» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

অষ্টম পরিচ্ছেদ

আলেকসাই ফকির।

আহুতি পড়িলে অগ্নি যেমন হু হু করিয়া জ্বলিয়া উঠে, তেমনি নিৰ্ম্মলার কথা শুনিয়া আমার অন্তরের চিন্তানল আজ শতগুণ পরিবর্দ্ধিত হইল। আমি কিছুতেই এই অসীম চিন্তাসাগরের পরপার প্রাপ্ত হইলাম না, কেবল প্রবল তরঙ্গে কাণ্ডারী-হীন তরীর ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।

এই সংসারে মানবের মন সকল অবস্থাতে ভাবনার সহিত ওতপ্রোত ভাবে বিজড়িত, যেমন শূন্যে লোষ্ট্রের অবস্থান অসম্ভব, তেমনি ভাবনার কবল হ’তে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়া এক প্রকার অসাধ্য ব্যাপার; এই ভাবনা নির্ব্বাচন করবার দোষে ও গুণে মানবের দুর্ল্লভ জন্ম সফল ও বিফল হ’য়ে থাকে, সুখ দুঃখ ভোগ ও স্বর্গ নরক লাভ ঘটে, আত্মা উন্নত কিম্বা অবনত হয়। ফল কথা, অসার ভাবনা ভুলে সেই ভাবময়ের ভাবনায় বিভোর থাকলে, ঊষার উদয়ে অন্ধকার রাশির ন্যায় অন্তরের মালিন্যভাব ও সঙ্কীর্ণতা তখনি লয় হ’য়ে যায়, ঔষধে নম্রশির ভুজঙ্গ সম দুর্দান্ত ইন্দ্ৰিয় প্রায় বশ্যতা স্বীকার করে এবং একপ্রকার অভূতপূর্ব্ব বিমল আনন্দে চিত্তভূমি আপ্লুত হ’য়ে উঠে, কাজেই পরিণামে সেই ভাগ্যবানের পক্ষে নির্ব্বাণের পথ যে সম্যরূপে প্রশস্ত হয় তাহা বলাই বাহুল্য; আবার কোন উর্ব্বর ক্ষেত্রে বীজ বপন না করলে সেই ক্ষেত্র যেমন কণ্টকাকীর্ণ আগাছায় পরিপূর্ণ হ’য়ে থাকে, তেমনি সৎ চিন্তার অভাব হ’লে নানা-প্রকার কুচিন্তা হৃদয়রাজ্যে প্রবেশ করে এবং লোভের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ক’রে একেবারে মানবকে রিপুদের কৃতদাস ক’রে ফেলে। তখন বিবেকের হিতবাণী হিতাহিত জ্ঞানের তীব্র তিরস্কার আর কর্ণকুহরে স্থান পায় না। সে সময় রশ্মি-বিহীন অশ্বের ন্যায় মানব দিক্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হ’য়ে পড়ে; আবরণ হীন কর্পূরের ন্যায় অন্তরের কোমল ভাব ও মনুষ্যত্বটুকু কোথায় উধাও হয়ে যায়; লবণ স্পর্শে জলৌকার মতন সৎ-প্রবৃত্তিগুলি নিতান্ত সঙ্কুচিত হইয়া পড়ে, পশুভাব হৃদয়কন্দরে বদ্ধমূল হ’য়ে বসে, কাজেই তখন মানুষে ও পিশাচে বিশেষ কোন পার্থক্য থাকে না।

পুরুষের পড়্‌তা পড়লে সুসময় এলে এই ভাবনাই আবার সুখের নিদানভূত হয়; কল্পনা-সহচরীর সঙ্গে এই মর্ত্ত্যে থেকেও স্বর্গরাজ্যে ভ্রমণ করে, পারিজাতের সুবাসে রাত্র দিন ভোর থাকে, আবার কাহার সেই ভাবনার প্রভাবে মৰ্ম্মস্থলে যেন শত বৃশ্চিক দংশন করে এবং শরবিদ্ধ হরিণের ন্যায় ভীষণ যাতনায় ছট্‌ফট্ করে।

আমারও যখন সুসময় ছিল, তখন ভাবনায় কত সুখ হ’তো, কত আশা ভরসা সুখ আনন্দ ও উৎসাহ হৃদয় সমুদ্রে ভাসিয়া বেড়াইত, কত মধুর মন প্রাণ স্নিগ্ধকারী সুচিত্র স্বপ্নেলব্ধ বিভবের ন্যায় হৃদয়-দর্পণে প্রতিফলিত হ’তো, কাজেই জীবনের সেই সুখ স্বপ্ন স্বরূপ মধুর ভাবনা আমার কতই প্রীতিপদ হ’য়েছিল; কিন্তু এক্ষণে সেই ভাবনা আমার পক্ষে নিতান্ত মৰ্ম্মঘাতী হ’য়েছে।

আমার জীবনের সেই সুখ চিন্তা অতীব যত্নের সহিত গোপন ক’রে রেখেছিলাম, কাহার নিকট ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করি নাই; কেবল আশা-সূত্র অবলম্বন ক’রে কল্পনা-রাজ্যে ভ্রমণ করতাম; কিন্তু আজ আমার সেই সুখ-চিন্তা অন্তরিত হ’লো এবং তার পরিবর্ত্তে এমন এক মৰ্ম্মভেদী ভাবনা উপস্থিত হ’ল যে, তাহার আক্রমণে আমি নিতান্ত ব্যথিত হ’য়ে পড়লেম, এমন কি আমার বুকের শোণিত যেন শুষ্ক হ’তে আরম্ভ হ’লো।

আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, কিষণজি বাবু কি গিন্নী আমার কেহ আপনার জন নয়। তাহ’লে আমি কে? বাঁবু যে কনৌজী ব্ৰাহ্মণ, তাহারি বা স্থিরতা কি? যেরূপ শুনতেছি তাহাতে বঙ্গবাসী বাঙ্গালী হবার সম্ভাবনা। বোধ হয় সম্পূর্ণরূপে আত্মগোপন করবার অভিপ্রায়ে একেবারে হিন্দু সেজেছেন; কিন্তু ওর গুরুদেব লোকটা কে? তিনি সন্ন্যাসী হ’য়ে আমাকে কোথায় পেলেন, আমার দ্বারায় শেষে তার কি কাৰ্য্য সাধন হবে? এরূপ ছদ্মবেশী নরাধমের উপর আমার প্রতিপালনের ভার কেন দিলেন? প্রভৃতি প্রশ্ন আমার মনোমধ্যে উদয় হ’লো; কিন্তু, একটির মীমাংসা করতে সক্ষম হ’লেম না।

আমার মনের চাঞ্চল্য ভয়ানক বৃদ্ধি পাইল, একবার মনে হ’লো যে, কাশীধামে গিয়ে অভয়ানন্দ স্বামীর অন্বেষণ করি এবং তাঁর নিকট গিয়ে প্রাণের কপাট খুলে সব কথা বলি। কারণ তিনি ছাড়া আর কেহই আমার মনের এই প্রদীপ্ত কৌতূহলানল নির্ব্বাণ করতে পারবে না।

আমার কে পিতা, কে মাতা, কি জাতি, কিরূপ অবস্থায় তিনি আমাকে পেয়েছেন, আমার পিতা মাতা জীবিত আছেন কিনা, তা তিনিই জানেন আর কর্ত্তা বোধ হয় জানলেও জানতে পারেন, কিন্তু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে কোন ফল হবে না, বরং হিতে বিপরীত হবার নিতান্ত সম্ভাবনা। তারপর কাশীধামে স্বামীজির কাছে যাওয়া বড় সহজ কথা নয়। আমার এক পয়সারও সম্বল নাই, সুতরাং এ অবস্থায় আমি কিরূপে সুদূর কাশীধামে যাব?

আমি শয্যার উপর শুয়ে এই সব কথা মনে মনে তোলাপাড়া করিতে লাগিলাম, কিন্তু কিছুই স্থির করতে পারলেম না। অন্তরে বিষম বিপ্লব উপস্থিত হ’লো, ভয়ানক উৎকণ্ঠায় হৃদয় আক্রান্ত হ’লো, কাজেই আমি কিছুতেই আর বিন্দুমাত্র শান্তিলাভে সমর্থ হ’লেম না। পূর্ব্বেকার ভাবনায় সুখ ছিল, ভাবতে ইচ্ছা হ’তো, কিন্তু সম্প্রতি আমি যে নূতন ভাবনা-সাগরে মগ্ন হ’লেম, তাতে আমার হৃদয়-মধ্যে যেন বিষাক্ত শলাকা বিদ্ধ হ’তে লাগল, প্রাণ একপ্রকার অব্যক্ত যাতনায় প্রপীড়িত হ’লো, পূর্ব্বেকার ন্যায় সেই অন্তরের প্রফুল্ল ভাবটুকু আর পুনঃ প্রাপ্ত হ’লেম না। কতদিন পরে যে আমার মনের এই বিষম সন্দেহ নিরাকৃত হবে, তাহা ভবিষ্যতের তমোময় গর্ভে নিহিত ও আমার সৌভাগ্য সাপেক্ষ।

সর্ব্বপ্রকার পার্থিব চিন্তা এখন আমার অন্তর হ’তে অন্তর্হিত হয়েছে, কেবল প্রকৃতপক্ষে আমি যে কোন্ কুলে জন্মগ্রহণ ক’রেছি, স্বামীজী কি সূত্রে আমাকে পেলেন, এই চিন্তাই আমার হৃদয়ে প্রবল হ’য়ে উঠলো, আমি তন্ময়চিত্তে তাহাই ভাবিতে লাগিলাম।

এদিকে ক্রমে বেলা ৫টা বেজে গেল, দিবাকরের সেই সৰ্ব্বজন ভীতকর রৌদ্র-মূর্ত্তি এখন অনেকটা রম্যরূপে পরিণত হ’লো। সুখ-সৌভাগ্য ও দর্প যে কাহার কখন চিরস্থায়ী হয় না, এই নীতি শেখাবার জন্য সূৰ্য্যদেব পশ্চিম গগনে ঢ’লে পড়লেন, উচ্চ উচ্চ বৃক্ষ চূড়া সকল ক্ষণেকের জন্য সুবর্ণ মুকুট মস্তকে পরিধান করিল, পক্ষীকুল স্ব স্ব সন্তানের জন্য আকুল হ’য়ে বিভু গুণ গাইতে গাইতে নিজেদের বাসায় প্রত্যাগত হ’তে লাগলো, গাভীগণ বৎস্যসহ ঘরমুখো হ’লো। সূর্য্যদেবের পতন দেখে দু’ একটি ফুল ক্রমে ক্রমে ঘোমটা খুলে বিদ্রূপের হাসি হাসতে লাগলো, দু’ একটি তারা এই রঙ্গ দেখবার জন্য গগনবক্ষ হ’তে উঁকি দিতে আরম্ভ করলো, ক্রমে সিমন্তিনীর সিমত্তে সিন্দুর বিন্দুর ন্যায় চন্দ্রদেব স্বভাব সুন্দরীর ললাটদেশে শোভা পাইল।

সন্ধ্যা সমাগত দেখে আমার চমক ভাঙ্গিল, আমি বাহিরে আসিয়া মুখ হাত ধুইলাম এবং সদর বাড়ী উদ্দেশে যাত্রা করিলাম!

আমি সদরে আসিয়া দেখিলাম যে, বারাণ্ডায় যে ছোট তক্তপোষখানিতে ব’সে আমি পার্সী পড়ি, সেইখানেতে একজন মুসলমান ফকির বসিয়া আছে।

আমি ফকির সাহেবের সাজগোজ ও ধরণ ধারণ দেখে অবাক্ হ’লেম্। কারণ লোকটা যে কি উদ্দেশে আজ এখানে এসেছে, তা বুঝতে আমার বাকী রইলো না। লোকটা যদিও ফকিরের সাজ ধ’রেছে, কিন্তু তথাপি নিষ্ঠুরতা ও বদমাইসি যেন তার মুখমণ্ডলে মাখানো আছে। কাজেই লোকটা যে সৎ নয়, কোনরূপ দুঃসাহসিক কার্য্যোদ্ধারের উপযুক্ত পাত্র, তাতে আর আমার অণুমাত্র সন্দেহ রহিল না।

ফকির সাহেব লোকটা বেশ লম্বা চওড়া, হাত পাগুলি দীর্ঘ, সুদৃঢ় ও মাংসল, বক্ষঃস্থল প্রশস্ত ও কটী ক্ষীণ, কাজেই ফকির সাহেব যে বিশেষ বলশালী ব্যক্তি, তাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যদিও তাহার বয়স ৬০ বৎসরের কাছাকাছি হবে, কিন্তু তথাপি তাহার মাংস বিন্দুমাত্র ঢিলা হয় নাই, যুবকের ন্যায় উৎসাহ ব্যঞ্ছক নয়নের জ্যোতি আছে।

ফকির সাহেবের মাথায় জটার নাম মাত্র নাই, কেবল তেল-কুচ কুচে ঝাকড়া ঝাকড়া চুলগুলিতে মাথার মাঝখানে ঝুঁটী বেঁধেছে, গলায় ছোট বড় প্রভৃতি রকম একটা রাঙা ফিতে দিয়ে রকম বেরকমের ঝোড়াখানেক মালা গলায় শোভা পাচ্ছে এবং এক ছড়া ছোট মালা ট্রুকাপীর সইয়ের মত তার হাতে আছে।

একটি নীল রংয়ের সামান্য কোপ্নিতে ফকির সাহেবের লজ্জা নিবারণ ক’রেছে; কাঁধে পাট করা একখানি কম্বল ও হাতে শিংয়ের ন্যায় পাকানো এক গাছি ছোট লাঠি আছে ও কড়াতে আঁটা একখানি কিস্তি পৃষ্ঠের দিকে ঝুলছে।

ফকিরজির মুখখানি বাটীর ন্যায় গোল, কপালটী বেয়াড়া উঁচু, চক্ষু দু’টি ক্ষুদ্র, ঈষৎ কোটরগত ও আরক্তিম, দৃষ্টি বক্র ও কুটিল, নাসিকাটি বেশ উন্নত এবং দুই একটি বসন্তের চিরস্থায়ী দাগে বদনমণ্ডল চিত্রিত। সাইজির গোঁপের মাঝখানটি কামানো, কেবল দুই পাশে ফাক্ ফাক্‌ দু-চার গাছি কটা কটা গোঁফ শোভা পাচ্ছে এবং সেই গোঁপের উপযুক্ত মাঝখানে ছাগল দাড়ি বিশেষ তামার শলার ন্যায় কটা কয়েক গাছ চুল বাতাসে ফুর ফুর্ ক’রে উড়ছে।

ফকির সাহেবের ডান হাতের বাহুর উপর লাল সালুতে মোড়া এক ধাবড়া তাবিজ, কলাছড়ার ন্যায় ঢেঙ্গা ঢেঙ্গা আঙ্গুলে লাল জরদা প্রভৃতি ঝুটো পাথর বসানো গুটিকয়েক রূপার আংটী ও হাতের তালু মেদীপাতার রংয়ে রঞ্জিত ছিল। ফলকথা ফকির সাহেবকে দেখলেই একটি জল জন্তু বুজরুক, হাড়েটক বদমাইস ও বেমালুম খাঁটী বর্ণচোরা আম ব’লে সকলের বোধ হ’য়ে থাকে। এইজন্য বোধ হয় সূক্ষ্মদর্শী পণ্ডিতেরা বলেন যে, মানবের মনের ভাব অনেকটা তার মুখমণ্ডলে প্রতিফলিত হ’য়ে থাকে। সেইজন্য একজনকে দেখলে মন প্রাণ যেমন আনন্দ সাগরে মগ্ন হয়, তাঁর চরণে সর্ব্বস্ব দেবার সাধ প্রবল হয়, আবার একজনকে দেখলে মনে কেমন একপ্রকার অভূতপূর্ব্ব ঘৃণার উদয় হয়ে থাকে ও বিষতুল্য তার সঙ্গ ত্যাগ করবার ইচ্ছা প্রবল হয়।

ফকির সাহেবের শ্রীমুখ দেখে তার উপর আমার বিন্দুমাত্র ভক্তির উদয় হয় নাই, বরং তাকে একজন ঘোর ভণ্ড বদমাইস ব’লে জ্ঞান হ’য়েছিল। যদিও আমি তাকে নিতান্ত ঘৃণার চক্ষে দেখতে লাগলাম, কিন্তু তথাপি কেতামতন তাহাকে একটি লম্বা সেলাম করতে হলো। কারণ তখনও মুসলমান রাজত্বের আমেজ ছিল, কাজেই মুসলমান ফকিরদের তখন অপ্রতিহত ক্ষমতা ও প্রচুর সম্মান ছিল। কেহ ফকিরদের সামান্য মাত্ৰ অপমান করলে, কাজীর বিচারে তাকে কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হ’তো, সুতরাং প্রকাশ্যে কেহ ফকিরদের অসম্মান করতে সাহসী হ’তো না।

আমি সেলাম করলে, সাইজি হাসি মুখে তার পাশে আমাকে বসতে বললো ও খুব মোলায়েম ভাবে কহিল, “আরে ভেইয়া, তোম্রা নাম কা?” আমি সেই ছোট তক্তপোষের একধারে উপবেশন ক’রে উত্তর করিলাম, “আমার নাম হরিদাস।”

ফকির। “কিষণজি বাবু তোমরা কোন্ লাগতো?”

আমি। হামরা চাচা হোতা।

ফকির। আচ্ছা ভেইয়া, বাবু সাব কা মুল্লুক কাঁহা?

এই প্রশ্নে আমি একটু বিব্রত হইলাম, কি যে উত্তর করি কিছুই স্থির করতে পারলেম না। এদিকে বাবুকে যখন চাচা ব’লে পরিচয় দিয়েছি, তখন জানি না বললে খাটবে না, কাজেই একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কহিলাম, “বাবুর মুল্লুক গয়া জিলা টিকারিমে, হুঁয়া বাবুকা জমিদারী হ্যায়।”

ফকির। আচ্ছা ভেইয়া, বাবুকা জমিদারীমে আমদানি কেৎনা?

আমি। দশ হাজার রূপেয়া সাফ, মুনফা হোগা।

আমার এই উত্তর শুনে সাইজি একবার কট্‌মট্ ক’রে আমার মুখের দিকে চাহিলেন; ভাবে বোধ হ’লো, আমার এই কথাটা ফকির সাহেবের তেমন বিশ্বাস হ’লো না, বোধ হয় বাবুর সম্বন্ধে আরো দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার সাধ ফকির সাহেবের মনে মনে ছিল, কিন্তু তাহা আর বলিবার অবসর হইল না, কারণ সেই সময়ে খোদ কৰ্ত্তা গা হাত ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল, কাজেই ফকির সাহেবকে তখনকার মতন ঢোক গিলিতে হইল।

কর্ত্তা ফকিরকে লইয়া বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করিলেন, চাকরে তামাক দিয়া গেল, তাঁহারা দরজা বন্ধ করিয়া উভয়ে চুপি চুপি কি পরামর্শ করিতে লাগিলেন।

আমি একাকী বাহিরে সেই তক্তাপোষের উপর বসিয়া রহিলাম। যদিও কর্ত্তা দরজা বন্ধ করিয়া অতি সাবধানের সহিত খুব চুপি চুপি কথা কহিতেছেন, কিন্তু তথাপি আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, গত রাত্রে গুলিতে হত সেই হতভাগ্য মুসলমানের শবদেহ সরাইবার জন্য এই পরামর্শ চলিতেছে। নিশ্চয় সেই বহুরূপী ঘোর ভণ্ড ঠাকুর সাহেব, এ উদ্দেশ্যের জন্য এই ব্যাটাকে পাঠিয়েছেন। এ বেটা যেরূপ ষণ্ডা ও বলবান, তাতে ও একাকী অনায়াসে সেই লাস বয়ে নিয়ে যেতে পারবে; এখন দেখা যাক্ কি উপায়ে সে লাসটা সাবাড় করে।

আমি সেইখানে বসে এই সব কথা মনে মনে ভাবছি, প্রায় দু’ ঘণ্টা সময় হ’য়েছে, এমন সময় কর্ত্তা দোর খুলে বাহিরে এলেন এবং আমার কাছে এসে খুব স্নেহম্বরে কহিলেন, “বাবা হরিদাস! তোমাকে একটি কাজ করতে হবে।”

আমি অবনত মুখে উত্তর করিলাম, “কি করতে হবে, আজ্ঞা করুন?”

কৰ্ত্তা খুব মোলায়েমভাবে কহিলেন, “এমন কিছু নয়, তুমি কেবল এই ফকির বেটার পেছনে পেছনে যাবে এবং দেখবে, এ বেটা একটা বস্তা গঙ্গায় ফেলে কিনা; ও বেটা নেড়ের উপর ততদূর বিশ্বাস করা যায় না, সেইজন্য তোমাকে সঙ্গে পাঠাচ্ছি। কারণ তোমার মত বিশ্বাসের পাত্র আর আমি দেখি নাই; সেইজন্য তোমাকে প্রাণ দিয়েও বিশ্বাস ক’রে থাকি; যাই হোক্ এখন শীঘ্র শীঘ্র কাজটা শেষ ক’রে এসো।”

আমি বুঝতে পালাম কর্ত্তা কাজ আদায়ের জন্য আমাকে খুব বিশ্বাসের পাত্র, ভাল ছেলে ব’লে সুখ্যাতি করলেন। পাছে লাসটা গঙ্গায় না ফেলে দেয়, সেইজন্য আমাকে সঙ্গে দিলেন। পাপীর সহিত পাপীর, বদমাইসের সহিত বাইসের, চোরের সহিত চোরের মিলন বটে, গরজের জন্য পরস্পর বন্ধুতা সূত্রে আবদ্ধ হয় সত্য, কিন্তু কেহ কাহাকেও অকপটে বিশ্বাস করতে পারে না; পরস্পর পরস্পরের নিকট হৃদয় লুকাইয়া রাখে, প্রাণের কপাট খুলতে কাহারও সাহস হয় না। সেইজন্য কর্ত্তা নিজের দলের লোক সাইজিকেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারলেন না, পাছে কোনরূপ বিপদ ঘটায়, এই আশঙ্কায় আমাকে তার সঙ্গে পাঠাচ্ছেন।

যদিও আমি সকল কথা বুঝতে পালাম, সাইজি কিসের বস্তা ল’য়ে যাবে তাহাও জানতে বাকী রইল না, কিন্তু তথাপি কৰ্ত্তাকে প্রকাশ্যে কোন কথা জিজ্ঞাসা করলাম না। কেবল শিষ্ট বালকের, ন্যায় এক “যে আজ্ঞা” বলে মাথা হেট ক’রে রইলাম।

কর্ত্তা আর কিছু না ব’লে সেই কক্ষ মধ্যে পুনরায় প্রবেশ করলেন এবং প্রায় আধ ঘণ্টাটাক পরে সাইজিকে নিয়ে কর্ত্তা বাইরে এলেন। আমি দেখলাম যে, অমিতবলী সাইজি সেই মুসলমানের শব একটা বস্তার মধ্যে পূরিয়া পিঠে ফেলিয়া সেই কম্বল দ্বারায় বুকের সহিত উত্তম- রূপে বেঁধেছে এবং এক হাতে সেই ছোট লাঠি ও অন্য হাতে তসবীর মালা শোভা পাচ্ছে।

ফকির সাহেব বাড়ী থেকে বেরুলেন, কর্ত্তার ইঙ্গিতক্রমে আমিও তার পিছু পিছু চললাম। শেষে সেই গলি পার হ’য়ে আমরা সদর রাস্তায় পড়লাম।

সদর রাস্তায় পড়ে ফকির সাহেব একেবারে সপ্তমে সুর তুলে “আলেক” ব’লে চীৎকার ক’রে উঠলেন। সে সময় ফকিরদের খুব সম্মান ছিল, লক্ষপতি ধনী ব্যক্তিও ফকির দেখলে মস্তক অবনত করতেন, কাজেই ফকির সাহেবের রব শুনে পথিকেরা সসম্ভ্রমে পথ ছাড়িয়া দিল ও সেলামের ধূম প’ড়ে গেল। সাইজি কোন দিকে আর লক্ষ্য না ক’রে দ্রুতপদে অগ্রসর হ’তে লাগলো এবং এক একবার সেইরূপ চীৎকার ক’রে রাস্তা সাফ ক’রে লইলো। আমি জেলের পশ্চাদ্‌বর্ত্তী হাঁড়ির ন্যায় তার পিছনে পিছনে চললাম।

আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা গঙ্গাতীরে এসে উপস্থিত হ’লাম। তখন রাত্রি প্রায় দশটার অধিক হবে না; কিন্তু এই জনমানব-পরিশূন্য নির্জ্জন স্থানে এসে আমার বোধ হ’লো যেন অর্দ্ধরাত্রি অতীত হ’য়েছে। সহরের কোলাহলের নামমাত্র এখানে নাই; কেবল বেকার কুকুরের চীৎকার ও রাত্রিচর পক্ষীর পক্ষ-তাড়ন-জনিত শব্দে সে স্থানের নিস্তব্ধতা কথঞ্চিৎ ভঙ্গ হচ্ছে।

ফকিরজি গঙ্গার ধার ধ’রে প্রায় পোয়াটাক্ রাস্তা চ’লে গেল, আমি তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যেতে লাগলাম; শেষে ফকির সাহেব খুব উঁচু পাড়ের উপর দাড়াইয়া সেই বস্তা গঙ্গার জলে ফেলে দিল, আমি শব্দ শুনতে পেলাম, সুতরাং সেই বস্তায় আবদ্ধ শব যে সুরধনীর অতলতলে নিমগ্ন হ’লো, তাতে আর আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না।

আমরা দু’জনেই ঘর মুখো হ’লাম; এবং পরস্পর নানাপ্রকার কথাবার্ত্তায় প্রবৃত্ত হ’লাম।

প্রথমেই ফকির সাহেব আমাকে দুশো তারিফ করলো, আখেরে আমি যে একটা উঁচুদরের কাজের লোক হব, তাহাও বলতে ভুললো না; কিন্তু সে সব অসার মনরাখা কথা আমার আদৌ গ্রাহ্য হ’লো না; আমার এক কাণ দিয়ে প্রবেশ ক’রে, অন্য কাণ দিয়ে বাহির হয়ে গেল।

ফকির সাহেব কর্ত্তার ঘরকন্না সম্বন্ধে অনেক কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি সবদিক্ বজায় রেখে বুদ্ধি খরচ ক’রে তাহার যথাযথ উত্তর দিলাম, কোন কথায় আমাকে ঠকাইতে পারিল না। এই কয়দিন বদমাইসদের কাণ্ডকারখানা দেখে আমার যথেষ্ট বহুদর্শীত্ব লাভ হ’য়েছে, বুদ্ধিরূপ কৃপাণে ধার ধ’রেছে, কাজেই এখন দেশকাল পাত্র বুঝে কথা কইতে শিখেছি।

আমি ফকির সাহেবের কথার ভাবে বেশ বুঝতে পারলাম যে, কৰ্ত্তার সহিত তার বেশী মেশামেশি ভাব নাই; অল্পদিন হ’লো আলাপ হ’য়েছে, তাই আমাদিগের বাবুটীকে ঠিক চেনার জন্য আমাকে এত কথা জিজ্ঞাসা করছে। ফল কথা এই ভণ্ড ফকিরটা যে অতি ভয়ানক প্রকৃতির লোক, অতীব বলবান্ ও ঘোর নিষ্ঠুরকর্ম্মা, এমন কি কোন ডাকাতের দলের সর্দ্দার, তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কেবল লোকের চক্ষে ধূলি দেবার জন্য এই ফকিরী সাজ ধ’রেছে। বোধ হয় এ জগতে এমন কোন অকাৰ্য্য নাই, যা এই ফকির দুরাচার সম্পন্ন করতে না পারে। এ বেটা নিশ্চয় সেই ঠাকুর সাহেবের প্রেরিত লোক; একা একটা লাস বেমালুম বহন ক’রে আনা বড় সহজ কথা নয়; কিন্তু ছেলেরা যেমন খেলানা নিয়ে যায়, সেইরূপ এ ব্যাটা অনায়াসে ওরূপ ভারী বস্তাটা ব’য়ে নিয়ে গঙ্গায় ফেলে দিলে; তাহ’লে লোকটা বড় সাধারণ নয়, নিশ্চয় বয়সে এরূপ শত শত দুঃসাহসিক কাজ ক’রেছে। ঠাকুর সাহেব নাম সাবাড়ের অভিপ্রায়ে এরকম কেজো লোক পঠিয়েছে। তবে এ লোকটার সঙ্গে আমাদের কর্ত্তার যে হালে আলাপ পরিচয় হয়েছে, তা আমি ফকির সাহেবের কথাবার্ত্তার ঢঙ্গে বেশ বুঝতে পারলাম।

এই জগতে চোরের সহিত চোরের মিলন হয় বটে, পরস্পর মিত্রতা-পাশে আবদ্ধ হয় সত্য, কিন্তু কেহ কাহার কথা সত্যজ্ঞানে বিশ্বাস করে না। কারণ তমসাবৃত কূপে যেমন কমল বিকশিত হয় না, তেমনি কলুষ-রাশি পরিপূর্ণ মলিন হৃদয়ে অকপট বিশ্বাসরূপ মহারত্নের অবস্থান নিতান্ত অসম্ভব। যে বিশ্বাসের প্রভাবে এই মরণশীল মনুষ্য অমরত্ব অবধি লাভ করতে পারে, কঠোর জঠর যন্ত্রণার দায় হ’তে একেবারে মুক্ত হয়, ইহকাল সৰ্ব্বস্ব নিষ্ঠুরকর্ম্মা এই সব নর প্রেতেরা সেই বিশ্বাসের মাহাত্ম্য কি বুঝবে? তারা নিজে যেরূপ দরের লোক, অপর সকলকে সেইরূপ জ্ঞান করে, মৌখিক মিষ্ট কথায় পরস্পর পরস্পরকে প্রতারণা করতে সাধ্যমত চেষ্টা করে। সেইজন্য কর্ত্তার সম্বন্ধে সঠিক খপর জানার জন্য ফকির সাহেব এতগুলি মোলায়েম কথা খরচ করলে ও সঙ্গে সঙ্গে অনেক কথা যাচাই ক’রে নিলে। কারণ তাহার সাথের-ভাই কর্ত্তা মহাশয়ের কথার মধ্যে যে অনেক খাদ আছে, তাহা অনেকটা আঁচে বুঝতে পেরেছিল; তাই কর্ত্তা মশায় প্রকৃতপক্ষে লোকটা কে, তাহা জানবার জন্য আমাকে এত জেরা করিল; কিন্তু তাহাতে ফকির সাহেবের উদ্দেশ্য আদৌ সিদ্ধ হ’লো না। কারণ বুদ্ধি খরচ করে এমনি ভাবে তার কথার উত্তর দিলাম যে, ছদ্মবেশী কর্ত্তার মান সম্ভ্রম অক্ষুণ্ণ রইলো। ফকির সাহেবের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদয় হ’লো না।

অনেক কথাবার্ত্তার পর আমার উপর ফকির সাহেবকে অনেকটা প্রসন্ন দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা দাতা সাহেব! তোমার আস্তানা কোথায়?”

ফকির সাহেব কহিলেন, “আরে ভেইয়া! হাম্ ফকির আদমি হ্যায়, হাম্‌রা রয়নেকা ঠিকানা ক্যায়া?”

আমি এই ফাঁকা উত্তরে নিরস্ত না হ’য়ে পুনরায় কহিলাম, “যেখানে হয় এক জায়গায় তো বাস করেন?”

ফকির। হ্যাঁ ভেইয়া, হ্যাম্ দরগামে রয়তা।

আমি। সে দরগা কোথায়?

ফকির। এই সহরমে হ্যায়। তোম্ জুম্মা পীরের দরগাকা বাৎ কভু শোনা নেই?

আমি। কই না, আমি তো শুনি নাই।

ফকির সাহেব বিস্মিতভাবে কহিল, “আরে ভেইয়া! তোম দরগা জান্‌তা নেই? এই ভর সহরনে এসা আয়েসকা জায়গা আউর নেহি। সরকা জেৎনা সৌখিন বড় আদমির নেড়কা হুঁয়া হরদম আতা হ্যায়, হুঁয়া তোম্ বেসখ চিজ মাঙ্গো তো হাজির হোগা। দরগামে এয়সা আদ্‌মি হ্যায় যে, তোমকো হাতমে আসমানকা চাঁদ দেনে সেক্‌তা। কোই শালা দুসমন কি কোতয়ালিকা বরকন্দাজ হ্যায় শির বাড়ানে সেক্‌তা নেহি; যো দরগামে পৌঁছা গিয়া, উসকা আপদ সব কাট্ গিয়া। এরসা আয়েসকা জায়গা এই ভর্ দুনিয়াকা বিচ মে আওর হ্যায় নেহি।

আমি কথার ভাবে বেশ বুঝতে পারলাম যে ফকির সাহেবের কথিত দরগা একটি ভয়ানক বদমাইসের আড্ডা; আমি পূর্ব্বে ঠাকুর সাহেবের আখড়ায় একবার গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু ভিতরের কোন কাণ্ডকারখানা দেখি নাই, কাজেই এ দরগার মধ্যে বদমাইসদের কার্য্য কলাপ দেখবার সাধ প্রবল হ’লো, আমি কিছুতেই আমার অন্তরের প্রদীপ্ত কৌতুহলকে দমন করতে পারলাম না। অবশেষে আমি কহিলাম, “দাতা সাহেব! আমি তোমার দরগা একবার দেখতে পাবো?”

ফকির সাহেব এক গাল হেসে আমার কাঁধের উপর ডান হাতখানি দিয়ে উত্তর করিল, “আরে তোম্ বাবুকা ভাতিজা, বেসখ হামলোক্‌কা দোস্ত আদমি, তোম্ আল্ববৎ জানেকো লায়েক হ্যায়। বেসখ তোম্রা ওয়াস্তে হাম্ দো চার রূপেয়া খরচ করেগা।”

বালসুলভ কৌতূহলে আমার অন্তর পূর্ণ হ’লো, কাজেই অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা করবার আর অবসর রহিল না। আমি ফকির সাহেবের উদারতায় নিতান্ত প্রীত হ’লাম এবং দরগার মধ্যে বদমাইসদের কাণ্ড কারখানা দেখবার অভিপ্রায়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চল্লাম, অন্তরে কোনপ্রকার দ্বিধা কি ভয় হ’লো না। হায়! তখন একবার স্বপ্নেও ভাবি নাই যে, এই সামান্য সূত্র হ’তে আমার জীবন স্রোত অন্যদিক দিয়ে প্রবাহিত হবে।