☼ অদ্বৈত মল্লবর্মণ ☼
তিতাস একটি নদীর নাম
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
চৈত্রের মাঝামাঝি। বসন্তের তখন পুরা যৌবন। আসিল দোল পূর্ণিমা। কে কাকে নিয়া কখন দুলিয়াছিল। সেই যে দোলা দিয়াছিল তারা তাদের দোলনায়, স্মৃতির অতলে তারই ঢেউ। অমর হইয়া লাগিয়া গিয়াছে গগনে পবনে বনে বনে, মানুষের মনে মনে। মানুষ নিজেকে নিজে রাঙায়। তাতেও পূর্ণ তৃপ্তি পায় না। প্রিয়জনকে রাঙায়, তাতেও পূর্ণ তৃপ্তি পায় না – তখন তারা আত্মপর বিচার না করিয়া, সকলকেই রাঙাইয়া আপন করিয়া তুলিতে চায়।
তেমনি রাঙাইবার ধুম পড়িয়া গেল শুকদেবপুরের খলাতে
তারা ঘটা করিয়া দোল করিবে, দশজনকে নিয়া আনন্দ করিবে। শুকদেবপুর গ্রামের সকলকেই তারা নিমন্ত্রণ করিল। মোড়লের গাঙের রায়ত হিসাবে কিশোররাও নিমন্ত্রিত হইল। কাল সকাল থেকে রাত অবধি হোলি, গানবাজনা, রঙখেলা, খাওয়া-দাওয়া হইবে।
‘খলাতে দোল-পুন্নিমায় খুব আরব্বা হয়। মাইয়া লোকে করতাল বাজাইয়া যা নাচে! নাচেত না, যেন পরীর মত নিত্য করে। পায়ে ঘুঙরা, হাতে রাম-করতাল। এ নাচ যে না দেখছে, মায়ের গর্ভে রইছে।’
তিলকের এই কথায় সুবলের খুব লোভ হইল। কিন্তু তার মন অপ্রসন্ন। ধুতি গামছা দুইই তার ময়লা।
কিশোর সমাধান বাতলাইয়া দিলঃ নদীর ওপারে হাত বসে। সাবান কিনিয়া আনিলেই হয়।
কিন্তু এক টুকরা সাবানের জন্য এত বড় নদী পাড়ি দেওয়া চলেনা।
শেষে সমাধান আপনা থেকেই হইয়া গেল।
ভাটিতে বেদের বহর নোঙর করিয়াছে। বেদেনীরা আয়না চিরুনী সাবান বঁড়শি, মাথার কাঁটা, কাঁচের চুড়ি, পুঁতির মালা লইয়া নৌকা করিয়া শুকদেবপুরের ঘাটে ঘাটে বেসাত করিয়া যায়। সাপের ঝাঁপিও দুই একটা সঙ্গে থাকে।
কিশোরেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত। বেলা বাড়িয়াছে। আর একটু বাড়িলে মাছেরা অতলে ডুব দিবে। এখনি যত ছাঁকিয়া তোলা যায় নদী হইতে। উঠিতেছেও খুব। এমন সময়ে এক বেদেনী ডাক দিল, ‘অ, দাদা, মাছ আছে?’
কিনিতে আসিয়া তারা বড় বিরক্ত করে। তিলক ঝান্নু লোক। বলিল, ‘না মাছ নাই।’
বেদেনীর বিশ্বাস হইল না। বৈঠা বাহিয়া তার বাবুই পাখির মাসার মত নৌকাখানা কিশোরদের নৌকার সঙ্গে মিশাইল। সে তার নৌকার দড়ি হাতে করিয়া লাফ দিয়া কিশোরের নৌকায় উঠিল, ডরার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কি জাল্লা, মাছ না নাই! চাইর পয়সার মাছ দেও।’
কিশোরের জালে অনেক মাছ উঠিয়াছে। বাঁশের গোঁড়ায় পা দিয়া, জালের হাতায় টান মারিয়া সে বুক চিতাইল; তার পিথ ঠেকিল বেদনীর বুকে।
বেদেনী তরুণী। স্বাস্থ্যবতী। তার স্তনদুইটি দুর্বিনীতভাবে উঁচাইয়া উঠিয়াছে। তার কোমল উন্নত স্পর্শ কিশোরের সর্ব-শরীরে বিদ্যুতের শিহরণ তুলিল। বাঁশের গুড়ি হইতে পড়িয়া গিয়া, হাত পা ভাঙ্গিয়া সে হয়ত একটা কাণ্ড করিয়া বসিত। বেদেনী এক হাত ডান বগলের তলায় ও অন্য হাত বাম কাঁধের উপরে দিয়া বুক পর্যন্ত বাড়াইয়া কিশোরকে নিজের বুকে চাপিয়া ধরিল। অবলম্বন পাইয়া কিশোর পড়িয়া গেল না। কিন্তু দিশা হারাইল। বেদেনীর বুকটা সাপের মত ঠাণ্ডা। তারই চাপ হইতে ধীরে ধীরে মুক্ত করিয়া দিয়া বলিল, ‘অ দাদা, পড় কেনে। আমারে ধরবার পার না?’
তিলক গলুই হইতে ডাকিয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি তোমার নাওয়ে যাও।’
‘তুমি বুড়া মানুষ, তোমার সাথে আমার কি? আমার বেসাতি এই জনার সাথে।’ সে কিশোরের কাঁধের উপর হাত দিয়া আবার তার বুকখানা কিশোরের পিঠে ঠেকাইতে গেল।
‘এ জনা তোমার কোন্ জনমের কুটুম গো?’
‘শকুন্যা বুড়া, উকুইন্যা বুড়া, তুই কথা কইসনা, তুই কেমনে্ জানবি এজনা আমার কি?’
নিজের লোককে গাল দিতেছে। উভয়সঙ্কটে পরিয়া কিশোর বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি অখন তোমার নাওয়ে যাও।’
‘মাছ দিলেই যাই। বাস করতে কি আইচই?’
‘এই নেও চাইর পয়সার মাছ। এইবার যাও।’
‘মাছ পাইলাম, কিন্তু মানুষ ত পাইলাম না। তুমি মনের মানুষ।’
‘নাগরালি রাখ। আমার তিলকের বড় রাগ।’
‘রাগের ধার ধারি না। মনের মানুষ থুইয়া যাই, শেষে বুক থাপড়াইয়া কান্দি। অত ঠকাঠকির বেসাতি আমি করি না।’
কিশোরের হাসি পাইল। বলিল, ‘এক পলকে মনের মানুষ হইয়া গেলাম। তোমার আগের মনের মানুষ কই?’
‘উইড়া গেছে, সময় থাকতে বান্ধি নাই, তোমারে সময় থাকতে বান্ধতে চাই।’
‘কি তোমার আছে গো বাদ্যানী, বান্ধবা কি দিয়া?’
‘সাপ দিয়া। ঝাঁপিতে সাপ আছে –’
বেদেনী ঝাঁপি খুলিয়া দুই হাতে দুইটা সাপ বাহির করিয়া আনিল। আগাইয়া দিল কিশোরের গলার কাছে।
কিশোর ভয় পাইয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি তোমার সাপ সরাও। বড় ডর করে।’
‘সরাইতে পাড়ি, যদি আমার কথা রাখ।’
‘কি কথা, কও না।’
‘আর দুইটা মাছ ফাও দেও – ’
‘এই নেও!’ কিশোর অপ্রসন্ন মুখে কতকগুলি মাছ তুলিয়া দিয়া বলিল, ‘এইবার তুমি যাও।’
‘যাই। তুমি বড় ভাল মানুষ। তুমি আমার নাতিন-জামাই।’
কিশোর সর্গের ইন্দ্রসভা হইতে একঠেলায় মাটিতে পরিয়া গেল!
বেদেনী বিজয়িনীর বেশে চলিয়া যাইতেছিল, এমন সময় সুবল ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তোমার কাছে সাবান আছে? আমারে দুই পয়সার সাবান দিয়া যাও।’
গান শুরু হওয়ার আগেই তিন জনে সজা-গোজ করিয়া খলায় উপস্থিত হইল। সাজের মধ্যে, ধুতি ঢিলা করিল, গামছা কাঁধ হইতে কায়দা করিয়া বুকে ঝুলাইল। পেশীবহুল বাহু বুক এই সজ্জাতেই শ্রীসম্পন্ন হইয়াছে। গিয়া দেখে অপরূপ কাণ্ড।
মোড়লের বড় বড় চারিটা বিল আছে। বর্ষাকালে চারিদিক জলে একাকার হইয়া যায়। তখন দেশদেশান্তরের মাছ এই সব বিলে আসর জমায়। জল কমিয়া আসিলে মোড়লের লোকেরা বিলগুলিতে বাঁধ দেয়। সব মাছ তখন বন্দী হয়। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ রুই কাতলা নান্দিল মৃগেল মাছ। দূরদূরান্তরের গ্রাম হইতে মালোদের অনেক নৌকা আসে। একএকটি নৌকাতে থাকে চার পাঁচজন পুরুষ ও পনর কুড়িজন স্ত্রীলোক। এমনিভাবে বারো গাঁয়ের বারো রকম মালোনরনারী এক জায়গায় জড়ো হয়। ছয় মাসের স্থায়িত্ব নিয়া বড় বড় চালাঘর উঠিতে থাকে। একেকটা চালা একদৌড়ের পথ লম্বা।
কারোর সঙ্গে কারোর কোনকালে দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। এখানে আসিয়া সকলে এক সংসারের লোক হইয়া গিয়াছে। এক সঙ্গে খায়, থাকে, কাজ করে। মহোৎসবের রান্নার মত স্তূপাকারে ভাত তরকারি রান্না হয়। ঢালা পংক্তিতে বসিয়া খায়। মুখ ধুইয়া আবার কাজে বসে।
কি অত কাজ? না, মেয়েরা বটি মেলিয়া কাতারে কাতারে বসিয়া যায়। পুরুষেরা মাছের ঝুড়ি ধরাধরি করিয়া আনিয়া তাহাদের পাশে স্তূপ করিতে থাকে। মেয়েদের হাত চলে ঠিক কলের মত। এতবড় মাছটাকে পলকে ঘুরাইয়া পেটে পিঠে গলায় তিন পোচ দিয়া ঘাড়ের উপর দিয়া ছুঁড়িয়া মারে, সে-মাছ যথাস্থানে জড় হয়। আরেক দল পুরুষ সেখান হইতে নিয়া ডাঙ্গিতে তোলে শুখাইবার জন্য। দিনের পর দিন এই ভাবে তিন মাস কাজ চলে। ছয় মাসের প্রবাস সারিয়া তারা যার যার দেশে পাড়ি জমায়। ইহাকে বলে ‘খলা-বাওায়া।’
তারা ঝুড়িভরা আবির আনিয়াছে। গামলাভরা রঙ গুলিয়াছে। চৌকোণা চার-থাকের একটা মাটির সিঁড়ির উপর দুই পাশে পোঁতা দুইখানা বাঁশের সঙ্গে দড়ি বাঁধিয়া একখণ্ড সালু কাপড়ে একটি ছোট গোপাল ঝুলাইয়াছে। নিতান্তই নাড়ুগোপাল। পাশে রাধা নাই। হামা দিয়া হাত বাড়াইয়া লাল কাপড়ের বাঁধনে লটকাইয়া একা একাই ঝুলিতেছে। এক-একজন আসিয়া তার গায়ে মাথায় আবির মাখাইয়া একটা করিয়া দোলা দিয়া যায়। তারই দোলনে সে অনবরত দুলিয়া চলিতেছে।
এ-পক্ষ প্রস্তুত। শুকদেবপুরের দল এখনো আসিয়া পৌঁছায় নাই। আপ্যায়নকারীদের একজন তিলকদিগকে ঠাকুরের কাছে নিয়া ঝুড়ি হইতে কয়েক মুঠা আবির একখানা ছোট পিতলের থালিতে দিয়া বলিল, ‘ঠাকুরের চরণে আবির দেও।’
প্রেমের দেবতা কোথায় কার জন্য ফাঁদ পাতিয়া রাখে কেউ কি বলিতে পারে? উজানীনগরের খলাতে কিশোর এমনি একটা ফাদে পড়িল। কার সঙ্গে কার জোড়বাঁধা হইয়া থাকে তাও কেউ বলিতে পারে না। যাকে জীবনে কখনো দেখি নাই হঠাৎ একদিন তাকে দেখিয়া মনে হয় সে যেন চিরজনমের আপন। প্রেমের দেবতা অলক্ষে কার সঙ্গে কখন কার গাঁটছড়া বাঁধিয়াছেন কেউ জানে না।
তারাত তিন জনে গোপালকে আবিরে রঞ্জিত করিল। তারপর কয়েকজন পুরুষ মানুষ তাহাদের গালে মাথায় আবির দিয়া রাঙাইবার পর তিন চারজন স্ত্রীলোক আবিরের থালা লইয়া আগাইয়া আসিল। কয়েকজন, কিশোরের কাছে মাতৃসমা। তারা কিশোরের কপাল রাঙাইল। আশীর্বাদের মত সে-আবির গ্রহণ করিয়া কিশোর নিজে তাদের পায়ে আবির মাখাইয়া কপালে পায়ের ধূলা ঠেকাইল।
কয়েকজন তরুণী। বোন বউদিদের বয়সী। তারা আবির লাগাইল গালে আর কপালে। কিশোর নীরবে গ্রহণ করিল। গোলমালে ফেলিল আর একজন।
অবিবাহিতা মেয়ে। দেহে যৌবনের সব চিহ্ন ফুটিয়াছে। সে-সব ছাপাইয়া বহিয়াছে রূপের বান। বসন্তের এই উদাত্ত দিবসে মনে লাগিয়াছে বাসন্তী রঙ। প্রাণে জাগিয়াছে অজানা উন্মাদনা। পঞ্চদশী। বড়ই সাংঘাতিক বয়স এইটা। মনের চঞ্চলতা শরীরে ফুটিয়া বাহির হয়। হইবেই। মালোর মেয়েরা বিবাহের আগে অত বড় থাকে না। অতখানি বড় হয় বিবাহের দুই তিন বছর পর। কোথা হইতে কেমন করিয়া এই অনিয়ম এখানে আসিয়া পড়িয়াছে।
কিশোরের গালে আবির দিতে মেয়েটার হাত কাঁপিল; বুক দুরু দুরু করিতে লাগিল। তার ছন্দময় হাতখানার কোমল স্পর্শ কিশোরের মনের এক রহস্যলোকের পদ্মরাজের ঘোমটা-ঢাকা দলগুলিকে একটি একটি করিয়া মেলিয়া দিল। সেই অজানা-স্পর্শের শিহরণে কাঁপিয়া উঠিয়া সে তাকাইল মেয়েটির চোখের দিকে। সে-চোখে মিনতি। সে-মিনতি বুঝি কিশোরকে ডাকিয়া বলিতেচেঃ বহুজনমের এই আবিরের থালা সাজাইয়া রাখিয়াছি। তোমারই জন্যে। তুমি লও। আমার আবিরের সঙ্গে তুমি আমাকেও লও।
থালা সুদ্ধ তার অবাদ্ধ হাত দুইটি কাঁপিতেছে। লজ্জায় লাল হইয়া সে চোখ নত করিল। তাকে বাঁচাইল তার মা। মাথার কাপড় একটু টানিয়া সলজ্জভাবে তার মেয়েকে নিজের বুকে আশ্রয় দিল।
কিশোরের ধ্যান ভাঙ্গিল সুবল। হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়া বলিল, ‘অ দাদা, গানের আসরে চল।’