অদ্বৈত মল্লবর্মণ

তিতাস একটি নদীর নাম

রাঙা নাও

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ইহাদের নামে কেউ কোন দিন মামলা করে নাই। এরাও কোন দিন কারো নামে নালিশ করে নাই। তাই এই দুঃসংবাদে সারা পরিবারে একটা বিষাদের ছায়া পড়িল। চিন্তান্বিত মুখে সকলে কাদির মিয়াকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। একটা ঝানু মামলাবাজ অতিথি যে ঘরের কোণে আত্মগোপন করিয়া আছে সে কথা কেউ জানিল না, যা ও বা খুশী জানিত, সেও ভুলিয়া গেল। কিন্তু মামলার নাম শুনিলে আত্মগোপন করিয়া থাকিবার লোক সে নয়। কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া সকলের মাঝখানে ঝাঁপাইয়া পড়িল।

‘কোন তারিখে, কার কোর্টে নালিশ লাগাইয়াছে কও!’

কাদির চমকাইয়া উঠিল; ‘কেড তুমি?’

‘আমি নিজামত মুহুরী, বেয়াই!’

‘বেয়াই! আমি মনে করছিলাম, বুঝি বউরূপী।’

‘যা তুমি মনে কর। এই জীবনে কত বউরূপীরে নাচাইলাম। শেষে তোমার কাছে নিজে বউরূপী সাজতে হইল।’

‘কও কি তুমি?’

‘ঠিক কথাই কই। দুই একটা মামলাটামলা ত করল না। কি কইরা জানবা মুহুরীর কত মুরাদ। ঘুড়িরে দেই আসমানে তুইল্যা, লাটাই রাখি হাতে। যতই উড়ে যতই পড়ে, আমার হাতেই সব। জজ-মাজিষ্টর ত ডালপালা। গোড়া থাকে এই মুহুরীর হাতে। কি নাম কইলা উজানচরের মাগন সরকার না? কোন চিন্তা কইর না। দুই চারটা সাক্ষীসাবুদ যোগাড় কইরা রাখ, মামলা তোমারে জিতাইয়া দেমু, কইয়া রাখলাম।’

ছাদিরও সমর্থন করিল, ‘বা’জান তুমি ডরাইও না। হউরে যখন সাহস দেয়, তখন জিত হইবই বা’জান।’

কাদিরের মুখে শিরাগুলি কঠিন হইয়া উঠিল।

‘বেয়াই তোমার কোন ডর নাই। দেখ আমি কি করতে পারি। একবার দেখ—মিছা মামলা লাগাইছে, আমিও মিছা সাক্ষী লাগামু। মামলা নষ্ট ত করুমই, তার উপর তার নামে, লোক লাগাইয়া গরুচুরি করার, না হইলে খামারের ধান চুরি করার পালটা মামলা লাগামু তবে ছাড়ুম। তুমি কিছু কইর না, খালি খাড়া হইয়া দেখ—’

কাদিরের মুখ আরও কঠিন হইয়া উঠিল।

ছাদির শেষ চেষ্টা করিল, ‘বা’জান-—’

‘না না, তারে আমি ডরাই না।’

‘তবে চল আমার সাথে। দেখি, কই কি করছে। মামলার গোড়া কাটা যায় কিনা। চল কাইল সকালে।’

‘হ, কাইল সকালেই যামু। কিন্তুক তোমার সাথে যামু না, আর তোমার আই আদালতেও যামু না। আমি একবার যামু তারই কাছে।’

‘তার কাছে গিয়া কি করবা?’

‘তার চোখে চোখ রাইখ্যা জিগামু—তার ইমানের কাছে জিগামু, আমার বাড়ির গোপাট দিয়া যাইবার সময় তারে বিনাখতে টাকা দিছি—সেই-কথাটা তার মনে আছে কি না।’

‘যদি কয় মনে নাই?’

‘পারব না। মুহুরী পারব না। আমার এই চোখের ভিতর দিয়া আল্লার গজব তারে পোড়াইয়া খাক করব। কি সাধ্য আছে তার, এই রকম দিনে ডাকাতি, হাওরে ডাকাতি করব?’

ছেলে হতাশ হইয়া বলিল, ‘বা’জান, তুমি বড় কাঁচা কাম কর।’

ততোধিক হতাশ হইয়া মুহুরী বলিল, ‘পাড়াগাওয়ে থাক, পাড়াগাইয়া বুঝ্‌ তোমার। তোমারে খামকা উপদেশ দিয়া লাভ নাই। তোমারে কওয়া যা, ধান ক্ষেতে গিয়া কওনঅ তাই। থাক গরুর সাথে মাঠে, গরুর বুদ্ধিই তো হইব তোমার।’

এভাবে বুদ্ধির খোঁটা দেওয়ায় পিতাপুত্র দুজনেই চটিল।

‘আমার কাছে কত লোক যায় মামলা মোকদ্দমার পরামর্শ লইতে। তুমি শালা কোন দিন কি গেছলা? অত জমিজমা ক্ষেত পাখর তোমার। জীবনে দুইদশটা মামলা করলা না, কিসের তুমি কুঠিয়াল? পুঁটি মাছের পরাণ তোমার। মামলার নামে কাঁইপ্যা উঠ। নইলে দেখতা, মাগন সরকারেরে কি ভাবে আমি কাইত করি?’

একটু অহেতুক বচসার সৃষ্টি হইল। মুহুরী রাগিয়াই আসিয়াছিল। মুহুরী নামক জীবকে দুইচক্ষে দেখিতে পারে না, কাদির এ কথা স্পষ্ট ভাবে জানাইয়া দেওয়াতে তার আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লাগিল। বলিল, ‘থাকি আমি ভদ্রলোকের গাঁওয়ে, চলি আমি বাবু ভুইয়ার সাথে। কারো কাছে কি কই যে, আমি সম্বন্ধ করছি তোমার মত চাষার সাথে?’

‘গরীবের বাড়িতে হাতীর পাড়া পড়ক, এও আমারা চাই না বা’জি।’ বাপের হইয়া জবাব দিল ছাদির।

বাপ তার এভাবে বসিয়া অপমানিত হইয়াছে, দেখিয়া খুশীর বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। আড়াল হইতে সে সকলকে শুনাইয়া বলিল, ‘এমন অসম্মানী হইবার লাগি এই গাঁওয়ে তুমি কেনে আইঅ বা’জি।’

মুহুরী জানাইল সে ভুল করিয়াছে। সে এখনই চলিয়া যাইতেছে। অতঃপর সব বাড়িতে যাইবে, কিন্তু চাষার বাড়িতে কোনদিন যাইবে না।

কাদির ততোধিক চটিয়া বলিল, রাত দুপুরে চলিয়া যাইবে। সাহস কত। যাও না যদি ক্ষমতা থাকে।

মুহুরী যাইতে উদ্যত হইলে তাড়াতাড়ি কাদির দুইটা লাঠি বাহির করিল। মুহুরী হতভম্ব হইয়া গেল। কাদির একটা লাঠি নিজের হাতে লইল এবং বাকি লাঠিটা নাতি রমুর হাতে দিয়া বলিল, ‘নে শালা, তর দাদারে মার্‌।’

রমু লাঠিটা হাতে লইয়া গো-বেচারার মত একবার কাদিরের মাথার দিকে আরেকবার মুহুরীর মাথার দিকে তাকাইতে লাগিল; কার মাথায় মারিবে বুঝি-বা ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না।

সেইদিন বিকালবেলা, মাগন সরকার মামলা লাগাইয়া ব্রাহ্মণবাড়ীয়া হইতে বাড়ি ফিরিতেছিল। তিতাস-নদীর তীর ধরিয়া পথ। সূর্য এলাইয়া পড়িয়াছে। তিতাসের ঐ পারে মাঠ ময়দান ছাড়াইয়া অস্পষ্ট গ্রামের রেখা। তারই ওপারে সূর্য একটু পরেই অস্ত যাইবে। পশ্চিমাকাশ লাল হইয়া উঠিয়াছে। তার সেই লালিমা আবার মেঘের স্তরে স্তরে নানা রঙের পিচকারী ছুড়িয়া মারিতেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিয়াছে। চারিদিকে শান্ত, সমাহিত ভাব। কাছেই বাড়িঘর। গাইগরু ধীরেসুস্থে আপন মনে বাড়িতে ফিরিতেছে। রাখালের তাড়া করার অপেক্ষা রাখিতেছে না। বামদিকে তটরেখা, ডানদিকে বেড়া। কি সব ক্ষেত লাগাইয়াছে, তারই জন্য বেড়া। গলায় ঝুলানো রেশমী চাঁদর হাওয়ায় উড়িয়া এক একবার বেড়ার কঞ্চিতে গিয়া লাগিতেছিল। পায়ের মসৃণ জুতায় লাগিতেছিল জমিনের ধূলা। সব কিছু বাঁচাইয়া পথ চলিতে মাগন সরকারের মন চিন্তায় উদ্বেল হইয়া উঠিল। এ মাঠেও তার অনেক জমি আছে। কত জমি, সে নিজেই অনেক সময় ঠাহর রাখিতে পারে না। মাঝে মাঝে গোলাইয়া যায়, কত জমি সে করিয়াছে; কিন্তু কি করিয়া সে-সব জমি করিয়াছে, সে-খবর জ্বলন্ত অঙ্গারের মতই তার চোখের সামনে আজ যেন জ্বলজ্বল করিয়া দুই একবার জ্বলিয়া উঠিল।

এমন সময় পথে রশিদ মোড়লের সঙ্গে দেখা।

রশিদ মোড়লের খালি পা, লুঙ্গি পুরা, গায়ে একটা ফতুয়া। বয়সে মাগন সরকারের মতই প্রবীণ।

‘রসিদ ভাই!’

‘কি?’

‘দোলগোবিন্দ সা’র খবর শুনছ ত?’

‘তা আর শুনছি না। কলিকাতা থাইক্যা তার ভাতিজার নামে চিঠি আইছে।’

‘অবস্থা নাকি খারাপ?’

‘হ। একেবারে হাতে-বৈঠা-ঘাটে-নাও অবস্থা।’

‘কি হইব দাদা!’

‘কি অরে হইব, মরব!’

‘মইরা কি হইব?’

রশিদ একটু হাসিল, কিন্তু জানিল না যে, মাগনের একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস তিতাসের ছোট ঢেউয়ের মত বাতাসে একটু ঢেউ খেলাইয়া দিয়া গেল!