- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
মানব চক্ষুর অগোচর সেই পরাৎপর পরমপুরুষের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর ক’রে একেবারে রিক্ত হস্তে বহির্গত হইয়াছিলাম। প্রকৃতপক্ষে একগাছি বংশ দণ্ড, অলাবুর একটী কমণ্ডলু, পরিধেয় বসন ও একখানি কম্বল ভিন্ন আর আমার কাছে কিছুই ছিল না। পাছে কোন দ্রব্য সঞ্চয় করিবার ইচ্ছা হয়, এই আশঙ্কায় ঝুলি পৰ্য্যন্ত সঙ্গে লই নাই। সন্ন্যাসী মহাশয়ের উপদেশ মত একমাত্র তাঁর উপর আমার সমস্ত ভার অর্পণ করিলাম।
প্রথম দিনেই আমার মনের সাহস বাড়িয়া গেল, কেন না সেই মহিমাময়ের মহিমার প্রকৃষ্ট প্রমাণ আমি প্রাপ্ত হ’লাম এবং মনে মনে বুঝিলাম যে, সেই কৃপাময়ের উপর অকপটে নির্ভর করলে তার কখন কোন বিষয়ের অভাব হয় না।
প্রাতঃকালে কাশী হ’তে বহির্গত হইলাম এবং প্রায় সাত আট ক্রোশ পথ পর্য্যটন ক’রে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম এবং রাস্তার ধারে একটা গাছের তলায় বিশ্রাম করিতে বসিলাম।
আমি যেখানে বসিলাম তাহার দুধারেই মাঠ, নিকটে কোন গ্রাম ছিল না। আমি সে সময় যদিও ক্ষুধা তৃষ্ণায় নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িয়াছিলাম, কিন্তু তথাপি তিনি যদি খেতে দেন তো খাব, নইলে উপবাসে থাকবো, এই বিশ্বাসের বশবতী হ’য়ে সেই লোকালয় পরিশূন্য স্থানে কম্বল পাতিয়া শয়ন করিয়া রহিলাম।
বেলা আন্দাজ তিনটার সময় সেই মাঠ পার হ’য়ে এক ভাঁড় হাতে ক’রে একটা লোক আমার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং প্রণাম করিয়া কহিল, “বাবা, আমার গাই বিয়াইয়াছে, আমি মানসিক করিয়াছিলাম যে, কোন সাধুকে দুগ্ধপান করাইয়া তবে আমরা সেই দুগ্ধ ব্যবহার করিব। কপালক্রমে আজ আপনাকে পাইয়াছি, আপনি দুগ্ধটুকু পান করুন।”
সেই লোকটি এই কথা ব’লে দুগ্ধের ভাঁড়টি আমার কাছে রেখে তখনি প্রস্থান করিল।
সেই নির্জ্জন মাঠে আমি যে কোন দ্রব্য পাইব, এরূপ আশা ছিল না, কাজেই এ ব্যাপারে আমি যারপরনাই বিস্মিত হইলাম এবং প্রাণ খুলিয়া সেই পরাৎপর পরমপুরুষকে ধন্যবাদ দিলাম। মনে করিলাম যে, তাঁহার উপর নির্ভর করিলে কখন কাহাকেও উপবাসে থাকিতে হয় না। তাঁর পদানত ভক্তদের জন্য পাষাণের মধ্য দিয়াও যে স্নিগ্ধ বারিধারা বাহির হইয়া থাকে ও নিতান্ত পাষণ্ডের নিরস অন্তরও যে করুণা-রসে আর্দ্র করিয়া দেন তাহা যথার্থ, কেন না, তা না হ’লে এই ত্রিপান্তর মাঠে কখনই এমন খাঁটী দুগ্ধ পাইতাম না।
অধম জীবের উপর বিশ্বকর্ত্তার করুণার স্পষ্ট প্রমাণ পাইয়া বিমল ভক্তিরসে আমার হৃদয় উথলিয়া উঠিল, কাজেই তখন আমার আর ক্ষুধা তৃষ্ণা বলিয়া কিছু রহিল না, কেবল একমনে সেই ভাবময়ের বিষয় ভাবিতে লাগিলাম।
সন্ধ্যার সময় সেই দুগ্ধটুকু পান করিয়া সম্পূর্ণ অনাথ অবস্থায় সেই নির্জ্জন বৃক্ষতলে শয়ন করিয়া রহিলাম। তখন কেমন এক প্রকার সাহসে হৃদয় পূর্ণ হইয়াছিল, কাজেই এরূপ স্থানে একাকী থাকিতে মনে বিন্দুমাত্র ভয়ের সঞ্চার হইল না। পরমসুখে নিরুদ্বেগে সেইখানেই নিদ্রা গেলাম। পূর্ব্বে দাওয়ানজির সুসজ্জিত কক্ষে গদি আঁটা পালংয়ের উপর শয়ন করিয়াও আমার এমন সুনিদ্রা হইত না। কারণ তখন মনের মধ্যে বিষম উৎকণ্ঠা পূর্ণ মাত্রায় বিরাজ করিত, এখনকার ন্যায় হৃদয় শান্ত হয় নাই, কি প্রাণের পিপাসা মেটে নাই।
প্রভাতে গাছতলা হ’তে যাত্রা ক’রে মৃজাপুরে গিয়া উপস্থিত হইলাম এবং পাহাড়ের উপর দেবীকে দর্শনার্থ গমন করিলাম। দেবীকে দর্শন করিয়া ফিরিয়া আসিতেছি, এমন সময় একখানি ক্ষুদ্র দোকানে বাঙ্গালীর ন্যায় বেশভূষায় ভূষিত একটা ভদ্রলোককে দেখিতে পাইলাম। লোকটাকে দেখিয়া আমার প্রাণটা ঝাৎ করিয়া উঠিল, যেন কোথায় দেখিয়াছি ব’লে বোধ হইল, কাজেই একদৃষ্টে তাহার দিকে চাহিয়া রহিলাম, তিনিও নিতান্ত বিস্মিতভাবে একদৃষ্টে আমাকে দেখিতে লাগিলেন।
আমরা উভয়েই সম্পূর্ণরূপে পূর্ব্বরূপ ত্যাগ করিয়াছিলাম, নূতন ভোলে নূতন বেশভূষায় ভূষিত হ’য়ে একপ্রকার নূতন মানুষ হইয়া পড়িয়াছিলাম, তাতেই পরস্পর পরস্পরকে চিনিতে একটু বিলম্ব হইয়াছিল, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে আমার সেই ভ্রম অপনীত হইল, আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, ইনিই সেই হাবুজখানার দারোগা লছমীপ্রসাদ বাবু, যিনি আমার প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিলেন। তবে সে সময় হিন্দুস্থানীর ন্যায় ঢং ও কাপড় চোপড় পরা ছিল, কিন্তু এখন একটা বাঙ্গালী সাজিয়াছেন।
আমি প্রথমে তাঁহার সহিত কথা কহিতেই তিনি নিতান্ত উল্লাসিতভাবে আমার পদতলে প্রণত হইলেন ও আনন্দে অধীর হ’য়ে কহিলেন, “ঠিক কথা, আমি পূৰ্ব্বেই মনে ক’রেছিলাম যে, আপনি এ পৃথিবীর লোক নন্, কেবল কর্ম্মসূত্রের জন্য দিন-কয়েক সংসারক্ষেত্রে বিচরণ ক’রেছিলেন, যাই হোক্, এ অবস্থায় আপনাকে যে দেখিতে পাইব, তাহা কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই। আমার নিতান্ত সৌভাগ্য-প্রযুক্ত আজ আপনার চরণ দর্শন করিয়া কৃতার্থ হইলাম। কাজী সাহেবের অদ্ভূত বিচারে আপনার এক বৎসরের জন্য কারাবাস হইয়াছিল, কিন্তু তারপর কি হইল, এই নবীন বয়সে কেন সন্ন্যাসী সজিলেন তাহা জানি না। অতএব কৃপা ক’রে আমাকে সেই সকল কথা বলুন।”
আমি অকপটে আমার আত্মকাহিনী তাহার নিকট বর্ণনা করিলাম, কাজেই কথা প্রসঙ্গে মুর্শিদাবাদে আমার প্রতিপালক কিষণজিবাবু প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিটা যে কে, কি জন্য ছদ্মবেশ ধার করিয়াছিল, তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িল।
আমার এই সকল কথা শুনিয়া তিনি নিতান্ত পুলকিতভাবে কহিলেন, “কি আশ্চর্য্য! আপনি সেই নরাধমের আশ্রয়ে ছিলেন, আমি পূৰ্ব্ব হ’তে জানিতাম যে পশ্চিমে তার বাপ যে গুরু ক’রেছিলেন, সেই গুরু প্রতিপালন করবার জন্য একটী ছেলে ঐ নরাধমের করে অর্পণ ক’রেছিলেন। কিন্তু আপনি যে সেই ছেলে, তাহা আমি কিছুতেই চিনিতে পারি নাই।
লছমীপ্রসাদ বাবুর এই কথায় আমি নিতান্ত বিস্মিত হইয়া কহিলাম, “আপনি কি কৃষ্ণনামবাবুকে চিনিতেন নাকি?”
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া তিনি উত্তর করিলেন, “চিনা অদূরের কথা, আমি এই নরাধমকে ধরিবার জন্য নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়াছি। শেষে সন্ধান পাইলাম যে, পাপাত্মা মুর্শিদাবাদে আছে। সহজে কাৰ্য্যসিদ্ধি হবে ব’লে আমিও আত্মগোপন করলাম, বাঙ্গালী হ’য়ে হিন্দুস্থানী সাজলাম, মুসলমান রাজসরকারে চাকরী যোগাড় করলাম। পাকা পাকা বদমাইসদের আড্ডায় গোপনে সন্ধান নিলাম, তথাপি কিন্তু পাপাত্মাকে কিছুতেই ধরিতে পারিলাম না। কেন না নরাধম নাম ভাঁড়াইয়া নূতন মানুষ হইয়া পড়িয়াছিল। সেইজন্য এত চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। কিন্তু সেই মঙ্গলময়ের মঙ্গলময় সংসারে কেহ কখন চিরকাল পাপ করিয়া পরিত্রাণ পায় না। কাল পূৰ্ণ হ’লে নিশ্চয় তার সাবধানতার জাল ছিন্ন হ’য়ে যায়। নরাধম কৃষ্ণনামের ভাগ্যে এই অকাট্য নিয়মের অন্যথা হয় নাই। যে পাপাত্মা এতদিন সে সকল করিয়াছিল, এতদিনের পর তাহার প্রায়শ্চিত্তের কাল সমাগত হ’য়েছে। আমি সুদারুণ প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি নিবৃত্তি করবার অভিপ্রায়ে এতদূর আসিয়াছি। লছমীপ্রসাদ আমার কাল্পনিক নাম, আমার প্রকৃত নাম লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। প্রভো, আপনাকে আর অধিক কি বলবো, সেই পাপিনী হরিনামবাবুর সহধর্ম্মিণী আমার সহোদরা ভগ্নী। বিধবা হবার পর কুলে কালি দিয়ে, সমাজে আমাদের উচ্চ মাথা হেঁট করিয়ে, ঐ পাপাত্মা নরাধমের সঙ্গে পালিয়েছিল। প্রায় সতেরো বৎসরের পর আমি সন্ধান পেয়ে ধরিলাম বটে, কিন্তু পাপিনী লজ্জায় তার পাপমুখ আর দেখালে না; আত্মহত্যা ক’রে সকল যন্ত্রণা ও লাঞ্ছনার কবল হতে মুক্তিলাভ করিল। তবে সকল পাপের নায়ক, সয়তানের প্রতিরূপতুল্য নরাধম কৃষ্ণনাম কোন গতিকে সংবাদ পেয়ে পলায়ন ক’রেছিল, সেইজন্য সে যাত্রায় রাজদণ্ড হতে নিষ্কৃতি লাভ ক’রেছিল। কিন্তু এবার আর রক্ষা নাই, নিশ্চয় ফাঁসিকাষ্ঠে পাপাত্মার পাপজীবনের অবসান হবে। মানুষ চেষ্টা ক’রে মানুষকে ফাঁকি দিতে পারে না, কিন্তু রাতদিনের কর্ত্তা সেই ভগবানের চক্ষে ধূলা দেওয়া কাহারও ক্ষমতার অধীন নহে।”
আমি তখন প্রকৃত ব্যাপার বুঝিতে পারিলাম। সম্ভবতঃ নিৰ্ম্মলা ইহার আশ্রয়ে বাস করিতেছে। এক্ষণে কৌশলে সেই কথা জানিবার চেষ্টা করি। আমি মনে মনে এই কথা স্থির ক’রে কহিলাম, “গিন্নির সহস্র দোষ থাক, কিন্তু তিনি আমাকে পুত্ত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেন, আমিও মা বলিয়া জানিতাম, সুতরাং তাহার এরূপ শোচনীয় মৃত্যুতে নিতান্ত দুঃখিত হইলাম। তিনি দেবীর উচ্চাসন হ’তে পরিভ্রষ্ট হ’য়ে একেবারে শূকরীর অধম হ’য়েছিলেন বটে, কিন্তু তথাপি রমণীজনসুলভ অনেক সদ্গুণাবলী প্রচুর পরিমাণে তাহার হৃদয়ভাণ্ডারে সঞ্চিত ছিল। সেইজন্য আমি ও ভৃত্যাদি সকলে তাঁহাকে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা বলিয়া জ্ঞান করিতাম, কারণ স্নেহময়ী জননীর ন্যায় তিনি সকলকে আদর যত্ন করিতেন। সেই গুণবতী উদারস্বভাবা রমণীর কেন যে এমন ভয়ানক ভ্ৰম হইয়াছিল তাহা বলিতে পারি না। পাপাত্মা যে ঘোর ভণ্ড নরপ্রেত সদৃশ কুৎসিতকর্ম্মা ও সয়তানের সহোদর ছিল, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। মুর্শিদাবাদে আসিয়াও জুচ্চুরি ক’রে অর্থ উপার্জ্জন করতেন, সহরের যাবতীয় বিখ্যাত বদমাইসদের সঙ্গে তাহার জানা শুনা ছিল। বাড়ীতে জুয়াখেলা হইত, তাহার অধীনে কতকগুলো পাকা বদমাইস দালাল ছিল, তারা লোভ দেখিয়ে মূর্খ বড়মানুষের ছেলেদের ভুলিয়ে আনতো এবং যে কোন উপায়ে হোক, তাহাদের সঙ্গে যাহা কিছু থাকিত তাহাই হস্তগত করিত।
এইরূপে একদিন মোহিতলাল সরকার নামে এক বখা বড় মানুষের ছেলেকে এক বেটা দালাল নিয়ে আসে, তাকে বিশেষরূপে ঠকাবার জন্য পূৰ্ব্ব হ’তে একটা ষড়যন্ত্র হ’য়েছিল। সেই দালাল বেটা বলে যে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং খেলিতে আসিবেন, কাজেই কিছু বেশী থাকিলে অনেক টাকা জিতিতে পারা যাবে।
মূর্খ মোহিতবাবু একজন কৃপণ নরাধম ধনীর সন্তান, কিন্তু হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ঘোর উচ্ছৃঙ্খল ও ভয়ানক নির্ব্বোধ। সে বেটা এই সকল কথা সত্য ব’লে বিশ্বাস করিল ও কিছু দাও মারিবার অভিপ্রায়ে দুইশত মোহর সঙ্গে লইয়া খেলিতে আসিয়াছিল।
নির্ব্বোধ যুবককে ঠকাবার উদ্দেশে ঠাকুরসাহেব নামে একবেটা বৃদ্ধ বদমাইস জালরাজা সাজিল ও বৈঠকখানার মধ্যে খেলা আরম্ভ হইল।
রহমন খাঁ নামে একবেটা মুসলমান পাকা বদমাইস খোট্টা সেজে, দেবীপ্রসাদ নাম নিয়ে কোতোয়ালির ভয়ে লুকিয়েছিল; সেই বেটাই দালাল হ’য়ে এই শীকার যোগাড় ক’রে ফাঁদে এনে ফেলেছিল। তা ছাড়া জালরাজার সঙ্গে আর একটা গুণ্ডাগোচের নেড়ে রাজপারিষদ হ’য়ে এসেছিল।
খানিক রাত্রে বোধ হয় যুবকের কাছ হতে মোহর কেড়ে নেবার যোগাড় হয়, কাজেই যুবক আত্মরক্ষার জন্য পিন্তল দ্বারায় রহিম মোল্লা নামক সেই রাজপারিষদকে খুন ক’রে পলায়ন করে। শেষকালে আমি কিনা রহিম মোল্লার খুনদায়ে অভিযুক্ত হ’লাম এবং আগাগোড়া মিথ্যা প্রমাণের উপর নির্ভর করে নিরপেক্ষ বিচারকমহাশয় আমাকে এক বৎসরের জন্য জেল দিলেন। যেরূপ অদ্ভুত প্রমাণের বলে আমার সাজা হইল, তাহা শুনিলে আপনি কিছুতেই হাস্য সম্বরণ করিতে পারিবেন না।”
হাসি হাসি মুখে লক্ষ্মীনারায়ণবাবু কহিলেন, “আমি সব শুনিয়াছি, তবে বুঝিবার যাহা অবশিষ্ট ছিল, তাহা অদ্য প্রভুর কৃপায় মিটিয়া গেল।”
আমি ঈষৎ হাস্যে কহিলাম, “আমি আপনার অপেক্ষা বয়সে ছোট, তার উপর কৃতজ্ঞ, সুতরাং আমাকে প্রভূ ব’লে সম্বোধন করলে আমার লজ্জাবোধ করে। সেই বিপন্ন অবস্থায় আপনি আমার যে উপকার ক’রেছিলেন, তাহা আমি এ-জীবনে কখনই বিস্মৃত হইব না; আপনার সেই সকল অনন্যসাধারণ স্বর্গীয় গুণাবলী আমার শেষ মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত মনে অক্ষুণ্ণভাবে জাগরূক থাকিবে। নিতান্ত অনুগত কনিষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় আমাকে স্নেহ সম্বোধন করিলে অধিক বাধিত হইব।”
লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু একটু ব্যস্তভাবে কহিলেন, “বাপরে, তা কি কখন হয়! ছোট সাপ কি সাপ নয়, বরং বড় সাপ অপেক্ষা ছোট সাপের বিষ অধিক, একবার দংশন করলে, আর কোন রোজার বাবাও আরোগ্য করতে পারবে না। আপনি আমার বয়সে ছোট সত্য, কিন্তু তথাপি আমার পক্ষে আপনি সৰ্ব্বাংশে পূজনীয় ব্যক্তি। যাই হোক্, আপনি এক্ষণে কোথায় যেতে সঙ্কল্প ক’রেছেন?”
আমি। আমি একবার এলাহাবাদে যাইব। কারণ সেখানে আমার পিতামাতা বাস করিতেছেন। তাঁহাদের শ্রীচরণ দর্শন করিয়া গুরুদেবের আজ্ঞায় লাহোর উদ্দেশে যাত্রা করিব।
লক্ষ্মীনারাণ বাবু নিতান্ত পুলকিতভাবে কহিলেন, “তাহ’লে বেশ হ’য়েছে, আমিও এলাহাবাদে যাইব। কারণ সেই নরাধম মুরশিদাবাদ হইতে পলায়ন করিয়া পিণ্ডারি নামক বিখ্যাত ডাকাতদলে মিশিয়াছে। সম্প্রতি নর্ম্মদা-তীরে ইংরাজদের সহিত সেই ডাকাতদলের ক্ষুদ্র যুদ্ধ হ’য়ে গেছে, তাতে অনেক ডাকাত ম’রেছে, বাকী ধরা পড়েছে, এলাহাবাদে তাদের বিচার হবে। শুনিয়াছি সেই নরাধমও সেই সঙ্গে ধরা পড়িয়াছে। সম্প্রতি তাহাদের বিচার হবে; আমি সেইজন্য সেইখানে যাইতেছি। কারণ সে বেটা যে কিরূপ দরের লোক, তাহা বিচারকের কাছে প্রকাশ করিয়া দিব। কাজেই তাহ’লে দণ্ডের মাত্রা নিশ্চয় বৃদ্ধি হবে। আমি সেই উদ্দেশের বশবর্ত্তী হ’য়ে এলাহাবাদে যাইতেছি।
আমি। আচ্ছা, আপনি কি একাকী দেশ হ’তে আসিতেছেন?
লক্ষ্মী। না, আমি আর একটা বিষম ঝঞ্ঝাটে পড়িয়াছি। বোধ হয় আপনার স্মরণ আছে যে, নির্ম্মলা নামে ঐ নরাধমের একটী কন্যা ছিল। ঘটনাক্রমে সেই কন্যাটী এখন আমার হাতে পড়িয়াছে, কিন্তু তাহাকে লইয়া আমি মহা বিব্রত হইয়া পড়িয়াছি। বোধ হয় সেই মেয়েটার ঘাড়ে কোন ভূত আশ্রয় লইয়াছে। কেন না, তাহার বয়স হইয়াছে কিন্তু সে বিবাহ করিতে কিছুতেই স্বীকৃতা নহে, অথচ তাহার মনের প্রকৃত ভাব কাহার নিকট প্রকাশ করে না। আজ প্রায় ছয়মাস অতীত হইল সে কঠিন রোগে আক্রান্তা হইয়া পড়িয়াছে, দেশের কবিরাজেরা রোগ নিতান্ত দুঃসাধ্য ব’লে প্রকাশ করিয়াছেন, এবং বায়ু পরিবর্ত্তনের জন্য উপদেশ দিয়াছেন। আমি তাই আমার বৃদ্ধ মাতা ও তাহাকে সঙ্গে লইয়া দেশ হইতে পশ্চিমে আসিয়াছি এবং তাহাদের কাশীতে রাখিয়া পাপাত্মা কৃষ্ণনামের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার জন্য এলাহাবাদে যাইতেছি। আমি নির্ম্মলার যে প্রকার অবস্থা দেখিয়া আসিয়াছি, তাহাতে আর ফিরিয়া গিয়া যে তাহাকে দেখিতে পাইব, এরূপ বিশ্বাস আমার নাই।”
ত্রিকালজ্ঞ সন্ন্যাসীমহাশয় আমাকে সেই অভাগিনীর পরিণাম বলিয়াছিলেন। কাজেই আমি মনে মনে বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, যে দিন আমি দীক্ষিত হইয়াছি, সেই দিনই নিৰ্ম্মলার প্রাণপক্ষী তাহার দেহপিঞ্জর ত্যাগ করিয়াছে। বোধ হয় লক্ষ্মীনারায়ণবাবু তাহার পূর্ব্বে কাশী হইতে বহির্গত হ’য়েছিলেন, সেইজন্য এখনও জানিতে পারেন নাই। তবে সে সম্বন্ধের কোন কথা আমি তাহার নিকট প্রকাশ করিলাম না, বা আমার চিত্তচাঞ্চল্যের কোন লক্ষণ দেখাইলাম না। সাধ্যমতে আত্মসংযম ক’রে শান্তভাবে সব কথা শুনিলাম। কাঁটাগাছে যেমন গোলাপ ফুল ফোটে, সাপের মাথায় যেমন মাণিক থাকে, তেমনি সেই সরলা বালিকা ওপ্রকার নরপ্রেত তুল্য পাষণ্ডের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছিল, কিন্তু সংসারে এসে একদিনের তরেও সুখী হ’তে পারলে না। বিধির কঠোর বিধিতে বিকশিত হবার পূর্ব্বে বিশুষ্ক হইল। ফলতঃ এই অভাগার জন্য যে সেই ধৰ্ম্মপ্রাণা গুণবতী অকালে কাল-কবলে নীত হ’লো তাতে আর অণুমাত্র সন্দেহ নাই। আহা, মন্দভাগিনী মনের কষ্ট প্রাণের জ্বালা অন্তর মধ্যে লুক্কায়িত করিয়া রাখিয়াছিল, কাহার নিকট ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করে নাই। হায়! নিতান্ত দুঃখের বিষয় যে, অন্তিমকালে তাহার সঙ্গে আমার একবার শেষ দেখা হইল না। আহা, অভাগিনী কুসুমমালা জ্ঞানে কালসর্পকে কণ্ঠে ধারণ করিয়াছিল, সেই জন্য অকালে অতৃপ্ত বাসনায় এই ভবলীলা শেষ করিতে বাধ্য হইল।
নির্ম্মলার ন্যায় আমি আমার মনের ভাবকে প্রচ্ছন্ন ক’রে রাখিলাম, কাজেই লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু ভিতরের কোন কথা জানিতে পারিলেন না। আমি সেই দোকানেই সে দিন অতিবাহিত করিলাম ও প্রভাতে লক্ষ্মীনারায়ণ বাবুর সঙ্গে এলাহাবাদ উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।