অদ্বৈত মল্লবর্মণ

তিতাস একটি নদীর নাম

রামধনু

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

ঘাটে আসিয়া যে-বধূট সকলের চেয়ে বেশি দেরি করে, বেশি কথা বলে, আর কথায় কথায় ছড়া কাটে, তুনিয়ায় তার পরিচয় দিবার উপলক্ষ্য মাত্র দুইটি—এক, সাদকপুরের বনমালীর বোন বলিয়া, আর দুই, লবচন্দ্রের বউ বলিয়া। তবে এখানে প্রথমোক্ত নামে তার পরিচয় বেশি নাই, শেষোক্ত নামেই সে মালোপাড়ায় অভিহিত। কথার মাঝে মাঝে সুন্দর ছড়া কটিতে পারে বলিয়া সকল নারীরা তাকে একটু সমীহ করে; সে যেন দশজনের মাঝে একজন। শ্রাদ্ধের দিন অনেক নারী দেখিতে আসিল। সেও আসিল। নাপিত আসিয়া অনন্তর মস্তক মুণ্ডন করিয়া গেল। অনন্ত কতকগুলি খড়ের উপর শুইত, সেই খড়গুলি, হাতের আধছোঁড়া নিত্যসঙ্গী কুশাসনখানা, কাঁধের ও কটিদেশের মাঠ-কাপড়ের চিলত দুইখানা সেই নারীর কথামত নদীতীরে ঘাটের একটু দূরে কাদায় পুতিয়া না করিয়া আসিল। পুরোহিত চাউলভরা পাঁচটি মালসাতে মন্ত্র পড়িয়া অনন্তর মাতৃশ্ৰাদ্ধ সমাধা করতঃ একটা সিকি ট্যাকে গুঁজিয়া চলিয়া গেলে, সেই স্ত্রীলোকটি তাড়া দিল, ভতি বাড়নের কত দেরি। কড়া র্ডিগ মানুষ। ভুখে মরতাছে!’

সুবলার বউর এক হাতে সব কাজ করিয়া উঠিতে দেরি হইল। তবু সে পরিপাটি করিয়া পাঁচটি ব্যঞ্জন রণধিল। অনন্ত এক স্থানে বসিয়া পড়িয়াছিল। মাসীর মা খেকাইয়া উঠিল, ‘নিষ্কর্ম গোঁসাই, আরে আমার নিষ্কর্ম গোঁসাই, একটা কলার খোল কাইট্যা আনতে পারলে না!’

সেই নারী প্রতিবাদ করিল, ‘চিরদিন গালি দিও মা, আইজের দিনখান সইয়া থাক। দাও দেও, আমি খোল কাইট্যা আনি।’

লম্বা একটা খোলে ভাতব্যঞ্জন সাজাইয়া সুবলার বউ বলিল, ‘রাঁড়িরে শেষ খাওন খাওয়াইয়া দেই, আর ত কোনদিন খাইতে আইব না।’

খোলের এককোণে একটু পান সুপারি, একটু তামাক টিকাও দেওয়া হইল।

সেই নারী সুবলার বউকে বলিল, ‘তোমার সাথে ত কত ভাব আছিল দিদি! তুমি যাইও না। আমি যাই তারে লইয়া।’

অনন্ত ভাত ব্যঞ্জন ভরতি খোলটা হাতে করিয়া নদীর পারের দিকে চলিল, সঙ্গে চলিল সেই স্ত্রীলোকটি। সে নির্দেশ দিল, না-জল না-শুকনা, এমুন জায়গাত, রাইখ্যা পাছ ফির আইয়া পড়, আর পিছের দিকে চাইস না।’

অনন্ত জন্মের মত মাকে শেষ খাবার দিয়া স্ত্রীলোকটির পিছু পিছু বাড়ি চলিয়া আসিল।

লোকে তেপথা পথে রোগীকে স্নান করায়, ফুল দিয়া রাখে। যে পা দিবে সেই মরিবে। এ আপদ একদিন কেন সেই পথ দিয়া আসে না!–হবিষ্যের সময় একবার করিয়া খাইত, এখন খায় তিনবার করিয়া। কোথা হইতে আসেত এত খাওয়া?

—বুড়ির এই কথাটা ভাবিবার মত। বুড়া চিন্তা করে, এক মানুষ সে। তিন পেট চালায় তার উপর এই অবাঞ্ছিত পোষ্য। কিন্তু কি করা যায়!

একদিন বুড়ি প্রস্তাব করিল, ‘ছরাদ্দ শান্তি হইয়া গেছে। অখন কানে ধইরা নিয়া জাল্লার নাওয়ে তুল।’

বুড়া ইন্ধন জোগাইল, ‘হ। জগতারের ডহরের গহীন পানিত একদিন কানে ধইরা তুইল্যা দিমু ছাইড়া। আপদ যাইব।’

নদীর উপর নৌকাতে ভাসিয়া মাছ ধরার আনন্দ অনন্তর মনে দমকা হাওয়ার মত একটা দোলা জাগাইয়া দিল, কিন্তু বুড়া-বুড়ির কথার ধরণ দেখিয়া উহা উবিয়া গেল।

তাহা সত্ত্বেও একদিন সন্ধ্যাবেলা জাল কাঁধে লইয়া বুড়া যখন হুকুম করিল, ‘এই অনন্ত, হুঙ্কা-চোঙ্গা হাতে নে, আজ তোরে লইয়া জালে যামু।’ অনন্ত তখন বিদ্যুতের বেগে আদিষ্ট দ্রব্যগুলি হাতে লইয়া পরম বাধিতের মত আদেশকারীর পাছে পাছে চলিল।

মাসী দৌড়াইয়া আসিয়া বাধা দিল। বাপ তার অত্যন্ত রাগী মানুষ। রাগ হইয়া যখন মারিতে আরম্ভ করিবে, এক নৌকায় অনন্তকে তখন বাঁচাইবে কে?

‘হাতের আগুন নিব তে না নিব তে তুমি তারে জালে নিওনা বাবা। ছোট মানুষ। জলে পইড়া মরে, না সাপে খাইয়া মারে, কে কইব। অখন তারে নিওনা, আরেকটু বড় হইলে নিও।’

মাসীর কথায় অনন্ত অপ্রসন্ন মুখে নিরস্ত হইল। এবং বুড়াবুড়ি নিরস্ত হইল আরো অপ্রসন্ন মুখে, ভবিষ্যতের এক প্রবল ঝড়ের আভাষ দিয়া।

মাঝে মাঝে ঝড় হয়। কোনদিন দিনের বেলা, কখনে রাত্রিতে। দিনের ঝড়ে বেশি ভাবনা নাই; রাতের ঝড়ে বেশি ভাবনা। বাঁশের খুঁটির মাথায় দাড়ানো ঘরখানি কাঁপিয় উঠে। মুচড়াইয়া বুঝিবা ফেলিয়া দেয়। কিন্তু তাতেও আত ভয় করে না। কোন রাতে ঝড় আরম্ভ হইলে সহজে কমিতে চায় না। সারারাত্রি চলে তার দাপট। কোনে কোন সময়ে প্রতি রাতে ঝড় আসে। সারাদিন খায় দায়, সন্ধ্যার দিকে আসন্ন ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হয়। ঈশান কোণের কালো মেঘ সারা আকাশে ধোঁয়ার মত ছড়াইয়া গিয়া হু হু করিয়া বাতাস আসে। তারপর আসে ঝড়। ভয় হয় ঘরট। বুঝিবা এ রাতেই পড়িয়া যাইবে। পড়ে না। কিন্তু আজই ত শেষ নয়। কালকের ঝড়ে যদি পড়িয়া যায়। পরশুর ঝড়ে! কিন্তু তাতেও অত ভয় করে না –যত ভয় করে বুড়াকে। কোন ঝড়ের রাতে অনন্তকে টানিয়া লইয়া নৌকায় তুলিবে, মেয়ে মানুষ সে, বুড়া বাপ তার বাধা মানিবে না। কি সে করিবে। একটা নিঃসহায় নারীর শেষ গচ্ছিত ধন নষ্ট হইয়া যাইবে। ঝড়ে কোন গাঙের বাঁকে বুড়ার নাও উল্টাইয়া যাইবে। বুড় ত মরিবেই, এটাকেও সঙ্গে নিয়া মারিবে।

দিনের ঝড় অনন্তর খুব ভাল লাগে। একদিন অকারণে পাড়ায় ঘুরিতে ঘুরিতে ঝড় আসিয়া পড়িল। যার যার উঠানে ছেলেরা খেলা করিতেছিল বড়রা ডাকিয়া ঘরে নিয়া ঢুকিল। অনন্তকে কেউ ডাকিল না। কার ঘরে গিয়া উঠিবে ভাবিতেছিল, এমন সময় দেখা গেল যে স্ত্রীলোকটি তার মার শ্রাদ্ধের দিনে তার সঙ্গে নদীর পারে গিয়াছিল সে তার হাত ধরিয়া টানিতেছে। এক সঙ্গে ঝড় ও বৃষ্টি তুই আসিল। সঙ্গে সঙ্গে শিল পড়িল। অনন্তর ন্যাড়া মাথায় কয়েকটা শিল প্রচণ্ড আঘাত করিল, আর ঝড়ো হাওয়ার তোড়ে কয়েকটি বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা তার খড়িউঠা চামড়ায় তীরের মত গিয়া বিধিল। কিন্তু পরক্ষণেই সেই নারীর মাথার ঘোমটা খুলিয়া গেল, বাহির হইয়া পড়িল খোঁপাট। আর সিথির উপর সযত্নে আঁকা দগদগে লাল সিন্দুরের চিহ্নট। বড় বড় কয়েকটা শিল সযত্নশোভিত খোঁপাটিকে থেতলাইয়া দিল, বড় বড় কয়েকটা বৃষ্টির ফোট৷ তার সিন্দুরের দাগ গলাইয়া ফ্যাকাসে করিয়া দিল; তার ঘোমটার কাপড় দিয়া ইতিপূর্বেই সে অনন্তর থেলো মাথাটিকে ঢাকিয়া দিয়াছিল।

কারো ঘরে না গিয়া সে অনন্তকে নিয়া তার নিজের ঘরের বারান্দায় গিয়া থামিল। ততক্ষণে ঝড়ের প্রচণ্ড মাতামাতি স্বরু হইয়া গিয়াছে। ঝড়ের এতবড় আলামত অনন্ত জীবনে কোনদিন দেখে নাই। চারিদিকে ঘরের চালগুলি কাঁপিতেছে, গাছগুলি মুচড়াইয়া এক একবার মাটিতে ঠেকিতেছে আবার উপরে উঠিতেছে, লতাপাত। ছিঁড়িয়া মাটিতে গড়াইতেছে, আবার কোথায় কোন দিকে বাতাস তাহাদিগকে ঝাটাইয়া লইয়া যাইতেছে। ঝড় খুব শক্তিশালী সন্দেহ নাই। কিন্তু এ নারীও কম শক্তিশালী নহে। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া সমানে সে চেচাইয়া চলিয়াছে, ‘দোহাই রামের দোহাই লক্ষ্মণের, দোহাই বাণ রাজার; দোহাই ত্রিশ কোটি দেব তার। কিন্তু ঝড় নির্বিকার। দাম্ভিক অঙ্গুলি হেলনে ত্রিশ কোটি দেবতাকে কাত করিয়া বহিয়াই চলিল। এবার তার গলার আওয়াজ কাপাষ্টয়া অন্য অস্ত্র বাহির করিয়া দিল, ‘এইঘরে তোর ভাইগ্লা বউ ছুইসন ছু ইসনা— এইঘরে তোর ভাইগ্না বউ, ছু ইসনা ছু ইসনা। কিন্তু ঝড় এ বাধাও মানিল না। পাশব শক্তিতে বিক্রম দেখাইয়া প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরটা কঁপাইয়া দিয়া গেল। সে নারীও দমিবার নয়। এবার সুর সপ্তমে চড়াইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, যা বেটা যা, পাহাড়ে যা, পর্বতে যা, বড় বড় বিরিক্ষের সনে যুদ্ধ কইরা যা। এ-আদেশ অগ্রাহ করিতে না পারিয়াই বুঝিব। ঝড়টা একটু মন্দা হইয়া আসিল এবং ঝিমাইয়া ঝিমাইয়া এক সময় তারও দম বন্ধ হইয়া গেল। অনন্ত বিস্ময়ভরা চোখে তাকাইয়া রহিল তার মুখের দিকে। কি কড়া আদেশ। এমন যে ঝড়, সেও এই নারীর কথায় মাথা নত করিল!

ঝড়ে মালোপাড়ার প্রায়ই সাংঘাতিক রকমের ক্ষতি করিয়া থাকে। তাদের অর্ধেক সম্পত্তি থাকে বাড়িতে, আর অর্ধেক থাকে নদীতে। যাদের ঘর বাড়ি ঠিক থাকে, তারা হয়ত তিতাসে গিয়া দেখে নাওখানা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। আর যারা নাওয়ে থাকিয়া সারারাত তুফানের সাথে যুঝিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছে, তারা হয়ত বাড়িতে আসিয়া দেখে ঘর পড়িয়া গিয়াছে।

আজিকার এত বড় ঝড়ে কিন্তু মালোপাড়ার অধিক লোকের ক্ষতি করিতে পারে নাই। ক্ষতি করিয়াছে মাত্র দুইটি পরিবারের। কালোবরণের বড় নাওখানা লইয়া মাছ কিনিবার জন্য বড় গাঙে গিয়াছিল। সে নাওখানা ভাঙ্গিয়৷ গিয়াছে। লোকজন পায়ে হঁটিয়া পরদিন বাড়ি আসিয়া জানাইয়াছে, একখানা তক্তাও পাওয়া গেল না। একেবারে চুরমার করিয়া ফেলিয়াছে।

ঘর ভাঙ্গিয়াছে অনন্তর মাসীর বাবার। যে ঘরে অনন্তকে লইয়া মাসী শুইত সেই ঘরখানা।

ঘরখানা আবার তুলিয়া লইয়া, হিসাব করিয়া দেখা গেল, বুড়ার গাটের সব টাকাকড়ি খরচ হইয়া গিয়াছে। এখন দিনআনা দিন-খাওয়ার অবস্থা। যেদিন মাছ না পাইবে সেদিন উপবাস করিতে হইবে। ঘোর তুর্দিনে এমন অবস্থায় একটা উপরি পোষ্যকে কিছুতেই রাখা চলে না। একথা বুড়ার জপমালা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আর না বললেও মাসীর বুঝিতে কষ্ট হয় না। তার মার রকমসকম দেখিয়া মনে হয়, একদিন হয়ত সত্যই ছেলেটার পিঠে সে পোড়া কাঠ চাপিয়া ধরিবে।

অনেক দিন ধরিয়া সে কালোর মার কথা ভাবিতেছিল। একদিন তার কাছে গিয়া বলিল, ‘আপনে ত তার মারে কত ভালবাসতেন। আমার কাছে তার কষ্টের পারাপার নাই। আপনে তারে লইয়া যান, দুই মুঠ খাইয়া বাঁচব।

কিন্তু কালোর মার মন খারাপ। অতবড় নৌকা ভাঙ্গিয়৷ গিয়াছে। এমন বিপদে কার না মন খারাপ হয়। এই সময়ে এসব ভাবনার কথা এড়াইয়া চলিতেই ভাল লাগে। তবে কালোর মা একেবারে নিরাশ করিল না; বর্ষার পর মুদিন আসিলে কালোবরণ উত্তর হইতে কাঠ আনিবে, নূতন নাও গড়িবে। সে নাওয়ে যখন জিয়লের ক্ষেপ দিতে যাইবে, কালে। তখন অনন্তকে সঙ্গে নিতে ভুলিবে না। এই কথা শুনিয়া সুবলার বউর ভিতরটা মোচড় দিয়া উঠিল।

কিন্তু সে অনেক দিনের কথা।

আর একদিন খুব বৃষ্টি হইয়া গেল। বাদলায় পান খুব পচে। তখন পচা-ভালে-মেশানো বিড়ায় বিড়ায় পান ফেলিয়া দেয় দোকানীরা। অনন্তর বয়সী ছেলেমেয়েরা এমন পান হাতভরতি করিয়া কুড়াইয়া আনিতেছে। মাসীর মা নিজের চোখে দেখিয়াছে। তারা অনেক পান আনিয়াছে। আর তাদের মা’র ডালায় করিয়া লইয়া ধুইয়া খাইয়া মুখ লাল করিয়াছে। অনন্ত কেন গেল না, গেলে ত আনিতে পারিত। অনন্তর খুব ভাল লাগে, হাটে-বাজারে ঘুরিতে। বুড়ির ইঙ্গিত পাইয়া সে খুশিমনে ছুটিল বাজারের দিকে।

বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে একটু আগে। বাজারের রাস্তা দিয়া তখনও জলের স্রোত চলিতেছে। কোথায় কোন ডোবা উপচাইয়াছে, তারই জল। দুএকটি পানাও আসে সেই জলের সঙ্গে। অনন্তর বয়সী কয়েকটি ছেলে, তাদের বাপদাদার যেমন লম্বা বাঁশের আগায় জাল বাঁধিয়া খালের দুই পাড় আগ লাইয়া জাল পাতে, তারই অনুকরণে রাস্তার দুইধার বন্ধ করিয়া দুইটি কঞ্চিতে দড়ি আর সূতা বাঁধিয়া জাল পাতিয়া বসিয়াছে। পায়ের গোড়ালির চাপে কঞ্চির আগা উচাইয়া, দড়ি টানিয়া, বুক চিতাইয়া, যেন কত মাছই জালে উঠিয়াছে এমন একটি ভাব-ভঙ্গিতে না-দেখা মাছ সব ঝাড়িয়া ফেলিতেছে। অনন্তকে তারা একসাথে ডাক দিয়া তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। দৌড়িয়া আসিয়া অনন্ত সকৌতুহলে বলিল, ‘কি মাছ উঠেরে?’

‘এই তর চান্দা বৈচা, তিত্‌-পুটি। জববর মাছ উজাইছে, আইজকার ঢলে।’

অনন্ত ও তাদের সঙ্গে মাছ-ধরার খেলায় মাতিয়া গেল।

কতক্ষণ এই খেলা চলিল। শুধুই খেলা। মেয়েরা যেমন মাটির ভাত রাঁধিয়া রাঁধা-রাঁধা খেলা করে, তেমনি এ মাছ-ধরা-ধরা খেলা।

সহসা তাদেরই একজন আবিষ্কার করিল একটা সত্যিকারের কৈ মাছের বাচ্চা কান্‌কো আছড়াইয়া উজাইবার চেষ্টা করিতেছে। সব কয়টি দস্তিছেলে একসঙ্গে হৈ হৈ করিয়া ছুটিয়া গিয়া মাছটিকে লুঠ করিয়া আনিল। তারপর দেখা গেল—একের পর এক ছোট বড় কৈ মাছ স্রোত ঠেলিয়৷ উজাইতেছে। অনন্তর দলের তখন মহা স্ফূর্তি। যার পরণে যা ছিল, তারই কোচড় করিয়া তারা ইচ্ছামত কৈ মাছ ধরিল। ধরিতে ধরিতে বেল ফুরাইয়া গেল। রাস্তার জলের স্রোতটুকু একসময় বন্ধ হইয়া গেল। কৈ মাছও আজিকার মত উজাইবার পালা সাঙ্গ করিল।

পানের কথা অনন্তর একবারও মনে পড়িল না। এক কোচড় জ্যান্ত কৈ মাছ লইয়া খুশি মনে সে ঘরে গিয়া ঢুকিল।

বাড়ির কর্তার মন ভাল না। খালে জাল পাতিয়া পুটি মাছে নাও বোঝাই করিয়া ফেলিয়াছে, কিন্তু এক পয়সাও বেচিতে পারিল না। বাদলার দিন বলিয়া ব্যাপারী আসিল না, হাটও বসিল না। বাদলার দিন বলিয়া শুখাইতে ও দেওয়া চলিবে না। এত মাছ সে করিবে কি?

‘আমি চাইলাম পান, লইয়া আইছে মাছ। মাছ দিয়া আমি কি করুম। আমার কি মাছের অভাব?’ বুড়ি গজ গজ করিতে লাগিল।

পরের দিন দুপুরে বুড়ির মনে পড়িয়া গেল, অনন্তকে তো পোড়াকাঠ মারা হয় নাই। উনানের ধারে গিয়া দেখে সেখানে পোড়া কাঠ নাই। তার উমুনমুখী মেয়ে খড়দিয়া রান্না করিতেছে। অনন্ত কাছে বসিয়া কি যেন গিলিতেছে। বুড়ি খপ করিয়া একমুঠা পোড়া খড় উনান হইতে তুলিয়া লইল। একদিক তখনে৷ জলিতেছে। কিন্তু এ দিয়া তো পিঠে মারা যায় না। মুখে গুঁজিয়া দেওয়া যায়। বুড়ি এক হাতে অনন্তর হাত ধরিয়া আরেক হাতে জ্বলন্ত খড় তার মুখে গুজিতে গেল।. তার মেয়ে বাধা দিতে আসিলে তারও মুখে গুজিতে গেল। মেয়ে হেঁচ কা টানে খড়গুলি বুড়ির হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া মাটিতে ফেলিয়া দিল। আচমকা খড়ের আগুন হাতে লাগিয়া বুড়ির হাতের খানিকটা পুড়িয়া গেল। রাগে কাপিতে কাপিতে সে মেয়ের গলা চাপিয়া ধরিল। তারপর মায়েতে মেয়েতে শুরু হইল তুমুল ধ্বস্তাধস্তি। মেয়ে শেষে কায়দা করিয়া মাকে মাটিতে, ফেলিয়া বুকের উপর বসিল। তারপর চুলের মুঠি ধরিয়া তার মাথাটা ঘন ঘন মাটিতে ঠুকিয়া শেষে ছাড়িয়া দিল। বুড়ি ছাড়া পাইয়া কোন রকমে উঠিয়া গিয়া ভাতের হাঁড়িটা বড় ঘরে টানিয়া তুলিয়া খিল আঁটিয়া দিল।

মারামারির মাঝখানে অনন্ত বাহির হইয়া গিয়াছিল। যার আদেশে ঝড় থামিয়া গিয়াছিল, সেই নারীকে ডাকিয়া আনিবার জন্য। সে না হইলে, এই যুদ্ধ থামাইবে কে? কিন্তু তাকে ঘরে পায় নাই। ফিরিয়া আসিয়া দেখে মাসী মানমুখে বসিয়া আছে। চুলগুলি আলুথালু। পিঠের কাপড় খুলিয়া গিয়াছে। রণজয়ের ক্লান্তিতে যেন ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে মাসী। ভয়ে ভয়ে কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেই সহসা তার দিকে চাহিয়া মাসীর চোখ দুইটি জ্বলিয়া উঠিল। বজের মত গর্জন করিয়া উঠিয়া সে বলিল, শত্তুর, তুই বাইর হ। এই ঘরে তুই ভাত খাস ত তোর সাতগুষ্ঠির মাথা খাস। তোর লাগি আমার মায়েরে মারলাম। তুই আমার কি, ঠ্যাঙ্গের তলা, পায়ের ধূলা। যা যা, অখনই যা, যমের মুখে য। ডাকিনী যোগিনীর মুখে যা, কালীর মুখে যা। ধর্মে যেন আর তোরে ফিরাইয়া না আনে। চোখের মাথা নাকের মাথা খাইয়া যেখানে যমে টানে, সেইখানে যা। আমার সামনে আর মুখ দেখাইস না। তোর মা গেছে যে-পথে, তুইও সেই পথে যা।

কিন্তু ওকি, অনন্তর অমন আদর-কুড়ানো স্নান মুখখান যে দৃঢ়তায় কঠোর হইয়া উঠিল। অমন ঢল ঢল আয়ত চোখ ছষ্টটা যে শৈশব-সূর্যের মত লাল তেজালে৷ হইয়া উঠিল! ওকি! সুবলার বউ কি স্বপ্ন দেখিতেছে!

কোন যুদ্ধজয়ী বীর যেন পলকে সব কিছু ফেলিয়া ছড়াইয়া চলিয়া যাইতেছে। ছোট ছোট পা দুইখানাতে এত জোর। মাটি কাঁপাইয়া যেন চলিয়াছে অনন্ত। ছুটিতেছে না, ধীরে ধীরে পা ফেলিতেছে। কিন্তু কি শব্দ! এক একটা পদক্ষেপ যেন তার বুকে আসিয়া আঘাত করিতেছে। বারান্দা হইতে উঠানে নামিয়াছে। তার বুকের সীমানাটুকু ছাড়াইয়া অনন্ত যেন এখনি কোন এক আজান জগতে লাফ দিবে। সুবলার বউ আর স্থির থাকিতে পারিল না। উঠিয়া হাত বাড়াইয়া স্বলিত কণ্ঠে ডাকিল, অনন্ত! অনন্ত ফিরিল না। সুবলার বউ পড়িয়া যাইতেছিল। তার মা কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া ধরিল। মার বৃদ্ধ বুকে মাথা রাখিয়া সুবলার বউ এলাইয়া পড়িল, সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ দুইটিও বুজিয়া আসিল।

অন্তহীন আকাশের তলায় অনন্তর আজ পরম মুক্তি। কারো পিছুর ডাকে সে আর সাড়া দিবে না। প্রথমেই তিতাসের পারে গিয়া দাঁড়াইল। প্রাণ ভরিয়া একবার দেখিয়া লইল নদীটাকে। ঢেউয়ের পর ঢেউ চলিয়াছে, দুরন্ত স্বপ্নের মত, উদাত্ত সঙ্গীতের মত। জল বাড়িতেছে। নৌকাণ্ডলি চলিয়াছে। কোথাও বাঁধা বন্ধ নাই। সব কিছুতেই যেন একটা সচল ব্যস্ততা! আজিকার এই সময়ে সে যদি আসিত। আসিবে বলিয়া গিয়াছে। কতদিন ত হইয়া গেল। সেত আসিল না! বাজারের ঘাটে যেখানে সে নৌকা ভিড়াইয়াছিল সেখানে গিয়া দাঁড়াইল। এখানে দিনের পর দিন বসিয়া থাকিবে। তার জন্য প্রতীক্ষা করিবে। একদিন হাটবারে সে আসিবেই।

খালের মুখে মস্তবড় একটা ভাঙ্গা নৌকা ‘গেরাপী’ দিয়া রাখিয়াছে। অনন্ত তার উপর গিয়া উঠিল। ভয়ানক পিছল। বাতায় ধরিয়া ছইয়ের ভিতর ঢুকিল। নৌকায় আধ বোঝাই জল। চাহিলে ভয় করে। একবার পা ফস্কাইয়া তলায় পড়িয়া গেলে অনন্ত সে-জলে ডুবিয়া মারা যাইবে। পাছার দিকে কয়েকখানা পালিস পাটাতন। রোদ বৃষ্টি কিছুই ঢুকিবে না। কেউ দেখিতে পাইবে না। ভারী মৃন্দর। এখানে অনন্ত চিরদিন কাটাইয়া দিতে পারিবে। যতদিন সে না আসিবে, এখানেই কাটাইয়া দিবে।

এখান হইতে সোজা দক্ষিণ দিকে নদীর গতি। চাহিলে শেষ অবধি দেখা যায়। বহু দূরদূরান্তর হইতে, দক্ষিণের রাজ্য হইতে কেউ বুঝি ঢেউ চালাইয়া দেয়, সেই ঢেউ আসিয়া লাগে অনন্তর এই নৌকাখানাতে। সেদিকে চোখ মেলিয়া চাহিয়া থাকে। কিন্তু সে ত ওদিক হইতে আসিবে না, সে আসিবে পশ্চিম দিক হইতে।

অনন্ত একএকবার পশ্চিম দিকে যতদূর চোখ যায়, চাহিয়া দেখে—সে আসে না। ব্যর্থতায় তার মন ভরিয়া যায়। আবার দক্ষিণ দিকে চায়, দেখে নদী কত দীর্ঘ। এই দীর্ঘত তার মন আশায় ভরাইয়া দেয়।

বিকালে ক্ষুধা পাইলে চুপি চুপি নামিয়া আসিয়া সেই পানওয়ালাটার সামনে দাঁড়াইল। আজ হাটবার নয়। পানওয়ালা তেমনিভাবে পান ভাজাইয়া চলিয়াছে। তার ইঙ্গিত পাইয়া এক হাঁড়ি জল তুলিয়া দিল। সেও প্রতিদানে এক গোছা পান তার দিকে ফেলিয়া দিল। অনন্ত পান লইল না। কি ভাবিয়া লোকটা একটি পয়সা দিল। অনন্ত এক পয়সার ছোলাভাজ খাইয়া দেখিল পেট ভরিয়া গিয়াছে।

কালো আঁধার। পাটাতনে শুইয়া খুব ভয় করিতেছিল। কিন্তু কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সকালে জাগিয়া দেখে সারারাত তার মা ঠিক তার কাছটিতে শুইয়া গিয়াছে, তার দেহের উষ্ণতা এখনও পাটাতনে লাগিয়া রহিয়াছে। ওরা মিথ্যাকথা বলিয়াছে। মা কি কখনও তার অনিষ্ট করিতে পারে? মা দিনের বেলা দেখা দিতে পারে না মরিয়া গিয়াছে বলিয়া, কিন্তু রাতে ঠিক আসিবে। আর সে কিছুরই ভয় করিবে না।