» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উদ্‌যোগপৰ্ব্ব।

নৌকা ছাড়িয়া দিলে, আমি মির্জ্জা সাহেবের কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখি যে, ধ্যানস্থ যোগীর ন্যায় চক্ষু মুদ্রিত ক’রে তিনি কি এক গভীর চিন্তাকূপে নিমগ্ন হ’য়েছেন; তখন বাহ্যিক-জগতের সহিত তাঁহার মনের কোন সম্বন্ধ আছে ব’লে আমার বোধ হ’ল না। কারণ আমার পদশব্দেও তাঁহার চমক ভাঙ্গিল না।

আমি প্রায় দশমিনিট দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় তিনি আমাকে দেখিলেন এবং একটী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বিষণ্ণভাবে কহিলেন, “বোস ভাই, বোস, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।”

আমি সেই গালচের একধারে বসিয়া তাঁহার এই চিন্তার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহাতে তিনি উত্তর করিলেন, “আমি কেবল নবাববাহাদুরের পরিণামটা ভাবিতেছি, যেরূপ গতিক দেখিলাম, তাহাতে আপোষে মিটবার আর কোন সম্ভাবনা নাই। এখন সমস্ত দেশটী উদরস্ত না করিলে ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানী নিরন্ত হইবেন না। এদিকে মিরকাসিমখাঁ পূর্ব্ব নবাবের ন্যায় অপদার্থ কাপুরুষ নহে, রাজার কর্ত্তব্য সাধনে, নিরপেক্ষভাবে প্রজারঞ্জনে, তাঁহার বিশেষ আগ্রহ আছে, নিজের যথার্থ প্রাপ্য বিষয় বুঝিয়া লইতেও তিনি জানেন, সুতরাং ইংরাজদের সঙ্গে কিছুতেই তাহার বনিবনাত হবে না। তিনি বিনা রক্তপাতে আপোষে গোলমাল মেটাবার জন্য যে সকল ন্যায়সঙ্গত সদুপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহা কোম্পানীর কর্ম্মচারীদের অবিবেচনায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইল, কাজেই আর বৃথা কালহরণ যুক্তিসঙ্গত ব’লে বোধ করিলাম না।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইংরাজেরা আপনাকে কি উত্তর দিলেন?”

মির্জ্জা। তাহারা আমার সকল কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিল এবং বিদ্রূপের স্বরে কহিল, নবাব বাহাদুরের মতিভ্রম উপস্থিত হয়েছে। খৃষ্টানেরা মিথ্যাকথা কি প্রবঞ্চনা জানে না, ওসব এদেশের কালা আদমির নিজস্ব সম্পত্তি। ঈশ্বরের দশ আজ্ঞার মধ্যে মিথ্যা কথা বলা পাপ বলে উল্লেখিত হ’য়েছে, কাজেই খৃষ্টানেরা তাহা মানিয়া চলে। নবাববাহাদুর না বুঝিয়া ইংরাজদের উপর মিথ্যা দোষারোপ করিতেছেন। ফলকথা ইংরাজদের বিরুদ্ধাচরণ করিলে, তাহার ভাগ্যে কখনই শুভফল ফলিবে না। তাহারা যখন আমার সকল কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিল, নবাববাহাদুরের যুক্তিযুক্ত আবেদন গ্রাহ্যের মধ্যে আনিল না, অধিকন্তু ভয় দেখাইয়া কথা কহিল, তখন তাহাদের অভিপ্রায় সুবিধাজনক নহে। তাহারা সুবেদারবাহাদুরকে বিষহীন সর্পের ন্যায় নিস্তেজ ব’লে জ্ঞান করিয়াছে।

আমি। তাহ’লে আপনি কি স্থির করলেন?

মির্জ্জা। যার রাজ্য তিনিই স্থির করবেন, তবে গতিক বড় ভাল নহে। তেজস্বী মিরকাসিমখাঁ এইরূপে অবজ্ঞাত হ’য়ে কখনই নীরবে এই অপমানরাশি সহ্য করবেন না। নিশ্চয় একটা যুদ্ধবিগ্রহ উপস্থিত হবে এবং তাহাতে মুসলমান রাজত্বের নাম পর্য্যন্ত ধরাপৃষ্ঠ হ’তে অপনীত হ’য়ে যাবে, আর কেউ সুবেদাররূপে বাঙ্গালার মসনদে বসিবে না।

মির্জ্জাসাহেবের মুখে এই সকল কথা শুনিয়া, আমি মনে মনে বিশেষ দুঃখিত হইলাম। কারণ নবার বাহাদুরের উপর আমাদের যথেষ্ট মমতার সঞ্চার হইয়াছিল। তিনি যে, কিছুতেই প্রবল প্রতাপান্বিত ইংরাজদের সহিত যুদ্ধে জয়ী হইতে পারবেন না, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম এবং তজ্জন্য বিশেষ চিন্তান্বিত হইলাম।

যাহা হউক অনুকুল বাতাস পাইয়া পালভরে আমাদের নৌকা চলিতে লাগিল এবং চৌদ্দদিনের দিন প্রাতঃকালে আমরা মুঙ্গেরে উপস্থিত হইলাম।

আমরা তীরে উঠিয়াই শুনিলাম যে, ৪/৫ দিন হইল নবাব বাহাদুর এখানে আসিয়াছেন। কাজেই আমারা দুর্গমধ্যে গিয়া আগে তাঁহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম।

মির্জ্জা সাহেবের নিকট কলিকাতার সংবাদ শুনিয়া তিনি ক্রোধকম্পিত স্বরে কহিলেন, “ইংরাজদের মনোগত অভিপ্ৰায় আমি পূৰ্ব্ব হ’তেই বুঝিয়াছি, কেবল আরও দিনকয়েক সময় লইবার জন্য এরূপ কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলাম। যাই হোক্ যখন ইংরাজদের সঙ্গে আমার বিবাদ অনিবাৰ্য্য হইয়া পড়িল, তখন আর কাল বিলম্ব না ক’রে ভাবী-যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া যাক্। তোমরা এখন বিশ্রাম করগে, তারপর রাত্রিতে আসিয়া পুনরায় সাক্ষাৎ করিও।”

দুর্গের মধ্যে একটী কক্ষ আমার বাসের জন্য নির্দ্দিষ্ট হইল, একজন কণোজি ব্রাহ্মণ রন্ধন করিয়া দিল। আহারাদি করিয়া ক্ষণেক বিশ্রামের পর দুর্গের চারিদিক দেখিবার জন্য বহির্গত হইলাম।

দেখিলাম, চারিদিকে খুব খরভাবে যুদ্ধের উদ্‌যোগ চলিতেছে। শত শত শিবির স্থাপন পূর্ব্বক তাহাতে সৈন্যগণ বাস করিতেছে ও সেনানীদের নির্দ্দেশ ক্রমে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করিতেছে। একদিকে শতাধিক কর্ম্মকার বর্শা তলোয়ার প্রভৃতি অস্ত্রে শাণ দিতেছে এবং রাশি রাশি নূতন অস্ত্রাদি ও গুলি গোলা প্ৰস্তুত করিয়া সঞ্চয় করিতেছে। সৈন্য ও অশ্বাদির জন্য রসদ সংগ্রহ করিয়া ভাণ্ডারে সঞ্চিত হইতেছে; ফলকথা দুর্গের চারিদিকেই ভাবী-যুদ্ধের জন্য খরভাবে উদ্‌যোগ আয়োজনের ধুম পড়িয়া গিয়াছে।

রসদ বিভাগের তত্ত্বাবধারণ ও সৈন্যদের বিলি করিবার ভার আমার উপর অর্পিত হইল এবং চারিজন মুহুরি হিসাব রাখিবার জন্য আমার অধীনে নিযুক্ত হইল, তখন চারিদিক হইতে সৈন্য মুঙ্গেরের দুর্গে জমায়াৎ‍ হইতেছে, কাজেই আমার আর নিশ্বাস ফেলিবার সময় রহিল না, উদয়াস্ত সমানভাবে পরিশ্রম করিতে হইল।

এইরূপে কিছুদিন অতিবাহিত হইয়া গেল। একদিন কথা প্রসঙ্গে আমি জানিতে পারিলাম যে, নদীয়ার রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র পুত্ত্রের সহিত এই দুর্গমধ্যে বন্দীভাবে আছেন। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করিয়া জ্ঞাত হইলাম যে, নবাববাহাদুর যুদ্ধের সাহায্যের জন্য বার লক্ষ টাকা দাবী করেন, কিন্তু মহারাষ্ট্রেরা পুনঃ পুনঃ দেশ লুণ্ঠন করায় প্রজাদের অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় হইয়াছে, সুতরাং অতো টাকা আদায়ের আর কোন সম্ভাবনা নাই বলিয়া তিনি স্বইচ্ছায় আসিয়া বন্দী হইয়াছেন। তাঁহার কর্ম্মচারীরা টাকা আদায় করিয়া পাঠাইলে তিনি মুক্ত হইবেন।

পূর্ব্বে কিষণজি বাবুর বাড়ীতে জোয়া খেলার মজলিসে জালরাজাকে দেখিয়া ছিলাম, এখন প্রকৃত ব্যক্তিকে দেখিবার সখ আমার মন মধ্যে নিতান্ত প্রবল হইয়া উঠিল।

দুর্গের সম্ভ্রান্ত কয়েদিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা কাহার পক্ষে অনায়াসসাধ্য নহে, কিন্তু আমার উপর নবাব বাহাদুরের বিশেষ একটু অনুগ্রহ ছিল বলিয়া দুর্গস্থ সকল সেনানী ও রাজপুরুষেরা আমাকে একটু খাতির যত্ন করিতেন, বিশেষ কিল্লাদার রেয়েলদার হামিদ খাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্ব হইয়াছিল। সেই জন্য নবাবসাহেবকে না জানাইয়া এই ব্যাপারে কৃতকাৰ্য্য হইয়াছিলাম।

একদিন সন্ধ্যার পর হামিদ খাঁর সহায়তায় মহারাজ যে কক্ষে বাস করিতেছেন, তথায় উপস্থিত হইলাম। যদিও মহারাজা তথায় বন্দীভাবে অবস্থান ক’চ্ছেন, কিন্তু তথাপি তাঁহার অবস্থা সাধারণ কয়েদির ন্যায় নহে। তিনি যে কক্ষে বাস করিতেছেন, তাহা বেশ সুসজ্জিত ও তাঁহার ন্যায় উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির উপযুক্ত। তা ছাড়া রসুইয়ের একজন ব্রাহ্মণ ও চারিজন খানসামা সেবার কার্য্যে নিযুক্ত আছে।

আমি সেই কক্ষমধ্যে গিয়া দেখিলাম, মহারাজ একখানি উৎকৃষ্ট গালচের আসনের উপর বসিয়া সন্ধ্যা করিতেছেন ও সম্মুখে রূপার কোশাকুশি শোভা পাইতেছে। আমি এই মহাত্মার প্রশান্তমূর্ত্তি, জ্ঞানগৰ্ব্বিত বদনমণ্ডল, সমুজ্জ্বল নয়নদ্বয় দেখিয়া তাঁহাকে একজন মহানুভব ব্যক্তি বলিয়া বোধ করিলাম। যদিও চিন্তায় মহারাজ ঈষৎ কৃশ এবং বর্ণ অনেকটা বিবর্ণ হইয়াছে, তথাপি বিভূতি আচ্ছাদিত অগ্নির ন্যায় এক প্রকার স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য তাঁহার দেহমধ্যে বিরাজ করিতেছে।

আমি গললগ্নিকৃতবাসে মহারাজকে প্রণাম করিলাম, তিনি ইঙ্গিত দ্বারায় আমাকে বসিতে বলিলেন, কাজেই নিকটস্থ একখানি চৌকির উপর বসিয়া মহারাজের অনন্যসাধারণ সৌন্দর্য্যরাশি দেখিতে লাগিলাম।

প্রায় একঘণ্টা পরে মহারাজ সন্ধ্যা বন্দনাদি শেষ করিয়া, অতীব স্নেহস্বরে ও ধীর বচনে কহিলেন, “তুমি কে বাপু?”

আমি সবিনয়ে যুক্তকরে উত্তর করিলাম, “রাজন! নবাববাহাদুর এ দীনকে রসদবিভাগের দারোগার পদ দিয়া প্রতিপালন করিতেছেন।”

মহা। নবাব বাহাদুর কি আমার নিকট তোমাকে পাঠাইয়াছেন?

আমি। আজ্ঞে না, তিনি এ সম্বন্ধের কোন কথা পরিজ্ঞাত নন, আমি স্বইচ্ছায় কেবলমাত্র আপনাকে দর্শন করিবার অভিপ্রায়ে আসিয়াছি।

মহারাজ ঈষদাস্যে উত্তর করিলেন, “কেন বাপু, এই দুঃসময় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে এলে? আমার দ্বারায় এখন ত তোমার কোন উপকার হ’তে পারে না।

আমি উত্তর করিলাম, “মহারাজ! আমি কোনরূপ প্রত্যাশাপন্ন হ’য়ে প্রভুর সমক্ষে আসি নাই। পূর্ব্বে মহারাজার গৌরবময় নাম ও অদ্ভুত কীৰ্ত্তিগাঁথা শুনিয়াছিলাম, তাই কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য নবাববাহাদুরের অজ্ঞাতসারে কিল্লাদারের সাহায্যে আপনার শ্রীচরণ দর্শন আশায় আসিয়াছি। কি আশ্চর্য্য যাহার দাতৃত্বগুণে লক্ষ লক্ষ ব্রাহ্মণ নিস্করে বাস করিতেছেন, যাঁহার দয়ার উৎস উৎসারিত হ’য়ে সহস্র সহস্র লোকের দারিদ্র জন্মের মতন ঘুচাইয়াছে, যাঁহার সুনাম সংসারাকাশে ধূমকেতুর ন্যায় সমুজ্জ্বল র’য়েছে, আজ সেই মহাত্মাকে কি না যবনের কারাগারে বন্দিভাবে অবস্থান করতে হ’লো! ইহাতেই স্পষ্টবোধ হ’চ্ছে, সৎকার্য্যের পুরস্কার এ জগতে নাই।”

মহারাজ আমার কথা শুনিয়া ঈষদাস্যে কহিলেন, “বাপু, আমার ভাগ্যের ফল আমাকেই ভোগ করতে হবে। এই কৰ্ম্মভূমিতে কেহই নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা দুঃখ ভোগ করে না। বিশেষ তোমাদের নবাব বাহাদুর আমাকে বলপূর্বক ধরিয়া আনেন নাই, আমি টাকা দিতে না পারায় স্বইচ্ছায় এখানে আসিয়া বন্দি হইয়াছি।

আমি। কেন আপনি স্বইচ্ছায় বন্দি হইলেন?

মহা। বাপু, তোমাদের নবাববাহাদুর নজরানা বলিয়া আমার নিকট বার লক্ষ টাকা দাবী করেন এবং টাকা সংগ্রহের জন্য তিন মাস সময় দেন। আমি বুঝিয়া দেখিলাম যে, দস্যুর ন্যায় প্রজাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন না করিলে এই টাকা সংগৃহীত হইবে না, কারণ বর্গির হাঙ্গামায় সমগ্র বাঙ্গালাদেশ একপ্রকার নিঃস্ব হইয়া পড়িয়াছে। এ অবস্থায় আমি তাদের পিতৃসম ভূস্বামী হ’য়ে কি ক’রে তাদের বাটীতে ডাকাতের ন্যায় ডাকাতি করি। কাজেই টাকার প্রতিভূস্বরূপ আমরা পিতা পুত্ত্রে এই মুঙ্গেরের দুর্গে আবদ্ধ আছি।

আমি। কতদিন আপনি এ অবস্থায় অবস্থান করবেন?

মহা। তাহা জগদম্বাই জানেন, তবে আমার দাওয়ানজি টাকা সংগ্রহের চেষ্টায় আছে, কিন্তু কতদিনে যে এত টাকা সংগৃহীত হবে, তাহা বলিতে পারি না। বিশেষ আমি প্রজাপীড়ন করতে দাওয়ানকে নিষেধ করিয়াছি। কারণ প্রজাপীড়ন ক’রে ইহকাল পরকাল নষ্ট করা অপেক্ষা চিরকাল যবনের কারাগারে রুদ্ধ থাকাও শ্রেয়ঙ্কর বোধ করি।

আমি মহারাজের শ্রীমুখের কথা শুনিয়া মনে মনে নিতান্ত পরিতুষ্ট হইলাম, কিন্তু ঈদৃশ ধর্ম্মভীরু প্রজারঞ্জক সদাশয় মহাত্মাকে কেন এরূপ বিড়ম্বনা ভোগ করিতে হইল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না।

মহারাজ আমার ন্যায় সামান্য ব্যক্তির সহিত অতি সরলভাবে কৰ্ত্তাবাৰ্ত্তা কহিতে লাগিলেন, আমি তাহার অকপট ব্যবহারে ও জ্ঞানগর্ভ কথা শুনিয়া নিতান্ত পরিতুষ্ট হইলাম এবং রাত্রি প্রায় এগারটার সময় তাহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম।

ক্রমে রাজাবাহাদুরের সহিত আমার বেশ সম্ভাব হইল, আমি অবকাশ রঞ্জনের একটী প্রকৃষ্ট উপায় প্রাপ্ত হ’লাম, কাজেই কাজকর্ম্মের পর রাত্রিতে অবসর পাইলেই রাজাবাহাদুরের নিকট আসিতাম এবং বিবিধ সদালাপে পরমসুখে সময় কাটাইতাম। রাজাবাহাদুর আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, আমি যাহা জানিতাম বা বা শুনিয়াছিলাম তাহা অকপটে তাঁহার নিকট প্রকাশ করিয়া বলিলাম এবং আমার ক্ষুদ্র জীবনের মধ্যে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহারও উল্লেখ করিলাম, একটা কথাও গোপন করিলাম না। কারণ এরূপ মহানুভব ব্যক্তির সঙ্গে মিথ্যা কথা বলা কিছুতেই যুক্তিযুক্ত ব’লে বোধ করিলাম না।

মহারাজ অতীব মনযোগের সহিত আমার কথাগুলি শুনিলেন ও একবার আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত ক’রে কহিলেন, “বাপু, তোমাকে পূর্ব্বে দেখিয়াই বোধ হইয়াছিল যে, তুমি কখনই সামান্য ব্যক্তি নও, কেন না, তোমার শ্রীঅঙ্গে ভাগ্যবান ব্যক্তির বিশেষ কোন লক্ষণ বিরাজমান আছে। প্রথম দর্শনে আমার মনে একটু সন্দেহ হইয়াছিল, এখন স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, অতীব শুভক্ষণে তোমার জন্ম হইয়াছে। ভবিষ্যতে নিশ্চয় তুমি উন্নতির উচ্চশিখরে উঠিবে ও বহুকাল পর্য্যন্ত তোমার নাম লোকের স্মৃতিমন্দিরে বিরাজমান থাকিবে। আমাদের ন্যায় অধম বিষয়ী লোক অপেক্ষা তোমার অবস্থা সমধিক উন্নত। চিরকাল কখনই তোমাকে যবনের অধীনে চাকুরী করিতে হইবে না।

ফলকথা রাজাবাহাদুরের নিকট আমার আদর যত্ন খুব বাড়িয়া গেল, তিনি আমাকে দেখিলেই নিতান্ত প্রীত হইতেন এবং বালকের ন্যায় অতি সরলভাবে আমার সহিত কথাবার্ত্তা করিতেন, এইরূপে মহারাজার ন্যায় মহানুভব ব্যক্তিকে সঙ্গীরূপে পাইয়া পরমসুখে দিনপাত করিতে লাগিলাম।