অদ্বৈত মল্লবর্মণ

তিতাস একটি নদীর নাম

রাঙা নাও

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

এমনি সময়ে পাশেই একখানা নৌকা ভিড়িয়াছে, তার মধ্যে একজন স্ত্রীলোককে আরেকজন স্ত্রীলোক এই বলিয়া প্রবোধ দিতেছে, ‘চিন্তা কইরা শরীর কালা কইর না দিদি। গাঙের বুকে কত লোক কত গান গাইয়া যায়, গাঙে কি তার রেখ থাকে?’

এমন সময় অনন্ত ফিসফিস্ করিয়া অনন্তবালার কানের কাছে বলিল, ‘মাসী।’

অনন্তবালার চোখ কৌতুহলে বড় হইয়া উঠিল। অনন্তর দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া সে তার ঐতিহাসিক মাসীকে দেখিল।

বিধবা নারী। এখনও তরুণীর পর্যায়েই দাঁড়াইয়া আছে, কিন্তু শরীরের লাবণ্য ধুইয়া গিয়াছে। মুখখন সুন্দর, কিন্তু মলিন। দেখিলে মায়া লাগে।

‘এই মাসীই তোমারে তাড়াইয়া দিল।’

‘দিল ত!’

মাসী ডাকে আকৃষ্ট হইয়া সুবলার-বউ চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, তারপর সহসা উদাম হইয়া বলিয়া উঠিল, অনন্ত! আমার অনন্ত!

দুই নৌকার বাত লাগানো ছিল। লাফাইয়া সে এ নৌকাতে আসিয়া উঠিল এবং অনন্তর দিকে দুই হাত বাড়াইয়া দিল। মাসী মাসী বলিয়া অনন্তও হাত বাড়াইল। দেখিল, মাসীর তুই চোখে অশ্রুর বন্যা বহিয়াছে। তাহার নিজের চোখেও জলে ভরিয়া উঠিল।

এমন সময় উদয়তারা পাষাণের মূর্তির মত নিবাত-নিষ্কম্প ভাবে আগাইয়া আসিল।

তার দিকে মন না দিয়া মাসী অনন্তকে আরও জোরে বুকে চাপিয়া ধরিল, তারপর তার পিঠে হাত বুলাইতে বুলাইতে, রুদ্ধ গলা কোন রকমে পরিষ্কার করিয়া বলিল, এতদিন তুই কোথায় ছিলি।

দুই চোখ বুজিয়া সে বলিয়া চলিয়াছে, এতদিন কোথায় ছিলি, কার কাছে ছিলি, কে তোকে খাইতে দিত, কে শুইবার সময় গল্প শুনাইত, ঘুম পাড়াইত/

নির্মম নিষ্ঠুর উদয়তারার স্বর সপ্তমে চড়িল, ‘হ, যারে কুলার বাতাস দিয়া দূর কইরা দেয়, তারে কয় কে ঘুম পাড়াইত!’

অনন্তর পূর্ব-কথা স্মরণ হইল। তার মুখের শিরাগুলি, হাতের কজি দুইটি কঠিন হইয়া উঠিল। মাসীকে ছাড়িয়া দিয়া ঘাড় নিচু করিয়া বলিল, ‘মাসী আমারে তুমি ছাইড়া দেও।’

‘তুইও কি আমার পর হইয়া গেলি অনন্ত!’

—আপন তো কোন কালে নই মাসী। মার সই তুমি। মা যতদিন ছিল, তোমার কাছে আমার আদরও ততদিনই ছিল। মা মরিয়া গেলে, সে আদর একদিন হাট-বাজারের মতই ভাঙ্গিয়া পড়িল।

—ভাঙ্গিয়া পড়িল! কি করিয়া তুই বুঝিলি যে, ভাঙ্গিয়৷ পড়িল?

—যাও যাও আমি সব বুঝি। যেদিন হইতে মা গেছে, সেদিন হইতে সব গেছে। সেদিন হইতেই আমি ধরিয়া রাখিয়াছি পরবাসী বনবাসী আমি,—যে ডাকিয়া ঘরে লইবে তার ঘরই আমার ঘর, যে ঘৃণা করিয়া তাড়াইয়া দিবে, তার ঘরই আমার পর l

‘আরে বেইমান কাউয়া, এই সগল কথা তোরে কে শিখাইল, কোন বান্দিনীর ঝিয়ে শিখাইল?’

উদয়তারা এবার ফাটিয়া পড়িল, ‘আ লো বান্দিনীর ঘরের চান্দিনী। মুখ সামলাইয়া কথা ক, বুক সামলাইয়া বাড়ি যা। বেশি কথা তুলিস না, ছালার মুখ খুলিস না।’

সুবলার বউ আর সহ করিতে পারিল না। সাংঘাতিক একটা কিছু করিবার আয়োজনে সে আরও একটু আগাইয়া আসিয়া অনন্তর একখানা হাত ধরিল। অনন্তও জোর করিয়া মাসীর হাত ছাড়াইয়া উদয়তারার আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ করিয়া লইয়া বলিল, ‘তুমি আমারে আদর জানাইও না মাসী।’

মাসীর ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গিয়া গেল। অপমানে তার মাথা লুটাইয়া পড়িতে চাহিল। উদয়তারা অবিশ্রাম গালি দিয়া চলিয়াছে। সবই অনন্তর জন্য। রাগে মাসীর আপাদমস্তক জলিয়া গেল, বলিল, আদর আমি তোকে জানাইবই, তবে, মুখে নয়, হাতে।

এই বলিয়া সে অনন্তর চুলের মুঠি ধরিয়া পিঠে দুম্‌দুম্‌ করিয়া কীল মারিতে লাগিল। অনন্ত ভয়ার্ত চোখে মাসীর ক্রুদ্ধ জলস্ত চোখ দুটির দিকে চাহিয়াই চোখ নত করিল এবং তার ক্রোধের আগুনে নিজেকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়া দিল। মার খাইতে খাইতে অনন্ত পাটাতনে নেতাইয়া পড়িল। সকলে থ হইয়া দেখিতেছিল। সহসা যেন সম্বিৎ পাইয়া উদয়তারা গর্জাইয়া উঠিল এবং সিংহিনীর থাবা হইতে হরিণ-শিশুর মত অনন্তকে মাসীর কবল হইতে মুক্ত করিল। অনন্ত তখন বলির কবুতরের মত কাঁপিতেছে।

তারপর যে কাণ্ড হইল তাহা বলিবার নয়। উদয়তারা সহ নৌকার সব কয়জন স্ত্রীলোক মিলিয়া সুবলার বউকে পাটাতনে শোয়াইল, তারপর সকলে সমবেতভাবে হাতেপায়ে প্রহারের পর প্রহারের দ্বারা জর্জরিত করিতে লাগিল।

অনেক মার মারিয়া জব্দ করার পর, শেষে তাহারা ছাড়িয়া দিল। অতি কষ্টে দেহটা টানিয়া তুলিয়া সুবলার-বউ বুকের ও উরুর কাপড় ঠিক করিল এবং আলুথালু বেশে টলিতে টলিতে নিজেদের নৌকায় গিয়া উঠিল। চারিদিকের নৌকাণ্ডলি হইতে হাজার হাজার লোক তখন তাহার দিকে চাহিয়া আছে।

অপমানে, লজ্জায় সে আর মাথা তুলিতে পারিল না। সঙ্গিনীরা তাহাকে ধরিয়া বসাইলে সে পাটাতনের উপর শুইয়া ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

উদয়তারার দল বিজয়গর্বে ফুলিতে লাগিল। কিন্তু অনন্ত তখনও কাঁপিতেছে। পুরুষেরা দাঁড় টানিয়া নৌকা সরাইয়া লইতেছে। আর কোনদিন বোধ হয় দেখা হইবে না। অনন্ত ভয়েভয়ে ওদিকে ঘাড় ফিরাইল। মাসী পাঠাতনের উপর উপুড় হইয়া ফোঁপাইতেছে। সেই নৌকার পুরুষেরা হতভম্ব হইয়া পড়িয়াছিল। বলিল, থাক আর নাও-দোঁড়ানি দেখিয়া কাজ নাই। চল ফিরিয়া যাই।

তাহারা ফিরিয়া চলিল। অনেক দূরপথ। কিন্তু তাড়া নাই। অনেক বেলা আছে। নৌকা-দৌড়ের এলাকা ছাড়াইয়া খোলা জায়গায় আসিয়া তাহার হাপ ছাড়িল। দেখা গেল, এত দেরী করিয়াও একখান নৌকা দৌড়ের এলাকার দিকে যাইতেছে। যাইতেছে আর সারি গাহিতেছে — সকলের সকলি আছে আমার নাই গো কেউ। আমার অন্তরে গরজি উঠে সমুদ্দুরের ঢেউ। নদীর কিনারে গেলাম পার হইবার আশে। নাও আছে কাণ্ডারী নাই শুধু ডিঙ্গা ভাসে।