- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
একত্রিংশ পরিচ্ছেদ
দীক্ষা।
বাস্তবিক সম্পূর্ণরূপে আজ আমার আশা মিটিল। কেন না অনেক দিন হ’তে যে কথা জানিবার সাধ আমার মনমধ্যে প্রবল ছিল, যার জন্য এমন সুখের অবস্থায় পতিত হইয়াও যথার্থ সুখী হইতে পারি নাই, নিয়ত নিতান্ত উৎকন্ঠিত অবস্থায় কালাতিপাত করিতে হইত, আমার জীবনের এই গুপ্তকথা আজ জানিলাম। কিন্তু এখনও একটা কথা বলেন নাই, সেই কথাটা এইবার শুনিতে হইবে।
আমি মনে মনে এই স্থির করিয়া বাষ্পগদগদ স্বরে কহিলাম, “প্রভো, আমার সেই পিতা মাতা কি এখনো জীবিত আছেন?”
সন্ন্যাসীমহাশয় ঈষৎহাস্যে কহিলেন, “হাঁ তাঁহারা উভয়েই জীবিত আছেন। সম্প্রতি তোমার ভ্রাতা নানকদাস মুখোপাধ্যায় উক্ত সর্দ্দারের পুত্ত্রের নিকট চাকরী করিতেছে এবং লাহোরে আছে ও তোমার পিতা মাতা এলাহাবাদের মুটিগঞ্জে একটী বাড়ী কিনিয়া বাস করিতেছেন। এলাহাবাদে গঙ্গা আছে ব’লে আর দেশে না গিয়ে এইখানেই অন্তিমকালের বাসস্থান স্থির করিয়াছেন। তুমি আমার নিকট মন্ত্র লইয়া তাহাদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে সাক্ষাৎ করিবে, কিন্তু আশ্রমে রাত্রিবাস করিতে পারিবে না। কারণ তাহলে তোমার জীবনের ব্রতভঙ্গ হইবে, কাজেই তাদের সঙ্গে চোখের দেখা ছাড়া একত্রে বাস করতে পারবে না। আমি যাহা তোমায় প্রদান করিব তাহাতে তুমি চিরকাল প্রফুল্ল-চিত্ত বিহঙ্গের ন্যায় স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারবে, কখন কাহার মায়ার ফাঁসে, আবদ্ধ হইতে হইবে না। পাপিষ্ঠ কৃষ্ণনাম এসকল কথা জানে, সেইজন্য তার মেয়ের সঙ্গে তোমার বিবাহ দিতে সাহস করিল না। তবে তোমার উপর সেই অভাগিনীর অনুরাগের সঞ্চার হইয়াছিল, জগতের আর কাহাকেও সে হৃদয় দান করিতে কিছুতেই সম্মতা নহে। কিন্তু এদিকে কিছুতেই তাহার আশা পূর্ণ হইবার নহে, কাজেই এ জন্মে তাহাকে অতৃপ্ত বাসনায় ফিরিতে হইবে।
আমি সলজ্জভাবে কহিলাম, “সেই অভাগিনীর পরিণাম কি হবে?”
ঈষৎ হাস্যে সন্ন্যাসীঠাকুর কহিলেন, “পরের কথা জানিয়া তোমার কি লাভ হবে? তবে তাকে একেবারে পর বলতে তোমার মন সরবে না। কিন্তু বৎস, তোমার অবস্থা স্মরণ ক’রে মনকে সংযত কর। যদিও সে এখনো জীবিত আছে, তথাপি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতেও তোমায় অনুমতি দিতে পারি না। কারণ প্রলোভনের বস্তু হতে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিশেষ সে এক প্রকার তোমার জন্যই সংসারে নির্য্যাতন রাশি নিয়ত সহ্য করছে। কেন না এখন সে বয়স্থা হয়েছে, অথচ বিবাহ করিতে কিছুতেই স্বীকৃতা হয় না। তাহার মাতুল কোন সম্বন্ধ ঠিক করিলে আত্মহত্যা করিবার ভয় দেখায়, কাজেই এখনও অবিবাহিত অবস্থায় আছে। তবে এইজন্য তাকে সকলের নিকট হ’তে অশেষ প্রকার লাঞ্ছনা সহ্য করতে হচ্ছে। সুতরাং এ অবস্থায় তোমাদের পরস্পর সাক্ষাৎ হওয়া কিছুতেই যুক্তিযুক্ত নহে। তবে তোমার কৌতুহল তৃপ্তির জন্য তোমাকে এইমাত্র বলছি যে, সেই অসীম সহিষ্ণুতাগুণে ভূষিতা ধৰ্ম্মপ্রাণা বালিকার কুমারীধর্ম্ম অব্যাহত থাকিবে, তাহার পবিত্র অঙ্গ কেহ স্পর্শ করিতে পারিবে না। কুসুম বিকসিত হবার আগে বিশুষ্ক হইবে। অর্থাৎ যে দিন তুমি সন্ন্যাসধৰ্ম্ম গ্রহণ করিবে, সেই দিন সেই বালিকার প্রাণপাখী তাহার দেহপিঞ্জর ফেলিয়া পলাইবে। সুতরাং সেই কুমারীর পবিত্রতা যে অক্ষুণ্ণ থাকিবে তাহা বলাই বাহুল্য।”
আমি কহিলাম, “আমি নিজে তাহার মনের কথা জানিতাম, তবে এক দিনের তরে কখন কাহার নিকট ঘুণাক্ষরেও সে কথা প্রকাশ করি নাই, কিন্তু এই অধমকে নির্ম্মলা যে গোপনে এতদূর ভালবাসিয়াছিল, তাহার প্রণয় যে এরূপ গভীর, তাহা জানিতাম না।” এক্ষণে এই কথা শুনিয়া আমার হরিষে বিষাদ উপস্থিত হইল ও মানসিক কষ্টের নিদর্শন স্বরূপ একটী দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।
সৰ্ব্বজ্ঞ সন্ন্যাসীমহাশয় আমার মনের ভাব বুঝিয়া হাসি হাসি মুখে কহিল, “বাবা কাজটা বড় শক্ত, সেইজন্য তোমারও প্রাণে একটা ধাক্কা লাগলো, তবে অন্যে না পারুক তুমি নিশ্চয় সহ্য করতে সমর্থ হবে। যাঁর চরণে তোমার মস্তক বিক্রিত হ’য়েছে তুমি যাঁর দাস হ’য়ে এই সংসারে এসেছো, তিনিই তোমাকে এমন হৃদয়বল প্রদান করবেন যে, তুমি অনায়াসে পার্থিব প্রলোভন রাশিকে উপেক্ষা করতে সমর্থ হবে। বিশেষ তুমি যখন নিয়ত বিভুর বিমল বিভা উপভোগ করবে, তখন সামান্য খদ্যোতের ক্ষীণ আলোক তোমার পক্ষে যে একান্ত অকিঞ্চিৎকর তাহা বলাই বাহুল্য। তবে তুমি সৰ্ব্ব প্রযত্নে মনকে সংযত কর। কারণ কোন বৃহৎ জলপূর্ণ পাত্রে একটী সামান্য ছিদ্র হ’লে যেমন সেই পথ দিয়ে সমস্ত জল নিঃশেষ হ’য়ে যায়, তেমনি মন সামান্য মাত্র দুর্ব্বল হ’লে একেবারে তার অধঃপতন ঘটে থাকে। সেইজন্য পূৰ্ব্ব হ’তেই তোমাকে সাবধান করছি যে, সেই নিত্যপুরুষের চিন্তা ব্যতীত আর কোন পার্থিব অনিত্য চিন্তাকে তোমার হৃদয়পুরে প্রবেশ করতে দিও না। চঞ্চল মনকে সুদৃঢ় করিতে সাধ্যমত চেষ্টা কর। ইতঃপূর্ব্বে মুঙ্গেরের দুর্গ হ’তে সব ত্যাগ ক’রে একমাত্র কাপড় সম্বলে তোমাকে কেন যে আমার সঙ্গে আসিতে বলিয়াছিলাম তাহা বোধ হয় এক্ষণে বুঝিয়াছ?”
আমি ঘাড় নাড়িয়া তাঁহার কথার উত্তর দিলাম, তবে মুখে কিছু বলিলাম না, কারণ সে সময় আমার অন্তর মধ্যে যে কি বিষম বিপ্লব উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা আমি কিছুতেই বর্ণনা করিতে পারিতেছি না; তবে সন্ন্যাসীমহাশয়ের উপদেশমত মনকে সংযত করতে ও পূর্ব্বকথা সম্পূর্ণরূপে ভুলতে সাধ্যমত চেষ্টা করিলাম। কারণ পিতৃসত্য পালনের জন্য সাধারণ মনুষ্য অপেক্ষা আমাকে ভিন্ন ভাবে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করতে হবে। আপাতঃ মধুর মনুষ্যের ক্ষণিক প্রেম তুচ্ছ করে যার প্রেমের বিচ্ছেদ নাই, সেই প্রেমিকের প্রেম প্রার্থনা করতে হবে। কাজেই এখনকার সকল সাধ আহ্লাদ ও আশা আশঙ্কা, চিরদিনের মতন বিস্মৃতির অতলতলে জন্মের মতন বিসর্জ্জন দেওয়া এক্ষণে আমার পক্ষে প্রধান কৰ্ত্তব্য। তা না হ’লে আমার দুই কুল নষ্ট হবে, সুতরাং পরিণামে অনন্ত নরক যন্ত্রণা আমার এই সকল জ্ঞানকৃত পাপের উপযুক্ত দণ্ড হইবে। কাজেই এখন হ’তে চিত্তকে সম্পূর্ণরূপে বশীভূত করতে চেষ্টা করিব।
আমরা পাঁচদিন সেই শিবনিবাসে রহিলাম, ষষ্ঠ দিন কাশী উদ্দেশে যাত্রা করিলাম। মহারাজ আমাদের জন্য শিবিকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন, কিন্তু সন্ন্যাসীমহাশয় তাহাতে আপত্তি তুলিয়া কহিলেন, “রাজন আপনার আদর অপ্যায়নে নিতান্ত প্রীত হইলাম, কিন্তু সন্ন্যাসীর জন্য শিবিকার কোন প্রয়োজন নাই। কারণ, নিদাঘের প্রচণ্ড আতপ তাপ, বরষার প্রবল বরিষণ, শীতের ভীষণ প্রকোপ, যাদের অনাবৃত দেহে উলঙ্গ মস্তকে সহ্য করিতে হবে, তাদের পক্ষে এ বিড়ম্বনা কেন? এ জগতে সকল বস্তুই অভ্যাসসাপেক্ষ, সুতরাং অভ্যাস না করিলে কেহ কখন’ শ্রমসহিষ্ণু হতে পারে না। সুতরাং আমাদের পদব্রজেই কাশীধামে যাইতে হইবে। আমাদের জন্য শিবিকায় কোন আবশ্যক নাই। আমরা সচ্ছন্দে পদব্রজে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিতে দেখিতে মনের আনন্দে অগ্রসর হইব।
সন্ন্যাসীমহাশয় শিবিকা কি লোকজন সঙ্গে লইতে যদিও নিতান্ত অনিচ্ছুক হইলেন, কিন্তু তথাপি মহারাজ দুজন ভৃত্য ও জিনিষ পত্রাদি বহিবার জন্য একটি টাট্টু ঘোড়া ও উপযুক্ত খাদ্য দ্রব্যাদি নিতান্ত জেদ করিয়া সঙ্গে দিলেন। কাজেই সন্ন্যাসীমহাশয় আর অসম্মত হইতে পারিলেন না! কাজেই আমরা মহারাজ প্রদত্ত এই সকল সরঞ্জাম সহ পশ্চিমে যাত্রা করিলাম।
উনিশ দিন পর্যটনের পর আমরা বারাণসিধামে উপস্থিত হইলাম এবং গণেশমহল্লায় তাঁহার এক শিষ্যের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা কাশীতে উপস্থিত হইলাম ও সেই বাটীতে বাস করিতে লাগিলাম। সন্ন্যাসী মহাশয়ের প্রমুখাৎ জ্ঞাত হইলাম যে, কার্ত্তিক মাসের পূর্ণিমার দিন আমার দীক্ষা হইবে।
তবে প্রায় এই একমাসকাল আমাকে আলস্যে অতিবাহিত করিতে হইল না। এখানে পৌঁছিবার পর দিন হইতে সন্ন্যাসীমহাশয় নিজে আমাকে সংস্কৃত শিখাইতে আরম্ভ করিলেন। কাজেই আমি চিত্তবিনোদনের একটা প্রকৃষ্ট উপায় প্রাপ্ত হইলাম।
আমি অতি মনোযোগের সহিত এই বেদভাষা শিখিতে লাগিলাম। এক স্নানের সময় ব্যতীত আর আমি বাসার বাহির হইতাম না। পুঁথি লইয়া কেবল পাঠাভ্যাস করিতাম। এইরূপে ক্রমে ক্রমে একমাস অনন্তকালসাগরে গিয়া মিশিল।
এই সময়ের মধ্যে আমি অনেকটা আমার অস্থির অন্তরকে সুস্থির ক’রেছি, চঞ্চল মনকে কৰ্ত্তব্য পথে এনেছি, হৃদিভাণ্ডারে সন্তোষরূপ মহারত্ন সঞ্চিত ক’রেছি এবং পার্থিব মায়াপাশ বিচ্ছিন্ন ক’রে কেবলমাত্র আমার গুরুদেব সন্ন্যাসী মহাশয়ের আজ্ঞার অপেক্ষায় আছি। আমি ৺কাশীধামে আসিয়া কাহারও সঙ্গে আলাপ করি নাই, কি কোন প্রকার আমোদ আহ্লাদে যোগদান করি নাই। দেওয়ালির সময় সমগ্র নগরী উৎসবে মত্ত হইয়া থাকে, সকলে নানাপ্রকার রুচীভেদে বিবিধ প্রকার প্রমোদ প্রমত্ত হইয়া পড়ে, কিন্তু আমি কোথাও কোন উৎসব দেখিতে যাই নাই বা কাহার সঙ্গে মিশি নাই। সন্ন্যাসীঠাকুর আমার ঈদৃশ আচরণে ও সকল বিষয়ে নিস্পৃহতা সন্দর্শনে আমার উপর যে প্রীত হইয়াছিলেন তাহা বলাই বাহুল্য।
কার্ত্তিক পূর্ণিমার দিন খুব প্রাতঃকালে সন্ন্যাসীমহাশয় আমাকে সঙ্গে ক’রে মণিকর্ণিকার ঘাটে লইয়া গেলেন। সেখানে প্রায় ৫০/৬০ জন নানকপন্থি সন্ন্যাসী একত্রিত হইয়াছে। তাঁহারা আমাদের দেখিয়াই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিল ও “গুরু নানককি-জয়” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল।
সেইখানে আমি মস্তক মুণ্ডন ক’রে পবিত্র গেরুয়াবাস পরিধান করিলাম, সেই সন্ন্যাসীরা সকলে গোল হইয়া দাঁড়াইলেন, তাহার মধ্যস্থলে দুইখানি কুশাসন পাতা হইল, স্বামীজি আমাকে লইয়া সেইখানে উপবেশন করিলেন।
সকলে নিস্তব্ধ হইলে স্বামীজি আমার কর্ণমূলে সন্ন্যাসের মহামন্ত্র প্রদান করিলেন। সহসা আমার সর্ব্বশরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল এবং তড়িতশক্তির প্রভাবে যেমন জড় বস্তু সঞ্চালিত হয়, তেমনি আমার দুর্ব্বল হৃদয় যেন এক প্রকার অভূতপূর্ব্ব বলে মণ্ডিত হইল, প্রাণ কেমন অনাস্বাদিতপূর্ব্ব আনন্দের প্লাবনে প্লাবিত হইয়া উঠিল।
এইরূপে আমার দীক্ষা শেষ হইল। আজ আমি মহাগুরু নানকের মতে সন্ন্যাসী হইলাম, কাজেই সংসারের সঙ্গে আর আমার কোন সম্পর্ক রহিল না। গুরুদেব পূর্ব্ব হ’তেই উদ্যোগ করিয়া রাখিয়াছিলেন, কাজেই এই সকল সন্ন্যাসীরা আমাদের বাসায় আসিয়া সকলে আহার করিলেন ও সন্ধ্যার সময় সকলে যে যার স্থানে প্রস্থান করিলেন।
রাত্রিতে সন্ন্যাসীমহাশয় আমাকে সস্নেহে কহিলেন, “বৎস হরিদাস! আজ হ’তে তুমি নূতন জীবন লাভ করিলে, সংসারে আর কাহার সহিত তোমার কোন সম্পর্ক রহিল না। এখন হ’তে তোমাকে তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হবে, কারণ তারি সেবক হ’য়ে তুমি জন্মগ্রহণ ক’রেছো। জগতের উপকার সাধন ব্যতীত তোমার জীবনে আর কোন কৰ্ত্তব্যকর্ম্ম নাই। তুমি কল্য এখান হইতে যাত্রা করিবে ও এলাহাবাদে পিতামাতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া লাহোরে আমার সহিত মিলিত হইবে। আমি সেই সময় তোমার তীর্থযাত্রার বন্দোবস্ত করিয়া দিব। বৎস, এই সংসারে সম্পূর্ণরূপে সম্বলশূন্য হ’লে তবে সেই পরাৎপর পরমপুরুষ তাহার সম্বল হ’য়ে থাকেন। তুমি এইবার আমার এই কথার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হাতে হাতে প্রাপ্ত হবে ও সেই মহিমাময়ের অদ্ভুত মহিমা প্রত্যক্ষ করবে। তুমি এক কপর্দ্দক মাত্র সঙ্গে না নিয়ে যাত্রা করবে, দেখবে যখনি তোমার যা অভাব হবে, সেই অভাবমোচনকারী কোন না কোন সূত্রে তাহা মোচন করিয়া দিবেন। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন বস্তু গ্রহণ করিবে না, যদি পাও তখনি দরিদ্রদিগকে বিতরণ করিয়া দিবে। কারণ সম্পূর্ণরূপে নিঃসম্বল না হ’লে সেই কৃপাময়ের কৃপা লাভ করতে পারবে না। কেন না তিনি কেবলমাত্র নিরুপায়ের উপায় ও অসহায়ের সহায় হ’য়ে থাকেন। একান্ত মনে তাঁর উপর যে সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে পারে তার কখন কোন বিষয়ে বিন্দুমাত্র অভাব হয় না। সুতরাং তুমি একাকী পদব্রজে কি ক’রে এই সুদূরপথ অতিক্রম করবে তা একবারও ভেবো না। প্রভুর নাম স্মরণ ক’রে বহির্গত হও, দেখবে সকল বিষয়ে তোমার সুবিধা হবে। ক্ষুধা পেলেই খাদ্য পাবে, কিন্তু কি ভাবে কে যে এনে দিবে তা পূর্ব্ব হ’তে স্থির করবার কাহার ক্ষমতা নাই।
এই কথার পর পরদিন প্রাতঃকালে দণ্ড ও কমণ্ডলু ল’য়ে, সম্পূর্ণ নিঃসম্বলে, ঈশ্বরের নাম স্মরণ ক’রে কাশী হ’তে বহির্গত হ’লাম এবং প্রশস্ত রাজপথ ধরিয়া এলাহাবাদের দিকে অগ্রসর হইলাম।