☼ অদ্বৈত মল্লবর্মণ ☼
তিতাস একটি নদীর নাম
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
যে-শিশু আকাশ-কোণে হামাগুঁড়ি দিয়া উঠিয়াছিল, সে এখন ধাপে ধাপে আগাইয়া আসিতেছে। সুনীল স্বচ্ছ আকাশখান দূরের না-দেখা-জগৎ হইতে অনেকখানি নিচে যেন নামিয়া আসিয়া ঘুমন্ত মালোপাড়ার উপর চাদোয়া ধরিয়াছে। গায়ে-গায়ে লাগানো ছনের ঘরগুলি বিমল আলোর ধারায় স্নান করিয়া এককালে মাথা তুলিয়া আছে। কানাচে কানাচে পড়িয়াছে ছোট ছোট ছায়া। তাই মাড়াইয়া চলিতে লাগিল রামপ্রসাদ। মালোপাড়ায় জোৎস্নার এমন অজস্রতা। এর প্রতিঘরের উপর গলিয়া-পড়া রূপলোকের এমন পরিপূর্ণ হাসি। নির্মল আকাশের স্বচ্ছতার সঙ্গে মাথা-উচুকর ঘরবাড়িগুলির এমন আবেগময় আলিঙ্গন। এ দৃশ্য পাড়ার আর কেউ দেখিল না, দেখিল কেবল রামপ্রসাদ।
আরো একজন দেখিতেছিল। কিন্তু সে দেখা অর্থহীন, অনুভূতিহীন। রামপ্রসাদ গিয়া রামকেশবের উঠানে পা দিতেই দেখে, সে ধাঁ করিয়া উঠানের একধার হইতে অন্যধারে চলিয়া যাইতেছে।
রামকেশবের উঠানে আলোর তেজ কম। সারা উঠান ঢাকিয়া বাঁশের আগায় জাল ছড়াইয়া রাখিয়াছে। মাটির উপর তার ছায়া পড়িয়াছে। জালের খোপের ভিতর দিয়া মাছেরা মাথা গলাইতে পারে না, কিন্তু চাঁদের আলোরে আটকায় কার সাধ্য। প্রতি খোপের ফাঁক দিয়া সে আলো উঠানের স্বচ্ছ মাটিতে পড়িয়াছে। কোন্ সুচতুর মালোর মেয়ে বুঝি অপার্থিব ক্ষমতায় আলোর জাল বুনিয়া রামকেশবের উঠানের মাটিতে বিছাইয়া দিয়াছে।
উত্তরের ভিটির ঘর রামকেশবের। দুইচালের ঘর। সামনে একফালি বারান্দা। অনুচ্চ ভিটির কিনারাগুলি স্থানে স্থানে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। ঘরের পুবের অংশ অন্দরমহল। এককালে আবরু-বেড়া ছিল। ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে অনেক দিন। আগে ছেঁড়া জাল দিয়া ভাঙ্গ জায়গাগুলি ঢাকিবার চেষ্টা হইত। এখন আর সেরূপ চেষ্টা নাই, দেখিলেই মনে হইবে এ বাড়ির আবরুরক্ষার প্রয়োজন ফুরাইয়া গিয়াছে।
বারান্দার উপরে একপাশে চালের সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখিয়াছে কতকগুলি এলোমেলো দড়াদড়ি। তার পাশে কয়েকটা ছেঁড়াজালের পুটুলি উপরি-উপরি মাটিতে ফেলিয়া রাখিয়াছে। তারই উপরে কুকুর-কুণ্ডলী দিয়া বোধ হয় লোকটা শুইয়াছিল। ধণ করিয়া উঠানে নামিয়া রামপ্রসাদের সামনা দিয়া ভৌতিক ক্ষিপ্রতায় তিন লাফে উঠান পার হইয়া গেল। খালি গা। পরনে একখানি গামছা। মাথায় এক বোঝা আলুথালু চুল। মুখ ভরতি দাড়ি। যাইবার সময় জালের নিচেকার বুনানো আলোছায়ায় তার মাটিমাখা কালো শরীরটা চিক্চিক্ করিয়া উঠিল। একটু অস্বাভাবিক ফোলা শরীর।
রামপ্রসাদ দেখিয়া চিনিল!
সে বুলানো হাত ছটি ঘনঘন নাড়িতে নাড়িতে মুখ বাড়াইয়া আক্রমণের ভঙ্গিতে আগাইয়া আসিল। রামপ্রসাদের মুখের কাছে মুখ আনিয়া বিকৃতমুখে মান একটু হাসিয়া বিজ্ঞের মত আস্তে বলিল, ‘অ, মাত্বর, অতদিন পরে। আচ্ছা বারিন্দায় উঠ, দেখ কি কাণ্ডখান হইয়া আছে।’
‘কি কাণ্ড হইয়া আছে। আরে শালা কি কাণ্ড।’
‘দেখ না গিয়া? হাত ধরিয়া বারান্দায় তুলিয়া নিয়া দেখাইল। দা দিয়া মাটিতে তিন চারটা গর্ত খুড়িয়াছে। লম্বা গর্ত। একটার মুখ খুঁড়িতে খুঁড়িতে আরেকটার গায়ের উপর তুলিয়া দিয়াছে। সেইখানে আঙ্গুল ঠেকাইয়া বলিল, ‘দেখ চাইয়া, কি হইতাছে। মাইয়া চুরি হইতাছে। এই তোমার মেঘনা গাঙ, অইখানে খাড়ি। খাড়িতে আছিল নাও, বড় গাঙে কি কইরা গেল। জাইগ্যা দেখি মাইয়াচুরি হইতাছে। বাইরে জোছনা ফট্ফট্ করে, ভিতরে আন্ধাইরে মাইয়া চুরি হয়। তুমি কি কও মাত্বর।’
রামপ্রসাদ কিছুই কহিল না। তিতাসের শুশুক মাছগুলি যেমন সন্ধ্যার ছায়া পাইয়া ভাসিয়া নিঃশ্বাস ছাড়ে, জালের পুটুলিগুলির উপর বসিতে বসিতে তেমনি ফোস করিয়া একটা নিঃশ্বাসের শব্দ তার নাক দিয়া বাহির হইল।
ঘরের ভিতর রামকেশব অকাতরে ঘুমাইতেছে। নাকডাকার শব্দ শোনা যায়। শেষরাতে জালে যাইবে। এখন তাকে ডাকিয়া জাগান মর্মান্তিক। ঘুমভাঙা মানুষ মাথা ঠিক রাখিয়া জাল ফেলিতে পারে না। তার রোজগারটাই মাটি হইবে। শেষরাতের আর দেরি কত।
রামপ্রসাদ অধিক ভাবিতে পারিল না। চিন্তাতে বিমনা, ক্লান্তিতে অবশ রামপ্রসাদকে জালের উষ্ণতাটুকুর মাঝে ঘুম একেবারে কাত করিয়া ফেলিয়া দিল।
রাত শেষ হইবার আগেই একবার ঘুম ভাঙিয়াছিল। পাগল তাহার একান্ত কাছে। হাতের কাছে মাটি খুড়িবার একটা দা রাখিয়াছে। একটা কিছু করিয়া ফেলা স্বাভাবিক। চোখ মেলিবার সঙ্গে সঙ্গে এ-ভয়ই সে করিতেছিল। চোখ খুলিয়া দেখে, একজন তার অতি কাছে বসিয়া, মুখখানা তারই মুখের কাছাকাছি। ভয় পাইবার আগে জড়তাগ্রস্ত চোখ কচলাইয়া আবার দেখিল-—রামকেশব। তাকে আগলাইয়া রাখিয়াছে। বুড়ার দাড়িগুলি তার দাড়িগুলির একান্ত কাছে। প্রশস্ত লোমশ বুকখানাও তার বুকের অতি নিকটে। তার লোমশ বুকের উষ্ণতা রামপ্রসাদের বুকেও লাগিতেছে।
রামকেশবের বয়স তার চাইতে আরো বেশি। শরীর তার মতই শক্তির পরিচয় দিলেও, তার চাইতে বেশি ভাঙিয়া পড়িয়াছে। চুল দাড়ি চোখের ভ্রূ কানের লোম এখনো কাঁচাপাকা। রামপ্রসাদের শণের মত শাদা চুলদাড়ির নিকট তাকে আকাশের পথে কাত-হইয়া-দৌড়-দেওয়া চাঁদের বারান্দায়-ঢুকিয়া-পড়া আলোতে নাবালকের মত দেখাইতেছে। যেন দুইটি প্রাগৈতিহাসিক শিশুর অপার্থিব সমন্বয় ঘটিয়াছে, যার ইতিহাস স্তব্ধ রাত্রি ছাড়া আর কেউ জানে না। আর একজন যে জানে, তার কোন অনুভূতি নাই।
দুইজনের মধ্যে এই রকম কথাবার্তা হইল—
—মাতবরের ছেলে, ডাক দিলে না, কোন সময়ে আসিয়াছ জানিলাম না। শীতে কষ্ট পাইলে।
—না মালোর ছেলে, শীতে কষ্ট বেশি পাই নাই। ঘুমাইয়া পড়িলে আবার কষ্ট কি। ভাবিলাম তুমি যখন শেষরাতে নদীতে যাইবে, তোমার নৌকায় আমি যাইব। তুমি আমাকে যাত্রাবাড়িতে নামাইয়া দিবে।
—সারা রাতে একবার বাহির হইয়াছিলাম। বাহির হইয়া দেখি একটা মানুষ। কাছে আসিয়া দেখি তুমি। জাগাইলাম না। পাগলট কাছে। তাই বসিয়া গেলাম শিয়রে। রাতের জালে যাওয়া আর বাবা আমারে দিয়া কুলাইবে না। খেউ তুলিয়া জালে হাত দিলে হাত ঠক ঠক করিয়া কাপে। গাঙের বাতাসে কান-কপাল ভাঙ্গিয়া নামায়। বুক যেন ভের্ণতা ছুরি দিয়া কাটে। আমার কি আর বাবা মাছ ধরার সময় আছে। আমার এখন গুফার মধ্যে বসিয়া বসিয়া তামাক টানিয়া কাটাইবার দিন। বিধি তারে কোন পাগল বানাইল। কত পাগল ভাল হয়, আমার পাগল আর ভাল হইল না। ঘরে আসিয়া বস, আমি তামাক জ্বালাই।
মাটির গাছাতে কেরোসিনের আলো মিটমিট করিতেছে। বাহির হইবার সময়েই রামকেশব জালিয়াছিল। তারই মলিন আলোতে ঘরখানার মলিনতা অধিকতর স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। ভাঙা চাটাইর উপর ময়লা ছেঁড়া কাঁথা পাতিয়া বিছানা। দুইটি বালিশের একটিতে তুলা বাহির হইয়াছে। সেটিতে রামকেশব শুইয়াছিল, চুলে দাড়িতে একটু একটু তুলা এখনো লাগিয়া রহিয়াছে। অন্য বালিশটিতে মাথা রাখিয়া যে শুইয়া আছে, খুব ভারী রোঁয়াওঠা কাঁথাতে তার পা থেকে মাথার বালিশ অবধি ঢাকা। সে রামকেশবের পরিবার।
‘অ বুড়ি, উঠ, চাইয়া দেখ্ —’
কাঁথার পুঁটুলি নড়িয়া উঠিল। মলিন কন্থাবরণের অন্তরাল হইতে উন্মোচিত হইয়া ততোধিক মলিন মুখখানা প্রশ্ন করিল, ‘অত রাইতে বাড়িতে কোন কুটুমের পাড়া।’
‘বজ্জাত বুড়ি, কথা কইস না। জামাই!’
জামাই! জীর্ণ স্মৃতির ছেঁড়া সূতাগুলি মিলাইতে অনেকবার চেষ্টা করিল। কিন্তু তার বাড়িতে জামাই কে আসিতে পারে হিসাবে মিলাইতে পারিল না। পিচুটি-পড়া চোখে ঘুমের ঘোর। ছাপপড়া খড়িওঠা চামড়ার মুখমণ্ডলে
ঘুমের জড়-প্রলেপ। তার উপর ফাঁকে ফাঁকে দাত না থাকায় মুখের ইঁ। —এ সকল মিলাইয়া বুড়ির হতবুদ্ধির মত তার দিকে চাহিয়া থাকাকে রামকেশবের নিকট এত কুৎসিৎ মনে হইল যে, আর সহ করিতে পারিল না। হাত ধরিয়া তাকে এক টানে তুলিয়া বসাইল। খুলিয়া-যাওয়া কটির ও বুকের কাপড় অশেষ চেষ্টায় ঠিক করিতে করিতে বুড়ি জিজ্ঞাসা করিল, ‘জামাই আইল কোন খান থাইক্যা, না কইলে কেমনে বুঝি কও।’
‘যাত্রাবাড়ির জামাই। বসন্তর বাপ।’
ভাগ্নী-জামাই। দেশদেশান্তরে মান্য করে। ভাগ্নী মরিয়া গিয়াছে। তাই এবাড়িতে আর আসা-যাওয়া নাই।
বুড়ির মাথা কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হওয়ার পর ঘোমটা টানিয়া দেওয়ার কথা মনে পড়িল।
রাতের স্তব্ধতা ভেদ করিয়া অনেক দূরে মোরগ ডাকিয়া উঠিল। যারা খাটিয়া খায় ইহা তাদের নিকট ব্রাহ্মমুহূর্ত। এই সময়ে চাষীর মেয়ের ধানসিদ্ধ করিবার জন্য উনুনের মুখে আগুন দেয়। মালোর মেয়ের চোখে মুখে জল দিয়া শণস্থত। কাটিতে বসে। পুরুষেরা যারা আগ-রাতে যায় নাই, এই সময়ে জাল-কাঁধে রওনা হয়।
কাঁধে জাল হাতে হুকা রামকেশব বাহিরে পা দিতে দিতে বলিল, ‘মাত্বরের পুত, আইজ কিন্তু যাইও না।’
প্রতিটি ঘরের আঙ্গিনাতে রোদ নামিয়াছে। সকালের সোনালি রোদ। কারো বউ-ঝি বসিয়া নাই। কারো ছেলেমেয়ে বিছানায় পড়িয়া নাই। তারা আঙ্গিনায় নামিয়া পড়িয়াছে। মায়েদের শাড়ি দুই ভণজ করিয়া গা ঢাকিয়া গলাতে বাধা ছিল। রোদ পাইয়া খুলিয়া দিয়াছে। খালি গায়ে এখন খেলাতে মগ্ন। কালোতে ফরসাতে মেশা সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল শিশুর দল।
রামপ্রসাদ তাহাই দেখিতে দেখিতে নদীর দিকে চলিল। তার চোখে আজ রোদের সোনা মিশিয়া চারদিক সোনাময় হইয়া গিয়াছে। আজ এরা যেন সব সোনার শিশু। সোনার খেলন হাঁড়িখুঁড়ি লইয়া রূপার বালিতে ভাত চাপাইয়া চাঁদসুরুজের দেশে নিমন্ত্রণ পাঠাইয়াছে। তবে নেহাৎই খাইবার স্থূল নিমন্ত্রণ।
অনন্তও আঙ্গিনাতে নামিয়া খেলায় মাতিয়াছে। মায়ের শাদাপাড়ের কাপড়খানা দুই ভাঁজ করিয়া গলায় বাঁধা।
রামপ্রসাদ তার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। সেও এই শাদাচুল দাড়িওয়ালা লোকটার দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর সহসা কি ভাবিয়া বারান্দার উপর উঠিয়া ডাকিল, ‘মা।’
মা বারান্দায় নামিয়া, এমন মানুষকে তার তাঙ্গিনায় এমন বিহবলভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া এত বিস্মিত হইল যে, না পারিল ভিতরে চলিয়া যাইতে না পারিল মাথার ঘোমটা টানিয়া দিতে।
রামপ্রসাদ আরও অগ্রসর হইয়া অনন্তর একখানা হাত ধরিয়া হাসিমুখে বলিল, আমাকে দেখিয়া তোর ভয় করে? আমি তো তোর এখানে কোন বিচার করিতে আসি নাই। আসিয়াছি কেবল তোকে দেখিবার জন্য। ভিন্ন গ্রামের মানুষ আমি। আমার বাড়িতে তোর মার মত মা নাই। আমার আঙ্গিনাতে তোর মত ছোট দাতৃভাইয়েরা খেলা করে না। মা যদি এ গায়ে না উঠিয়া আমার গায়ে গিয়া উঠিত, এক ঘর আছি, আমার গায়ে তাহা হইলে দুই ঘর হইত।
…