☼ অদ্বৈত মল্লবর্মণ ☼
তিতাস একটি নদীর নাম
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এ গাঁয়ে একজন নূতন বাসিন্দা আসিয়াছে, খবরটা যারাই পাইল তারাই খুশি হইল। মালোপাড়ার সবচেয়ে যে ধনী ছিল, তারই গিন্নি কালোর মা ছেলেদের বলিয়া একখানা পোড়ে ভিটি কম দামে ছাড়িয়া দিল; ছেলেমেয়েরা হৈ চৈ করিয়া তার আগাছা সাফ করিল, তারপর পাড়ার পাঁচজনে মিলিয়া তার উপর একখানা ঘর তুলিয়া দিল।
নূতন ঘরে অনন্তদিগকে রাখিয়া একদিন তুই বুড়া বিদায় হইল। বিদায় দিতে ঘাটে আসিয়া অনস্তুর মা অনেকক্ষণ আত্মসম্বরণ করিয়া ছিল। ঘাটের মেয়ের কাজ ফেলিয়া এই বিদায়দৃশ্য দেখিতেছে।
তাদের নৌকাখানা মাঝ-নদীতে পড়িয়া আগাইয়া চলিয়াছে। এতটুকু পথ গিয়াই বুঝি দুই বুড়া শ্রাস্ত হইয়া পড়িয়াছে। দাঁড় বাহিতে বাহিতে হাতের কব্জিতে তারা কি কপালের ঘাম মুছিতেছে। অনন্তর মার মনে হইল তারা ঘাম মুছিবার ছল করিয়া দুইজনেই চোখের জল মুছিতেছে।
নৌকা আরো দূরে সরিয়া যাইতেছে। আরো আরো দূরে। অনেক ছোট দেখাইতেছে নৌকাখানাকে। মানুষ দুজনকেও এবার দেখাইতেছে অনেক অনেক ছোট। যেন ছুটি শিশু—যেন চাঁদের দেশের দুটি শিশু যাত্রাগানের বুড়ার পোষাক পরিয়া নাও বাহিয়া চলিয়াছে। এ জগতের নয় তারা। কেন আসিয়াছিল—আর থাকিবে না; ক্রমেই উপরে উঠিয়া ছোট হইয়া যাইতেছে—এখনই মিলাইয়া যাইবে।
অনন্তর মা এবার কাঁদিয়া উঠিল।
হয়ত মাটিতে পড়িয়া লুটাইয়া কাঁদিত। এই সময়ে একজন কে আগাইয়া আসিয়া তাকে ধরিয়া ফেলিল।
অশ্রুভরা চোখ তুলিয়া চাহিয়া দেখে, সে তারই সমবয়সী। তারই মত সে-জনারও বিধবার বেশ।
পাড়ার কৌতুহলী নারীরা বলাবলি করে সে কে, কোন দেশে বিয়া হইয়াছিল। ছেলের বাপ কবে মরিয়াছে—ছেলে তখন পেটে, না কোলে, না হাঁটিতে শিখিয়াছে।
কালোর মা মেজাজী মানুষ। স্বামী অনেক টাকা রাখিয়া মারা গিয়াছে। ছেলেরাও রোজগারী। পাড়ার সবাই মান্য করে। বছরে তার ঘরে পাঁচ ছ মণ শণ সূতা কাটা হয়। তাতে বড় বড় জাল বোনে, সে-জালে বড় বড় মাছ ধরে। অনেক টাকা ঘরে আসে।
সেই কালোর মারও কৌতুহল হয়। সকালে একবার দেখিয়া গিয়াছে। বিকালেও দেখিতে আসিল। কথাটা কি করিয়া তোলা যায় ভাবিয়া না পাইয়া শুধু বলিল, ‘কি লামা, তোর মা-আবাগি কি আমার মত?’
‘হ মা, ঠিক তোমার মত।’
‘আছে?’
‘জানি না ত মা?’
‘অ৷ কপাল।’
ঘর বানাইতে হাতের সম্বল ফুরাইয়া গিয়াছে। বাকি দিন কি ভাবে কাটিবে, কালোর মা চলিয়া গেলে সে তাই ভাবিতে বসে।
কিন্তু লোকে তাকে ভাবিবার অবসর দেয় না। একটু পরেই একদল বর্ষীয়সী নারী আসিল। কালোবরণের বাড়িকে বড়বাড়ি বলে। তার বাড়ি আর এ-বাড়ির মাঝখানে একটি বাঁশের বেড়া। সেই বেড়াতে কাপড় শুখাইতে দিয়াছিল। সেখানা আনিয়া বিছাইয়া দিবে কিনা ভাবিতেছে। তার। ভাবিবার অবসর না দিয়া মাটিতেই বসিয়া পড়িল।
একজন বলিল, ‘পান আছে মা?’
আরেকজন বলিল, ‘তামুক খাওয়া। আছে নি হুঙ্কাকলকি? তামুক আছে নি?’ অনন্তর মা মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে থাকে। তার ঘরে এসবের কিছুই নাই।
একজন কোমর হইতে সুচারু কাজ-করা একটি ছোট রঙিন থলে বাহির করিয়া হাতে হাতে পান বাটিয়া দিল। অনন্তর মাকেও একটা পান লইতে হইল। সে-নারীর দাতগুলি পানে কালোবর্ণ। দুই তিনটা পান গালে পুরিয়া আঙ্গুলের ডগায় খানিকটা চুন লাগাইল। চিবানোর ফাঁকে ফাঁকে তারই খানিকটা দাঁতে লাগাইতেছে। মুখখান হইয়াছে টকটকে লাল। অনন্তর মা অবাক হইয়া তার দিকে চাহিয়া রহিল।
‘কি দেখছ, মা, অপাক হইয়া? আমি খুব বেশি বটপাত খাই না। আমি আর কত খাই! আমার শাশুড়িএ যা বটপাত খাইত!’
‘বটপাতা?’ অনন্তর মা বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল।
সে-নারী সঙ্গিনীর দিকে ইঙ্গিত করাতে কথাটা সে বুঝাইয়া দিল, ‘তাইনের শ্বশুরের নাম পাণ্ডব। পান কইতে পারে না, পানেরে কয় বটপাতা।’
—’আর তামুক খাইত আমার শ্বশুর। মাথায় এক ঝাঁকড়া বাবরি চুল। যমদূতের মত চোউখ। আম্রা ডরাইতাম। সারিন্দা বাজাইত আর তামুক খাইত।’
—“আর আমার নন্দের শাশুড়ি। জামাই আইলে তারে ঠকান চাই। পান সাজাইয়া কইত, ‘পান খাও রসিক জামাই কথা কও ঠারে, পানের জন্ম অইল কোন অবতারে। যদি না কইতে পার পানের জন্মকথা, ছাগল হইয়া খা ও শাওড়াগাছের পাতা!’ —খাইত কোন জামাই পান তার সামনে?”
এসব হাসিঠাট্টার কথাতে অনন্তর মার মন বসে না। বর্ষিয়সী রঙ্গিণীরা তার মন পায় না। মনে করে এ নারী অনেক দূরের। এইত একমুঠা মেয়ে। তাকেও দলে পাইবে না! অত দেমাক!
কিন্তু অনন্ত উহাদের মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। এরা বুঝি রূপকথার দেশের। এদের মনেমনে অনেক গল্প জমা আছে, বলিলে কোনদিন ফুরাইবে না।
—একজন গল্পের ঝাপি খুলিল, ‘আমার শ্বশুরের অনেক কিচ্ছা আছে। তুমরি খেলা জানত। উঠানের দুই দিকে দুই উস্তাদ খাড়াইত। একজন মন্ত্র পইড়া সাপ চালান দিত, আরেকজন ময়ুর চালাইয়া সেই সল্প সংহার করত। সেই মন্ত্র না জানা থাকলে মরণ। সেইজন আবার ফিরতি আগুন চালান দিত, অন্তজন বরুণ মন্ত্রে মেঘ নামাইয়া আগুন নিভাইত। একবার কামরূপ কামিখ্যা হইতে এক উস্তাদ বাস্তানী আইল আমার শ্বশুরের লগে তুম্রি খেলতে। পরথম খেলা হইল গাওয়ের আর এক উস্তাদের লগে। বাদ্যানী সরষার মধ্যে মন্ত্র পইড়া উস্তাদের পরাণ টিপ্যা ধরল— বাদ্যানী সরষাবান্ধা গিরোর মধ্যে টিপা দেয়, আর উস্তাদের নাক দিয়া গলগল কইরা রক্ত পড়ে। উস্তাদ এর পালটা মন্ত্র জানত না। আমার শ্বশুর আছিল কাছেই। বাদ্যানীরে এক ধাক্কায় মাটিতে ফালাইয়া সরষা-বন্ধন খুইল্য উস্তাদরে বাঁচাইল। বাদ্যানী রাইগ্য৷ আগুন। কইল, বাপের বেটা হওত, এই মারলাম ভীমরুল বাণ, বাঁচাও নিজেরে। আমার শ্বশুর ধূলাবৃষ্টি বাণে সব ভীমরুলরে কানা কইরা দিল, আর পাল্ট। এমন এক বাণ মারল—বাদ্যানীর পিন্ধনের শাড়ি কেবল উপরের দিকে ওঠে, কেবল উপরের দিকে ওঠে। তুই হাতে যতই নিচের দিকে টাইন্যা রাখতে চায়, শাড়ি ততই ফরাত, কইরা গিয়া উপরে উঠে। শেষে বাদ্যানী এক দৌড়ে তার নাওএর ভিতরে গিয়া লাজ বাঁচাইল।—’
আর বলা হইল না। কালোর মা আসিয়া আসর ভাঙিয়া দিল। সূর্যের উদয়ে যেমন আঁধার সরিয়া যায়, কালোর মার আবির্ভাবে তেমনি গল্পবাজ নারীরা, বেলা বেশি নাই এই অজুহাতে সরিয়া পড়িল।
বেলা কালোর মারও বেশি নাই। তিন বউ সারারাত সূতা কাটিয়া শেষরাতে শুইয়াছিল। অল্প একটু ঘুমাইতেই কালোবরণের জালে যাওয়ার সময় হইল। ভোররাতে রোজ এরা জাল লইয়া নদীতে যায়। বেচার বউরা কি আর করে। স্বামীর পাশ হইতে উঠিয়া কেউ তামাক-টিকার ডিবা, কেউ মালসা খলুই জালের পুটলি হাতে নিয়া বাহির হইয়া পড়ে। ততক্ষণে ফরসা হইতে থাকে। পাখপাখালির ডাক শুরু হয়। কালোর মা যতদিন বাঁচিয়া আছে এই সময়ে বউদের উঠিতেই হইবে। সকল বাড়ির বউদের আগে কালোর বাড়ির বউদের স্নান করিয়া আসা চাই।
তারপর পূবের আকাশ রাঙা করিয়া সূর্য উঠিলে তিনচারিট পড়ে ভিটাতে জালের ঘের দিয়া আগের দিনের মাছ শুখাইতে দেওয়া চাই। কালোর মা ততক্ষণ তরুণ রোদ গায়ে লাগাইতে লাগাইতে তিতাসের পাড়ে গিয়া বাজারের ঘাটের দিকে মুখ করিয়া দাঁড়ায়। রাতের জেলেদের মাছেভর নৌকাণ্ডলিতে বাজারের ঘাট ছাইয়া ফেলে। তার উপর শত শত বেপারি ওঠা নামা করে। সোরগোলের অন্ত থাকে না। তাদেরই একজন কালোবরণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলে, তোমার মা দাঁড়াইয়া আছে। মার দাঁড়াইবার ভঙ্গিটিও রাজসিক। অল্পেতেই চেখে পড়ে। কালোবরণের ভাই এক দৌড়ে একঝাকা মাছ মার হাতে দিয়া যায়। বাড়িতে আনিলে পড়ে কোটার ধূম। দুই বেলার রান্নার মাছ রাখিয়া বাকি মাছ সেই জালের তলাতে রাখিয়া আসে। সারা গায়ের কণক তখন মালোপাড়ায় ভিড় করে। এ পাড়ায় আসিলে কাকেদেরও বেহায়াপনা বাড়ে। মানুষের চোখে ধূলা দিয়া কি করিয়া এক ফাঁকে জালের ঘেরের ভিতর থেকেই শোয়ানো মাছ টানিয়া নেয়। কিন্তু কালোর মা সজাগ। চৌকি পাতিয়া কঞ্চি হাতে নিয়া বসে। কাকের কয়েকটা ছোড়াপালক দড়িতে বাঁধিয়া কঞ্চির আগাতে ঝোলায়। সেই কঞ্চি নাড়িলে কাক কাছে আসে না, কেবল দূরে থেকে কী কী করে। কয়েকটি নাতি, নাতনি আছে। ছোট ছোট টুকরিতে মুড়ি লইয়া বুড়ির কোল ঘোঁসিয়া কেউ বসে, কেউ দাঁড়ায়। যেটি হাঁটিতে পারে না, শুধু দাঁড়াইতে পারে, তার হাত ধরিয়া, অন্য হাতে কঞ্চি দোলাইয়া বুড়ি ছড়া কাটে, ‘কাউয়ার দাদী মরল, কুল দিয়া ঢাকল, দূর হ কাউয়া দূর!’
এই কালোর মার কাছে সময়ের দাম আছে। তার কাছে অনন্তর মা তো দুগ্ধপোষ্য। যারা বিনা কাজে সময় কাটাইতে আসিয়াছিল, তারা চলিয়া গেলে বলিল, ‘কামকাজ নাই কোন?’
কাজের মধ্যে ঘাটে গিয়া এক কলসি জল আনিতে হইবে। এ ছাড়া আর কি যে করিতে হইবে ভাবিয়া পায় না অনন্তর মা। অথচ করিতে হইবে অনেক কিছু। কাজ সে করিবে। কে তাকে হাতে ধরিয়া কাজ করার সন্ধান দেখাইয়া দিবে। কালোর মা কেবল কাজের তাড়া দিতে জানে, কাজের পথ দেখাইতে জানে না।
কাজের পথ যে-জন দেখাইয়া গেল সে সুব্লার বউ।
অল্প বয়সে বিধবা। সেদিন ঘাটে সেই তাকে ধরিয়াছিল। তার সেই সমবেদনার নিঃশ্বাস এখনো অনন্তর মার চোখে মুখে বুকে লাগিয়া আছে।
সুবলার বউ এ কয়দিন কেবল উঁকিঝুঁকি মারিতেছিল। এক থাকিলে দেখে মুখখানা ভার; গোমরা মুখের সঙ্গে ভাব করিতে যাওয়া নিরর্থক। যখন কাছে মানুষ থাকে, তখন মানুষ বলিতে ঐ কালোর মা। মুবলার বউ এই কালোর মাকেই সহিতে পারে না।
হরিণী যেমন নিজের কস্তুরীর গন্ধ অনুভব করে, সুবলার বউয়ের আবির্ভাবও অনন্তর মা তেমনি করিয়া অনুভব করিল। জেলে রমণীর ঘরে থাকিবে কাটা আ-কাটা সূতা, এক আধখানা অসমাপ্ত জাল, আর সূতাকাটার জালবোনার নানা কিসিমের সরঞ্জাম। এই যদি না রহিল তো জেলেনীর ঘরে আর কায়স্থানীর ঘরে তফাৎ রহিল কোথায়। ঘটিবাটিগুলিও দুই দিন মাজা হয় নাই, তাও তার দৃষ্টি এড়াইল না। মনেমনে সুবলার বউ বলিল, এর আলসেমি দুইদিনেই ভাঙ্গিতে হইবে। তার মাথার চুলে দেবদুলভ অজস্রতা। সাধ হয় খুলিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখে। মুখখান মলিন। তবু সুন্দর। চিবুক ধরিয়া নাড়িয়া দিলে বেশ হইত। সুন্দর চোখ দুইটি শুভদৃষ্টির সময় কার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল। কেমন না জানি ছিল সে জন। কিন্তু সে তো আর নাই। এও তো আমারি মত বিধবা।
‘ছাওয়ালের বাপ কবে স্বগ গে গেল দিদি ‘
‘জানি না।’
‘বলি, মারা গেছে ত?’
‘জানি না।’
‘বিয়া হইছিল কোন গাঁয়ে?’
‘জানি না।’
‘আমি কই, বিয়া একটা হইছিল ত?’
‘জানি না দিদি ৷’
সুবলার বউ না চটিয়া পারিল না, ‘পোড়া কপাল! কই, এই ছাওয়ালটা হইছে বিয়া হইয়া ত?’
মনে মনে খানিক ভাবিয়া নিয়া এবারও আগের মতই জবাব দিল, ‘জানি না ত দিদি।’
‘খালি জানি না, জানি না, জানি না। তুমি কি দিদি কিছুই জান না!—না কি জিভে কামড় শিরে হাত, কেমনে আইল জগন্নাথ? আসমান থাইক্য হইছে বুঝি।’
অনন্তর মা অপমানে মরিয়া যাইতে থাকে।
‘ঘরখান যেন শূদ্রাণীর মন্দির। না আছে এক বোন্দা সূতা, না আছে একখান তক্লি। নিজে যেমন ফুল-বামনি,—
‘সূতা পাওয়া যাইব আইজ দুপুরে। ঐ বাড়ির বউঠাকুরাইনে দিবে।’
‘ও, কালোর মা? দর কত?’
‘জানি না। ধারে দিবে।’
সুবলার বউ গম্ভীর হইয়া গেল। এইত জগৎবেড় ফেলিয়াছে। এ দিকে রাঘব-বোয়াল আছে মনের আনন্দে।
‘ভাল মানুষের হাতেই পড়ছ দিদি!’
‘দিদি তুমি কি যে কও। কি সোনার মানুষ গে দিদি। কত আদর করে আমারে আর অনন্তরে?’
সুবলার বউ মনে মনে হাসে।
‘তুমি তারে সন্দে কর কেনে?’
“সন্দে করি কেনে? আমার অন্তরে বড় জ্বালা দিয়া রাখছে। এমন জ্বালা, যা কইবার উপায় নাই, দেখাইবার সাধ্য নাই।’
‘বুঝলাম।’
বাপের ঘরে এক নাল সূতা। কাটিতে হয় নাই। শিখিবারও সুযোগ পায় নাই কোনদিন। দশ শের সূতা লইয়া সে অথৈ জলে পড়িল।
দুপুরের পরে সুবলার বউ কতকগুলি সূতা কাটার হাতিয়ার লইয়া হাজির হইল। সেগুলি মাটিতে নামাইয়া বলিল, ‘এই নেও বড় টাকু, মোটা স্থতার লাগি, এই নেও ছোট টাকু, চিকন সূতার। আর এই একখানা পিঁড়ি দিলাম, ঘাটে গিয়া শণের লাছি এর উপরে আছড়াইয়া ধুইয়া আনবা। তার পর রইদে শুখাইবা। রাইতে আইয়া সব শিখাইয়া দিমু।’
অনন্তর মা’র প্রথম চেষ্টার ফল দেখিয়া সুবলার বউ হাসিয়া খুন। বলে, ‘আমার দিদি কাটুনি সূতা কাটতে পারে, একনাল সুতায় হস্তী বান্ধা পড়ে।’
দ্বিতীয় দিনের ফল দেখিয়া খুশি হইয়া বলিল, ‘এইবার কাট চিকন সূতা ছোট টাকু লইয়া।’
সাত দিনে চৌদ্দ ‘নিড়ি’ সূতা হইল। সাতটা মোটা সূতার, সাতটা সরু সূতার। মোট এক টাকা ও সরু দুই টাকা সের দরে একদিন কৈবর্ত পাড়ার লোক আসিয়া পরমাদরে কিনিয়া নিল।
সূতা বিক্রির পর কালোর মা আসিয়া বসিল, বলিল, ‘পোড়া চোখের জ্বালায় বাঁচি না। বাওচণ্ডীর মত বাইর হইয়া গেল মানুষটা কে গ মা, কে?’
‘নাম ত জানি না মা। খালি মুখ চিনা। ঐ যে সূতা। আনতে গেছলাম—’
‘ও, চিনছি। সুবলার বউ। সুবলা নাই, তার বউ আছে। আগে ডাকত বাসন্তী। আমি ডাকতাম রামদাস্যার ভাগ নি। আমার ছোট পুতের সাথে বিয়ার কথা হইছিল, সেই বিয়া হইল গগনের পুত সুবলার সাথে। সেই সুবলা মরল। ছেমড়ি তার নামের জয়ঢাক হইয়া রইল। অখন ছোট বড় সগলেই ডাকে সুবলার-বউ।’
‘আপনের ছোট ছাওয়ালের সাথে কথাবার্তা ঠিক হইয়া গেছল বুঝি?
‘হমা। তারও আগে হওনের কথা আছিল, রামকেশবের ঘরের কিশোরের সাথে। যে কিশোর অখন পাগল হইয়া বনে বনে ফিরে।’