- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আজব চিঠি!
দেখতে দেখতে দুই দিন কেটে গেল, এই দুই দিনের মধ্যে বিস্তীর্ণ জগতের কত স্থানে যে কত অদ্ভূত ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে, কত লব্ধপ্রতিষ্ঠ রাজ্যের, কত উন্নত গ্রামের যে ভাগ্য পরিবর্ত্তন হইয়াছে, কত সুখের সংসার যে সহসা শ্মশানে পরিণত হইয়াছে, তার আর ইয়ত্তা নাই। প্রতি মুহূর্ত্তে সুখমত্ত মানবের আয়ু-ধন নিঃশব্দে হরণ করিয়া অপার কাল-সাগরে মিশিতেছে। যে চতুর, ভাগ্য যার একান্ত অনুকুল, ক্ষণস্থায়ী মনুষ্য জন্মকে সার্থক করা যার উদ্দেশ্য, যেই আপাত-মধুর পরিণাম-বিরস জগতের প্রলোভন হইতে পৃথক্ থেকে এই নিয়ত-গতিশীল সময়ের সদ্ব্যবহার দ্বারায় জীবনকে নিত্য সুখভোগের অধিকারী করে, আর যে আলস্যের অনুগত, বিলাস পরায়ণ ও ঘোর মূর্খ, সেই নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর অনিত্য সুখে মত্ত হ’য়ে সুধাময় নিত্যসুখে বঞ্চিত হয়। বহুমূল্য হীরকের সঙ্গিত একখণ্ড লোষ্ট্রের বিনিময় করে, শুকের উপযুক্ত সুবর্ণ পিঞ্জরে বায়সকে আবদ্ধ রাখে, সুতরাং পরিণামে সুদারুণ অনুতাপানলে যে সেই সব হতভাগ্যের মর্ম্মস্থল নিয়ত দগ্ধ হয় তাহা নিশ্চয়।
এক দিকের হিসাবে আমার ক্ষুদ্র জীবনের দুই দিন কাটিয়া গেল ও অন্য দিকের হিসাবে আমি দুই দিনের বড় হইলাম, অর্থাৎ আমার বয়স যাহা ছিল, তাহার দুই দিন বাড়িল। এই দুই দিন আমি নিতান্ত উৎকণ্ঠিত ভাবে যাপন করিলাম। আমার মনে যে কি একটা খট্কা হইয়াছে, কোন্ বিষয় যে আমি রাত্রি দিন ভাবি, চতুরা গিন্নী আমার মুখের বিষণ্ণভাব দেখিয়া অনেকটা বুঝিতে পারিয়াছিলেন, সুতরাং যাহাতে আমার চিত্তাকাশ পূর্ব্বেকার ন্যায় বিমল হয়, তাহার জন্য গিন্নী অশেষ প্রকার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহার হুকুমক্রমে সকালে মৌলবী সাহেব আমাকে পড়াইতে আসেন, আমার আহারের সময় দুবেলা গিন্নী স্বয়ং উপস্থিত হইয়া ব্রাহ্মণ ঠাকুরের উপর খপরদারী করেন, খুব মিষ্টি ভাষায় কথা কন, ফলতঃ পূর্ব্বেকার অপেক্ষা সকল বিষয়েই আমার আদর ও যত্ন বাড়িয়া উঠিল।
কনোজি বামুনের ছেলে মুর্শিদাবাদে পাওয়া যায় না ব’লে যে, তাহার মেয়ের বিবাহ হয় নাই, এ কথা আমাকে বোঝাইবার জন্য গিন্নী অনেকগুলি মোলাম্ কথা খরচ করিয়াছিলেন। আমি ঘাড় হেঁট করিয়া সকল কথা শুনিতাম বটে, কিন্তু কোন কথাই আমার বিশ্বাস হইত না। আমার প্রতি গিন্নীর এত আদর, এত যত্ন সমুদয় যে কপটতা-মিশ্রিত তাহা আমি বিলক্ষণরূপে বুঝিতে পারিয়াছিলাম, সুতরাং সেরূপ স্বার্থমূলক মৌখিক স্নেহে যে আমার মন প্রাণ শীতল হইত না তাহা বলাই বাহুল্য।
যদিও আজকাল আমার চিত্ত-সাগর প্রশান্ত নহে, রাত্র দিন তরঙ্গ উঠিতেছে, কিন্তু তথাপি সেই বাটীতে নিতান্ত মনকষ্টে আমাকে দিনপাত করিতে হইত না। সুবিস্তীর্ণ মরুভূমে ওয়েসীসের ন্যায় কিষণলাল বাবুর পাপ-সংসারে আমার মন-প্রাণ মুগ্ধকর এক বস্তু ছিল, অন্ধকারময় পথভ্রষ্ট পথিক ক্ষণপ্রভার ক্ষণপ্রভায় যেমন পথ প্রাপ্ত হয়, নির্ব্বাণ স্থানে মন্দ মন্দ সমীরণ সঞ্চারিত হইলে যেমন সকলের মন প্রাণ সুশীতল হইয়া থাকে, তেমনি আমার নিতান্ত মনকষ্টের সময় অকলঙ্ক শশীসম নির্ম্মলার বদনকমল নিরীক্ষণ করিলে সকলপ্রকার দুশ্চিন্তা অপনীত হইয়া মনে একপ্রকার অভূতপূর্ব্ব আনন্দের উদয় হইত, আমি সে সময় সমগ্র জগৎকে বিস্মৃত হইতাম। জাগতিক সকলপ্রকার চিন্তা আমার অন্তর হইতে দূরীভূত হইত, আমার বোধ হইত, যেন আমি পাপময় সংসার পরিত্যাগ করিয়া অমরাবতীতে ভ্রমণ করিতেছি।
নিৰ্ম্মলাকে দেখিলে কেন যে আমার অন্তরের ঈদৃশ ভাবান্তর উপস্থিত হইত তাহা তখন আমি বুঝিতে পারিতাম না। সে সময় আমি উৎকট বাসনার বশীভূত হই নাই, দারুণ লোভের অনলেও আমার হৃদয় প্রজ্জ্বলিত হয় নাই, কিন্তু তথাপি নিৰ্ম্মলাকে না দেখিলে কিছুতেই মনে শান্তিলাভ করিতে পারিতাম না।
আজকাল নিৰ্ম্মলা আমার নিকট আসিলে, পূর্ব্বেকার ন্যায় নয়ন ভরিয়া তাহাকে দেখিতে সাহস হইত না; নিতান্ত কুণ্ঠিতভাবে তস্করের ন্যায় ভয়ে ভয়ে দেখিতে হইত, কিন্তু কিছুতেই দেখিবার পিপাসা মিটিত না। নয়ন হইতে অন্তরাল হইলে আমার মানসপটে সেই মনমোহিনীর মোহিনী মূর্ত্তি অঙ্কিত থাকিত। এইস্থানে আমার যাহা মনের ভাব, তাহা অকপটে ব্যক্ত করিলাম, কিন্তু নিতান্ত লজ্জাশীলা সরলা নির্ম্মলার মনের ভাব একমাত্র সর্ব্ব-নিয়ন্তা জগদীশ্বর ব্যতীত আর সকলের পক্ষে অপরিজ্ঞাত।
শনিবার প্রাতঃকালে নিয়মমত আমি বারান্দার বসিয়া আমার পার্সী পুস্তক পড়িতেছি, তখন বেলা প্রায় নয়টা, মৌলবী সাহেব আমাকে পাঠ করিতে দিয়া প্রস্থান করিয়াছেন, আমি মনে মনে সেই নূতন পাঠ মুখস্থ করিতেছি, এমন সময় বাবু অন্দরমহল হইতে বাহিরে আসিলেন। বাবু আমার নিকট দাড়াইয়া খুব স্নেহ-স্বরে আমাকে কহিলেন, “বাবা হরিদাস! একটা কাজ কর তো বাবা!”
আমি বিনীত ভাবে উত্তর করিলাম, “কি করিতে হইবে আজ্ঞা করুন।”
বাবু আমার মুখের দিকে একবার কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, “এমন কিছু নয়, একখানা পত্র লিখে দিচ্ছি, তুমি সেইখানা দেবীপ্রসাদ বক্সীকে দিয়ে আসবে, বড় জরুরি খবর তাতে আছে, খবরদার যেন আর কোন লোকের হাতে না পড়ে। তোমাকে বড় ভালবাসি ও প্রাণের সহিত বিশ্বাস করি ব’লে এমন জরুরি কাজে পাঠাচ্ছি।”
আমি বিনীত ভাবে উত্তর করিলাম, “দেবীপ্রসাদ বাবুর ঠিকানা আমি তো জানি না, তাহ’লে আমি কি ক’রে যাবো?”
কৰ্ত্তা আদর ক’রে আমার পীঠে খুব আস্তে একটা ফুলো চাপড় মেরে সস্নেহে কহিলেন, ‘আরে হাবা ছেলে, লোকে জিজ্ঞাসা ক’রে দিল্লী লাহোর চলে যাচ্ছে, আর তুমি ঠাকুর সাহেবের আখড়ায় গিয়ে এই চিঠিখানা দিয়ে আসতে পারবে না? বিশেষ ঐ পত্রখানা যার নামে লিখছি, সে লোকটা নামজাদা ও সবাই তাকে চেনে, তুমি যাকে জিজ্ঞাসা করবে সেই দেখিয়ে দিবে। সহরের যাবতীয় সৌখিন বড় মানুষের ছেলেরা বড় বড় কাজের জন্য তার ওখানে সৰ্ব্বদা যাতায়াত ক’রে থাকে।’
কর্ত্তা বক্তৃতার ঢঙ্গে তাহার ডাহিনের দোহার দেবীপ্রসাদের অনেক গুণানুকীৰ্ত্তন করিলেন, তিনি যে সহরের মধ্যে একটা নামজাদা উঁচুদরের মানুষ তাহাও বলিতে ভুলিলেন না, কিন্তু তাঁহার কথাগুলি আমার এক কাণ দিয়া প্রবেশ করিয়া অন্য কাণ দিয়া বাহির হইয়া গেল, তাঁহার একটি কথাও আমার বিশ্বাস হইল না। কারণ সে দিন কর্ত্তার সঙ্গে দেবীপ্রসাদের সেই কথাবার্ত্তা আমি স্বকর্ণে শুনিয়াছিলাম, কাহার বিপক্ষে যে একটা ষড়যন্ত্র হইতেছে, তাহা অনুমানে বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম, সুতরাং দেবীপ্রসাদ যে সৎ লোক নয়, একটা নিষ্ঠুর-হৃদয় বদমাইস তাহাতে আর আমার সন্দেহ ছিল না, কাজেই কথার মুখে তাহার ঈদৃশ লম্বা চওড়া সুখ্যাতি কিরূপে সত্য বলিয়া আমার বিশ্বাস হইবে? তবে আমি মুখে কোন কথা বলিলাম না, কেবল কাঠের পুতুলের মতন দাড়াইয়া রহিলাম। কৰ্ত্তা আমাকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিয়া বৈঠকখানার মধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং প্রায় আধ ঘণ্টা পরে একখানি পত্র হাতে করিয়া বাহিরে আসিলেন।
কৰ্ত্তা সেই পত্রখানি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “এখানি অতি সাবধানের সহিত কোঁচার খুটে বাঁধিয়া রাখ এবং বরাবর ঠাকুর সাহেবের আখড়ায় গিয়ে দেবীপ্রসাদের হাতে এই পত্র দিও, খবরদার যেন অন্য কাহারও হাতে না পড়ে। যদি তাকে দেখতে না পাও, তাহ’লে চিঠি নিয়ে ফিরে এসো। এর মধ্যে সঙ্গিন সঙ্গিন খবর লেখা আছে। খবরদার দেবীপ্রসাদ ছাড়া আর কাহারও হাতে পত্র দিও না।”
কর্ত্তা এইরূপে আমাকে পুনঃ পুনঃ সাবধান ক’রে ঠাকুর সাহেবের ঠিকানাটা ব’লে দিলেন, আমি তাঁকে প্রণাম করে, পত্রখানা কাপড়ের খুটে বেঁধে তখনি যাত্রা করিলাম।
খানিক দূর যাইতে না যাইতেই বালসুলভ কৌতুহলে আমার হৃদয় পূর্ণ হইল। আমি ভাবিতে লাগিলাম যে, কর্ত্তা যখন এই পত্রখানি দেবীপ্রসাদ ছাড়া আর কাহারও হাতে যাতে না পড়ে, তার জন্য পুনঃ পুনঃ আমাকে এত সাবধান ক’রে দিলেন, তখন অবশ্য কোন বিশেষ গোপনীয় কথা লেখা আছে; তা না থাকলে বাবু কখনই আমাকে এত সাবধান ক’রে দিতেন না। বিশেষতঃ তিনি নিজে ব’লেছিলেন, এতে সঙ্গিন সঙ্গিন খবর আছে। পূর্ব্বেকার ন্যায় বাবুর উপর আমার ততদূর বিশ্বাস নাই, সেই রাত্রে কর্ত্ত। ও গিন্নীর কথা শুনে প্রাণে বিষম খট্কা ও ভয়ানক সন্দেহ হইয়াছে; বাবু যে ছদ্মবেশী ও নিতান্ত অর্থলোলুপ তা আমি অনেকটা বুঝিতে পারিয়াছি। সুতরাং এ হেন কর্ত্তা দেবীপ্রসাদের মতন বদমাইস লোককে কি গোপনীয় কথা লিখেছেন, জানবার জন্য নিতান্ত কৌতূহল হইল, সুতরাং কৌশল করিয়া কর্ত্তার পত্রখানি পড়িবার উপায় অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম।
আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির অভিপ্রায়ে পথিপার্শ্বস্থ কাজি জেহানকাদের নামক একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের বাটীসংলগ্ন উদ্যান মধ্যে প্রবেশ করিলাম ও বৃহৎ পুষ্করিণীর চাঁদনীতে বসিয়া পত্রখানি উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম যে, পত্রখানি খামে মোড়া ও আঠার দ্বারায় উত্তমরূপে জোড়া আছে।
যদিও এখন আমি বুঝিতে পারিয়াছি যে, একের পত্র অন্যের পাঠ করা নিতান্ত অন্যায় ও অভদ্ৰাসূচক; কিন্তু সে সময় আমি কৌতূহলের বশবর্ত্তী হইয়া কৰ্ত্তা বক্সীকে কি লিখিয়াছেন পড়িবার জন্য নিতান্ত ব্যগ্র হইলাম, এবং পত্রের যে যে স্থান জোড়া, তথায় জল দিয়া উত্তমরূপে ভিজাইলাম এবং একটা সরু কাঁটা দিয়া খুব আস্তে আস্তে সাবধানে এক দিক্ খুলিয়া পত্রখানি বাহির করিয়া লইলাম। তাহাতে এই লেখা ছিল—
শ্রীশ্রীদুর্গা।
শরণং।
পরম শুভাশীর্ব্বাদ বিজ্ঞাপনঞ্চ বিশেষ—
পরে ভাইজীউর কুশল ৺স্থানে নিয়ত প্রার্থনা করিতেছি, তাহাতে অত্রানন্দ হয়, পরে ভাইজীউর কহতমত, আগত শনিবারের জন্য সকলপ্রকার যোগাড় করিয়াছি, কিন্তু বিছ্ মোল্লায় গলদ্ হইয়া পড়িয়াছে, সেই জন্য ভাইজীউর নিকট এই আশীর্ব্বাদী চিঠি ভেজিতে হইয়াছে।
সে দিনকার কাজের আঞ্জামের জন্য আমি আমার যে দু’জন বিশ্বাসী লোক ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম, তাহাদের মধ্যে একজন হঠাৎ একটা তুচ্ছে কাজ বেগতিক হওয়ায় পিঁজরার আটক পড়িয়াছে ও অন্য জন গা ঢাকা দিয়াছে। কাজেই তুমি তোমার পছন্দ মত দু’জন কেজো লোক ঠিক করিয়া আসিবে এবং তাহাদের হাতে একসুট্ রাজা সাজবার পোষাক ও সরঞ্জাম যোগাড় করিয়া পাঠাইবে; কারণ ইঁদুরে আমার নিজের পোষাকটা একেবারে মাটি করিয়া ফেলিয়াছে।
তুমি সব রকম কাজের লায়েক, খুব হুসিয়ার লোক আনিবে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই, কাজেই তোমায় অধিক লেখা বাহুল্য। আমি আর আর সব প্রস্তুত করিয়া রাখিলাম, তুমি যথাকালে শীকার সহ উপস্থিত হইবে।
ইতি ১১ চৈত্র, সন ১১৭২ সাল।
আশীৰ্ব্বাদক—
কিষণলাল বাজপাই।
পত্রখানি পাঠ করিয়া সেইরূপে খামের মধ্যে পূরিয়া আবার বন্ধ করিলাম, বুঝিলাম ইহাতে বিশেষ কোন সঙ্গিন খবর নাই। তবে কি জন্য যে কৰ্ত্তা যাহাতে পরের হাতে পত্র না পড়ে, তার জন্য সাবধান কল্লেন, এর কারণ তো কিছুমাত্র ঠিক করিতে পারিলাম না।
আমি পত্রখানি সমস্তই পড়িলাম বটে, কিন্তু তাহার প্রকৃত মৰ্ম্ম কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। কৰ্ত্তা লিখিয়াছেন যে, আমার একজন লোক গা ঢাকা দিয়াছে ও একজন লোক পিঁজ্রায় আটক আছে; এ কথার মানে কি? মানুষ ত আর জানোয়ার নয় যে পিঁজরায় থাকবে। তবে কর্ত্তা এমন কথা কেন লিখলেন? তারপর রাজা সাজবার পোষাক চেয়ে আনতে লিখেছেন কেন— রাজা সাজবার তার কি প্রয়োজন?
যদিও আমি পত্রের প্রকৃত অর্থ বুঝিতে পারিলাম না, কিন্তু তাহাতে যে কোন ভয়ানক গোপনীয় কথা লেখা আছে, তাহা আমার বোধ হইল না; কাজেই অনেকটা প্রফুল্ল চিত্তে দেবী প্রসাদের বাসা উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।
বাবু আমাকে কহিয়াছিলেন যে, বাজারের পূর্ব্ব দিকের গলি ধরিয়া বরাবর গিয়া গঙ্গার ধারে পড়বে, সেই বাগানের মধ্যে ঠাকুর সাহেবের আখড়ায় গেলে দেবীপ্রসাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে।
আমিও বাবুর নির্দ্দেশক্রমে সেই গলির রাস্তা দিয়া গঙ্গার ধারে পড়িলাম এবং তথা হইতে ঠাকুর সাহেবের আখড়া জিজ্ঞাসা করিতে করিতে ক্রমে সেই বৃহৎ আমবাগান দেখিতে পাইলাম।