- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ভয়ানক ব্যাপার!
বেলা আন্দাজ তিনটার সময় আমি দেবীপ্রসাদের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম এবং সেই আটচালার নিকট দিয়া যাইতে লাগিলাম। কিন্তু বাহিরে সেই সন্ন্যাসী ঠাকুরকে দেখিতে পাইলাম না, কেবল আটচালার ভিতর হইতে সেতারের আওয়াজ ও ফরমাসি গোচ হাসির গটরা শুনিতে পাইলাম; আমি আর অধিকক্ষণ তথায় অপেক্ষা না করিয়া বাটী উদ্দেশ্যে যাত্রা করিলাম।
আমি ক্রমে সেই মাঠ পার হইয়া রাস্তার উপর উঠিলাম এবং গঙ্গাতীরের রাস্তা ধরিয়া পশ্চিম মুখে চলিলাম। যাইতে যাইতে ভাবিতে লাগিলাম যে, যেরূপ দেবতা, বাহনও তার তদনুরূপ হয়; কিষণজি বাবু নিজে যে রকম দরের লোক, তাহার বন্ধুবান্ধবগুলিও সেইরূপ দরের। কারণ জলের সঙ্গে যেমন তৈল কিছুতেই মিশ্রিত হয় না, তেমনি সাধুর সহিত অসাধু ব্যক্তির মিলন একান্ত অসম্ভব। বাবু নিজে ছদ্মবেশী ও পাপ-পরায়ণ, সেইজন্য এই সকল ঘোর কপটি দুরাত্মাদের সহিত মিত্ৰতা স্থাপন করিয়াছেন। এই যে ঠাকুর সাহেবের আখড়া দেখিলাম, ইহা নিশ্চয় পাপের নিকেতন, যাবতীয় অপকর্ম্মের আগার। আর নিজে ঠাকুরও যে কুকুর অপেক্ষা অধম, তাহার আর অণুমাত্র সন্দেহ নাই।
দেবীপ্রসাদকে পূৰ্ব্ব হইতে বদ্মাইস লোক ব’লে আমার ধারণা ছিল; কিন্তু তাহার অবস্থা যে এতদূর শোচনীয়, তাহা আমি জানিতাম না। মেষ-চর্ম্মাবৃত বাঘের ন্যায় এই সংসারে কপটি পাপাত্মারা বিচরণ করে। তাদের কপটতাজাল ছিন্ন করা বড় সহজ ব্যাপার নহে। নরকের কীট অপেক্ষা অধম কত শত নরাধম যে এই সংসারে সাধুর বেশ ধারণ করিয়া সরলমতি মনুষ্যের সর্ব্বনাশ করিতেছে, তাহার আর সংখ্যা নাই। বিষপূর্ণ পাত্র যেমন অল্পেতে আচ্ছাদিত থাকে, তেমনি এই সব পাপাত্মারা মৌখিক মিষ্ট কথা কহিয়া যে কত শত সংসার জ্ঞান হীন, অন্ধবিশ্বাসী, নিরীহ ব্যক্তিদের প্রতারিত করে, তাহার আর ইয়ত্তা নাই। মিথ্যা কথা, কপটতা, পরস্বাপহরণ, যাদের জীবনের সারব্রত, তারা যদি সভ্য বলিয়া পরিগণিত হয়, তাহা হইলে এ সংসারে আর অসভ্য কে? যে স্থানে সভ্যতার কিছু বেশী প্রাবল্য, সেই স্থানেই প্রায় ঈদৃশ কপটতার আতিশয্য হইয়া থাকে।
বিধাতা যে সকল হাঁড়ির উপযুক্ত সরা নির্ম্মাণ করিয়াছেন, তাহা শ্রীমতী ফুলকুমারী সুন্দরীকে দেখিয়া আমার নিশ্চয় বিশ্বাস হইল। কারণ শ্রীমান্ যেমন দেবা, শ্রীমতীও তেমন তাহার উপযুক্ত দেবী, হুঁকোর খোলে ঘন কালো কালীতে দুর্গা নাম লিখিলে কেমন দেখায়, উল্লুকে ভাল্লুকে জড়াজড়ি করিলে যেমন বাহার খোলে, কালো মেয়েমানুষ নীলাম্বরি কাপড় পরিলে যেমন মানায়, শ্রীমান ও শ্রীমতী পাশাশি দাঁড়াইলে ঠিক সেইরূপ শোভা হইয়া থাকে।
আমি শ্রীমতী ফুলকুমারীর শ্রীমুখের একটি কথা শুনেই স্থির করিলাম যে, তিনি কখনই দেবীপ্রসাদের বিবাহকরা স্ত্রী নয়। পরিণয়ের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ ধৰ্ম্মপত্নী সহস্র কষ্টেও স্বামীকে সেরূপভাবে সম্বোধন করে না, পতি শত অপরাধে অপরাধী হইলেও সতী স্ত্রী তাহার অপরাধ প্রচ্ছন্ন রাখিতে চেষ্টা করে। তাহ’লে নিশ্চয়ই কুলু বক্সীর উপপত্নী হইবে। পাপাত্মা বাহিরে অমন ভদ্রলোক, কথায় কথায় লোককে ধর্ম্মোপদেশ দেয়, আর নিজে এরূপ পশুভাবে জীবন যাপন করে। বর্ণচোরা আমের ন্যায় এই সব জুয়াচোরেরা কেবল পরের সর্ব্বনাশ করিয়া জগতে জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া থাকে। যে কেহ সরলভাবে তাদের কথা সত্যজ্ঞানে বিশ্বাস করে, পাপিষ্ঠদের মতে তাহার তুল্য নির্ব্বোধ আর কেহই নাই; তাহার সর্ব্বনাশ করিতে বিশেষ কোন হানি নাই। হায়, দু’দিনের জন্য বিদেশে এসে যে এরা দেশের কথা একেবারে সব ভুলে গেল, খেলা ঘরের খেলা পেয়ে একেবারে মেতে উঠলো, নিজের নিজের মনুষ্যত্বকে বলী দিতে কুণ্ঠিত হ’লো না, এই দুৰ্ল্লভ মনুষ্য জন্মলাভ তার পক্ষে বিড়ম্বনায় পৰ্য্যবসিত হইল, দিন পেয়েও সেই দীনবন্ধুর শরাপন্ন হইতে পারিলে না। সোণার পিঁজরায় একটা কাল প্যাঁচা পুষে হেথায় অমূল্য জীবনধন অপব্যয় করলে। সেই পরম কারুণিক পরমপিতা পরমেশ্বর তাঁহার সৃষ্টভ্রান্ত-মানবদের ভবসাগরের প্রলোভনরূপ তুফান হ’তে পার হবার জন্য প্রত্যেক দেহীর দেহ-তরীতে বিবেককে কাণ্ডারি ক’রে দিয়েছেন। সেই বিবেক-ভ্ৰান্ত মানবকে পদে পদে সাবধান ক’রে দেয়; এবং ধৰ্ম্মপ্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করবার জন্য সাধ্যমতে চেষ্টা করে। কিন্তু এরা তার নিষেধে বধির হ’য়ে, পুনঃ পুনঃ পাপ কার্য্যে রত হয়ে ক্রমে ক্রমে হৃদয়খানি পাষাণে পরিণত ক’রেছে এবং বিবেকের কার্য্যকারী ক্ষমতা একেবারে নষ্ট ক’রে দিয়েছে। এখন এহেন মানবে ও পিশাচে কোন প্রভেদ নাই। দেবীপ্রসাদ প্রমুখ পাষণ্ডেরা যে সেই দরের লোক, ধৰ্ম্মজ্ঞান কি হিতাহিত বোধ ইহাদের যে আদৌ নাই। তাহা ইহাদের দৃষ্টে বেশ বুঝিতে পারিতেছি।
এই সকল নরপ্রেত যে কার্য্যোদ্ধারের জন্য সমবেত হইবে, তাহা কখনই সু হইবে না, নিশ্চয় তাহার তলে কোন লোমহর্ষণ ভয়াবহ ব্যাপার লুকানো আছে। এই সকল বদমাইস একত্র হ’য়ে কি করবে তাহা যে কোন উপায়ে হোক্ আমাকে নিশ্চয় দেখতে হবে।
আমি মনে মনে এই স্থির ক’রে দ্রুত পদসঞ্চারে বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমি বাড়ী আসিয়া দেখিলাম যে, খোদ কৰ্ত্তা দু’জন চাকরের সাহায্যে বৈঠকখানাটি ফিট্ করিয়া সাজাইয়াছেন, দেয়ালগিরিতে বাতি দিয়াছেন, তাকিয়ার ওয়াড়গুলি পরিবর্ত্তন করিয়াছেন এবং একখানি ধপধপে ফরসা চাদর পূর্ব্বেকার ময়লা চাদরখানির স্থান অধিকার করিয়া আছে।
আমাকে দেখিয়া বাবু তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন ঠিক্ চিনে যেতে পেরেছিলে তো? দেবীপ্রসাদ আমার পত্রের কি উত্তর দিলে?” আমি নিতান্ত বিনীতভাবে কহিলাম, “তিনি কোন পত্র লেখেন নাই, কেবল মুখে বলিয়া দিয়াছেন যে, এতো তাড়াতাড়ি ভাল লোক পাওয়া যাইবে না। কাজেই খোদ্ ঠাকুর সাহেবকে যোগাড় করতে হবে।”
কর্ত্তা আমার কথা শুনে ভ্রুকুটী ক’রে আপনা আপনি কহিল, “সে বেটা তো রাঘব বোয়াল, অল্পে বেটার পেট ভরবে না, তা অপেক্ষা একটা সস্তার লোক পেলে এ সময় ভাল হতো।” আমি বাবুর কথা শুনিয়াও শুনিলাম না, বিশ্রাম করিবার জন্য বরাবর বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিলাম।
ক্রমে সন্ধ্যাসতী ধরাতলে পদার্পণ করিলেন; সমস্ত দিন কপট মনুষ্যের পশুবৎ ব্যবহার সন্দর্শনে দেব-দিবাকর ক্রোধে রক্তিমাবরণ ধারণ করিয়া পশ্চিম গগণে লুক্কায়িত হইলেন। পতি বিরহে পদ্মিনী সতী অপার দুঃখনীরে নিমগ্না হইল; পরশ্রীকাতরা কুমুদিনী পদ্মিনীর দুর্দ্দশায় প্রফুল্লিত হইয়া হাস্য করিবার জন্য বিকসিত হইল; পক্ষীকূল এই অন্যায় আচরণ নিরীক্ষণ করিয়া ছি ছি করিতে করিতে স্ব স্ব নীড়ে প্রত্যাগত হইল। তখন দুষ্ট অন্ধকার আসিয়া ধরা সুন্দরীকে আক্রমণ করিল।
সন্ধ্যা সমাগত দেখিয়া বাবু বৈঠকখানায় আলো জ্বালিলেন; একখানা রূপোর থালায় পান, একটা গোলাবপাশ ও আতরদানি সেই ফরসা বিছানার উপর রাখিলেন, নিজেও উত্তম বেশ ভূষায় ভূষিত হইয়া তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া রহিলেন। কিন্তু অধিকক্ষণ তাঁহাকে সেরূপ আলস্যে ও উৎকণ্ঠিতভাবে অতিবাহিত করিতে হইল না, কারণ সঙ্কেত মত দরজা উদ্ঘাটিত হইল এবং দুইজন লোক গৃহে প্রবেশ করিল।
সেই দু’জন লোক প্রবিষ্ট হইয়া বরাবর বৈঠকখানায় আসিয়া বসিল, বাবু হাসি হাসি মুখে তাদের খুব আদর অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন, আমি অন্দরমহল হইতে আসিয়া জানালা দিয়া এই দুইজন লোককে দেখিবামাত্র একজনকে চিনিলাম ও অপার বিস্ময়-সাগরে মগ্ন হইলাম।
আমি সেই আটচালার রকের উপর যে মিষ্টভাষী সন্ন্যাসীকে দেখিয়া ছিলাম, তিনি সম্পূর্ণরূপে ভোল ফিরাইয়া আর একটা লোকের সহিত আমাদের বাটীতে আসিয়াছে। আমি ইতপূর্ব্বে যে বেশে সন্ন্যাসী ঠাকুরকে দেখিয়াছিলাম, এখন তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত। এরূপ ভয়ানক পরিবর্ত্তন হইয়াছে যে, এ যে সে লোক, তাহা চিনিয়া উঠা নিতান্ত দুঙ্কর।
সন্ন্যাসী ঠাকুর পাকাচুলে উক্তমরূপে টেরি কেটেছেন, তার উপর উত্তম লাট্টুদার পাগড়ি শোভা পাচ্ছে। গেরুয়া বসনের পরিবর্ত্তে রেশমী কাপড়ের পা-জামা পরিধান করিয়াছেন, সন্ন্যাসী ঠাকুরের গায়ে এক রঙা সাটীনের চাপকান, তদুপরি মখমলের এক কাবা, আঙ্গুলে ৭/৮টা আঙটী, গলায় এক ছড়া পাথর বসান চেনহার ও পায়ে এক জোড়া লপেটা জুতো শোভা পাইতেছে; আমি বেশ বুঝতে পারলুম যে, বাবু আমাকে এঁরই আখড়ার পাঠিয়ে ছিলেন, ইহার নাম ঠাকুর সাহেব।
ঠাকুরের সঙ্গী লোকটার নাম আমি তখন জানি নাই, তাহার বয়স আন্দাজ ৩২/৩৩ বৎসর, দেখিতে একটু বেঁটে, বর্ণ কাল, মুখখানা গোল, চক্ষু দু’টা ছোট ও কুঁচের মত লাল। লোকটার গোপ দাড়ি অধিক উঠে নাই, কেবল জুলপিটা খুব লম্বা ক’রে কামানো, গলাটা একটু ছোট, কাজেই সুকিঞ্চিৎ ঘাড়েগর্দ্দানে, হাত পাগুলি বেশ গোলগাল ও তাহার দেহের ঠিক অনুরূপ।
লোকটা খুব চোস্ত চুড়িদার পাজামা পরেছে, গায়ে একটা সাদা লিনুর চাপকান ও মাথায় হাতে বাঁধা পাগড়ি রহিয়াছে। যদিও সেই লোকটা ভদ্রোচিত বসন ভূষণে ভূষিত, কিন্তু তথাপি তাহার আকার কর্কশতা পরিশূন্য নহে; মুখমণ্ডলে ঘোর নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতার চিহ্ন বিদ্যমান রহিয়াছে।
আমি পূৰ্ব্ব হইতেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, এই কপট সন্ন্যাসীর নাম ঠাকুর সাহেব, ইনি আখড়ার কর্ত্তা, তারই নিজের মতন অনেকগুলি শিষ্য আছে, পরের সর্ব্বনাশ করাই তাদের জীবনের সারব্রত; নিশ্চয় সেই সব পাপাত্মাদের নীরস অন্তর শয়তানের আবাস ভূমি ও যাবতীয় গুরুতর পাপ কার্য্যের আধার।
আমি ঠাকুর সাহেবের কপটতা দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইলাম, লোকে বৃদ্ধ বয়সে দেহের নশ্বরত্ব বুঝিতে পারে, সুতরাং জাগতিক সকল প্রকার ভোগ বিলাসে আর কিছুমাত্র স্পৃহা থাকে না, তখন নিতান্ত চঞ্চল মন, সেই চিন্তামণির চরণ চিন্তায় ব্যস্ত হয়, মৃত্যুর জন্য সতত প্ৰস্তুত হইয়া থাকে; কিন্তু এ লোকটা চরমকালেও যখন এতদূর বহুরূপী, তখন এর অপেক্ষা ভয়ানক লোক এই ধরাতলে বিরল, নিশ্চয় এ বেটা সৰ্প অপেক্ষা ক্রুর, ব্যাঘ্র অপেক্ষআ হিংস্র। আজ যখন এরূপ রূপ পরিবর্ত্তন ক’রে এই রাত্রিকালে আমাদের বাড়ী আসিয়াছে, তখন নিশ্চয় আজ একটা কাণ্ড হইবে। এই সব ছদ্মবেশী বদমাইস লোক একত্রিত হ’য়ে কি করে, দেখিবার জন্য আমার অন্তর পূর্ব্ব হইতেই কৌতূহলে পূর্ণ হইল। কাজেই আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য আনি সেই জানালার ধারে নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলাম।
বাবুর অনুমতিক্রমে একজন ভৃত্য আসিয়া তামাক সাজিয়া দিয়া গেল; ঠাকুর সাহেব সেই ক্ষুদ্র চক্ষুর্দ্বয় মুদ্রিত একান্তমনে তামাকে মনোনিবেশ করিল, উভয় পার্শ্ব হইতে রাশি রাশি ধোঁয়া লাঙ্গুলাকৃতি হইয়া শূন্যে মিশিতে লাগিল; তারপর তামাকের মূল্য সম্যক্ ‘প্রকারে আদায় হইলে ঠাকুর সাহেব হুঁকাটি ত্যাগ করিল ও বাবুর দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “কৈ হে ভায়া! তোমার শীকার কোথায়? ক্রমে যে রাত হ’তে লাগলো।” বাবু উত্তর করলেন, কিছুমাত্র ভাববেন না, দেবীপ্রসাদ নিজে সঙ্গে ক’রে আনবে। তার মতন কেজো লোকে যে কাজের ভার নিয়েছে, তখন যে রকমে হউক, সে নিশ্চয় হাসিল করবে।”
ঠাকুর। তাতো বুঝলেন, কিন্তু আমাদের মজুরী তো ভাল রকম পোষাবে? খুব উঁচুদরের লোক তো—”
বাবু একগাল হেসে কহিল, “উঁচুদরের লোক না হইলে কি আর কৃষ্ণ নগরাধিপতির সহিত খেলতে সাহস করে। বক্সীর মুখে শুনেছি যে, খুব বেশী রকম রেস্ত নিয়ে আসবে।” ঠাকুর একটু মুচকে হেসে বলে, “তা হ’লেই হ’লো। কাছে রেস্ত কিছু বেশী থাকলে, যে কোন উপায়ে ইউক, আমাদের বাগে আসবে, সেইজন্য গোলা লোক সঙ্গে না এনে, এই রহিম মোল্লাকে আনলাম, এর দ্বারায় দুই রকম কাজ চলবে।”
আমি তখন বুঝতে পারলেম যে, ঠাকুরের সঙ্গীর নাম রহিম মোল্লা; নামেই স্পষ্ট বোধ হইল যে, এ লোকটা মুসলমান। পাপাত্মাদের অসাধ্য কোন কাৰ্য্যই নাই; কপটতার আবরণে আবৃত হ’য়ে ধর্ম্মের মুখোস পরে কেবল পরের সর্ব্বনাশ করিবার উপায় অনুসন্ধান করিতেছে, কিন্তু তার সঙ্গী রহিম মোল্লার দ্বারায় যে কি দু-রকম কাজ হইবে, তাহা তখন আমি বুঝিতে পারি নাই।
আমি দুরাত্মাদের কাণ্ড দেখিবার জন্য সেই জানালার ধারে দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় পুনরায় সদরদ্বার উদ্ঘাটিত হইল ও আর দুইজন লোক আমাদের গৃহে প্রবেশ করিয়া বরাবর উপরে আসিতে লাগিল। পাছে আমাকে দেখিতে পায় এই ভয়ে আমি তথা হইতে একটু অন্তরালে দাঁড়াইলাম ও তাহারা বৈঠকখানায় গিয়া বসিলে, আমি পুনরায় সেই জানালার ধারে আসিলাম।
আমি দেখিলাম যে, দেবীপ্রসাদ আর একজন অল্পবয়স্ক যুবককে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে।
যুবকের বয়ঃক্রম ২৫ বৎসরের অধিক হইবে না; আকার কিছু দীর্ঘ, বর্ণ ফিট্ গৌর, চক্ষুদ্বয় আকর্ণ বিস্তৃত ও উজ্জ্বল নাসিকাটি সরল ও উন্নত, কার্ম্মুকের ন্যায় ভ্রুযুগলযুক্ত, ললাটদেশ খুব প্রশস্ত; ফলতঃ যে যে লক্ষণ থাকিলে লোককে সুপুরুষ বলে, এই যুবকের সেই সেই লক্ষণ তাহার বদন মণ্ডলে বিমান আছে।
যুবকের বাহুযুগল খুব দৃঢ় মাংসল, বক্ষঃস্থল বিশাল, অঙ্গুলীচয় চম্পকদাম সদৃশ ও তিন চারিটি বহুমূল্য অঙ্গুরী দ্বারায় সুশোভিত; অভিনব যৌবন সমাগমে তাহার প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্যক্ প্রকারে সবল ও সুদৃঢ় হইয়াছে এবং তাহাকে দেখিলে খুব বলবান্ বলিয়া বোধ হয়।
যুবকের সর্ব্বাঙ্গ সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালীর ন্যায় বসনে ভূষণে ভূষিত। পরিধেয় একখানি উত্তম ঢাকাই ধুতি; গায়ে মসলিনের একটা আলখাল্লা, তস্য উপর কিংখাপের এক ফতুয়া ও সর্ব্বোপরি একখানি বেনারসী ওড়না ব্রাহ্মণের উপবীতের ন্যায় বাঁধা রহিয়াছে।
যুবকের গলায় দুই তিনটি চাবিযুক্ত এক ছড়া সরু সোণার গোট, অঙ্গুলিতে হীরকাঙ্গুরী ও পায়ে এক জোড়া উত্তম জরির লপেটা জুতা শোভা পাইতেছে।
বুধবার রাত্রে বাবুর সহিত বক্সীর যে কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, তাহা আমার স্মরণ হইল; সুতরাং আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, এই যুবকই আজিমগঞ্জের বার্লো সাহেবের কুঠির দাওয়ান মাণিকলাল সরকারের পুত্ত্র; আমি তখন ইহার নাম জানি নাই, কাজেই তাহা বলিতে পারিলাম না।
কর্ত্তাবাবুর অভ্যর্থনায় আপ্যায়িত হইয়া সকলে আসন পরিগ্রহ করিলে, বক্সী সেই ছোট চোখটা বুজিয়ে সেই যুবককে সম্বোধন করিয়া কহিল, “বাবুজি! স্বর্গে উঠতে গেলে যেমন সিঁড়ি ভাঙতে হয়, তেমনি এ সব আয়েসের জায়গায় আসতে হ’লে একটু কষ্ট স্বীকার করতে হয়। যেমন কাঁটা গাছে গোলাপ ফুল ফোটে, অন্ধকার খনির মধ্যে হীরক থাকে, সেইরূপ কিষণজি বাবু এই সামান্য পল্লী মধ্যে বাস করিতেছেন, কিন্তু সহরের যাবতীয় সৌখিন বড় লোক এখানে আসেন; এই দেখুন না, আপনার সঙ্গে একটু আমোদ করবেন ব’লে স্বয়ং মহারাজ আজ এখানে পদার্পণ ক’রেছেন।
বক্সীর কথা শেষ হইলে যুবক সসম্ভ্রমে জাল মহারাজকে অভিবাদন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মহারাজের রাজধানী কোথায়?”
নিজের মুখে নিজের পরিচয় দেওয়া রাজাদিগের নিয়মবিরুদ্ধ কাৰ্য্য; কাজেই জাল রাজাবাহাদুর নিজের পদমর্য্যাদা বজায় রাখিবার জন্য গম্ভীর মূর্ত্তি ধারণ করিয়া নীরবে বসিয়া রহিলেন। সুতরাং আমাদের বাবু নকিবের পদ গ্রহণ করিয়া কহিলেন, “মহারাজ বঙ্গদেশের কৃষ্ণনগরাধিপতি; ইঁহার নাম মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়। দুরাত্মা সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনচ্যুত হইবার পর মীরজাফর এখন নবাব হইয়াছেন; নূতন নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া জমিদারী সম্বন্ধে কোন বন্দোবস্ত করিবার জন্য মহারাজ মুর্শিদাবাদে শুভাগমন করিয়াছেন। আমি পূর্ব্বে মহারাজের সরকারে চাকরী করিতাম, আমার প্রতি মহারাজের বিশেষ অনুগ্রহ আছে, সেইজন্য অধমের কুটীরে পদার্পণ করিয়াছেন। মহারাজ আমার এখানে খুব ছদ্মবেশে আসিয়াছেন, সেইজন্য কোন সিপাহী কি ভৃত্যবর্গ সঙ্গে আসে নাই।
কর্ত্তাবাবুর নিকট পরিচয় শুনিয়া, যুবক আরও সম্ভ্রমের সহিত কথা কহিতে লাগিল; ঠাকুর সাহেব ওরফে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় রাজা রাজ্ড়ার ন্যায় খুব গম্ভীরভাবে দু’ একটী কথায় তাহার উত্তর দিলেন; অনেক মিষ্টালাপের পর বক্সী কহিল, আর বাজে কথায় আবশ্যক কি? মহারাজ যখন দয়া ক’রে এখানে পায়ের ধুলা দিয়েছেন, তখন আসুন, আজ একটু খেলা যাক্।
যুবক উত্তর করিল, “ক্ষতি কি, আমিও দুইশত মোহর সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।”
যুবকের এই সুসংবাদে সকলের মুখমণ্ডল আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। ‘শুভস্য শীঘ্রং’ এই মহাবাক্য উচ্চারণ ক’রে আমাদের বাবু তাকের উপর হ’তে এক জোড়া নূতন তাস পাড়লেন ও চাবিশুদ্ধ একটি সুন্দর হাত বাক্স কৃত্রিম রাজা বাহাদুরের পাশে রাখলেন।
তারপর চারিজনে মুখোমুখি হইয়া বসিল; আমাদের বাবু তাস লইয়া খুব তাসিয়া দুইখানা করিয়া সকলকে দিলেন। রাজা বাহাদুর সেই বাক্স খুলিয়া পাঁচখান মোহর বাহির করিয়া কহিলেন; “তা হলে আর অধিকে আবশ্যক নাই, প্রথমে পাঁচখান ক’রে রেস্ত বাঁধা যাক্।”
এই প্রস্তাবে সকলে স্বীকৃত হইল। আমাদের বাবু কেবল তাস দিতে আরম্ভ করিলেন; খেলোয়াড়দের মধ্যে কেহ বা হাতে তাস রাখিল, কেহ বা সব ফেলিয়া দিল। যে সকল কথা কস্মিনকালেও শুনি নাই, যাহার কিছুমাত্র অর্থ বুঝি না, সেই সকল কথা পরস্পরে বলিতে লাগিল। দোঁস, ত্রেস্ ইমরিত প্রভৃতি কত কথাই বলিল; সব কথা এখন আমার স্মরণ হইতেছে না। তবে এইমাত্র মনে হয় যে, একবার জাল রাজা বাহাদুর ‘কাতুর কাতুর’ বলে চীৎকার ক’রে উঠেন, আর তার একটু পরেই সেই যুবক ‘মাচ’ এই কথা ব’লে তাসে চুমো খেয়ে তিনখানা তাস ফেলে দিলে ও সকলের কোল হইতে মোহরগুলি কুড়াইয়া লইল।
এই রকম ভাবে তাহারা খেলতে লাগলো, অনবরত মোহরের ঝমাঝম শব্দ শোনা যেতে লাগলো; সেই জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার, অত্যন্ত বিরক্ত বোধ হইল, কাজেই বাটীর মধ্যে না গিয়া সেই বারাণ্ডার এক পার্শ্বে শয়ন করিলাম ও এই সব ছদ্মবেশী বদমাইসদের কার্য্যকলাপ ভাবিতে ভাবিতে ত্বরায় ঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইলাম।
ক্ষণেক পরে আমি এক পিস্তলের শব্দে জাগরিত হইলাম ও চক্ষু খুলিয়া দেখি যে, বৈঠকখানা হইতে একটা লোক বাহির হইয়া দ্রুতবেগে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল। আমি এই ব্যাপারে নিতান্ত ভীত ও বিস্মিত হইলাম; তাড়াতাড়ি সেই জানালার নিকট উপস্থিত হইয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল, ভয়ে বুক দুর্ দুর্ করিতে লাগিল। আমি দেখিলাম যে, বাবু, বক্সী ও ঠাকুর সাহেব তিন জনে মুখোমুখি বসিয়া চুপি চুপি কি কথা কহিতেছেন ও রাজপারিষদ সেই রহিম মোল্লা ঠিক দোরের নিকট পড়িয়া মৃত্যু যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতেছে। তাহার ঠিক বুকে গুলি বিদ্ধ হইয়াছে ও রক্তে সেই স্থানটা প্লাবিত হইয়াছে।
এই ভয়ানক দৃশ্য দেখেই আমি স্থির করিলাম যে, সেই যুবক খুন করিয়া পলায়ন করিয়াছে; কিন্তু তার ন্যায় ভদ্র সন্তান যে সহসা এরূপ ঘোর অপরাধ করিবে তাহা অসম্ভব। নিশ্চয় এই সব পাপাত্মারা তাহার উপর কোন অত্যচার করিবার উপক্রম করিয়াছিল, সেই জন্য বোধ হয় যুবক কেবল আত্মরক্ষার জন্য এই কার্য্য করিয়াছেন।
আমি এই সকল মনে ভাবিতেছি, এমন সময় ঠাকুর, বাবুকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “আর ভাবলে কি হবে? যা হবার তা তো হ’য়ে গেছে, ও বেটার নিকট যে পিস্তল ছিল তা কি ক’রে জানবো। যাই হোক্, আজ তো আর কিছু হবে না, কারণ রাত্রি অধিক নাই, কাল রাত্রিতে লাস সামলানো যাবে। আমি আখড়া থেকে লোক পাঠিয়ে দেবো, এখন আমরা আসি, তোমার ছোট ঘরে লাসটা রেখে দাও।”
ঠাকুর সাহেবের কথা শেষ হইলে বক্সী ও বাবুতে হাত ধরাধরি ক’রে রহিম মোল্লার মৃতদেহ সেই ছোট কুটীরের মধ্যে রাখিয়া চাবি বন্ধ করিল ও বাবুকে চুপি চুপি কি বলিয়া বিদায় গ্রহণ করিল, পাছে আমাকে দেখিতে পায়, এই আশঙ্কায় আমি ত্বরিতপদে বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিলাম।