- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
আশা মিটিল।
এক ভাদ্রমাসের শেষে আমরা মুঙ্গেরে আসিয়াছিলাম। দেখিতে দেখিতে আর এক ভাদ্র অতীত হইয়া আবার শ্রাবণ মাস আসিয়া পড়িল। দুই বৎসর পরে আমার জীবনের যে একটা ভয়ানক পরিবর্ত্তন ঘটিবে, তাহা আমি একদিনের তরেও ভুলি নাই। ব্রহ্মচারীমহাশয়ের সেই কথাগুলি আমার স্মরণপথে রাত্রদিন জাগরুক ছিল। কাজেই এই বৎসর পূর্ণ হয় দেখিয়া আমি মনে নিতান্ত উৎকণ্ঠিত হইলাম।
এদিকে আমার কাজকৰ্ম্ম খুব বাড়িয়া উঠিল, কেন না সে সময় সকল রকমে প্রায় ষোল হাজার লোক দুর্গমধ্যে উপস্থিত হইয়াছিল। আমাকে এই সকলের রসদ বিলি করিতে হইত। বাজার হইতে আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি কিনিবার ভার আমার উপর ছিল। যদিও এ কাজে বেশ দশ টাকা আয়ের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমি এক কপর্দ্দকও গ্রহণ করিতাম না, কিসে নবাববাহাদুরের মঙ্গল হইবে এই চিন্তাই আমার মনমধ্যে প্রবল ছিল। এইজন্য তীক্ষ্ণবুদ্ধি নবাবসাহেবের নিতান্ত বিশ্বাসভাজন হইয়া পড়িয়াছিলাম।
শ্রাবণ মাসের শেষভাগে একদিন আমি আমার সেরেস্তায় বসিয়া দৈনিক হিসাবপত্র দেখিতেছি, এমন সময় একজন ভৃত্য আসিয়া সংবাদ দিল যে, জটা-জুটধারী একজন সন্ন্যাসী আমার সহিত সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন, কথাটা শুনিয়া যে কিরূপ আনন্দ হইল, তাহা বৰ্ণনা করিতে পারিতেছি না। কাজেই তখনি উঠিয়া দ্রুতপদ-সঞ্চারে বাসার দিকে অগ্রসর হইলাম।
বাসায় আসিয়া দেখি যে, পূর্ব্বে মীরঘাটার কালীবাড়ীতে একবারমাত্র যে মহাত্মাকে দেখিলাম এবং যিনি কৃষ্ণনামবাবুর ওরফে কিষণজিবাবুর করে আমার প্রতিপালনের ভার অর্পণ ক’রেছিলেন; সেই মহাপুরুষ মেজের উপর একখানি মৃগছাল পাতিয়া বসিয়া আছেন। আমি বিপুল আনন্দে আত্মহারা হইয়া তখনি তাঁহার পদপ্রান্তে পতিত হইলাম এবং নিতান্ত আবেগভরে কহিলাম, “দয়াল প্রভো! আজ কয়েক বৎসর আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিবার অভিপ্রায়ে নিতান্ত উৎকণ্ঠিত ভাবে অবস্থান করছি। একবার মীরঘাটার কালীবাড়ীতে দেখা দিয়ে বঞ্চিত ক’রেছিলেন; আজ যখন ভাগ্যক্রমে পুনরায় কৃপা করলেন তখন আর শ্রীচরণ ছাড়িতেছি না। আমার সন্দেহ আপনাকে মিটাইতে হইবে।”
সদানন্দ সন্ন্যাসীমহাশয় কহিলেন, “বৎস! উঠ, তোমার সকল সন্দেহ মেটাবার জন্যই আমি আসিয়াছি। বামাচরণ তোমাকে তো ব’লেছিল যে, আর দুই বৎসর পরে তোমার জীবনের মহান্ পরিবর্ত্তন ঘটিবে। এতদিনের পর সেই পরিবর্ত্তনের সময় সমাগত হ’য়েছে।”
আমি নিতান্ত পুলকিতভাবে কহিলাম, “তাহ’লে কৃপা ক’রে বলুন, আমার পিতা মাতা কে, আমাকে কোথায় কি অবস্থায় প্রাপ্ত হইয়াছেন?”
ঈষদাস্যে সেই মহাপুরুষ উত্তর করিলেন, “বৎস! যখন এতদিন অপেক্ষা করিয়া আছ, তখন আর দিনকয়েক তোমার কৌতুহলকে দমন করিয়া রাখ। অল্পদিনের মধ্যে তোমাকে সকল কথা বুঝাইয়া দিব। এক্ষণে আমার আদেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হও।”
আমি করযোড়ে কহিলাম, “আজ্ঞা করুন?”
সন্ন্যাসীমহাশয় কহিলেন, “কাহাকেও কিছু না বলিয়া প্রস্তুত হইয়া থাকিবে; পরশ্ব রাত্রে আমি এমনি সময় আসিব, আমার সঙ্গে তোমাকে কাশীধামে যাইতে হইবে।”
আমি ঈষৎ ক্ষুণ্ণভাবে কহিলাম, “নবাববাহাদুর আমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস ক’রে থাকেন, তাঁকে কি কোন কথা না ব’লে গোপনে দুর্গ ত্যাগ করবো।”
গম্ভীরস্বরে সন্ন্যাসীমহাশয় কহিলেন, “না তাতে বিশেষ কোন আবশ্যক নাই। কারণ এই দু-দিনের মধ্যে নবাব সাহেবের ভয়ানক অবস্থা বিপর্যয় ঘটিবে, সে নিজেই মাথার ঘায়ে কুকুর পাগলের ন্যায় অবস্থায় প’ড়বে এবং সেই সঙ্গে তাহার মনুষ্যত্বটুকুও উবে গিয়ে পিশাচ অপেক্ষা নিষ্ঠুর ও কাণ্ডজ্ঞান শূন্য হবে, সুতরাং তার সঙ্গে আর সাক্ষাতের কোন আবশ্যক থাকিবে না। অচিরকাল মধ্যে তাহার রাজমুকুট স্থলিত হয়ে পড়িবে এবং নিজেই ভিখারীর অধম হবে।”
আমি এই সকল কথার প্রকৃত মৰ্ম্ম বুঝিতে না পারিয়া, নিতান্ত উদাসভাবে সেই মহাপুরুষের মুখেরদিকে চাহিয়া রহিলাম। তিনি আমার মনের ভাব বুঝিয়া পুনরায় কহিলেন, “তোমার মনের সন্দেহ অপনয়ন করবার অভিপ্রায়ে মিরকাসিমের পরিণামটা তোমার নিকট বলিতেছি, তাহ’লে তুমি স্পষ্ট বুঝতে পারবে যে, আর সেই হতভাগ্য বঙ্গের শেষ নবাবের সহিত সাক্ষাতের কোন ফল নাই।”
চতুর ইংরাজ কোম্পানীরা নবাবের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়াছেন, সেইজন্য তাহারা নয় শত গোরা, আড়াই হাজার এদেশীয় সিপাহী ও পাঁচটা কামান লইয়া বক্সারে শিবির সন্নিবেশ করিয়াছেন; অদ্য রাত্রি প্রভাত হ’লেই নবাববাহাদুর এই সংবাদ জ্ঞাত হইবেন, কাজেই যুদ্ধযাত্রার ধুম পড়িয়া যাইবে। নবাব নিজে এই ব্যাপারে নিতান্ত বিব্রত হইয়া পড়িবেন, সুতরাং আর কোন কথা তাহার মনে থাকিবে না। তারপর এই যুদ্ধে পরাস্ত হ’য়ে হিংস্র পশু তুল্য নিষ্ঠুর হইয়া উঠিবে এবং দুর্গে আসিয়া বাঙ্গালী ও সাহেব কয়েদীদের স্বহস্তে নিহত ক’রে নেপাল রাজ্যে পলায়ন করবে এবং রাজ্যের ভাবনা ভেবে ভেবে শেষে উন্মাদ হ’য়ে প’ড়বে।”
গুণগ্রাহী নবাববাহাদুরের ঈদৃশ শোচনীয় পরিণাম শুনিয়া মনে মনে নিতান্ত দুঃখিত হ’লাম; অধিকন্তু মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের জন্য বিশেষ চিন্তিত হ’লাম, কারণ সন্ন্যাসীমহাশয়ের প্রমুখাৎ জ্ঞাত হ’লাম যে, মিরকাসিম যুদ্ধে পরাস্ত হ’য়ে রাগের বশে সমস্ত বন্দিদের নিহত ক’রে পলায়ন করবে।
আমাকে বিমনা দেখিয়া সেই মহাপুরুষ কহিলেন, “তুমি মনে মনে কি ভাবিতেছ?”
আমি মনের ভাব গোপন না ক’রে কহিলাম, “এই দুর্গে নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্ত্র বার লক্ষ টাকার জন্য আবদ্ধ আছেন, আমি এ জন্মে তাঁহার তুল্য মহানুভব ব্যক্তি দেখি নাই, আমি মনে মনে সেই মহাত্মার বিষয় ভাবিতেছি।”
অল্পক্ষণ মুদ্রিত নেত্রে ভাবিয়া মহাপুরুষ উত্তর করিলেন, “স্বকীয় পুণ্য ফলে পুণ্যশ্লোক মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এ যাত্রা রক্ষা পাইবেন। তবে তুমি তাহাকে কহিবে, পরশ্ব দিন পলায়নের উপযুক্ত সুসময়। তিনি যেন এই শুভ অবসর পরিত্যাগ না করেন। ঐ দিন নবাবসাহেবের অনুমতিক্রমে সৈন্যরা যুদ্ধযাত্রা করিবে, কাজেই সেই সময় দুর্গ মধ্যে ভয়ানক গোলমাল ও বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবে, সকলেই স্ব স্ব কাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িবে, কাজেই সেই সময় কেহ তাহাকে লক্ষ করিবে না। তিনি সেই গোলযোগের সময় অবলীলাক্রমে দুর্গ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতে সক্ষম হইবেন। আর তুমিও তোমার হাতের সমস্ত কাজ শেষ করিয়া রাখিবে ও প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হইয়া থাকিবে, কারণ আমি আসিয়া আর অধিকক্ষণ বিলম্ব করিব না। নিকটে নৌকা প্রস্তুত থাকিবে, আমরা তখনি কাশীধামে যাত্রা করিব। আর নবাবসাহেব সসৈন্যে বক্সারে যাইবে, সম্ভবতঃ এই বিষম গোলযোগের সময় তোমার কথা তাহার স্মরণ থাকিবে না। তারপর নিজের সেনানীদের বিশ্বাসঘাতকতায় এক দিনের যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হবেও নিজেই প্রাণভয়ে পলায়ন করবে, কাজেই জগতে আর কাহার সহিত তাহার কোন সম্বন্ধ থাকিবে না; সুতরাং তার ভাবনা আর না ভেবে, আমার আদেশমত প্রস্তুত হ’য়ে থাকবে।”
সন্ন্যাসীঠাকুর এই কথা ব’লে আর কোনরূপ উত্তরের জন্য অপেক্ষা না ক’রে সে স্থান হ’তে প্রস্থান করিলেন, আমিও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গের সদর ফটক অবধি আসিলাম এবং পদধূলি লইয়া তখনকার মতন গমন করিলাম।
সেই রাত্রেই নবাব সাহেবের গুপ্তচরেরা আসিয়া সংবাদ দিল যে, ইংরাজেরা সসৈন্যে বক্সারে আসিয়া ছাউনি করিয়াছেন। কাজেই রজনী প্রভাত হইলেই দুর্গ মধ্যে মহা হুলুস্থুল উপস্থিত হইল।
নবাববাহাদুর সেনানীদের সহিত পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন যে, হঠাৎ অতর্কিতভাবে গিয়ে আক্রমণ করতে হবে, তাহ’লে সহজে ইংরাজেরা ছত্রভঙ্গ হ’য়ে প’ড়বে। আর যদি আমরা সসৈন্যে দুর্গের মধ্যে থাকি, আর শত্রুরা আসিয়া যদি দুর্গ অবরোধ ক’রে ফেলে, তাহ’লে একমাত্র রসদ অভাবে বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা। কাজেই আর কালবিলম্ব না ক’রে দুর্গ হ’তে বহির্গত হওয়া আবশ্যক।
অমনি দুর্গ মধ্যে সাজ সাজ রব পড়িয়া গেল, সৈন্যেরা রণক্ষেত্রে যাবার জন্য প্রস্তুত হ’তে লাগলো, খোদ নবাব সাহেব চারিদিক পরিদর্শন করতে লাগলেন, কাজেই বাত্যাবিক্ষোভিত রত্নাকরের ন্যায় দুর্গটি নিতান্ত অস্থির হইয়া উঠিল।
আমারও খুব কাজ পড়িল, আমি বড় বড় বয়েলগাড়ি ও উটে সৈন্যদের তাঁবু আবশ্যকীয় তৈজসাদি ও ঘি আটা ঘোড়ার দানা প্রভৃতি রসদ বোঝাই দিতে লাগিলাম। এইরূপে নিতান্ত ব্যস্তভাবে সমস্ত দিনটা অতিবাহিত হইল।
রাত্রিতে মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ ক’রে সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া বলিলাম, মহারাজ নিতান্ত প্রীতভাবে কহিলেন, “জগদম্বা যে এমন সুদিন দিবেন, তাহাতো বোধ হয় না। যাই হোক্, এই শত্রুপুরী মধ্যে তোমার ন্যায় সদাশয় ব্যক্তিকে যে বন্ধুরূপে পাইব তাহা কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই। আমার প্রতি তোমার ঈদৃশ অনুগ্রহে নিতান্ত বাধিত হ’লাম।”
আমি নিতান্ত মিনতির সহিত উত্তর করিলাম, “মহারাজার ন্যায় মহানুভব ব্যক্তির কোন সামান্য উপকার করিতে পারিলে নিজের জীবনকে সার্থক জ্ঞান করিব। আমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তির নিকট কোনরূপ বিনয় প্রকাশ ক’রে আমাকে লজ্জা দিবার আবশ্যক নাই। কাল সসৈন্যে নবাববাহাদুর ইংরাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিবেন, সুতরাং কল্য দুর্গ মধ্যে আদৌ শৃঙ্খলা থাকিবে না, সকলেই স্ব স্ব কার্য্যে ব্যস্ত থাকিবে, আপনার উপর আর কাহারো লক্ষ থাকিবে না। আপনি কল্যকার শুভ অবসর কিছুতেই পরিত্যাগ করিবেন না। আমি আপনাকে দুটো আর্দালির পাগড়ি ও চাপকান দিয়া যাইব, আপনারা পিতা পুত্ত্রে তাই পরিধান ক’রে নিরাপদে দুর্গ হ’তে বাহির হইতে পারিবেন, কাহার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হইবে না।”
মহারাজ আমার এই কথা যুক্তিসঙ্গত ব’লে বোধ করলেন এবং আমাকে শত শত ধন্যবাদ দিলেন। আমি তাঁহাকে প্রণাম ক’রে সেই রাত্রের মতন বিদায় গ্রহণ করিলাম।
সেই দেবপ্রতিম ত্রিকালজ্ঞ সন্ন্যাসীমহাশয়ের একটী কথাও আমার অবিশ্বাস হয় নাই, সুতরাং অচিরকাল মধ্যে যে, মিরকাসিমখাঁর পতন হইবে, তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। কিন্তু তখন অপরের বিষয় ভাবিবার আমার তেমন অবসর ছিল না, কেন না আমি নিজের চিন্তায় একান্ত বিব্রত হইয়া পড়িয়াছিলাম।
ব্রহ্মচারীমহাশয় আমাকে যে সময় অবধি অপেক্ষা করতে ব’লেছিলেন এতদিনের পর সেই সুসময় সমাগত হইল। সম্ভবতঃ এইবার আমার মনের সন্দেহ মিটিবে এবং আমি কে, কাহার পুত্ত্র, কেন সন্ন্যাসীমহাশয় পাপিষ্ঠ কৃষ্ণনামবাবুর করে আমার প্রতিপালনের ভার অর্পণ ক’রেছিলেন, তাহা জানিতে পারিব, এই ভাবিতে ভাবিতে’বিছানায় শুইয়া পড়িলাম।
সেই রাত্রে কত অভিনব আশা কত উৎকট বাসনা আমার হৃদয়-সমুদ্রে খেলিতে লাগিল, কাজেই সৰ্ব্বসন্তাপহারিণী নিদ্রাদেবী আমার নিকটস্থা হইলেন না। আমি সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় সেই নিশা অতিবাহিত করিলাম, তবে আমার হৃদয়ক্ষেত্র একপ্রকার অনাস্বাদিতপূর্ব্ব আনন্দের প্লাবনে প্লাবিত হইয়া উঠিল।
পরদিন প্রাতঃকাল হ’তেই দলে দলে সৈন্য রণক্ষেত্রাভিমুখে ছুটিল। আমিও রসদাদিপূর্ণ গাড়ি তাহাদের সঙ্গে প্রেরণ করিলাম, কাজেই কেল্লামধ্যে বিষম গোলমাল উপস্থিত হইল।
যদিও আমি কাজ কৰ্ম্মে নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম, কিন্তু তথাপি অন্যের অলক্ষে খুব গোপনে মহারাজকে দুটো আরদালির পোষাক দিয়া আসিলাম। আমার নিকটে সৈনিক বরকন্দাজ ও আরদালিদের নূতন পোষাক প্রচুর পরিমাণে ছিল, সেইজন্য সহজে সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইয়াছিলাম, অথচ কেই ঘুণাক্ষরেও আমার অভিপ্রায় জানিতে পারিল না।
নবাববাহাদুর তখন নিজের জ্বালায় বিব্রত হইয়া পড়িয়াছেন এবং সৈন্য প্রেরণের বন্দোবস্তে নিতান্ত ব্যস্ত হইয়াছেন, কাজেই আমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল না। আমিও জানিতে পারিয়াছিলাম যে, এই উদ্যম তাহার শেষ উদ্যম, কারণ রাজলক্ষ্মী তাঁহাকে জন্মের মতন ত্যাগ করিয়া ইংরাজদের অঙ্কশায়িনী হইবেন; কাজেই তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যুক্তিযুক্ত ব’লে বোধ করিলাম না। মনে ঠিক বুঝিলাম যে, এ জীবনে আর কখন নবাববাহাদুরের সঙ্গে আমার দেখা হইবে না।
আমি সমস্ত দিন কাজকর্ম্মে ব্যস্ত রহিলাম বটে, কিন্তু তলে তলে প্রস্থানের যোগাড় করিয়া রাখিলাম। সরকারি হিসাবে বাজারে যাহার যা পাওনা ছিল, তাহা মিটাইয়া দিলাম এবং খাতার জমা খরচ ঠিক করিয়া দেখাইয়া দিলাম।
সন্ধ্যার পর এক রকম প্রস্তুত হইয়া নিজের সেই কক্ষে বসিয়া আছি ও কতক্ষণে সন্ন্যাসীমহাশয় আসিবেন মনে মনে ভাবছি, এমন সময় সহসা একজন সিপাহী আসিয়া কহিল, “দুর্গের বাহিরে নিমগাছের তলায় একজন লোক আপনার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন।”
কে যে আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছে, তাহা যদিও আমি বুঝিতে পারিলাম, তথাপি ব্যাপারখানা দেখিবার জন্য, আমি যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থায় বহির্গত হইলাম, এক উত্তরীয় ভিন্ন আর কিছুই সঙ্গে লইলাম না।
আমি দ্রুতপদসঞ্চারে সেই গাছতলায় গিয়াই সেই দীর্ঘকার সৌম্যমূর্ত্তি সন্ন্যাসী মহাশয়কে দেখিতে পাইলাম। আমি তাঁহার পদতলে প্ৰণত হইলে, “আমার সঙ্গে এসো” কেবলমাত্র তিনি এই কথা বলিলেন। আমি সবিস্ময়ে আস্তে আস্তে কহিলাম, “এই কি শেষ যাওয়া?”
সন্ন্যাসী। হাঁ, কেন, তোমার কি কোন প্রতিবন্ধক আছে না কি?
আমি। কিছুমাত্র না, তবে পরিধেয় বস্ত্র ও সামান্য তৈজসাদি আমার যা আছে, তাকি সঙ্গে লইব না?
সন্ন্যাসীমহাশয় ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “না বৎস, আর কিছুই তোমাকে নিতে হবে না, কেন না লজ্জা নিবারণের জন্য পরিধেয় বসনখানি ভিন্ন পার্থিব আর কোন বস্তুতে তোমার বিন্দুমাত্র অধিকার নাই।
সন্ন্যাসীমহাশয়ের শ্রীমুখের এই কথা শুনে, সহসা আমার সর্ব্বশরীর যেন কণ্টকিত হইয়া উঠিল, প্রাণের মধ্যে কেমন এক প্রকার অনাস্বাদিতপূর্ব্ব বিমল আনন্দের লহরী ক্রীড়া করিতে লাগিল। আর আমার কোন কথা বলিতে সাহস হইল না। কাজেই কলের পুতুলের ন্যায় নীরবে তাঁহার পশ্চাদগামী হইলাম।
আমরা সেই গঙ্গাতীর ধরিয়া প্রায় ক্রোশটাক পথ অতিক্রম করিলাম এবং ঠিক বাঁকের মুখে একখানি ক্ষুদ্র নৌকা বাধা রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম।
সন্ন্যাসীমহাশয়ের ইঙ্গিতক্রমে, আমি সেই নৌকায় উঠিলাম এবং অপার আনন্দনীরে নিমগ্ন হইলাম, কারণ সেই ক্ষুদ্র নৌকাখানির মধ্যে মহারাজ ও তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্ত্র শিবচন্দ্র বসিয়া আছেন।
মহারাজা স্বপুত্ত্র সন্ন্যাসীমহাশয়ের পদপ্রান্তে পতিত হইলেন এবং সেই সঙ্গে আমার পদধূলি লইলেন। আমি ইহাতে নিতান্ত কুণ্ঠিত হইয়া মহারাজার পদধূলি লইবার জন্য হস্ত প্রসারণ করিলাম, কিন্তু মহারাজা তাতে বাধা দিয়া কহিলেন, “বাপরে, তাকি কখন হয়, ওতে যে আমার অপরাধ হবে। তুমি তো বাবা বড় সাধারণ ব্যক্তি নও, তোমার ঐ পদপ্রান্তে মুকুটধারী মহারাজার মুকুট পর্যন্ত নমিত হ’য়ে পড়বে ও লক্ষ লক্ষ মানব ভক্তিভাবে পূজা করবে। যাই হোক্, আপনাদের কৃপায় এ যাত্রা আশু মৃত্যুমুখ হতে রক্ষা পাইলাম, নিঃস্বার্থভাবে পরোপকার সাধনের জন্য মহাপুরুষেরা যে কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন, তাহা বেশ এক্ষণে বুঝিতে পারিলাম।”
কেন যে পরমজ্ঞানী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আমার ন্যায় বালকের পদধুলি লইলেন ও আমাকে ওরূপ কথা বলিলেন তাহা কিছুতেই বুঝিতে পারিলাম না; কাজেই কেবল উদাসভাবে চাহিয়া রহিলাম। সন্ন্যাসীমহাশয় আমার গতিক দেখিয়া হাসি হাসি মুখে মন্তক অবনত করিলেন, কিন্তু মুখে আমাকে কোন কথা বলিলেন না।
আমাদের নৌকা ছাড়িয়া দিল, অনুকুল বাতাস পাইয়া পাল তুলিয়া দিল, কাজেই ভাগীরথীর তরঙ্গরাশি ভেদ করিয়া সেই ক্ষুদ্র ছিপের ন্যায় নৌকাখানি তীরবেগে ছুটিতে লাগিল।
সন্ন্যাসীমহাশয়ের পূর্ব্বকথা মত আমার বিশ্বাস হইল যে, আমরা সকলে “কাশীধামে” যাইতেছি। সেইজন্য কথা প্রসঙ্গে সন্ন্যাসীমহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা প্রভো, কয়দিনে আমরা কাশীধানে পৌঁছিব?”
সন্ন্যাসীমহাশয় উত্তর করিলেন, “কাশীতে যাইবার সঙ্কল্প ছিল, কিন্তু মহারাজার অনুরোধে একবার ওঁর রাজত্বটা বেড়িয়ে স্থলপথে কাশী যাইব। সেইজন্য পুনরায় বাঙ্গালা দেশের দিকে যাইতেছি।”
মহারাজ নিজে যুক্তকরে অতীব মিনতির সহিত কহিলেন, “এ দীনের প্রতি প্রভুদের কৃপার ইয়ত্তা নাই। কেবল ঐ পদরজে দীনের পুরী পবিত্র হবে ব’লে নিয়ে যাচ্ছি। তারপর স্থলপথে কাশী যাইবার সুন্দর বন্দোবস্ত করিয়া দিব, প্রভুদের বিন্দুমাত্র কষ্ট হইবে না। দশ বার দিনের মধ্যে সচ্ছন্দে কাশীতে পৌঁছিতে সক্ষম হবেন।”
আমি মনে মনে বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, ইতঃপূর্ব্বে সন্ন্যাসীমহাশয়ের সহিত মহারাজার এ সম্বন্ধে কথাবার্ত্তা হ’য়েছিল, সম্ভবতঃ উভয়ের পরিচয়ও পূর্ব্ব হ’তে ছিল, কারণ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সর্ব্বাংশে একজন মহৎ ব্যক্তি, তাহার সহিত এই সন্ন্যাসীমহাশয়ের ন্যায় মহাপুরুষের পরিচয় থাকা কিছুতেই বিচিত্র নহে। যাই হোক্ এতদিনের পর যখন খোদ অভয়ানন্দ স্বামীকে পাইয়াছি, আর তিনি যখন আমাকে অভয় দিয়াছেন, তখন নিশ্চয় এইবার আমার মনের উৎকণ্ঠা, প্রাণের আশা মিটিবে। তিনি যেখানেই যান না, তাতে আমার বিশেষ কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। কারণ আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, উত্তরকালে এই মহাপুরুষই আমার জীবনের প্রভু হইবেন। আমার যখন বাইশ বৎসর বয়স প্রায় পূর্ণ হইয়াছে, তখন বোধ হয় আর আমাকে পরের আশ্রয়ে থাকিতে হইবে না; এইবার হ’তে হয়তো এই মহাত্মার সঙ্গে, আর নয়তো ইহার নিয়োগক্রমে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে হবে। তাহ’লে আমার তৈজসপত্র ও সৎ উপায়ে সঞ্চিত অর্থাদি সঙ্গে আনিতে কেন নিষেধ করিলেন? আমি যেমন শূন্য হাতে উত্তরীয় মাত্র কাঁধে দুর্গ হইতে বাহির হইলাম, অমনি আমাকে অনুসরণ করতে আজ্ঞা করিলেন। আমি স্মরণ করিয়া দিলেও গ্রাহ্য করিলেন না। কেবল আমাকে বল্লেন “লজ্জা নিবারণের জন্য পরিধেয় একখানি বস্ত্র ব্যতীত পার্থিব আর কোন বস্তুতে বিন্দুমাত্র আবশ্যক নাই। জীবন ধারণ করতে হ’লেই তো সে সব দ্রব্যের প্রয়োজন, কাজেই অর্থেরও আবশ্যক, কিন্তু সন্ন্যাসীমহাশয় আমাকে একেবারে শূন্য হাতে আসিতে কহিলেন কেন? সত্য সত্য কি এই পরিধেয় বসনখানি ভিন্ন আর কোন দ্রব্যে আমার আবশ্যক নাই? নিশ্চয় তাহার এই সব কথার কোন নিগূঢ় রহস্য আছে। যাই হোক্ আর অধিকদিন আমাকে এরূপ উৎকণ্ঠিত অবস্থায় অবস্থান করিতে হইবে না। যে কথা জানবার জন্য এতদিন ব্যগ্র হ’য়ে আছি; রাত্রিতে সুনিদ্রা হয় না, ঘোর অশান্তির ক্রোড়ে শয়ন করিয়া থাকি, সেই প্রাণের কৌতুহল এতদিনে মিটিবে। এখন দেখা যাক্, সন্ন্যাসীমহাশয় আমাকে নিয়ে কি করেন।
রাত্রি প্রভাত হ’লে দেখিলাম যে, আমাদের নৌকার দাড়ি মাঝি ইতর জাতীয় নহেন। যদিও তাঁহারা হীনজনের হ্যায় জীনবেশ ধারণ করিয়াছেন; কিন্তু তথাপি তাহাদের আকার প্রকার দেখিলে ও কথাবার্ত্তা শুনিলে, তাঁহারা যে ভদ্রসন্তান প্রকৃত দাঁড়ি মাঝি নহেন, তাহা সকলে বুঝিতে পারিয়া থাকেন। কাজেই এই কৃতজ্ঞ ভদ্রসন্তানেরা যে মহারাজার কোন বিশ্বস্ত অনুচর, প্রভুর উদ্ধারের জন্য এতদুর কষ্ট স্বীকার করিতেছে, তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম।
বাস্তবিক মহারাজার দাওয়ান কালিকাদাস রায় হাল ধরিয়াছেন, আর পেস্কার মদনগোপাল মুখোপাধ্যায় ও কাননগুই রতিকান্ত রায় দাড়ি হইয়াছেন। দাওয়ানজি মহাশয় ছয় লক্ষ টাকা সংগ্রহ করিয়া, মহারাজার উদ্ধারের জন্য আসিয়াছিলেন। তারপর ঘটনাস্রোত ভিন্ন দিক দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তাহারা সে অভিপ্রায় ত্যাগ করিলেন এবং লোকজনকে স্থলপথ দিয়ে যেতে অনুমতি দিয়া, তারা মহারাজকে নিয়ে জলপথে প্রস্থান করলেন, কেবল খোসালখাঁ নামে একজন জমাদার তাহাদের সঙ্গে রহিল।
কোন সহরের নিকট আমাদের নৌকা থামিত না, গঙ্গার কোন নির্জ্জন চরে নৌকা লাগাইয়া আমাদের রন্ধনাদি হইত এবং অধিকাংশ সময় রাত্রিতে নৌকা চলিত। এইরূপে নয় দিনে আমরা মহারাজার রাজ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
মহারাজার অতুলকীৰ্ত্তি দেবালয় পরিবেষ্টিত ভূস্বর্গবিশেষ শিবনিবাস নামক স্থানে আমরা আসিলাম। মহারাজের আগমন বৃত্তান্ত প্রকাশ হওয়ায় রাজধানী হইতে দলে দলে আম্লাবর্গ ও প্রধান ব্যক্তিগণ আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। কাজেই মহারাজার শুভাগমনে অনেক দিনের পর শিবনিবাস লোকারণ্য হইয়া উঠিল।
মহারাজার দ্বিতীয় রাণীর গর্ভজাত পুত্ত্র শম্ভুচন্দ্র পিতার ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার দীর্ঘ-কারাবাসে মনে মনে স্থির করিয়াছিল যে, তাঁহারা সেই যবন কারাগারেই প্রাণত্যাগ করিবেন, এ জন্মে আর ফিরিয়া আসিবেন না, কাজেই তিনি শূন্যসিংহাসনে বসিবার জন্য নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। ইহাতে দাওয়ানজি প্রভৃতি প্রধান প্রধান রাজপুরুষেরা নিতান্ত বিরক্ত হ’য়ে, ছয় লক্ষ টাকা সংগ্রহ ক’রে মুঙ্গেরে যাত্রা করিয়াছিলেন; কিন্তু দৈবানুগ্রহে টাকাও দিতে হইল না, অথচ মহারাজা মুক্ত হইয়া দেশে আসিলেন। এক্ষণে শম্ভুচন্দ্র লজ্জিতভাবে আসিয়া পিতৃপদে ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন, কাজেই বিশেষ কোন গোলযোগ হইল না, অল্পেই মিটিয়া গেল।
আমরা তিন, চারিদিন সেইখানে বিশ্রাম করিলাম। মহারাজা আমাদের রাজধানীতে লইয়া যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। কিন্তু সন্ন্যাসী মহাশয় তাঁহার কথায় প্রতিবাদ করিয়া কহিলেন, “মহারাজ ক্ষমা করিবেন, সময়ে কুলাইলে আমি নিশ্চয় মহাশয়ের অনুরোধ রক্ষা করিতাম। কি করবো, এই বালকের জন্য আমাকে খুব শীঘ্র কাশী যেতে হবে। কারণ ইহার সময় উপস্থিত হবার আর অধিক বিলম্ব নাই, ধার্য্য দিনে আমাকে সে কাৰ্য্য শেষ করতে হবে।”
মহারাজ হাসিয়া উত্তর করিলেন, “তাহ’লে আর একে অন্ধকারে রাখেন কেন? স্পষ্ট করিয়া সব কথা খুলিয়া বলিবার আর হানি কি?”
সন্ন্যাসীমহাশয় গম্ভীরভাবে কহিলেন, “হাঁ আজ আপনার সমক্ষে ইহাকে প্ৰকৃত কথা খুলিয়া বলিব এবং তাহার জীবনের কর্ত্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিব। কারণ নিজের অবস্থা বুঝিতে পারিলে, পূর্ব্ব হ’তেই সাবধান হ’তে পারবে, প্রমত্ত মনকে বোঝাবার অবসর পাবে, কাজেই আর বিলম্ব করবো না। বিশেষ পূর্ব্ব হ’তে জমি প্রস্তুত থাকলে বীজ পড়িবামাত্র অঙ্কুরিত হবার সম্ভাবনা।”
তারপর সন্ন্যাসী মহাশয় আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বংস হরিদাস! ইতঃপূর্ব্বে বামাচরণ ব্রহ্মচারীর নিকট কপট কিষণজিবাবুর প্রকৃত বিবরণ শুনিয়াছ, এক্ষণে তোমার নিজের আত্মকাহিনী শ্রবণ কর। তুমি যে সময়ের জন্য অপেক্ষা করিতেছে, সেই সময় সমাগত হবার আর অধিক বিলম্ব নাই। এক্ষণে তুমি কে, কি কর্ত্তব্যের গুরুভার মন্তকে লইয়া এই ধরাক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াছ তাহা শ্রবণ কর। —
রাজা তোডরমল্ল আকবর সাহের আমলে যখন রাজস্ব বন্দোবস্তের জন্য বাঙ্গালাদেশে আসিয়াছিলেন, সেই সময় ফুলিয়া গ্রাম নিবাসী বিষ্ণুচরণ মুখোপাধ্যায় নামক একজন কুলীন ব্রাহ্মণ কোন সূত্রে তাহার সঙ্গে অতি সুলগ্নে সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। মুখোপাধ্যায় মহাশয় প্রথমে টোলে ব্যাকরণাদি কিঞ্চিৎ পড়িয়াছিলেন, তারপর রাজমহলে থাকিয়া উত্তমরূপে পারশী পড়িয়াছিলেন। তোডর মল্ল তাহার গুণের পরিচর পাইয়া মোগল সরকারের রাজস্ব বিভাগে একটা চাকুরী প্রদান করিয়াছিলেন।
অল্পদিনের মধ্যে মুখোপাধ্যায় মহাশয় রাজা তোডর মল্লের এরূপ প্রিয়পাত্র হইয়া পড়িল যে, দিল্লী প্রত্যাবৰ্ত্তন সময় তাহাকেও সঙ্গে যাইতে অনুরোধ করিলেন এবং তাহার পরিবার ও জিনিষ পত্রের জন্য দুখানি বয়েল গাড়ী বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন।
সুচতুর মুখোপাধ্যায় মহাশয় এমন সুবিধা ত্যাগ করিলেন না, কাজেই জন্মভূমির মায়া কাটাইয়া নিজের স্ত্রী,পুত্ত্র, পুত্ত্রবধূ ও আর তিনজন আত্মীয়ের সঙ্গে দিল্লী যাত্রা করিলেন।
দিল্লী আসিয়া তোডর মল্লের কৃপায় মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের ভাগ্য-লক্ষ্মী প্রসন্না হইলেন, কাজেই দিল্লীর মধ্যে একখানি বাড়ী কিনিয়া দাসদাসী সহ সুখে বাস করিতে লাগিলেন। মুখোপাধ্যায় মহাশয় এখানে আসিয়া রাজস্ব বিভাগের সহকারী কাননগুইয়ের পদ পাইয়াছিলেন। সুতরাং অল্পদিনের মধ্যে তিনি বড়লোক বলিয়া পরিগণিত হইলেন। বাজারে নামডাক জাহির হইয়া পড়িল, এমন কি খোদ সম্রাটের সঙ্গে পর্যন্ত জানাশোনা হইল।
ত্রিশ বৎসর সুখ্যাতির সহিত কার্য্য করিয়া বিষ্ণুচরণ মুখোপাধ্যায় সাতাশি বৎসর বয়সে ইহধাম পরিত্যাগ করিলেন, তিনি প্রায় দশ বার লক্ষ টাকা সঞ্চয় করিয়া গিয়াছিলেন, কাজেই তাঁহার পুত্ত্র কীৰ্ত্তিচন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায় এত টাকা হাতে পাইয়া শয়তানের শিষ্যত্ব স্বীকার করিল এবং বিলাস সাগরে গা ভাসাইয়া দিল।
নিজে উপার্জ্জন না করলে কেহ কখন টাকার যত্ন বোঝে না, কীর্ত্তিচন্দ্র কখন এক পয়সাও উপার্জ্জন ক’রে নাই, চিরকাল আলালের ঘরের দুলালের ন্যায় পিতৃ-অন্ন ধ্বংস করিয়া আসিতেছিল, সে এখন এতো টাকা হাতে পাইয়া যে হূহাতে অপব্যয় করবে, তাহার আর আশ্চর্য্য কি?
নিয়ত অপব্যয় করলে কুবেরের ভাণ্ডারও শূন্য হ’য়ে যায়, সুতরাং অল্পদিনের মধ্যে হাতের নগদ টাকাও ফুরাইয়া গেল এবং দেনার দায়ে জমিদারীগুলিও বিক্রয় হইল। কাজেই একমাত্র তাহার দোষে বিষ্ণুচরণের সুখের সংসারে কষ্টের ছায়া পতিত হইল।
কীর্ত্তিচন্দ্রের ভাগ্যে একটী পুত্ত্র সন্তান জন্মিয়াছিল, তাহার নাম হরমোহন মুখোপাধ্যায়। হরমোহন বাল্যকাল হইতেই অতি সুশীল তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও মেধাবী ছিলেন, লেখা পড়ায় তাহার বিশেষ আগ্রহ ছিল, সেইজন্য অল্প বয়সে সংস্কৃত ও পারশীতে বিশেষ কৃতবিদ্য হইয়াছিলেন। তাহার পিতামহের নামডাক ছিল, সকলে তাহাকে একজন ধনী লোক বলিয়া জানিতেন; সেই জন্য উপনয়নের অল্পদিন পরে কানপুর প্রবাসী একজন শোত্রিয় ব্রাহ্মণের কন্যার সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছিল, সেই কন্যাটীর নাম বামাসুন্দরী দেবী।
হরমোহনবাবু দুঃখের সংসারে প্রবেশ করিলেন, কারণ তখন তাহার পিতার অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল, কাজেই হরমোন নিজের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য বাটী হইতে বহির্গত হইলেন এবং মুসলমানদের অধিকার ছাড়াইয়া পঞ্জাবে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
সেই সময় সমগ্র পাঞ্জাব প্রদেশ ভিন্ন ভিন্ন সর্দ্দারের দ্বারা শাসিত হইত। রণজিৎ সিংহের অভ্যুদয়ে যেরূপ এক রাজার শাসনাধীন হইয়াছিল, তখন সেরূপ ছিল না।
হরমোহনবাবু পঞ্জাবে আসিয়া ইতিহাস প্রসিদ্ধ ধ্যানসিংহের পিতামহ সর্দ্দার সমরসিংহের অধীনে একটা চাকুরী গ্রহণ করিলেন। হরমোহনবাবু নিতান্ত সুশীল ধর্ম্মভীরু ও কার্য্যদক্ষ ছিলেন, তাহার উপর সংস্কৃত ও পারশী উত্তমরূপে শিক্ষা করিয়াছিলেন, স্বধর্ম্মের উপর প্রগাঢ় আস্থা ছিল, কখন অসৎ উপায়ে একটী পয়সাও গ্রহণ করিতেন না; কাজেই অল্প দিনের মধ্যে তিনি সর্দ্দারবাহাদুরের নিতান্ত বিশ্বস্ত ও প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন এবং তিন বৎসরে মধ্যে সামান্য মুন্সীগিরি হইতে একেবারে তাহার বিস্তৃত জমীদারির সদর-নায়েবি পদ প্রাপ্ত হইলেন।
যদিও এই পদের মাসিক বেতন চল্লিশ টাকা মাত্র, কিন্তু নজর প্রভৃতিতে প্রচুর লাভ হইয়া থাকে। কাজেই হরমোহনবাবুর এক্ষণে প্রচুর আয় হইতে লাগিল। তিনি এক্ষণে লাহোরের প্রকাণ্ড সরকারি বাড়ীতে বড়মানুষি চালে দিন কাটাইতে লাগিলেন।
এই সময় তাহার পিতৃবিয়োগ হইয়াছিল। মুখোপাধ্যায় মহাশয় দিল্লীতে আসিয়া অতি ধূমধামের সহিত পিতৃশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করিলেন এবং বিধবা মাতা ও স্ত্রীকে লইয়া লাহোরে আসিলেন।
সাত আট বৎসর এই চাকরী করিয়া মুখোপাধ্যায় মহাশয় প্রায় লক্ষ টাকা সঞ্চয় করিয়া ফেলিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহার নামডাক ও পসার প্রতিপত্তি বৃদ্ধি হইল। কিন্তু এই সংসারে বিধাতা কাহাকেও সৰ্ব্বসুখী করেন না। কোন না কোন বিষয়ে একটা এমনি ভয়ানক অভাব রাখিয়া দেন যে, তার জন্য তার সমস্ত বিভব যেন ঘোর বিড়ম্বনায় পৰ্য্যবসিত হ’য়ে থাকে।
মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের ভাগ্যে এই অকাট্য ঐশ্বরিক নিয়মের অন্যথাচরণ হইল না। নিজের গুণে ও ভাগ্যের প্রসাদে তিনি এক্ষণে একজন কমলার প্রিয়পুত্ত্র হ’য়েছিলেন, কিন্তু সংসারের সার কান পুত্ত্ৰ কি কন্যা না হওয়ায়, তাহার এই ঐশ্বর্য্য ভোগ নিতান্ত তিক্তবোধ হইয়াছিল। শেষে তিনি গুরু নানকের মঠে আসিয়া তত্রস্থ মোহন্তের নিকট মানসিক করিলেন যে, বাবা যদি আমাকে দুটা পুত্ত্র দেন, তাহ’লে জ্যেষ্ঠটিকে আমি বাবার চরণে সমর্পণ করিব, সে পুত্ত্রের সহিত আমার কোন সম্বন্ধ থাকিবে না।
এই ঘটনার কিছু দিন পরে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের স্ত্রী অন্তঃস্বত্ত্বা হইলেন এবং যথাকালে একটী পুত্ত্র প্রসব করিলেন। কাজেই হরমোহন বাবুর নিরানন্দময় পুরী আনন্দ প্লাবনে প্লাবিত হইয়া উঠিল।
বাবার মহিমায় পরবৎসরেই তাহার আর একটী পুত্ত্র জন্মগ্রহণ করিল। ধর্ম্মভীরু সত্যবাদী মুখোপাধ্যায় মহাশয় অতি কষ্টে স্নেহপাশ ছিন্ন করিয়া নয়নপুত্তলি সদৃশ দেড় বৎসরের পুত্ত্রটীকে মঠে সেই মোহান্তমহাশয়ের করে সমর্পণ করিলেন।
আমি সেই মহান্তমহারাজের নিকট হ’তে মন্ত্রগ্রহণ করিয়াছিলাম, তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করিয়া মুদকিসহরে গুরু নানকের যে মঠ আছে, সেই মঠের কর্তৃত্ব ভার প্রদান করিয়াছিলেন। সেই সময় তীর্থ ভ্রমণে যাইবার জন্য গুরুদেবের সকাশে আসিয়াছিলাম। তিনি আমাকে আজ্ঞা করিলেন, “বৎস অভয়ানন্দ! এই বালককে এক্ষণে তোমার করে দিলাম। আমি জানি বঙ্গদেশে তোমার অনেক শিষ্য আছে, তুমি তাদের মধ্যে তোমার বিশেষ অনুগত কোন শিষ্যের করে এই বালকের প্রতিপালনের ভার অর্পণ করবে।
তারপর যখন ইহার বয়ক্রম বাইশ বৎসর হইবে সেই সময় কাশীতে লইয়া যাইবে এবং সন্ন্যাসের মন্ত্র প্রদান করিবে। তারপর তোমার যখন কালপূর্ণ হইবে, সেই সময় মুদকির মঠের ভার ইহার করে দিয়া যোগাধামে গমন করবে। তবে সন্ন্যাসী হইয়া যেন দ্বাদশবর্ষ ভারতবর্ষের সমস্ত তীর্থ পরিভ্রমণ করে, কারণ ভিন্ন ভিন্ন স্থানের প্রাকৃতিক শোভা নিরীক্ষণ করলে হৃদয় উন্নত ও মন সেই সৃষ্টিকর্ত্তার দিকে প্রধাবিত হইবে।
বৎস তুমিই সেই সত্যবাদী রামমোহন মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্ত্র, পুণ্যবতী বামাসুন্দরীদেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলে। আমিই তোমাকে প্রতিপালনের জন্য কৃষ্ণনামবাবুর বাটীতে রাখিয়াছিলাম ও গুরুদেব তোমার নাম হরিদাস রাখিতে আজ্ঞা করিয়াছিলেন। এক্ষণে তোমার বাইশ বৎসর বয়ঃক্রম হইয়াছে, কাজেই এইবার কাশীতে গিয়া তোমাকে সন্ন্যাসের মহামন্ত্র দান করিব।”
সন্ন্যাসীমহাশয়ের শ্রীমুখ-নিসৃত এই সকল কথা শুনিয়া আমার মনের সন্দেহ অপনীত হইল এবং আমি যে কে, কি উদ্দেশে এই ভবধামে আসিয়াছি, তাহা বুঝিতে পারিলাম, কাজেই এতদিনের পর আমার আশা মিটিল।