতাল যুবক তাই শুনে বলল, ‘মালিশ? কে করবে?’
কুড়ি পা হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ব দর্শন হয়ে যায় বৃন্দার। জওহরলাল নেহরু রোডের ট্রাফিক জ্যাম টপকে, মেট্রো চ্যানেলে নবযুগ পার্টির ‘জমি অধিগ্রহণ বিরোধী অবস্থান সমাবেশ’ টপকে সে পাতাল-প্রবেশ করে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অঞ্জলি এলা মেননের আঁকা মস্ত বড় ছবিটার দিকে চোখ যায়। অঞ্জলির আঁকা রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের পেইন্টিং-টা বৃন্দার খুব পছন্দের। যখনই দেখে, নতুন নতুন ইমেজ খুঁজে পায়। ঠিক করে একদিন এইটার একটা ফোটো তুলতে হবে। এখানে ক্যামেরা অ্যালাওড নয়। তবে লুকিয়ে একটা ছবি তোলাই যায়। পুলিশগুলো বুঝতে পারবে না।
ট্রেন আসার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে বৃন্দা। ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে ওঠে। কামরায় বেশ ভিড়। বসার জায়গা নেই। রবীন্দ্র সরোবরে যখন নামল, পৌনে আটটা বাজে। লেকের দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। বৃন্দা অনুভব করল, খুব ক্লান্ত লাগছে। কয়েকদিন টানা রাত জাগা, আজ অবেলায় ভরপেট খাওয়া দাওয়া, সব মিলিয়ে শরীর বশে নেই। বাড়ি ঢুকে বাথটবে এক ঘণ্টা শুয়ে থাকতে হবে।
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার মুখে। এখনও শান্তিধামে এক গাদা গাড়ি আর ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দাঁড়িয়ে রয়েছে নার্সিংহোমে ভরতি রোগীদের বাড়ির লোক। সুলতান বৃন্দাকে একগাল হেসে বলল, ‘পরিকছা খতম?’
বৃন্দা বলল, ‘হ্যাঁ, সুলতানচাচু।’
সুলতানকে বৃন্দা ‘চাচু’ বলে ডাকে। বিহারের বাসিন্দা সুলতান যাদবের বাংলায় অল্প হলেও হিন্দির টান আছে। সে শান্তিধামের দারোয়ান কাম গাড়ির ড্রাইভার কাম সিকিয়োরিটি। তার লাইসেন্সড আগ্নেয়াস্ত্র আছে। সুলতান দু’মাসে একবার বালিয়ায় নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যায়। বাকি সময়টা শান্তিধামেই থাকে। লম্বা-চওড়া, মোচওয়ালা, মাঝবয়সি মানুষটা বৃন্দাকে খুব ভালোবাসে। মাঝেমধ্যেই রাবড়ি, শোনপাপড়ি, গুলাবি রেউড়ি বা পেঠা খাওয়ায়।
লিফটে উঠতে গিয়ে বৃন্দা খেয়াল করল তাপসী আর কুনাল রুগির বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলছে। স্যামি পাশে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখছেন। তাঁর মুখে হাসিহাসি ভাব।
চারতলায় বসার ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মন্দিরা দৌড়ে এলেন। তাঁর হাতে টেলিফোন। উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি বৃন্দাকে বললেন, ‘এক্ষুনি খবরটা পেলাম। বিপিনদা অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পেয়েছেন।’
‘কে বলল? বাবা?’ ন্যাপস্যাক সোফায় ফেলে রিমোট টিপে ঘরের তাপমাত্রা কমায় বৃন্দা।
‘তোর বাবা বলার লোক নয়। বিপিনদাই ফোন করেছিল।’
‘কোন বইটার জন্য পেল?’
‘সেটা গত বইমেলায় বেরোল। বিধবাপুকুর।’
‘বিপিন দত্ত অ্যাকাডেমি পেয়েছে, তাতে তোমার এত আনন্দের কী আছে?’
‘তোরা বুঝবি না রে,’ নিজের উচ্ছ্বাসে লাগাম পরিয়ে সংযত হয়ে বলে মন্দিরা। ‘আমরা গ্রন্থ-প্রজন্মের লোক। লেখকরা আমাদের কাছে সেলিব্রিটি। তোদের কাছে রণবীর কপুর বা সলমান খান যা, আমাদের কাছে বিপিন দত্ত বা সুদিন চক্রবর্তী তাই। এই সব লোক তোর বাবার বন্ধু—এটা ভেবে গর্ব হয়।’
‘আমি চান করব। তারপর ওই বইটা পড়ব। বার করে রেখো তো।’ মন্দিরাকে হুকুম করে নিজের ঘরে ঢুকে যায় বৃন্দা। বাথরুমে গিয়ে বাথটবের কল খোলে। ঝুনুর মা এর মধ্যে এক গ্লাস লেবু চিনির সরবত নিয়ে এসেছে। বৃন্দা বলল, ‘ওটা বাথরুমেই রাখো। একটু পরে খাব।’
কাপড় জামা খুলে বাথটাবে নামে বৃন্দা। বাথ সল্ট আর শাওয়ার জেল দিয়ে যথেষ্ট ফেনা করা হয়েছে। এখন এই জলের মধ্যে সে অন্তত এক ঘণ্টা বসে থাকবে। শ্যাম্পু আর কন্ডিশনার বাথটবে বসেই লাগাবে।
জলে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বৃন্দা। আহ! কী শান্তি! শরীর আর মন একসঙ্গে শিথিল হয়ে আসে। এতদিন একটানা ঘাড় গুঁজে পড়াশুনো করার জন্য ঘাড়ে, রগে, চোখের পিছনে, কোমরে-ঘ্যানঘেনে এক ব্যথাগাছ বড় হচ্ছিল। বাথটবের ঈষদুষ্ণ জল তাকে শেকড় থেকে উপড়ে দেয়। ড্যাডি-জ গার্ল বৃন্দা নিজের মাথা থেকে কলেজকে সরিয়ে শান্তিধামে ফোকাস করে। লোনলি ওয়াইফ বিপিনের অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পাওয়ার এত উচ্ছ্বসিত কেন? এ কি শুধু সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ? নাকি সাহিত্যিকের প্রতিও? বৃন্দা ঠিক করে স্নান সেরে আজ সে কনট্রোল ফ্রিক-এর চেম্বারে আড়ি পাতবে। থ্রি উইচেস আর কনট্রোল ফ্রিক কী নিয়ে আড্ডা মারে এটা শোনা জরুরি।
উলটোপালটা ভাবতে ভাবতে কত সময় বাথটাবে কাটিয়ে দিয়েছে বৃন্দা, কে জানে! ঝুনুর মায়ের হাঁকডাকে হুঁশ ফিরল। উওম্যান ফ্রাইডের ধমক খেয়ে মনে পড়ল, সুপ্রভাতের কথা। অনেকদিন ঝুনুর সঙ্গে মোলাকাত হয়নি। রাত দুটোয় ঘুমোতে গেলে ভোরবেলা ওঠা সম্ভব নয়।
প্রথমদিন যখন ভোরবেলায় ঝুনুকে দেখেছিল বৃন্দা, তখন এক স্নিগ্ধ অনুভবে ভরে গিয়েছিল মন। সেই অনুভব আজ আর নেই। কদিন ধরে মাথায় ঘুরছে অন্য একটা ছেলের মুখ। মফসসলি, মাঝারি চেহারার একটা ছেলে। পড়াশুনোয় অর্ডিনারি, চেহারায় সাদামাঠা, মধ্যবিত্ত তরুণ। কোনও বৈশিষ্ট নেই। সেই জন্যই ছেলেটাকে মনে ধরেছে বৃন্দার। তার চারপাশে সবাই বিশিষ্ট। সবাই ভিআইপি। সবাই বিখ্যাত। বাবা কলকাতার এক নম্বর সার্জন, মা নামী অভিনেত্রী, বাবার বন্ধুরা বাংলার এক নম্বর কবি, এক নম্বর চলচ্চিত্রকার, এক নম্বর ঔপন্যাসিক। আর সে নিজে? এই মুহূর্তে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের অফিসিয়াল সুন্দরী শ্রেষ্ঠা।
এত স্পটলাইট, এত খ্যাতির বৃত্ত বৃন্দার অসহ্য লাগে। মনের মধ্যে সবসময় পালাই পালাই ভাব হয়। জীবনটা সর্বক্ষণ রেড কার্পেট সেরিমনি। এর মধ্যে কোথাও জীবন যাপনের বিরতি নেই। ওই ক্যাবলা ছেলেটার পাশে থাকলে নিজেকে স্বাভাবিক মনে হয় বৃন্দার। মনে হয় বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে গেল!
ছেলেটাকে অল্পস্বল্প ইঙ্গিত দিচ্ছে বৃন্দা। ছেলেটা কিছু বুঝতে পারছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। আনস্মার্ট তো, বেশি ইঙ্গিত দিলে ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে যাবে। তার থেকে এই ভালো। ‘ধীরে চলো’ নীতির পক্ষে মনে মনে সওয়াল করে বাথটাব ছাড়ে বৃন্দা। শরীর এখন ঝরঝরে লাগছে। আনাচে কানাচে যত ব্যথা বেদনা ছিল, সব উধাও। গা-মাথা মুছে, লিনেনের পোশাক গলিয়ে বাথরুম থেকে বেরোয় সে। বাকিরা কোথায় তদন্ত করা যাক।
মন্দিরা টিভির সামনে বসে রয়েছেন। স্কুপ চ্যানেলে একটা ইন্টারভিউ দেখাচ্ছে। উইকেন্ড পত্রিকার সাংবাদিক শক্তিরূপা সেনগুপ্ত ইন্টারভিউ নিচ্ছেন ঔপন্যাসিক বিপিন দত্তর। বিকেলে রেকর্ড করা অনুষ্ঠান, এখন রিপিট টেলিকাস্ট হচ্ছে। তলায় স্ক্রল যাচ্ছে, ‘এখন কেউ ফোন করবেন না। এই অনুষ্ঠান পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে।’
উইকেন্ড পত্রিকাটি শান্তিধামে ঢোকে। সিরিয়াস লেখা, লিজার অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট, ফ্যাশন, লাইফ স্টাইল, কমিকস, ওয়ার্ড গেম, নাম্বার গেম মিলে চমৎকার ফ্যামিলি ম্যাগাজিন। আম আদমির জন্য নানান মশলা থাকে। সিরিয়াস রিডারের জন্য একটি প্রবন্ধ, একটি ইন্টারভিউ ও একটি ধারাবাহিক আত্মজীবনী। বিপিনের সাক্ষাৎকারটি আগামী সংখ্যায় যাবে, আন্দাজ করল বৃন্দা।
শক্তিরূপা প্রশ্ন করছে, ‘বিধবাপুকুরের আজকের দিনে কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে? বিধবাবিবাহ আইন প্রচলিত হওয়ার পরে, পুকুরে ডুবে বিধবাদের আত্মহত্যার ঘটনা এখন আর ঘটে না।’
‘দ্য মোর থিংস চেঞ্জ, দ্য মোর দে রিমেন দ্য সেম। বিধবাপুকুরের উপন্যাসে দুটি প্রসঙ্গ আছে। একটি হল নারী শরীরের ওপরে পুরুষের দখলদারি। অন্যটি হল জমির ওপরে পুরুষের দখলদারি। দুটি বিষয় উপন্যাসের শেষে মিলে যাচ্ছে। গোরু ও জোরু, কামিনী ও কাঞ্চন, নারী ও নগরী—পিতৃতন্ত্র এদের আলাদা করে না। লিঙ্গ হোক বা লাঙল—যে কোনও কিছুর মাধ্যমে দখল নিতে চায়। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে দখলদারির ধরন বদলেছে। অতীতে জমিদারের লেঠেলবাহিনী জমির দখল নিত। আজ নেয় বহুজাতিক সংস্থা। দালালি খায় সরকার। অতীতে জমিদার পঞ্চদশী মেয়ের দখল নিত। দালালি খেত মেয়ের গরিব বাবা। আজ অর্গ্যানাইজড ইন্ডাসট্রি নারী শরীরকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করে। বাবা-মা উৎসাহভরে মেয়েকে বিকিনি শ্যুটে পাঠায়।’
‘শেষ উদাহরণটা আমার উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে না।’ বিপিনকে থামায় শক্তিরূপা।
‘আমি জানতাম যে আপনার পছন্দ হবে না। কেন না আমার যুক্তিক্রম মানলে আপনার ম্যাগাজিনও এই ধর্ষক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। যারা প্রতি ইস্যুর মলাটে হার্ড নিউজের ছবির পাশাপাশি অর্ধনগ্ন মেয়ের ছবি ছাপে। যারা ফিল গুড ফ্যাক্টর-ওয়ালা স্টোরি ছাড়া কভার স্টোরি করে না। সত্যিকারের খবর আসে পার্শ্ব রচনা হিসেবে।’
‘আমরা বিষয়ান্তরে চলে যাচ্ছি।’ তড়িঘড়ি ইন্টারভিউয়ের রাশ টানে শক্তিরূপা।
‘ছেড়ে দিন,’ হাত নেড়ে মাছি তাড়ায় বিপিন, ‘আসুন আমরা সেফ বিষয় নিয়ে কথা বলি। জীবন বীক্ষা, শিল্পীর অধিকার, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ…’
চাপান উতোর চলছে। মন্দিরা খুব মন দিয়ে শুনছেন। তাঁকে কিছু না বলে, হাউসকোট চাপিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে বৃন্দা। তার গন্তব্য একতলায় স্যামির চেম্বার।
তিনতলায় দেখা হয়ে গেল তাপসী আর কুনালের সঙ্গে। আজ শনিবার। কুনাল বাড়ি যাচ্ছে। তাপসী তার হাতে এক কৌটো গয়না বড়ি তুলে দিয়ে বলল, ‘গিন্নিকে বলবে আমি পাঠিয়েছি। আমাদের গ্রামে বানানো।’
‘গিন্নি গয়নার জন্য দাঁত খিঁচোয়। গয়না বড়ি দেখলে ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে আসবে।’ হাসতে হাসতে বলে কুনাল। বৃন্দাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে বলে, ‘এত রাতে কোথায় পালাচ্ছিস? বয়ফ্রেন্ড এসেছে নাকি?’
‘এলে তো ভালোই হতো!’ মুখভঙ্গি করে বৃন্দা। ‘আগে জোটাই একটা। তারপর ঠিক পালাব।’
কুনাল আর বৃন্দার মশকরার মাঝে তাপসী বলে, ‘তুমি চন্দন সরকারকে চেনো?’
‘হ্যাঁ। আমার ক্লাসমেট। তুমি ওকে কী করে চিনলে?’ অবাক হয়ে বলে বৃন্দা।
‘ও আমার গ্রামের ছেলে। আমার দাদা যে ইশকুলের হেড মাস্টার, ও সেই ইশকুলে পড়াশুনো করেছে। আমি ওর দিদির মতো।’
‘তোমার বাড়ি নতুনগ্রামে?’
‘হ্যাঁ। তুমি আমার গ্রামের নাম কী করে জানলে?’
‘চন্দন উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছিল। ওর গ্রামের নাম, ওর স্যামিলটন স্কুলের নাম আমাদের কলেজের সবাই জানে। আমি আর চন্দন ভালো বন্ধু।’
‘চন্দন বলছিল।’ হাসে তাপসী। হঠাৎ কণ্ঠস্বর বদলে ফেলে কড়া গলায় বলে, ‘তুমি কি বাবার চেম্বারে যাচ্ছ? ওখানে এখন ওঁর বন্ধুবান্ধব এসেছেন।’
‘জানি।’ তাপসীকে পাত্তা না দিয়ে একতলার নামে বৃন্দা। স্যামির চেম্বারের পিছন দিকে একটা অ্যান্টি-চেম্বার আছে। সেই ঘরে ঢুকে দেয়ালে আড়ি পাতে। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে মাতাল সুদিনের গলা, ‘আমি অ্যাকাডেমির কমিটি মেম্বারদের পায়ে নিয়মিত তেল মাখাতাম না। তাই আমি পাইনি। তুই মাখাতিস, তাই পেয়েছিস।’
বিপিনের গলা শোনা যায়, ‘আমি অ্যাকাডেমি প্রাইজ পাওয়ায় তুই কি ঈর্ষান্বিত? তা হলে অটোর পিছন দিকে যেটা লেখা থাকে সেটা ফলো কর। ”হিংসা কোরো না। চেষ্টা করো। তোমারও হবে”।’
‘ওরে আমার অটোওয়ালা রে!’ খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসেন সুদিন। ‘এবার বলবি, ‘বন্ধুত্ব বাড়িতে, ব্যবসা গাড়িতে’। কিংবা ‘৮০ বন্ধু। আবার দেখা হবে’।
‘আসি বন্ধুগণ। আবার দেখা হবে।’ মনোতোষের গলা শোনা যায়। ‘আজ এখানকার পরিবেশ দূষিত হয়ে গেছে। না থাকাই মঙ্গল।’
‘দূষিত হলে সেটা বিপিনের জন্য হয়েছে। সারাটা জীবন বিগ হাউসের দালালি করে গেল আর জনগণের কাছে নিজেকে অ্যান্টি-এস্ট্যাবলিশমেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে বিককিরি করল। হিপোক্রিট কাঁহিকা।’
‘হিংসে হিংসে!’ চেঁচিয়ে ওঠেন বিপিন, ‘দ্যাখ স্যামি, ওর কানগুলো সবুজ হয়ে গেছে।’
‘ইস্যুটা ডাইলিউট করিস না। দিস ইজ সিরিয়াস। জলের মতো গদ্য লিখে লিখে ইন্টেলিজেন্সটাকেও জলে ভাসিয়ে দিয়েছিস।’
‘আহ! সুদিন।’ স্যামির জড়ানো কণ্ঠস্বর এতক্ষণে শুনতে পেল বৃন্দা।
‘তুই আগামী শতকের তরুণ-তরুণীদের জন্য কবিতা লিখছিস, তাই লেখ। এখনকার জেনারেশন তোকে বুঝবে না।’ হাসতে হাসতে বলেন বিপিন, ‘তুই পস্টারিটির সাধনা করিস। তোর অমরত্ব চাই। আমার বাবা ওসব হ্যাং-আপ নেই। আমি নাস্তিক মানুষ। পরজন্মে বিশ্বাস করি না। আনন্দ, ফুর্তি, প্রশংসা, পুরষ্কার, রয়্যালটির টাকা—সব এই জন্মেই চাই।’
‘আমি তোর বই থেকে ছবিটা করলে, তোকে দিয়ে স্ক্রিপ্ট লেখাব। বলা যায় না, ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেতে পারিস।’ ফুট কাটে মনোতোষ।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। স্যামির বউকে না লাগালে তোর শান্তি নেই। এ আমি অনেক দিন থেকে জানি।’ চিৎকার করে ওঠেন সুদিন।
ঠাস করে চড় মারার শব্দ হল। শব্দ হয় গ্লাস ভাঙার। হাতাহাতি আর অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনে এক দৌড়ে লিফটে উঠে পড়ে বৃন্দা।
বাংলার বুদ্ধিজীবী! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃন্দা ভাবে, এঁদের ছবি কাগজের ফ্রন্ট পেজে প্রকাশিত হয়। টিভিতে এঁরা ইন্টারভিউ দেন। এঁদের নিয়ে লোকে গর্ববোধ করে। হায় রে! এঁদের থেকে সাধারণ মানুষ অনেক ভালো আছে। তারা বাজার যায়, রান্না করে, আপিস যায়, আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে শান্তিতে ঘুমোয়। মাইল মাইল লম্বা প্যাঁচ মাথার মধ্যে পুরে ঘুরে বেড়ায় না।
মফসসলি, পড়াশুনোয় মাঝারি, সাধারণ চেহারার অভির কথা মনে পড়ে যায় বৃন্দার। ওকে কাল একবার ফোন করতে হবে।