☼ অদ্বৈত মল্লবর্মণ ☼
তিতাস একটি নদীর নাম
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বড় ঘটা করিয়া, বড় তেজ দেখাইয়া চলিয়া গিয়াছে ছেলেট। যে-খানেই থাক, মরিবেন ঠিক। একটা গোটা মানুষের মরিয়া যাওয়া কি এতই সহজ? সে যদি আর কখনো ফিরিয়া এঘরে না আসিত, কেউ যদি তাকে দেখিতে পাইয়া সঙ্গে করিয়া নিয়া মানুষ করিত! কোন মুখে আর সে এঘরে আসিবে! ঈশ্বর করুন আর যেন সে ফিরিয়া না আসে। যার মা নাই, দুনিয়ার সব মানুষই তার কাছে সমান। আর কোন মানুষের বাড়িতে সে চলিয়া যাক।
চারদিন পরের এক দুপুরে নারীদের মজলিসে বসিয়া সুব্লার বউ এই কথাগুলিই ভাবিতেছিল। অনন্তর প্রসঙ্গ উঠিতেই বলিল, ‘আপদ গেছে ভাল হইছে। কার দায় কে সামলাইবে গো দিদি? আমার পেটের না পিঠের না, আমার কেনে আত ঝকমারি। মা খালি ঘরে পইড়া মরছে। কেউ নেয় না দেইখ্যা আমি গিয়া আনছিলাম। অখন শ্রাদ্ধশান্তি চুষ্টক্যা গেছে, অখন যেখানে খুশি গিয়া মরুক। আমার দায় ফইরাদ নাই।’
নিজে এতগুলি কথা বলিল সকলের অনন্ত সম্বন্ধে বলিবার সকল কথা চাপা দিবার জন্য। তবু একজন বলিয়া বসিল, আমার বিন্দাবন দেখিয়াছে, গামছায় করিয়া হাটে খলসে মাছ বেচিতেছে।
আর একজন পান চিবাইতে চিবাইতে বলিল, আমার নন্দলাল দেখিয়াছে, পচাপানের দোকানের সামনে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দোকানী কত পচা পান তার দিকে ছুড়িয়া ফেলিতেছিল, সে একটিও না ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে।
সুবলার বউ আর শুনিতে চায় না। কিন্তু তৃতীয় একজন না শুনাইয়া ছাড়িল না। কাল রাতের আঁধারে লবচন্দ্রের বউয়ের ঘরে গিয়া ঢুকিল কতকগুলি পানমুপারী নিয়া। লবচন্দ্রের বউ তাকে ভাত খাওয়াইয়া বিছানা করিয়া বলিল, শুইয়া থাক, কিন্তু শুইল না, বাহির হইয়া ভূতের মতন আঁধারে মিলাইয়া গেল। দিনের বেল লবচন্দ্রের বউ তার স্বামীকে দিয়া কি খোজাটাই না খোজাইয়াছে, কিন্তু কোথায় থাকে কেউ বলিতে পারে না! কেউ নাকি বলে জঙ্গলের মধ্যে থাকে, কেউ বলে শিয়ালের গর্তে থাকে— কেউ বলে, যাত্রাবাড়ির শ্মশানে যে মঠ আছে, তার ভিতর থাকে! ছেলেটা দেওয়ানা হইয়া না গেলেই হয় দিদি।
খুব যে দরদ লবচন্দ্রের বউ-এর। স্বামীকে দিয়া খোজাইয়াছে। বলি কয়দিনের কুটুম? এতদিন দেখাশুনা করিয়াছে কে? মা যখন মরিল, লবচন্দ্রর বউ তখন কোথায় ছিল? আর মরিতে আসিলেই যদি, এদিকের পথে ত কাটা দিয়া রাখে নাই কেউ। ভাত ভিক্ষা করিয়া খাইতে আসিয়া লবচন্দ্রর ঘরে কেন—এমন ভিক্ষা ত আমিও দিতে পারিতাম। কথাগুলি মুবলার বউ মনে মনে ভাবিল, কিন্তু প্রকাশ করিয়া বলিল না।,
রাত্রিতে পেট পুরিয়া খাইয়া শুইতে গিয়াছে, এমন সময় বিন্দার মা আসিয়া বলিল, ‘অ সুবলার বউ, দেইখ্যা যা রঙ্গ। ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া গিয়া দেখে অনন্ত আঁস্তাকুড়ের পাশে বসিয়া বসিয়া আঁচাইতেছে, আর লবচন্দ্রর বউ হাতে একটা কেরাসিনের কুপি লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। এতখানি সামনে গিয়া পড়া মুবলার বউয়ের অভিপ্রেত ছিল না। হকচকাইয়া গেল। ছেলেটা একটুও না চমকাইয়া হাতের ঘটি মাটিতে রাখিয়া গটগট করিয়া চলিয়া গেল; কেহ কিছু বলিতে পারিল না।
ফেরার পথে সুবলার বউ বলিল, ‘বিন্দার মা, একদিন ধইরা জন্মের শোধ মাইর দিয়া দেই, কি কও।’
বিন্দার মা কিছু বলিল না।
নৌকাটা হঠাৎ কিসে ধাক্কা খাইয়া থামিয়া গেল। কোমরজলে দাড়ানো মোটা মোটা গাছের জলের উপর দিয়া অনেক ডাল মেলিয়াছে, অজস্র পাতা মেলিয়াছে। সেই ডালপাতার গহনারণ্য মাথায় করিয়া নৌকা ঘাটের মাটিতে ঠেকিয়াছে। উদয়তারার তন্দ্র অসিয়াছিল। সচকিত হইল। বনমালী পাছার খুঁটি পুতিতেছে, নৌকার একটানা ঝাকুনিতে টের পাইল উদয়তারা। মুদিনে তার বিবাহ হইয়াছিল, মুদিনে সে এখান হইতে বিদায় হইয়াছে। তখন এসব জায়গা ছিল ডাঙ্গা। জল ছিল অনেক দূরে, গাঙের তলায়। তারপর উদায়তারার কত বর্ষা কাটিয়াছে জামাইবাড়িতে। এখানে কোন বর্ষার মুখ বিবাহের পর থেকে দেখে নাই। তবু পরিচিত গাছগুলি আধারেও তার মনে জ্বলজ্বল করিয়া উঠিল। তার তলার মাটি তখন শুকনা ঠনঠনে, সে মাটিতে বসিত চাঁদের হাট। ছেলেরা খেলিত গোল্লাছুট খেলা, আর মেয়েরা খেলিত পুতুলের ঘরকন্নার খেলা। কত ঠাণ্ডা ছিল এর তলার বাতাস। আর এখন এর তলায় ঠাণ্ডা জল থই থই করে। উদয়তারার বয়সী মেয়েরা চলিয়া গিয়াছে পরের দেশে পরের বাড়িতে, আর ছেলেরা এখন বড় হইয়া এ জলে স্নান করে।
পান সুপারির তিনকোণা থলে, একখানা কাপড় আর টুকিটাকি জিনিসের একটা ছোট পুটলি গুছাইয়া উদয়তার অনন্তর হাত ধরিয়া মাটিতে পা দিল।
‘দিশ কইরা পা বাড়াইবি অনন্ত, না হইলে পইড়া যাইবি। যে পিছলা I’
পদে পদে পতনোন্মুখ অনন্ত শক্ত করিয়া উদয়তারার হাতখানা ধরিয়া বলিল, ‘আমি পইড়া যাই। তুমি ত পড় না?’
‘আমার বাপ-ভাইয়ের দেশ। চিনা-পরিচিত সব। বর্ষায় কত লাই-খেলা খেলাইছি, সুদিনে কত পুতুলখেল খেলাইছি।’
খেলায় বুঝি খুব নিশা আছিল তোমার!’
‘আমার আর কি আছিল। নিশা আছিল আমার বড় ভইন নয়নতারার। ছোট ভইন আসমানতারারও কম আছিল না। এই খেলার লাগি মায়ে বাবায় কত গালি দিছে। পাড়ার লোকে কত সাত কথা পাঁচ কথা শুনাইছে। তিন ভইন একসাথে খেলাইছি বেড়াইছি, কেউরে গেরাহ করছি না। তারপর তিন দেশে তিন ভইনের বিয়া হইয়া গেল।’
‘সেই অবধি দেখা নাই বুঝি?’
‘না। গাঙে গাঙে দেখা হয়, তবু ভইনে ভইনে দেখা হয় না। বড় ভালমানুষ আমার বড় ভইন নয়নতারা আর ছোট ভইন আসমানতারা।’
তারার মেলা। অনন্ত নামগুলি একবার মনে মনে আওড়াইয়া লইল।
বনমালীর একার সংসার। বাহির হইতে দরজা বন্ধ করিয়া গিয়াছিল। ফিরিয়া আসিয়া দেখে অত রাতে ঘরের ভিতর আলো জ্বলিতেছে। আশচার্য হইবার কথা। সাড়াশব্দ না করিয়া উদয়তার হাঁটুর সাহায্যে দরজায় ধাক্কা দিলে দরজা মেলিয়া গেল এবং আশ্চর্যের সহিত দেখা গেল নয়নতারা আসমানতারা তুইজনে ঘরে বসিয়া গল্প করিতেছে–মেঝে৷ বোন উদয়তারারই গল্প। অতদিন পরে দুই বোনেরে একসঙ্গে পাইয়া উদয়তারা কি বলিবে ভাবিয়া পাইল না। কিন্তু আনন্দে চোখ দিয়া জল আসিয়া পড়িল। কি করিয়া আসিল তারা এ দারুণ বর্ষাকালে?
আসার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : বিদেশে মাছ ধরিতে গিয়৷ ছুইজনের বরের দেখা হয়। তারা ঠিক করিয়া ফেলে, অমুক মাসের অমুক তারিখে পরিবার নিয়া এখানে মিলিত হইবে। সেকথার কেহই খেলাপ করে নাই।
‘তারা দুইজন কই?
‘পাড়া বেড়াইতে গেছে।’
‘তোরা পাড়া বেড়াইতে গেলি না?
‘আমরা রাইতে পাড়া বেড়াই না, বেলাবেলি পাড়া বেড়ান শেষ কইরা ঘরে কুয়ারে খিলি দিয়া রাখি। তোরা গোকনগায়ের মানুষেরা বুঝি রাইতে পাড়া বেড়াস্?
বড় বোনের দিকে চোখ নাচাইয়া উদয়তারা গুনগুন করিয়া উঠিল, ‘জানি গো জানি নয়ানপুরের মানুষ; সবই জানি; অত ঠিসারা কইর না।’
এমন সময় তারা দুইজন আসিল। ছোট বোনের জামাই সঙ্গে, কাজেই নয়নতারা ও উদয়তার মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিল। কেবল আসমানতারার ঘোমটা কপালের নিচে নামিল। বড় বোনদের তুর্দশা দেখিয়া সে মৃত্যুমুকু হাস্ত করিতে লাগিল।
মালোদের দূরের মানুষের সঙ্গে দেখা হইলে আগেই উঠে মাছের কথা। কুশল মঙ্গলের কথা উঠে তার অনেক পরে। নয়নতারার বরের সামনের দিকের কয়েকটা দাত পড়িয়া গিয়াছে। গোছায় গোছায় চুল পাকিয়া উঠিয়াছে, খোচা খোচা দাড়িগোফেও শাদা-কালোর মেশাল। যৌবন তাহাকে ছাড়িয়া যাইতেছে—তবু গায়ের সামর্থ্যে ভাট পড়ে নাই। মেজ শালীর হাত হইতে হুকাটা হাতে করিয়া, মুখে লাগাইবার আগে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তিতাসে আজকাইল মাছ কেমুন পাওয়া যায়?
‘ঘরের বউয়ানি ঘরে থাকি, আমি কি জানি মাছের খবর! আমারে কেনে, পুরুষেরে যদি পাও জিগাইও।
‘জীবনে দেখলাম না তোমার পুরুষ কেমুন জন। সাথে আন না কেনে?
‘পুরুষ কি আমার মাথার বোঝা যে, তারে ফালাইয়া আই ইচ্ছা কইরা!’
‘মাথার বোঝা হইবে কেনে। হাতের কঙ্কণ, গলার পাঁচ নরী। সাথে আন ত শরীরের শোভা। না আন ত খালি শরীর।’
‘শীতলীয়া কথা কইও ন৷ সাধু; হাতের কঙ্কণ হাতে থাকে, গলার হার গলায় থাকে। আর সেই মানুষ তিতাসে মাছ ধরতে চইল্যা যায়। বাড়ি আইলে যদি কই অনেক দিন দাদারে দেখি না, চলনা গো, একদিন গিয়া দেইখ্যা আই, কয়, দাদারে নিয়াই সংসার কর গিয়া। তোমারে আমি চাই না। শুনছ কথা!’
‘ভুল করলা দিদি। পরাণ দিয়া চায় বইল্যাই চাই না কইতে পারছে।’
তার গলার মোটা তুলসীমালার দিকে চাহিয়া উদয়তারার খুব শ্রদ্ধা হইল। আরও শ্রদ্ধ হইল যখন দেখিল, তার চোখ দুইটি আবেশমাখ।–মুখ ভাবময় হইয়া উঠিতেছে—সে গান ধরিয়াছে —’ও চাঁদ গোর আমার শঙ্খ-শাড়ি, ও চাঁদ গৌর আমার সিথির সিন্দুর চুল-বান্ধা দড়ি, আমি গৌর-প্রেমের ভাও জানি না ধীরে ধীরে পাও ফেলি।’— গানের তালে তালে তার মাথাটাও তুলিতে লাগিল।
পরিবেশে আধ্যাত্মিক ভাবটা একটু ফিকা হইয়া আসিলে উদয়তারা বলিল, ‘দেখ মানুষ, আমার একখান কথা। দাদার লাগি কিছু একটা করল না। এমন কাতিক হইয়াই দাদা দিন কাটাইব। দাদার মাথায় কি শোলার মটুক কোন কালেই উঠব না?’
‘বনমালীর কথা কও? তুমি ত জান দিদি, মা বাপ ভাই বেরাদর যার নাই, ক্ষেত পাথর জাগা জমি যার নাই, টাকা কড়ি গয়নাগাটি যার নাই, তারে লোকে মাইয়া দেয়? অন্ততঃ তিনশ’ টাকা হাতে থাকৃত ত দেখতাম—মাইয়ার আবার অভাব।’
তিনশ’ টাকা। পর পর তিনটা বোনের বিবাহ হইয়াছে বাবা বাঁচিয়া থাকিতে। পণ লইয়াছে তিনশ’ টাকা করিয়া। আর এই টাকা দিয়া সমাজের লোক খাওয়াইছে। এখন বনমালীর নিকট হইতেও তিনশ’ টাকা পণ লইয়া মেয়ের বাপ তার সমাজকে খাওয়াইবে। কি ভীষণ সমস্যা! উদয়তার চুপ করিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে বলিল, ‘তোমার একটা ভইনটইন থাকলে দিয়া দেও।’
‘আপন ভইন নাই, আছে মামাত ভইন। কিন্তু আমার কোন হাত নাই!’
এমন সময় বনমালী ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকিল। তার হাতে কাঁধে কোমরে অনেক কিছু মালপত্র। আতপ চাউল, গুড়, তেল–এসব পিঠা করার সরঞ্জাম আনিয়াছে।
অনন্ত বিছানার একপাশে বসিয়া এতক্ষণ নীরবে তাহীদের কথাবার্তা শুনিতেছিল। এইবার বড় বোন নয়নতারার দৃষ্টি তাহার দিকে পড়িল। প্রত্যেকটি কথা যেন ছেলেটা গিলিয়া খাইতেছে, প্রত্যেকটা লোককে যেন নাড়ীর ভিতর পর্যন্ত দেখিয়া লইতেছে, এমনি কৌতূহল।
‘এরে তুই কই পাইলি?’
‘এ আমার পথের পাওয়া! মা বাপ নাই। সুবলার বউ রাঁড়ি মানুষ করত। পরে নি গে। বুঝে পরের মর্ম, একদিন খদাইয়া দিল। বড় মায়া লাগল আমার। লইয়া আইলাম, যদি কোনদিন কামে লাগে।’
বলে কি, পরের একটা ছেলে—মাটির পুতুল নয়, কাঠের পুতুল নয়, একটা ছেলে এমনি করিয়া পাইয়া গেল! একি দশে মানে, না তুনিয়া মানে। পেটে ধরিল না, মানুষ করিল না, পথের পাওয়া—তাই কি তার আপন হইয়া গেল? এমন করিয়া পরের ছেলে যদি আপন হইয়া যাইত তবে আর ভাবনা ছিল কি? কিন্তু হয় না। পরের ছেলে বড় বেইমান।
বনমালী ও পুরুষ দুইজন একটু আগেই অন্য ঘরে চলিয়। গিয়াছিল – কোন খালে কোন বিলে কোন সালে কত মাছ পড়িয়াছিল, তার সম্পর্কে তর্কাতর্কি তখন উচ্চগ্রামে উঠিয়াছে আর এঘর হইতে শোনা যাইতেছে। আসমানতারার বরের গল৷ সকলের উপরে। সরেস জেলে বলিয়া প্রতিবেশী দশ বারো গায়ের মালোদের মধ্যে তার নামডাক আছে। সেই গর্বে আসমানতারা বলিল, ‘আমারে দিয়া দে দিদি, আমি খাওয়াইয়া ধোঁয়াইয়া মানুষ করি; পরে একদিন বেইমান পক্ষীর মত উইড্রা যাউক, আমার কোন দুঃখ নাই।’
‘তোর ত দিন আছে ভইন। ঈশ্বর তোরে দিব—কিন্তু মামারে কোনকালে দিব না—এরে দিলে আমি নাচতে নাচতে লষ্টয়া যাই? নিঃসন্তান বুকের বেদন নয়নতার হাসিয়া হাস্ক করিল।
কেন আমি কি দোকানের গামছা না সাবান! কোন সাহসে আমাকে কিনিয়া নিতে চায় —অনন্ত এই কথা কয়টি মনে মনেই ভাবিল। প্রকাশ করিয়া বলিল না।
অনন্ত ও অন্যান্য পুরুষ মানুষদের খাওয়া হইয়া গেলে তিন বোনে এক পাতে বসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া খাইল। তারপর পাশের ঘরে তিন পুরুষের বিছানা করিয়া দিয়া, অনন্তকে এ ঘরে শোয়াইয়া, তিন বোনে পিঠা বানাইতে বসিল।
রাত অনেক হইয়াছে। প্রদীপের শিখা তিন বোনের মুখে হাতে কাপড়ে আলো দিয়াছে। পিছনের বড় বড় ছায় দেওয়ালে গিয়া পড়িয়াছে। ভাবে বোঝা গেল, তারা আজ সারারাত না ঘুমাইয়া কাটাইবে।
‘ঘুম আইলে কি করুম? ছোট বোন জিজ্ঞাসা করিল।
‘উদয়তারা শিলোকের রাজা। শিলোক দেউক, তার আমরা মানতি করি—ঘুম তা হইলে পলাইব। বলিল বড় বোন।
উদয়তারা একদল কাই হাতের তালুতে দলিতে দলিতে বলিল, ‘হিজল গাছে বিজল ধরে, সন্ধ্যা হইলে ভাইঙ্গা পড়ে —কও, এই কথার মান্তি কি?’
‘এই কথার মাস্তি হাট।’ বলিল আসমানতারা।
‘আচ্ছা,—পানির তলে বিন্দাজী গাছ ঝিকিমিকি করে, ইলস মাছে ঠোকর দিলে ঝরঝরাইয়া পড়ে?’
বড় বোন মানে বলিয়া দিল—’কুয়াসা।’
এইভাবে অনেকক্ষণ চলিল। অনন্তর খুব আমোদ লাগিতেছিল, কিন্তু ঘুমের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়া পারিল না। শুনিতে শুনিতে সে এক সময় ঘুমাইয়া পড়িল।
নিশুতি রাতে আপনা-থেকে ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তিন বোন তখনও অক্লাস্ত ভাবে হেঁয়ালী বলিতেছে আর হাত চালাইতেছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ মুদিয়া অনন্ত তখনও কানে শুনিতেছে —’আদা চাক্চাক দুধের বর্ণ, এ শিলোক না ভাঙ্গাইলে বৃথা জন্ম।’
এর মাস্তি—টাকা, বলিয়া এক বোন পাল্টা তীর ছাড়ে—