(৪)
পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে যে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপলব্ধিটির মধ্যে ব্রহ্মের জ্যোতিরূপ এবং জগতের আনন্দরূপ এই দুইটি বিশেষ দর্শন পরিলক্ষিত হয়। এই দুইটি দর্শনের তেমনি দুইটি গভীর প্রভাবও তাঁহার পরবর্তী সমগ্র জীবনে প্রতিফলিত হইয়াছে—একটি তাঁহার ব্যক্তিগত জীবনে, অপরটি তাঁহার সাহিত্য-সাধনায়।
প্রথম প্রভাবটির ফলে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনে সূর্য একটি বিশেষ স্থান গ্রহণ করিয়াছে। একদিন উদয়-আকাশে প্রভাতসূর্যের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ তাঁহারও হৃদয়-আকাশের আবরণ অপসারিত হইয়াছিল, দেখা দিয়াছিল সে-আকাশে ব্রহ্মজ্যোতি। এই কারণেই সূর্য এবং ব্রহ্মের প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে চিরকালের জন্য অচ্ছেদ্য বন্ধনে যোগযুক্ত, তাই সবিতা রবীন্দ্রনাথের নিকট ব্রহ্মদূতী।
যে-বিগ্রহ বা মন্ত্রের মাধ্যমে ইষ্টের সঙ্গে সাধকের মিলন ঘটে, সিদ্ধাবস্থাতেও সেই বিগ্রহ বা মন্ত্র সাধকের আরাধ্যরূপেই থাকে। এই কারণেই দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ নিজেকে বারম্বার বলিয়াছেন—সূর্যপূজারী, সূর্যোপাসক।
বস্তুত সৃষ্টজগতে সূর্যই একমাত্র ব্রহ্মের যথার্থ প্রতীকরূপে ঋষিসমাজে উপাসিত ও বন্দিত হইয়াছে। পৃথিবীতে সর্ববস্তুই আপন প্রকাশের জন্য সূর্যের আলোর অপেক্ষা করে, কিন্তু সূর্য স্বয়ং দূষ্পাঠ্য সঙ্গে জগতকেও প্রকাশ করিয়া থাকে। ব্রহ্মের স্বয়ম্প্রকাশ এই দূষ্পাঠ্য একমাত্র সূর্যই ধারণ ও বহন করিতেছে। কাজেই ব্রহ্মবাদী ঋষিদের নিকট সূর্য ব্রহ্মের প্রতীকরূপে উপাস্য ও পূজিত। রবীন্দ্রনাথও গোত্রে ও ধর্মে সেই ঋষি; কাজেই কোন মূর্তি বিগ্রহ মন্ত্র ইত্যাদির পরিবর্তে সূর্যই যে ব্রহ্মের দূতরূপে তাঁহার জীবনে অবির্ভূত হইবে, ইহা আদৌ আকস্মিক নহে, ইহাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত।
রবীন্দ্রনাথ বহুবার বলিয়াছেন যে, প্রত্যহ প্রভাতসূর্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁহার করা চাই-ই এবং যেদিন সূর্যের দেখা না পান, সেদিন দিনটাই তাঁহার ব্যর্থ ও নষ্ট হইয়া গিয়াছে বলিয়া তিনি মনে করিতেন। এই কারণেই কখনো কোথাও গেলে আবাসস্থানে পূর্বদিকের ঘরই তিনি বাছিয়া নিতেন, যেন প্রভাতে উঠিয়াই প্রিয়তমের জ্যোতির্ময়ী আকাশদূতীকে তিনি সময়মত অভ্যর্থনা করিতে পারেন। ইহাই ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রাত্যহিক এবং একমাত্র উপাসনা। পৃথিবীর সকল কবি বা সাধক একত্র মিলিয়াও রবীন্দ্রনাথের ন্যায় এত সূর্যবন্দনা করেন নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে সূর্য কি স্থান গ্রহণ করিয়াছে, তাহার একটু বিবরণ বা দৃষ্টান্ত দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। তাঁহার সূর্যোপসনার আরম্ভ তিনি এইভাবে করিয়াছেন—
প্রতিদিন যে পৃথিবী
প্রথম সৃষ্টির অক্লান্ত নির্মল দেববেশে দেয় দেখা,
আমি তার উম্মীলিত আলোকে অনুসরণ ক’রে
অন্বেষণ করি আপন অন্তরলোক॥
ইহার পরেই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বৈদিক ঋষির মত প্রার্থনা-মন্ত্র ধ্বনিত হইয়াছে—
আমিও প্রতিদিন উদয়দিগ্বলয় থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মিচ্ছটায়
প্রসারিত ক’রে দিই আমার জাগরণ,
বলি,—হে পূষণ,
তোমার হিরণ্ময় পাত্রে সত্যের মুখে আচ্ছন্ন,
উন্মুক্ত কর সেই আবরণ।
বলি,—হে সবিতা,
সরিয়ে দাও আমার এই দেহ, এই আচ্ছাদন,—
তোমার তেজোময় অঙ্গের সূক্ষ্ম অগ্নিকণায়
রচিত যে আমার দেহের অণুপরমাণু,
তারো অলক্ষ্য অন্তরে আছে তোমার কল্যাণতম রূপ,
তাই প্রকাশিত হোক আমার নিরাবিল দৃষ্টিতে
আমার অন্তরতম সত্য॥
অন্য একটি সূর্য স্তবে তিনি বলিয়াছেন—
“হে সবিতা তোমার কল্যাণতম রূপ
করো অপাবৃত,
সেই দিব্য আবির্ভাবে
হেরি আমি আপন আত্মারে
মৃত্যুর অতীত!”
প্রথম উপলব্ধিটির প্রথম প্রভাবের ফলে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত জীবনে সূর্যপূজারী বা সূর্যোপাসক। এই প্রভাবটির ফলেই তাঁহার নিজস্ব সাধনার ধারা বা পথটি উন্মুক্ত হইয়াছে—সে সাধনা হইল সূর্য-সাধনা।
অতঃপর রবীন্দ্রনাথের এই প্রথম উপলব্ধিটির দ্বিতীয় প্রভাবটির সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাইতেছে। প্রথম প্রভাব ব্যক্তিগত জীবনে, সেখানে তিনি সূর্য পূজারী; দ্বিতীয় প্রভাব তাঁহার সাহিত্য-জীবনে, সেখানে তিনি আনন্দের উপাসক।
প্রথম উপলব্ধিতে রবীন্দ্রনাথের নিকট জগতের আনন্দরূপ উদ্ঘাটিত হইয়াছিল, ইহার ফলে তাঁহার সাহিত্য-সাধনায় কখনো নিছক রূপসৃষ্টিকে রসসৃষ্টিকে তিনি লক্ষ্য বা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করিতে পারেন নাই। তাঁহার সাহিত্য-সাধনায় যে রূপের সাধনা দেখা যায়, তাহা আনন্দ-সাধনা, আর এই ‘আনন্দই ব্রহ্মের রূপ’ উপনিষদ বলেন। তাই তিনি সাহিত্যে যে রসসৃষ্টির সাধনা করিয়াছেন, তাহা আনন্দময়ের ‘রসো বৈ সঃ’-এর সাধনা।
এই প্রথম উপলব্ধিটি সম্বন্ধে তিনি নিজেই তাই এই প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, “এই আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা, যাকে আধ্যাত্মিক নাম দেওয়া যেতে পারে।……তখন স্পষ্ট দেখেছি, জগতের তুচ্ছতার আবরণ খসে গিয়ে সত্য অপরূপ সৌন্দর্যে দেখা দিয়েছে। সমস্ত বিশ্বের আনন্দরূপকে একদিন বাল্যাবস্থায় সুস্পষ্ট দেখেছিলুম, সেই জন্যেই ‘আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি’ উপনিষদের এই বাণী আমার মুখে বার বার ধ্বনিত হয়েছে। সেদিন দেখেছিলুম, বিশ্ব স্থূল নয়, বিশ্বে এমন কোন বস্তু নেই, যার মধ্যে রসস্পর্শ নেই। যা প্রত্যক্ষ দেখেছি তা নিয়ে তর্ক কেন? স্থূল আবরণের মৃত্যু আছে, অন্তরতম আনন্দময় যে সত্তা, তার মৃত্যু নেই।”
এই প্রথম অভিজ্ঞতাটিই তাঁহার কবি-জীবন বা সাহিত্য-সাধনায় নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ। এই জীবনধারা কোন পরিণতি গ্রহণ করিয়াছে, তাঁহার সাহিত্যক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথের নিজের আত্মপরিচয় হইতেই তাহা শোনানো যাইতেছে। তিনি বলিয়াছেন—
“এই সত্তর বৎসর নানাপথ আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, আজ আমার আর সংশয় নেই, আমি চঞ্চলের লীলাসহচর।…… আমি তত্ত্বজ্ঞানী শাস্ত্রজ্ঞানী গুরু বা নেতা নই,……শুভ্র নিরঞ্জনের যাঁরা দূত তাঁরা পৃথিবীর পাপক্ষালন করেন, মানবকে নির্মল নিরাময় কল্যাণব্রতে প্রবর্তিত করেন, তাঁরা আমার পূজ্য; তাঁদের আসনের কাছে আমার আসন পড়েনি। কিন্তু সেই এক শুভ্রজ্যোতি যখন বহু বিচিত্র হন, তখন তিনি নানা বর্ণের আলোকরশ্মিতে আপনাকে বিচ্ছুরিত করেন, বিশ্বকে রঞ্জিত করেন, আমি সেই বিচিত্রের দূত।…… তাঁর খেলাঘরের যদি কিছু খেলনা জুগিয়ে দিয়ে থাকি, মাটির ভাঁড়ে যদি কিছু আনন্দরস জুগিয়ে থাকি, সেই যথেষ্ট। এই ধূলো-মাটি-ঘাসের মধ্যে আমি হৃদয় ঢেলে দিয়ে গেলাম বনস্পতি ঔষধির মধ্যে। যারা মাটির কোলের কাছে আছে, যারা মাটিতে হাঁটতে আরম্ভ করে শেষকালে মাটিতেই বিশ্রাম করে, তাদের সকলের বন্ধু আমি, আমি কবি।”
এই কবিই মাটিকে তাঁহার কবিজীবনের শেষ প্রণাম জানাইয়া গিয়াছেন—
“সত্যের আনন্দরূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মূরতি
এই জেনে এ ধূলায় রাখিনু প্রণতি!”