- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বাবু দেবীপ্রসাদ।
কর্ত্তার নিকট হ’তে শুনেছিলাম যে, গঙ্গার ধার হইতে আধ ক্রোশ যাইলে দেবীপ্রসাদের বাসা প্রাপ্ত হইব; কিন্তু আমার বোধ হইল যে, প্রায় দুই ক্রোশ পথ পর্য্যটন করিয়া তবে সেই আম বাগান দেখিতে পাইলাম; প্রকৃত পক্ষে আমি সেই রৌদ্রে ভ্রমণ করিয়া নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম।
আমি যে স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, তথায় জনমানবের বসতি নাই; সম্মুখে এক বৃহৎ প্রান্তর ধূ ধূ করিতেছে। সেই প্রান্তর পার হইয়া আম বাগানে প্রবেশ করিতে হয়। সেই প্রান্তরে শত শত মুসলমানের পুরাতন সমাধি মন্দির বিরাজ করিতেছে; এ ছাড়া সহরের সমস্ত মৃত অশ্ব, গাভী, মহিষ প্রভৃতি সেই মাঠে নিক্ষেপ করিয়া থাকে।
দিনের বেলায় সেই মাঠ পার হইবার সময়ে ভয়ে আমার বুক গুর্ গুর্ করিতে লাগিল। চারি দিক্ ধূ ধূ করিতেছে; জনমানবের সাড়া শব্দ নাই, চতুর্দ্দিক নিস্তব্ধ; কেবল ইতস্ততঃ সঞ্চরণশীল শকুনি প্রভৃতি মাংসাশী পক্ষীর পক্ষতাড়নজনিত শব্দ শ্রুত হইতেছে ও ক্বচিৎ কোন বৃক্ষকোটরে পিপাসিত চাতক ফটিকজল ব’লে জলদের নিকট জল প্রার্থনা করিতেছে, ইহা ব্যতীত আর সমস্ত স্থির। প্রকৃতি দেবী যেন গভীর ধ্যানে নিমগ্না, গাভীকুল আহারে বীতস্পৃহ ও তরুচ্ছায়ায় রোমন্থনে ব্যস্ত।
আমি সাহসে ভর করিয়া সেই মাঠ পার হইলাম এবং সেই আম বাগানের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। খানিক দূর গিয়া দেখি যে, প্ৰকৃতি দেবীর স্বচ্ছ দর্পণের ন্যায় এক নূতন পুষ্করিণী জলজ কুসুমে শোভিত হইয়া সালঙ্কারা কামিনীর মত পরিদৃশ্যমান হ’চ্ছে; সেই পুষ্করিণীর তটে একখানি উলুর আচালা শোভা পাচ্ছে। আমি সেই আচালার নিকটস্থ হইয়া দেখিলাম যে, তাহার রকের উপর মৃগছাল পাতিয়া গৈরিক বসন পরিহিত একজন দীর্ঘকায় পুরুষ বসিয়া আছে।
বাস্তবিক লোক্টা লম্বে প্রায় পাঁচ হাতের উপর; কিন্তু প্রস্থে আধ হাতের অধিক হইবে না। বয়স প্রায় ষাটি বৎসরের উপর, হাত দু’খানি আরণ্যক-নরের অনুরূপ; মাথায় জটার নাম মাত্র নাই, কিন্তু তাহার পরিবর্ত্তে পাকা চুলে বাবরীর আদ্রা রহিয়াছে। লোকটার মুখ একটু লম্বা, নাকটি বাঁশীর মত সরল, চোখ ছোট ও তারা দু’টি বিড়ালের ন্যায় কটা, মুখে গোঁপ দাড়ির চিহ্ন নাই, বোধ হয় সন্ন্যাসী ঠাকুর সপ্তাহে দুইবার পরামাণিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সন্ন্যাসী ঠাকুরের বুক, কাঁদ খুব ঘন পাকা চুলে আচ্ছাদিত; গলায় ছোট বড় প্রভৃতি রুদ্রাক্ষের মালা লম্বিত; কপালে রক্তচন্দনের দীর্ঘ ফোঁটা; কাণে তুলা সহ আতর। সন্ন্যাসী ঠাকুরের সামনে পঞ্চপাদ্দ, পিছনে একটি ছোট তাকিয়া ও বামপার্শ্বে উত্তম ছিটের ঘেরাটোপে ঘেরা একটা হাতবাক্স রহিয়াছে। তিনি তাঁহার ঈষৎ আরক্তিম ক্ষুদ্র চক্ষুদ্বয় অর্দ্ধ নিমিলিত করিয়া গভীর ধ্যানে মগ্ন আছেন।
আমি সেই আটচালার নিকটস্থ হইয়াই বুঝিতে পারিলাম যে, বাবুর নির্দ্দেশমত ঠাকুর সাহেবের আখড়ায় উপস্থিত হইয়াছি; আমি দেখিলাম যে, আটচালার সামনে প্রায় পাঁচ ছয় কাঠা জমীতে নানাপ্রকার ফুলের গাছ শোভা পাইতেছে; উঠানের ঠিক মধ্যস্থলে প্রস্তর দিয়া বাঁধানো এক প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ বহুরূপ শাখা চতুর্দ্দিকে বিস্তীর্ণ করিয়া আছে, এবং নানাপ্রকার সুকণ্ঠ পক্ষীকুল তাহাতে আশ্রয় লইয়াছে, স্বৰ্গীয় সঙ্গীতের ন্যায় মনোমুগ্ধকর তাহাদের কূজন পথিকের কর্ণে অমৃত বরিষণ করিতেছে। ফলতঃ কোলাহল-পরিশূন্য সেই মনোহর স্থানে ভাবুকের চিত্ত আকৃষ্ট হইবার অনেক উপকরণ তথায় প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান আছে।
আমি নিবিষ্টমনে সেই স্থানের শোভা নিরীক্ষণ করিতেছি, এমন সময় সেই সন্ন্যাসীঠাকুর একবার সম্পূর্ণরূপে চাহিলেন এবং আমাকে দেখিতে পাইয়া অভদ্র লোকের ন্যায় নিতান্ত রুক্ষ্মস্বরে কহিলেন, “তুই বেটা কেরে?”
আমি যদিও সুসভ্য সন্ন্যাসীঠাকুরের সুমিষ্ট কথায় নিতান্ত আপ্যায়িত হইয়াছিলাম, কিন্তু তখন উপযুক্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে আমার ইচ্ছা বা সাহস হইল না, কাজেই আমি বিনীতভাবে কহিলাম, “কিষণলাল বাবু বক্সিজীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য আমাকে পাঠাইয়াছেন।”
জোঁকের মুখে লবণের ন্যায় আমার উত্তরে সন্ন্যাসী খুব নরম হ’য়ে পড়লেন, তিনি আপনাআপনি বাবুর গুণগান গাইতে লাগিলেন; কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সব কথাগুলি আমি বুঝিতে পারিলাম না, কারণ অর্দ্ধেক কথা তাঁহার কণ্ঠমধ্যে রহিয়া গেল। আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের ভাবভঙ্গী দেখিয়া ঠিক বুঝিতে পারিলাম যে, কোন তেজস্কর পদার্থ তাঁহার উদরাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইয়া নিজের কিঞ্চিৎ মহিমা প্রকাশ করিতেছেন।
স্রোতের ন্যায় বাবুর সুখ্যাতি সন্ন্যাসীর মুখ হইতে বহির্গত হইতেছে; তাহার আর বিরাম নাই। যেন দেবী সরস্বতী তাঁহার কণ্ঠে উপস্থিত হইয়াছেন। কিন্তু সেরূপ অসার প্রলাপ শুনিতে আমার ইচ্ছা হইল না, কাজেই আমি নিতান্ত বিরক্ত হইয়া কহিলাম, “মহাশয়! কোথায় গেলে দেবীপ্রসাদ বক্সীর সহিত সাক্ষাৎ হইবে?”
দুই তিনবার খুব উচ্চৈঃস্বরে এই কথা বলিবার পর তবে তাঁহার কর্ণ-গোচর হইল। তিনি আমার দিকে চাহিয়া সেইরূপ জড়িতস্বরে বলিলেন, “বক্সীর কাছে যাবে? আচ্ছা বাপধন! ঐ পুকুরের ওপারে যে সব ঘর আছে দেখতে পাচ্ছো, ঐখানে যাও; তাহ’লেই দেখা হবে। কিন্তু বাবা! যাবার সময় আমার কাছ দিয়ে যেয়ো, একেবারে তাজা করে ছেড়ে দেবো; আটদেড়ে ভাউলের মতন সাঁ সাঁ ক’রে ঘরের ধন ঘরে চ’লে যাবে। আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের কথার শেষভাগগুলি মনোযোগের সহিত শুনিলাম না; আমার কথার উত্তর পাইয়াই আমি বক্সীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য সে স্থান হইতে যাত্রা করিলাম। বিশেষ সন্ন্যাসী ঠাকুরের গতিক ও তাঁহার শ্রীমুখের মিষ্ট কথা শুনিয়া তাঁহার উপর আমার আদৌ ভক্তি হইল না।
আমি সন্নাসীর নির্দ্দেশমত পুকুরের ধার দিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম যে, একখানি সামান্য উলুর ঘরের সম্মুখে একটা আম গাছের তলায় খাটিয়া পাতিয়া দেবীপ্রসাদ শুইয়া আছেন; তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ উলঙ্গ কেবল সামান্য একটু ল্যাঙ্গোটে লজ্জা নিবারণ করিয়াছে। আমি পূৰ্ব্ব হইতেই বক্সিজীকে একজন ভদ্রলোক বলিয়া জানিতান; তিনিও হাজার, দু’হাজারের কম কথা কহিতেন না, নিজেকে খুব বড় নানুষের ছেলে বলিয়া পরিচয় দিতেন। কিন্তু আজ তাকে এরূপ সামান্য কুঁড়ে ঘরে, এত সামান্য অবস্থায় থাকিতে দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। আমার বেশ বোধ হইল যে, বক্সিজী সেই সাদা লিনুন মেরজাই ও পাগড়ীটি বোধ হয় কোন কলসী বা হাঁড়ির ভিতর রাখেন; তারপর বেরোবার সময় সেগুলি পরিয়া এক খিলি পান খাইয়া, কাণে একটু আতর গুঁজিয়া, বেমালুম ভদ্রলোক সাজেন।
আমার পায়ের শব্দ পাইয়া বক্সীজি সেই খাটিয়ার উপর হইতে ঘাড় উঁচু করিয়া সেই ছোট চোখটা বন্ধ করিয়া আমাকে দেখিতে লাগিলেন। প্রথমতঃ আমি তাঁহার দৃষ্টিপথের পথিক হইলে বিস্ময়ের পূর্ণ লক্ষণ সেই ভীষণ মুখমণ্ডলে প্রকটিত হইল। ক্রমে আমি তাঁহার নিকটস্থ হইলে সে খাটিয়া হইতে উঠিয়া সহাস্যে আমাকে কহিলেন, “আরে এসো হে ছোক্রা! ঠিক চিনে তো এসেচো? তোমার খুব সাহস আছে, বাঃ! তুমি বড় কাজের ছোকরা হ’তে পার; ভাল ক’রে কাজ শেখ, তবে আখেরে ভাল হবে। নিশ্চয় কিষণজি ভায়া তোমার কোন গুণ বুঝেছিল, সেই জন্য বিশ্বাস ক’রে একটা কাজে পাঠিয়েছে, যাই হোক এখন খবর কি বল দেখি?
আমি সেই খাটিয়ার উপর বসিয়া মুখে কোন কথা না কহিয়া কর্ত্তার পত্রখানি বক্সীর হাতে দিলাম; তিনি পত্রখানি না খুলে তার চারি দিক্ দেখতে লাগলেন এবং হঠাৎ আমার মুখের দিকে চাহিয়া দেড়টা চোখ লাল করিয়া নিতান্ত কর্কশ স্বরে কহিলেন, “পাজি নেমোকহারাম জ্যেঠা ছেলে! কারে চিঠি পড়তে দিয়েছিলি, সত্যি ক’রে বল?” বক্সীর কথায় ভয়ে আমার মুখ শুষ্ক হইয়া গেল, ভয়ে বুক গুর্ গুর্ করিতে লাগিল। আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, আমি যে পত্র খুলিয়াছিলাম, তাহা চতুর বক্সী জানিতে পারিয়াছে। বিশেষ যদিও আমি খুব সাবধানে পত্র খুলিয়াছিলাম, কিন্তু তথাপি তিন চার স্থানে অল্প অল্প চিড়িয়া গিয়াছে ও অনেকটা অপরিষ্কার হইয়াছে; কাজেই বক্সী যে জানিতে পারিবে তাহার আর বিচিত্র কি?
আমি ভয়ে অভিভূত হইয়া কি উত্তর দিব ভাবিতেছি, এমন সময় বক্সীজি খুব সপ্তমে উঠে বলতে লাগলো, “তুই যে রকম ভয়ানক নেমোকহারামি ক’রেছিস্, এ রকম কাজে জান্ যায়; কাঁচা মাথাটি দিতে হবে! ব্রহ্মার বেটা বিষ্ণু এলেও তোকে বাঁচাতে পারবে না। কিষণজি ভায়া শুনলে কখনই মাপ করবে না; এ রকম বেয়াদবী যদি মাফ করা যায়, তাহ’লে ব্যবসা বাণিজ্য সব খারাপ হ’য়ে যাবে।”
আমার সে সময় যদিও প্রাণে খুব ভয় হ’য়েছিল, কিন্তু আমি এমন কি অপরাধ করিয়াছি যে, তার জন্য আমার প্রাণদণ্ড হইতে পারে? বিশেষ কর্ত্তার পত্র পড়িবার দরুণ বক্সীর যে কি ব্যবসা বাণিজ্য মাটী হইয়া গেল, তাহা আমি কিছুতেই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।
বাস্তবিক বক্সীর সেই তিরস্কারে আমি নিতান্ত ভীত হইলাম; সামান্য কৌতুহল পরিতৃপ্তির জন্য যে ভয়ানক গর্হিত কার্য্য করিয়াছি, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম; কিন্তু তখন অন্তরে অনুতাপের সেবা ব্যতীত আর কোন উপায় নাই। আমার বিশেষ ভয় হইল যে, পাছে বাবু এই কথা শুনেন; কেন না, তিনি যদি ক্রুদ্ধ হইয়া বাটী হইতে আমায় বহিষ্কৃত করিয়া দেন, তাহা হইলে ত নির্ম্মলাকে আর দেখিতে পাইব না; সুতরাং আমার জীবন ধারণ করা দুষ্কর হইবে। আমার সে সময় নিজের প্রাণের ভয় কিছুমাত্র হইল না, কেবল নির্ম্মলার চিন্তা প্রবল হইয়া আমার অন্তরকে ব্যাকুল করিয়া তুলিল, আমি বক্সীকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য হাত যোড় করিয়া কাঁদ কাঁদ স্বরে বলিলাম, “দোহাই বক্সী মশাই! আমি দিব্য ক’রে বলছি, এই পত্র আমি কাহারো হাতে দিই নাই। আমার কেমন কুবুদ্ধি হইল আমি নিজে এই পত্রখানা খুলিয়া পড়িয়াছি; কিন্তু কিছুমাত্র বুঝিতে পারি নাই। আমাকে এইবার ক্ষমা করুন, আমি এমন অন্যায় কৰ্ম্ম আর কখন করিব না। আপনার পায়ে পড়ি, আপনি ওসব কথা বাবুকে বলিবেন না।”
আমি কাঁদ কাঁদ ভাবে এই কথাগুলি বলিলে দেবীপ্রসাদ বক্সী আমার উপর অনেকটা সদয় হ’লেন এবং একটু মুচকে হেসে তারপর জোর ক’রে গম্ভীর হ’য়ে কহিলেন, “আচ্ছা চিরকাল তুই যদি আমার বশে থেকে কাজ কর্ম্ম করিস্, তাহ’লে এ যাত্রা তোকে আমি বাঁচাইতে পারি। আর মন দিয়ে আমার কাছে কাজ কৰ্ম্ম শিখলে তুই একটা মানুষের মত মানুষ হবি। তোকে আর পরের অন্নদাস হ’য়ে থাকতে হবে না, চাই কি তোর তরফে চাকর চাকরাণি খাটবে। তোর মতন একটা বেশ চালাক চতুর ছোড়া পেলে, আমি বড় মানুষের ছেলেদের জেবের মাল নিজের ট্যাকে আছে ব’লে বোধ করি। তুই আমার কথা মতন কাজ করিস্, আমি তোর আখেরে ভাল করব।
যদিও আমার সেটা নিতান্ত অসময়, প্রাণেও যথেষ্ট ভয়ের সঞ্চার হ’য়েছে, কিন্তু তথাপি দেবীপ্রসাদ বাবুর মুরুব্বিয়ানার কায়দা দেখিয়া ও আমার ভাল করবার কথা শুনিয়া আমি একটু না হাসিয়া থাকিতে পারিলাম না। তবে আমার ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য তাহার নিকট হ’তে আমাকে যে কি কাজ কৰ্ম্ম শিখিতে হইবে, তাহা আমি তখন ভালরূপে বুঝিতে পারি নাই। শেষে তিনি নিজেই ব’লে ছিলেন যে, “তোর মতন একটা চালাক চতুর ছেলে পাল্লায় থাকলে, বড় মানুষের ছেলেদের জেবের মাল আমার ট্যাকে আছে ব’লে বোধ হয়। এ কথার মানে কি? দেবী প্রসাদ যে রকম দরের লোক তাতে তার দ্বারার সকল প্রকার অকার্য্য সাধন হওয়া সম্ভব। তবে নিজের দোষে আমি এখন ইহার কায়দায় পড়িয়াছি, সুতরাং তাহার মুখের উপর কোন কথা বলিতে আমার সাহস হ’লো না। তবে মনে মনে বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, ইহার কাছে যে কাজ কৰ্ম্ম শিখিতে হবে, তাহা কখন ভদ্রলোকের উপযুক্ত হবে না। বেটার কথার ভাবে স্পষ্ট বোধ হ’চ্ছে যে, বেটা আমাকে চুরি বিদ্যা শিখাইবে। যাই হোক্, এখন তো এ দায় হ’তে রক্ষা হই, তারপর বা মনে আছে তাই ক’ৰ্ব্বো।
আমি চুপ করে ব’সে আছি। এমন সময় দেবীপ্রসাদ আমার মুখের দিকে একবার কটাক্ষ ক’রে বলে, “কেমন রে, আমার কথা মতন কাজ ক’ৰ্ত্তে সম্মত আছিস্ তো?”
আমি তখন পাপিষ্ঠের ভয়ানক কায়দায় পড়িয়াছি, কাজেই কাঁদ কাঁদ ভাবে উত্তর করিলাম, “দোহাই বক্সী মহাশয়! আমি চিরকাল আপনার বশে থাকবো, আপনি যা হুকুম ক’ৰ্ব্বেন তাই শুনবো, কখন অবাধ্য হবো না।”
আমার এই কথা শুনে পাপিষ্ঠের ক্রোধানল প্রশমিত হইল এবং অনেকটা প্রসন্নভাবে কহিল “তোর আর কোন ভয় নাই। এখন প্রাণ খুলে ভরপুর মজা মারগে; আর যদি মালটাকে টপকাতে পারিস, তাহ’লে আমি মুরুব্বি হ’য়ে তোর সব যোগাড় ক’রে দেবো। কাকের মাংস যদি কাকে খায় তার চেয়ে আর আয়েস নাই; পাপিষ্ঠ এই কথা ব’লে মুলা-নিন্দিত দন্তগুলি বিকাশপূর্ব্বক হা হা ক’রে হাসিয়া উঠিল।
পাপাত্মা নিৰ্ম্মল স্বভাবা নিৰ্ম্মলাকে লক্ষ ক’রে যে শেষের কথাগুলি বলিয়াছে, তাহা বুঝিতে আমার বাকী রহিল না। কাজেই বিষম রোষে আমার দেহের শোণিত উতপ্ত হইয়া উঠিল এবং ইচ্ছা হইল যে, এক পদাঘাতে পাপিষ্ঠের মুখের চেহারা পরিবর্ত্তন করিয়া দি। কিন্তু পাছে হিতে বিপরীত হয়, পাপাত্মা কৰ্ত্তাকে পত্রের কথা বলিয়া দেয়, এই আশঙ্কায় ইচ্ছামত কার্য্য করিতে সাহসে কুলাইল না।
দেবীপ্রসাদ আমার মুখের দিকে একবার চাহিয়া খুব মোলায়েমভাবে কহিল, “রৌদ্রে অনেক দূর হ’তে এসেছো, মুখখানিও শুকিয়ে গেছে, এখন একটু জলটল খাও।” দেবীপ্রসাদ এই কথা ব’লে সেই ঘরের দিকে গিয়ে একটু চেঁচিয়ে বললেন, “বলি কুলু! ঘরে কিছু আছে কি?”
বক্সীর এই কথায় সেই কুঁড়ের ভিতর হইতে নিতান্ত কর্কশস্বরে কে উত্তর দিল, “হাঁ, ঘরে থাকার মধ্যে কেবল উনুনটা আছে; পোড়ারমুখো— আল্প্পেয়ে! কাল প্রাতঃকালে ঘটীটা অবধি বাঁধা দিয়ে গুলি খেয়েছিস্, আজ আবার ওখানে ব’সে ব’সে সাউখুড়ি নাড়া হচ্ছে।”
দেবীপ্রসাদ এইরূপ মিষ্ট সম্বোধনে কিছুমাত্র গরম বা অপ্রস্তুত না হয়ে সেইরূপ দত্ত বিকাশপূর্ব্বক কহিলেন, “তোমার ভাই সব সময় ঠাট্টা! একজন অপর লোক রয়েছে, সে তোমার তামাসা বুঝবে না, তাই হয় ত কি মনে ক’চ্ছে। এখন একবার বাইরে এসে দেখ দেখি, কে এসেছে।” বক্সীর আহ্বানে সেই মিষ্টভাষিণী বাহিরে আসিয়া সেই আম গাছের তলায় দাঁড়াইল। সেই রমণীরত্নকে দেখিয়া আমার মনে সন্দেহ হইল যে, ইনি ঘরের মধ্য হইতে আসিলেন, কি এই আম গাছ হইতে নামিলেন। বাস্তবিক এই দিনের বেলায় সেই রমণীর শ্রীমুখকমল দেখিয়া আমার মনে হঠাৎ ভয়ের সঞ্চার হইল; বোধ হয় রাত্রিতে দেখিলে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িতাম।
পূৰ্ব্বেই উক্ত হইয়াছে যে, ইহার নাম ফুলকুমারী, যেমন জাপান বার্ণীসের ন্যায় কালো ছেলের নাম লালচাঁদ রাখে, হস্তীনিন্দিত কোটরগত যার চক্ষু, তাকে যেমন আদর ক’রে লোক পদ্মপলাশলোচন ব’লে ডাকে, তেমনি নিশ্চয় কোন রসিক পুরুষ এই সুন্দরীর নাম ফুলকুমারী রাখিয়াছিলেন। ফুলকুমারীর বয়স কত তাহা ইতিহাসে লেখে নাই, সুতরাং আমরা কল্পিত কথা বলিয়া সুন্দরীর ক্রোধানলে পতঙ্গবৃত্তি অবলম্বন করিতে স্বীকৃত নহি।
কোথায় মা কবিজন হৃদি-বিহারিণী বাগেশ্বরি! কোথায় মা শ্বেত শতদল শোভিত শারদে! মা এই ঘোর কলিকালে মিথিলা, নবদ্বীপ, গৌড় প্রভৃতি প্রধান প্রধান নগর পরিত্যাগ ক’রে তুমি মহারাজা ইংরাজের রাজধানী কলিকাতার স্থান বিশেষে আসিয়া বাস করিতেছ; মাগো! তোমারই কৃপায় লক্ষ লক্ষ টীস্, শত শত নভেল, সহস্র সহস্র নাটক প্রত্যহ প্রেসরূপ মাতাল, বমির ন্যায় উদ্গীরণ করিতেছে। মা! সহরের রঙ্গমঞ্চগুলি আজকাল তোমার প্রিয় বৈঠকখানা; সেই জন্য ঘণ্টায় তিন চারিখানি হস্ত পদ ও মস্তক পরিশূন্য নাটক প্রসূত হইতেছে; দেবি, যাহারা গর্ভধারণ করিবার পূর্ব্বে কানাইয়ের মা হইয়াছে, বানান ভুল, ব্যাকরণ ভুল যাদের নিজস্ব সম্পত্তি, আজ কাল তারাই তোমার সুসন্তান; মাগো! এ অধম তো তাদের মধ্যে একজন। তবে মা, কি অপরাধে এ দাস তোমার সাধারণ-ভোগ্য কৃপা হ’তে বঞ্চিত হইবে? মাগো দাসের প্রতি কৃপা কটাক্ষ কর, গুটিকয়েক মোলায়েম কথা জুগিয়ে দাও, জিহ্বায় এক পা ও আমার কলমে এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে বর দাও, আমি যেন ফুলকুমারীর ন্যায় সাকারা সুন্দরীর রূপ বর্ণন করিতে সক্ষম হই।
আমার হলোফান এজাহারে কহিতে পারি যে, ফুলকুমারীর চুল দেখিয়া কখন কোন সর্প গর্ত্তের মধ্যে প্রবেশ করে নাই; কেন না, তাহার পাতলা চুলগুলি কাঁদের নীচে আসিয়া পড়িত না। ফুলকুমারী সখ করিয়া যখন সেই কেশে কবরী বাঁধিত, তখন ঠিক অগ্রহায়ণ মাসের কুমড়া বড়ি বলিয়া অনেকের ভ্রম হইত।
ফুলকুমারীর মুখখানি চাঁদের মতন বটে, কিন্তু অমাবস্যার; কোটর প্রবিষ্ট সেই ছোট ছোট চোখ দু’টি দেখে মনের খেদে হাতী নিবিড় বনে গিয়ে প্রবেশ ক’রেছে, কুচও লজ্জায় সুটির মধ্যে লুকাইয়া আছে। নাকটি তিল ফুলের মতন নয় বটে, কিন্তু টেয়া-পাখীর ঠোঁটের অনুরূপ; ভ্রুযুগল জ্ঞাতি-বিবাদে মত্ত হইয়া পরস্পর পৃথক্ হইয়া আছে; শ্রীমতীর ওষ্ঠদ্বয় যেন সুদূর আফ্রিকাখণ্ড হইতে হাওলাৎ করিয়া আনিয়াছে।
ফুলকুমারীর কুচযুগ পর্ব্বত শিখরের মতন উচ্চ নহে বা তাহা দেখিয়া কস্মিন্ কালেও কোন দাড়িম্ব বিদীর্ণ হয় নাই; কারণ শ্রীমতীর পয়োধর যুগল নাভী-সরোবরে স্নান করিবার জন্য অনেক দিন হইল যাত্রা করিয়াছে।
পাছে ফুলকুমারীর পায়ের উপমা না মেলে, এই ভয়ে বিধাতা হাড়গিল্লার সৃষ্টি করিয়াছেন; বাহু দেখে লজ্জায় সজনা ডালকে গাছের উপর ঝুলিয়ে রাখলেন; দাঁতের বাহার দেখে মূলাকে মাটির নীচে পুতলেন। ফুলকুমারীর বত্রিশটী দাঁতের মধ্যে ত্রিশটা অন্দরমহলে বাস করে, আর সম্মুখের দু’টি, মাথা উঁচু করিয়া রাত্র দিন তাহাদের পাহারা দেয়; প্রকাশমান দুই দন্তের দ্বারায় তাহার রূপ উথলিয়া পড়িতেছে। মুখেরও শত গুণ সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি হইয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, রাত্রিকালে ঐ সৌন্দর্য্য নয়নগোচর হইলে নিতান্ত সাহসিক পুরুষেরও ভয়ের সঞ্চার হয়। পথিক দেখিলে মনে মনে রাম নাম জপ করিতে বাধ্য হয়।
ফুলকুমারীর পা হইতে মাথা অবধি দেখিলে বোধ হয় যে, একখানি আবলুস কাঠের তক্তার উপর কোন কাঁচা কারিকর যেন কালো পাথরের মুণ্ড তৈরারি ক’রে বসাইয়া রাখিয়াছে।
ফুলকুমারী একখানি আড় ময়লা লালপেড়ে সাড়ী পরিধান করিয়াছে। শির ওঠা ওঠা শুকনো, হাতে দু’গাছি পিতলের বালা ও সেই ঢেউ খেলানো নাকে একটি ছোট তিলক শোভা পাইতেছে। শ্রীমতী একগাল পান খাইয়া যেন রক্তদন্তী সাজিয়াছেন ও সম্মুখের সেই বিরাট দন্তদ্বয় রক্তবর্ণে শোভিত হইয়া সংকীর্ত্তনের ধ্বজার ন্যায় উচ্চ হইয়া আছে।
ফুল ঘর হইতে বাহির হইয়া আমাদের নিকট দাঁড়াইলে, বক্সীজি আমার কাছে নিজের মান বাঁচাইবার জন্য কহিলেন, ফুলু! সব সময় ও রকম কি ঠাট্টা করতে আছে! ও রকম কথায় যে ভদ্রলোকের মান যায়; তোমার প্রাণ খড়ির মত ধপধপে সাদা কি না, সেইজন্য অত তলিয়ে বুঝে দেখ না, মুখে যা আসে তাই ব’লে ফেল, কিন্তু আমার মত সকলে ত সুরসিক নয় যে, তোমার ডায়মন্কাটা তামাসা বুঝতে পারবে? কাজেই গোলা লোকে হয় তো তোমার কথা সত্য ব’লে মনে করতে পারে। নাই হোক্, এই ছোকরা কিষণজি বাবুর বাড়ী থেকে এসেছে, এই পত্র এনেছে, নিশ্চয় এতে কোন খোস্ খবর আছে; বিশেষ আজ রাত্রে বাবুর বাড়ীতে একটা খুচরা কাজ হবার কথা আছে, বোধ হয় তারই সম্বন্ধে কোন কথা এই পত্রে আছে। তুমি একবার ঠাকুরের ওখান থেকে কিছু জলখাবার যদি পাও তো নিয়ে এসো; চাকর বেটারা এখন নাই যে, বাজার থেকে কিনে আনবে।”
দেবীপ্রসাসের এই কথায় শ্রীমতী ফুলু হাসিল কি না, তাহা ঠিক বলিতে পারা যায় না, কারণ সম্মুখের সেই দন্তদ্বয় সকল সময়ে সমভাবেই প্রকাশমান। কাজেই নারায়ণের শোওয়া বসার ন্যায় সেই বিধুবদনের মধুর হাস্য স্থির করা দুষ্কর, তবে শ্রীমতী বক্সীর কথায় আর কোন প্রতিবাদ না করিয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল।
ফুলু প্রস্থান করিলে দেবীপ্রসাদ এতক্ষণের পর পত্রখানি খুলে পাঠ করিল এবং গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ ভাবিয়া আমাকে কহিল, “দেখ হরিদাস! রাত নয়টার সময় আমি তোমাদের বাসায় যাবো, আমি যদি তোমাকে কোন কথা ব’লে থাকি, খবরদার কাহারো নিকট প্রকাশ ক’রো না, আর আমিও প্রাণান্তে তোমার কথা বাবুকে বলিব না; তুমি কিষণজি বাবুকে ব’লো যে, এত তাড়াতাড়ি ভাল লোক ত পাওয়া যাইবে না, কাজেই খোদ ঠাকুরকে জোটাতে হচ্ছে, এ ছাড়া আর উপায় নাই। তুমি কেবল এই কয়টি কথা বাবুকে বলবে।”
বক্সীর কথা শেষ হইলে ফুলকুমারী সুন্দরী একখানা ফেণি বাতাসা ও এক গ্লাস জল এনে আমাকে দিলেন। পাছে দেবীবাবু রাগ করে, এই ভয়ে সেই সুন্দরীর করকমল হইতে বাতাসা ও জল লইলাম এবং নিতান্ত অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও কিঞ্চিৎ বাতাসা খাইয়া জলপান করিলাম। বক্সিজী আমাকে তাহার মৌখিক উত্তরটি আর একবার তালিম দিয়া বিদায় প্রদান করিলেন; আমি সেই সব বদ্মাইসদের কাণ্ডকারখানা ভাবিতে ভাবিতে বাসা উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।