» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

এরা কে?

বৈঠকখানার পশ্চিম দিকে বাবুর অন্দর মহল, সেখানে দু’টা দরদালান-যুক্ত ঘর, একটা ঘরে বাবু ও অন্য ঘরে তাঁহাদের কন্যা একটী বৃদ্ধা চাকরাণী সহ বাস করেন। আমি কর্ত্তার গৃহের সামনেকার দরদালানে শরন করিয়া থাকি।

এক দিন আহারাদির পর সর্ব্বসন্তাপহারিণী নিদ্রাদেবীর সুকোমল অঙ্কে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছি, অন্তরাকাশে কোনরূপ চিন্তা-মেঘের নামমাত্র নাই; রাত্রি বোধ হয় দ্বিপ্রহর অতীত হইয়াছে, এমন সময় হঠাৎ আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। আমি জাগ্রত হ’য়ে শুনলাম যে, ঘরের মধ্যে গিন্নি যেন রেগে একটু চেঁচিয়ে কথা ক’চ্ছেন। আমি নিতান্ত কৌতুহলাক্রান্ত চিত্তে ও স্থির কর্ণে সেই শয্যার উপর শুইয়া রহিলাম।

গিন্নি পঞ্চমে সুর তুলে বললেন, “আঃ মরণ আর কি, দড়ি কলসী নিয়ে আঘাটায় নাবোগে, তোমার আর নরলোকে মুখ দেখিয়ে কাজ নাই। ছিঃ মরবার সময় হ’লো এখনো মিথ্যা কথা প্রতারণা জুচ্চুরি ছাড়লে না! তোমাকে আর কি বলবো, সকলি আমার কপালের দোষ!”

গিন্নির এই রোখা রোখা কথায় বাবু খুব নরম হ’য়ে আমতা আমতা ভাবে বলতে লাগলেন, “বলি তুমি যদি রাগ কর, তাহ’লে আমি দাঁড়াই কোথা? তুমি ভেবে দেখ দেখি, আমি তোমার জন্য কি না করেছি।”

যেমন আগুণে ঘি পড়লে দপ্ ক’রে জ্বলে উঠে, সাপকে লাঠি মারলে যেমন ফোস্ ক’রে উঠে, তেমনি গিন্নী-ঠাকুরাণী আরো রাগ ক’রে বাবুর কথায় বাধা দিয়ে বিদ্রূপের স্বরে বলেন, “আঃ মরণ আর কি, উনি আমার জন্য সব ক’রেছেন আর আমি কিছু করিনি। আমি কার জন্য জাত কুল খোয়ালেম, কার পরামর্শে অমন সংসার ছারেখারে দিলাম, কার মন রাখবার জন্য নারীসুলভ কোমলতা বিসর্জ্জন দিয়ে পিশাচিনীর অপেক্ষা নিষ্ঠুরা হ’লাম; কিন্তু হায় এত ক’রেও তোমার মন পেলাম না। এখনো আমার সঙ্গে চাতুরী খেলছো?”

গিন্নীর কথা শেষ হইলে বাবু অনেকটা জড়সড় ভাবে মিনতির স্বরে উত্তর করিলেন, “তোমার দিব্য ছোটবউ! আমি তোমার সঙ্গে কিছুমাত্র চাতুরী করিনি; তোমাকে যা যা ব’লেছি সব সত্য, একটাও মিথ্যা নয়। শনিবার অবধি অপেক্ষা কর, তারপর নিশ্চয়ই তোমার আদেশ পালন করবো। হাতে টাকা না হ’লে তো কোন কাৰ্য্য হবে না; কাযেই আগে রেস্তর যোগাড় দেখতে হবে।”

গিন্নী আগেকার সুর নরম ক’রে বাবুকে বললেন, “আবার কার সর্ব্বনাশ করবার মতলব করছ, পরের ভিটায় ঘুঘু না চরালে ত আর তোমাদের হাতে টাকা আসবে না? সংসারে এত লোক কত প্রকার সৎ উপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করছে, কিন্তু তোমাদের পরের গলায় ছুরি না দিলে দিন যায় না!”

গিন্নীর কথায় বাবু অনেকটা বিরক্ত হ’য়ে বলেন, “আঃ! ধান ভানতে শিবের গীত আন কেন? এ সংসারে টাকাই হচ্ছে একমাত্র জিনিস; টাকা হাতে না থাকলে সব দিক অন্ধকার দেখতে হয়। এই বোঝ না কেন, ইংরাজেরা সাত সমুদ্র তের নদী পার হ’য়ে কেবল টাকার জন্য এ দেশে এসেছে, আর রেশমের কারবারের ছল ক’রে, তাঁতিদের বুকের রক্ত শুষে নিজেরা বড় মানুষি করছে; যে বেটা বোকা, সে বেটাই ধর্ম্ম ধৰ্ম্ম ক’রে সংসারের সার আয়েস হ’তে বঞ্চিত হয়। যে বুদ্ধিমান্ এবং সংসারের সুখভোগ করা যাহার প্রধান উদ্দেশ্য, সে কখন ঐ সব মেয়েলি কথা গ্রাহ্য করে না। আমার মতে ইংরাজেরা খুব বুদ্ধিমান ও চতুর; কারণ তারা ধর্ম্মের বড় ধার ধারে না। কিরূপে উপার্জ্জন হবে এই চিন্তায় রাত্র দিন ব্যস্ত থাকে।”

কর্ত্তার এই সারগর্ভ বক্তৃতা শেষ হ’লে গিন্নী পূর্ব্বাপেক্ষা নরম সুরে বলেন, “কেন, টাকা টাকা ক’রে মরবার আবশ্যক কি? অন্য জায়গায় গেলে অবশ্য তার কিছু খরচ পত্র হবে; তার অপেক্ষা ঘরে ঘরে কাজ সার না? ওর চেয়ে ভাল ছেলে তো আর বাহিরে পাচ্ছো না।”

গিন্নীর কথায় কর্ত্তা একেবারে অগ্নিশৰ্ম্মা হ’য়ে বলতে লাগলেন, “পাগল আর কি! তা কি কখন হয়? তোমার মেয়ের জন্য খুব সুন্দর বর নিয়ে আসবো; টাকা ছাড়লে কি না পাওয়া যায়? টাকায় বাঘের দুধ মেলে, আমি নিশ্চিন্ত আছি, হাতে কিছু টাকা লাগলেই বর খুজতে বেরুবো, তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না।”

কর্ত্তা বলতে বারণ করলেন বটে; কিন্তু গিন্নি তবু নিশ্চিন্ত না হ’য়ে ঈষৎ নম্রস্বরে কহিল, “কেন আমি যা বল্লেম তা কি মন্দ কথা? ছেলেটি তো মন্দ নয়, রূপে গুণে সমান; টাকা নাই থাকলো তাতে ক্ষতি কি? মেয়ের কপালে সুখ থাকলে পাতার ঘরও অট্টালিকা হয়।”

কর্ত্তা বিরক্তির সহিত কহিল, “আঃ! রাম হ’তে না হ’তে রামায়ণ গাওনা কর কেন? তুমি যা বলচো, তা হবার নয়, হ’লে আমি নিজে উদ্যোগী হ’য়ে এ কাজ কৰ্ত্তাম। গোড়ার কথা জানলে তুমি কখনই বলতে না। গুরুর অনুরোধ ব’লে রেখেছি।”

গিন্নী কহিলেন, “গোড়ার কথা কি?”

আমি যদিও এ কথার উত্তর শুনিবার জন্য কাণ খাড়া করিয়া রইলাম, কিন্তু কর্ত্তা এমনি আস্তে আস্তে কথা কহিতে লাগিলেন যে, আমি তাহার একবর্ণও বুঝিতে পারিলাম না। গিন্নি আর কথাটি না ক’য়ে নিরস্ত হ’লেন, কাজেই ঘরটা নিস্তব্ধ হইল।

অল্পক্ষণ পরেই বুঝিলাম যে, কৰ্ত্ত। ও গিন্নি উভয়েই সর্ব্বসন্তাপহারিণী নিদ্রাদেবীর শান্তিময় ক্রোড়ে স্থান পাইয়াছেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ আজ আমি দেবীর সেই সাধারণ ভোগ্য কৃপা হ’তে বঞ্চিত হ’লেম। কারণ কর্ত্তা গিন্নির কথায় আমার মনে একটা বিষম খটকা উপস্থিত হ’য়েছে। আমি সেই শয্যায় শুয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে, প্রকৃতপক্ষে এরা কারা? কারণ গিন্নি যে ভাবে কথা কইলেন, তাতে খুব সন্দেহ হ’তে পারে; স্ত্রী পুরুষে এরূপ ভাবে কথোপকথন কখনই সম্ভবপর নহে। গিন্নি এক প্রকার স্পষ্টই বললেন যে, “কার জন্য জাতকুল নষ্ট করলাম— কার পরামর্শে অমন সোণার সংসারে আগুন লাগাইয়া দিলাম।” এ সব কথার মানে কি? শেষে গিন্নি যা বললেন, তাতে বেশ বোঝা গেল যে, গিন্নি তার মেয়ের বিবাহের কথা বলছেন। কৰ্ত্তা প্রথমে টাকার ওজর করলে, শনিবারে টাকা পাবো ব’লে আশ্বাস দিলে, তারপর গিন্নি টাকা যাতে না খরচ হয়, তার জন্য ঘরে ঘরে কাজ সারতে বলেন। কৰ্ত্তা সেই কথায় রেগে উঠে আপত্তি ক’রে বললেন, “না তা হবে না, কিছুতেই হবার নয়, হবার হ’লে আমি নিজে উদ্যোগী হ’য়ে কৰ্ত্তাম।” নিশ্চয় গিন্নি আমাকে লক্ষ্য ক’রে এ কথা ব’লেছিলেন। তারপর গিন্নি গোড়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে; চুপি চুপি কি বলেন, নিশ্চয় আমার কথাই হ’য়েছিল, তার আর সন্দেহ নাই।

যদিও কর্ত্তার সব কথার মানে বুঝতে পারলেম না, কিন্তু ভাবে এটা বেশ বুঝলেম যে, আমি এদের বাড়ীর ছেলে নয়; এরা দয়া ক’রে আমাকে প্রতিপালন ক’চ্চেন। কর্ত্তা নিশ্চয় ভিতরের কথা চুপি চুপি গিন্নিকে ব’লেছেন। তিনি যেরূপ টাকার মহিমা কীর্ত্তন করলেন, তাতে বেশ বোধ হ’লো যে, উনি টাকার জন্য না পারেন এমন কাজ জগতে নাই; কিন্তু তা হ’লেও আমার দ্বারায় কিসে উনি লাভবান্ হবেন? তার পর ওর গুরুদেব কে? তিনি ওকে কি আজ্ঞা ক’রেছেন? শয্যার উপর শয়ন করিয়া মনে মনে এই সব কথা ভাবতে লাগলেম্, কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। প্রাণে বড় ভয় হইল, বুক্ দুর্ দুর্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল, স্বেদজলে সৰ্ব্বাঙ্গ সিক্ত হইল, দারুণ পিপাসায় কণ্ঠদেশ বিশুষ্ক হইয়া উঠিল। ঘোর মানসিক যাতনায় কাতর হইয়া শয্যার উপর শরবিদ্ধ হরিণের ন্যায় ছট্‌ফট্ করিতে লাগিলাম; কিছুতেই শান্তিলাভে সমর্থ হইলাম না। মনে দারুণ উৎকণ্ঠা, বিষম সন্দেহ, ভয়ানক ত্রাস আসিয়া উপস্থিত হইল। যতই এই সকল কথা ভাবি; ততই অনিষ্ট-চিন্তা অন্তরে উদয় হইয়া প্রাণকে ব্যাকুল করিয়া তোলে। আমাকে এরা পুত্ত্রের ন্যায় যত্নে পালন ক’চ্চেন, শেষে এরাই আমাকে কোন বিপদে ফেলবেন, এ তো আমার সহসা বিশ্বাস হয় না। আর তাতে এদেরই বা কি লাভ হইবে? কিন্তু তা হ’লে নির্জ্জনে প্রাণের কপাট খুলে কর্ত্তা গিন্নীকে চুপি চুপি কি এমন গোড়ার কথা বললেন যে, গিন্নী শুনেই একেবারে জল হ’য়ে গেলেন। আর কোন কথাটি বললেন না, এরই বা মানে কি? বিশেষ গিন্নী যদি কর্ত্তার বিবাহিতা স্ত্রী হবেন, তা হ’লে কি ক’রে কর্ত্তার মুখের উপর বললেন যে, “কার জন্য আমি জাতিকুল নষ্ট করিয়াছি।” এ কথারই বা মানে কি?

যদিও আমি সে সময় ছেলেমানুষ, কিন্তু তবু স্বামী ও স্ত্রীতে যে এরূপ বাক্যালাপ অসম্ভব, তা আমি বেশ বুঝতে পারলাম; কাজেই বিষম সন্দেহ ও বিস্ময়ের যুগপৎ আক্রমণে আমার চিত্তভূমি আক্রান্ত হ’লো। আমি নিবিষ্ট মনে এই সকল বিষয় ভাবিতে লাগিলাম; কিন্তু কোন বিষয়ের মীমাংসা করিতে পারিলাম না, সন্দেহের তুফানে মন প্রাণ ভাসিতে লাগিল। ক্রমে উহার প্রধান বার্ত্তাবহ স্নিগ্ধ সমীরণের শৈত্যতা অনুভব করিতে করিতে আমার ঈষৎ তন্দ্রা উপস্থিত হইল। সুতরাং সুশীতল বারিবর্ষণে প্রদীপ্ত পাবক যেরূপ প্রশমিত হয়, তেমনি আমার অন্তরের সুদারুণ চিন্তানল তখনকার মতন নিৰ্ব্বাপিত হইল।