» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

উপসংহার

লক্ষ্মীনারায়ণ বাবুর সঙ্গে এলাহাবাদে পৌঁছিলাম বটে, কিন্তু তাঁহার বাসার মধ্যে না গিয়া বরাবর গন্তব্য স্থানের দিকে যাত্রা করিলাম।

বেলা আন্দাজ আটটার সময় মুটীগঞ্জে গিয়া পৌঁছিলাম এবং এক দোকানিকে জিজ্ঞাসা ক’রে হরমোহন মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বাটী ঠিক করিলাম। আনি গেট বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ ক’রে, “মা, ক্ষুধিত অতিথীকে ভিক্ষা দাও” ব’লে চীৎকার করে উঠলাম।

অল্পক্ষণ পরে অনুমানিক ৫০/৫৫ বৎসর বয়স্কা একটী সধবা স্ত্রীলোক ভিক্ষা দেবার জন্য বাহিরে আসিলেন, কিন্তু তাঁহার ভিক্ষাপাত্র হাতেই রহিল, তিনি আসিয়াই কেবল উদাসভাবে আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।

এই গরীয়সী রমণীকে দেখিবামাত্র আমার সর্ব্বশরীর যেন কণ্টকিত হইয়া উঠিল, মন প্রাণ যেন এক প্রকার সন্তোষসাগরে সাঁতার দিতে আরম্ভ করিল, কাজেই এই রমণী যে কে তাহা আমি অনেকটা অনুমানে বুঝিতে পারিলাম, কিন্তু মুখে কিছু বলিলাম না, কেবল একদৃষ্টে তাঁহাকে দেখিতে লাগিলাম, তবে সহসা বর্ষাকালের সরোবরের ন্যায় আমার চক্ষু দুটা অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

অনেকক্ষণ পরে সেই রমণী ছল ছল নেত্রে বাষ্পগদ্‌গদস্বরে কহিলেন, “বাবা কোন অভাগিনীর বুকে ছুরি মেরে তুমি বাড়ী হ’তে বেরিয়েছ? আহা! আমার সে এতদিনে বোধ হয় এত বড় হ’তো।” এই কথা ব’লে রমণী অজস্র অশ্রুজল বিসর্জ্জন করতে লাগলো।

আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল, আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না, মনের আবেগ ভরে তাঁহার পদতলে প্রণত হ’য়ে কহিলাম, “মাগো! আমিই তোমার ছেলে, দেড় বৎসর বয়সের সময় লাহোরে সন্ন্যাসীর করে আমাকেই আপনারা সমর্পণ করেছিলেন।”

মা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে “বাপ রে তুই কি আমার হারানিধি!” এই কথা বলে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। মার কান্না শ্রবণে উপর হ’তে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিলেন এবং বলিলেন, “আরে অভাগিনী, আর কেন মায়া বাড়াও, ওতে আর তো আমাদের কোন অধিকার নাই; জন্মের মতন প্রভুপদে উৎসর্গ ক’রেছি, তোমার নানকদাস হ’তে দুঃখ দূর হবে, সেই তোমার যথার্থ পুত্ত্র” তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে কহিলেন, “বাবা এতদিনের পর কি আমাদের মনে পড়িল?”

ইনিই যে আমার পিতা তাহা বুঝিতে আমার বিলম্ব হইল না, কাজেই আমি তাঁহার পদধূলি লইলাম, কিন্তু তিনি পুনঃ প্রণাম ক’রে ঈষৎ কুণ্ঠিতভাবে কহিলেন, “বাবা তোমার প্রণাম গ্রহণ করবার আর আমার সাধ্য নাই। তোমাকে জন্মের মত প্রভুপদে দান ক’রেছি, বোধ হয় সব কথা তুমি সন্ন্যাসী মহাশয়ের নিকট শুনিয়াছ। তাহ’লে তোমাকে আর কি বলবো। মাঝে মাঝে এসে দেখা দিয়ো, ইহা ভিন্ন তোমাকে আর কিছু বলবার আমার আর কোন অধিকার নাই।”

সেই দিন সেই বাটীতে রহিলাম, সমস্ত দিন রাত মার সঙ্গে কথা ক’য়েও সব কথা শেষ হইল না, কিন্তু আমি তার পরদিন কিছুতেই রহিলাম না, কাজেই মার চোখের জল দেখতে দেখতে বাটী হইতে বহির্গত হইলাম।

আমি লক্ষ্মীনারায়ণ বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম, “পাপাত্মা কৃষ্ণনাম” এখানে জহরলাল শেঠ নামে পিণ্ডারিদলে গুপ্তচরের কর্ম্ম করিত, সম্প্রতি আরো ৬০ জন পিণ্ডারি ডাকাতের সঙ্গে সে ধরা পড়িয়াছে। শীঘ্র তাদের বিচার হবে। দুইজন ইংরাজ সৈনিক ও একজন মৌলবী বিচারক নিযুক্ত হ’য়েছেন। সরকার পক্ষ হ’তে আমাকে সাক্ষ্য মান্য করিয়াছে, এই বেনামদার জহরলাল প্রকৃতপক্ষে লোকটা কে, তাহা আমি আদালতে প্রমাণ করিয়া দিব এবং পূর্ব্ব গুণের কথা বলিব।

কৃষ্ণনামের পরিণামটা দেখাবার সাধ আমার মনমধ্যে প্রবল হইল, কাজেই আমি কয়েক দিন এলাহাবাদে রহিলাম, কিন্তু পিতা কি মাতার সঙ্গে আর একদিন ও সাক্ষাৎ করিলাম না।

সাতদিনের পর বিচার শেষ হইয়া গেল। ডাকাতদলের গোয়েন্দা ব’লে কৃষ্ণনামের চৌদ্দ বৎসরের জন্য দীপান্তর বাসের আজ্ঞা হইল। ইতঃমধ্যে লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু পত্রদ্বারায় জ্ঞাত হ’লো যে নিৰ্ম্মলার মৃত্যু হইয়াছে। তিনি আমাকে এই কথা বলিলেন। আমি তারিখ মিলাইয়া দেখিলাম যে দিন আমি মন্ত্র গ্রহণ ক’রেছি সেই দিন নিৰ্ম্মলার মৃত্যু হইয়াছে।

আমি আর সেখানে একদিনও অপেক্ষা করিলাম না, পরদিন প্রভাতে গুরুদেবের পাদ চিন্তা করিয়া লাহোর উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।

সমাপ্তি