» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ

নীলমণি বসাক।

নবাববাহাদুরের মুখে ঈদৃশ বীরত্বব্যঞ্জক সারগর্ভ কথা শুনিয়া আমি মনে মনে নিতান্ত প্রীত হ’লাম এবং তাঁহাকে একজন তেজস্বী শাসনকৰ্ত্তা ব’লে বোধ করিলাম। যাহা হউক এক্ষণে বিজয় লক্ষ্মী যে কাহার প্রতি প্রসন্ন হইবেন তাহা সাধারণ মনুষ্যের জ্ঞানাতীত বলিয়া আমি মনমধ্যে এ বিষয়ের আর আলোচনা করিলাম না।

এদিকে দেখতে দেখতে সাতদিন বিস্মৃতির অতলতলে নিমজ্জিত হ’লো। আটদিনের দিন প্রাতঃকালে দাওয়ানজিমহাশয় আমাকে কহিলেন, “অদ্য আহারাদির পর তোমাকে যাত্রা করতে হবে, নৌকা প্রস্তুত হয়েছে। আমি তোমার যাত্রার সমস্ত উদ্‌যোগ করিয়া রাখিয়াছি। তুমি কলিকাতা হইয়া মুঙ্গেরে উপস্থিত হবে, নবাববাহাদুর ও সসৈন্যে স্থলপথে যাত্রা করিবেন। তিনি তোমার ভাল করিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন। তবে তুমি আমাকে একেবারে ভুলিও না, মাঝে মাঝে পত্রাদি লিখিও।”

আমি কৃতজ্ঞতাভরে কহিলাম, “আপনার ঋণ আমি এ জন্মে কিছুতেই পরিশোধ করতে পারবো না। আমার ন্যায় সামান্য ব্যক্তিকে ঈদৃশ অনুগ্রহ প্রকাশ আপনার মহত্ত্বের পরিচায়ক। তবে আমি যদি কোন অপরাধ ক’রে থাকি, নিজগুণে এই অধমকে ক্ষমা করিবেন। আপনার শ্রীচরণে আমার এইমাত্র নিবেদন।”

দাওয়ানজিমহাশয় শশব্যস্তে নমস্কার করিয়া কহিলেন, “আরে বাপরে, অমন কথা ব’লো না। তোমার পদরজে আমার বাটী পবিত্র হ’য়েছে, আর আমিও সেই সঙ্গে ধন্য হ’য়েছি। বিপুল বলশালী হস্তী নিজের বল না বুঝে যেমন ক্ষুদ্রপ্রাণ মাহুতের আনুগত্য স্বীকার করে, তেমনি তুমি নিজের স্বরূপত্ত্ব না বুঝে আমার ন্যায় হীনজনের নিকট ঈদৃশ বিনয় প্রকাশ করছো। ফলকথা, এই জগতে তোমার ভাগ্য ভিন্ন উপকরণে গঠিত হ’য়েছে, আর আমি অভাগা ব’লে খেলাঘরের খেলনা হাতে দিয়ে বিধাতা বঞ্চিত করেছেন। ফলকথা, ফুলের সঙ্গে থাকলে তৈল যেমন সুরোভিত হয়, তেমনি তোমার সদ্‌গুণে আমি অবধি কৃতার্থ হ’লাম। কেন না তোমার ন্যায় ভাগ্যবানের সেবা করিলে তাহার জীবনসাৰ্থক হ’য়ে থাকে, এমন কি তাহার মানবজন্ম ধারণ সফল হয়।”

আমি এই সকল কথার প্রকৃত মর্ম্ম না বুঝে, নিতান্ত উদাসভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। দাওয়ানজিমহাশয় আমার ভাবগতিক দেখিয়া একটু হাসিলেন, কিন্তু প্রকাশ্যে আর কোন কথা বলিলেন না, কাজেই সে সম্বন্ধের কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমারও সাহসে কুলাইল না, আমি চুপ করিয়া রহিলাম। তবে আমার প্রাণের মধ্যে একটা খটকা রহিয়া গেল।

দাওয়ানজিমহাশয় চাকরকে আমার কাপড়চোপড় গুছাইয়া দিতে আজ্ঞা করিলেন ও আমাকে প্রস্তুত থাকিতে বলিয়া বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন।

বেলা আন্দাজ দুটার সময় দাওয়ানজিমহাশয় বাহিরে আসিলেন এবং নবাববাহাদুরের সেই মোহরযুক্ত বাহালনামা পত্রখানি আমার হাতে দিলেন, আমি সেখানি সযত্নে আমার জামার জেবের মধ্যে রাখলাম। তারপর দাওয়ানজিমহাশয় কাজকর্ম্ম সম্বন্ধে দুচারটি সময়োচিত উপদেশ দিয়া বিদায় দিলেন। আমার কাপড়চোপড় পরিপূর্ণ একটী বেতের পেট্রা ও শয্যাদি একজন চাকর মাথায় করিয়া চলিল, নিচে গাড়ি প্রস্তুত ছিল, আমি সেই চাকর সহ গাড়ীতে উঠিয়া গঙ্গাতীর উদ্দেশে গমন করিলাম।

আমি গঙ্গাতীরে আসিয়া দেখিলাম যে, পাশাপাশি আঠারখানি বড় নৌকা সজ্জিত রহিয়াছে এবং প্রত্যেকখানি হইতে ইসলামধর্ম্মের চিহ্নিত পতাকা পৎ পৎ শব্দে উড়িতেছে।

তীর হ’তে নৌকা অবধি কাঠের পাটাতন পাতা ছিল, আমি তাহার উপর দিয়ে নৌকায় উঠিলাম এবং অপার আনন্দ-সাগরে নিমগ্ন হ’লাম। আমি ইতঃপূর্ব্বে নবাববাহাদুরে মুখে মির্জ্জা আলি এই নাম শুনেছিলাম, কিন্তু আমার সেই উপকারী সহৃদয় কারাধ্যক্ষ মহাশয়কে যে রাজদূত করিয়া কলিকাতায় পাঠাইতেছেন, তাহা ঠিক বুঝিতে পারি নাই। এক্ষণে সেই উদারহৃদয় মহাত্মাকে প্রত্যক্ষে দেখে আমার আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না।

আমাকে দেখিয়া মির্জ্জা সাহেবের মুখমণ্ডলে বিস্ময়ে লক্ষণ সকল প্রকটিত হইল, আমি মুখে কিছু না ব’লে, আমার জামার জেব হ’তে সেই বাহালনামাখানি তাঁহার হাতে দিলাম। তিনি সেইখানি পাঠ ক’রে নিতান্ত প্রীতভাবে হাসি হাসি মুখে আমার হাতখানি ধরিয়া কহিলেন, “ধন্য, সেই লীলাময়ের লীলা ধন্য, ক্ষীণবুদ্ধি মানবের কি সাধ্য যে তাহা উপলব্ধি করে। কখন স্বপ্নেও যাহা ভাবি নাই, এক্ষণে প্রত্যক্ষে তাহাই ঘটিল। পূর্ব্বে কয়েদিভাবে এ দীনকে দেখা দিয়েছিলে, এখন আবার আমার দক্ষিণহস্ত স্বরূপ সহকারীরূপে এলে, আমার পক্ষে ইহার অপেক্ষা আর আনন্দের বিষয় কি হ’তে পারে? আমি তখুনি ব’লেছিলাম যে একদিন মেঘরাশি ভেদ ক’রে দিবাকর নিশ্চয় বিমল আভা বিতরণ করবেন; বস্ত্রাঞ্চলে অগ্নি কখন প্রচ্ছন্ন থাকবে না, কিন্তু এত শীঘ্র যে এরূপ অদ্ভুত পরিবর্ত্তন হবে, নবাবসরকারে তুমি এমন দায়িত্বপূর্ণ সম্মানের পদ পাবে, আবার এই সঙ্কট সময়ে আমার সহকারী হবে, তাহা কখন ভাবি নাই। আজ সেই মহিমাময়ের অপার মহিমা দেখে আমি যারপর নাই বিস্মিত ও আনন্দিত হ’য়েছি। কারণ তোমার সঙ্গজনিত বিমল সুখলাভে কৃতার্থ হবার সুন্দর অবসর পুনরায় প্রাপ্ত হ’লাম। ভাষায় এমন কোন কথা নাই যে, তার দ্বারায় আমার মনের আনন্দ প্রকাশ করিয়া থাকি। যাই হোক কিরূপে তুমি খোদ নবাবসাহেবের অনুগ্রহ লাভ করলে, আর তারপর তুমি কোথার গেলে, এতদিন কোথায় কিরূপ অবস্থায় ছিলে, তাহা আমার নিকট প্রকাশ ক’রে বল। ভরসা করি বিধর্ম্মী যবন ব’লে কোন কথা গোপন করবে না।”

আমি নিতান্ত বিনীতভাবে কহিলাম, “অমন কথা বলিবেন না, এই জগতের মধ্যে আপনার তুল্য আত্মীয় আর আমার কেহই নাই। আপনি আমাকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ ক’রে রেখেছেন। আপনার সেই সদ্‌ব্যবহার ও আশার অতীত অনুগ্রহ আমি এ জীবনে কিছুতেই বিস্মৃত হব না। আপনার মোহনমূর্ত্তিখানি চিরকালের জন্য স্মৃতি মন্দিরে বিগ্রহের ন্যায় বিরাজ করিবে। আপনার ন্যায় উদারহৃদয় সমদর্শী মহাত্মার নিকট আমার কিছুই গোপন করিবার নাই।”

আমি এই ব’লে খালাসের পর হ’তে আমার ক্ষুদ্র জীবনে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, যেরূপে দাওয়ানজিমহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হ’লো, তাহা আমি অকপটে তাহার নিকট প্রকাশ করিয়া বলিলাম।

আমার কথা শুনিয়া মির্জ্জা সাহেব একটী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “ধর্ম্ম যে ধার্ম্মিকদের রক্ষা ক’রে থাকেন, তাহার শত শত প্রমাণ সংসারে প্রাপ্ত হওয়া যায়। এখন দেখা যাক্, আমাদের নবীন সুবেদারের ভাগ্যে কি ঘটে? তিনি তো নিজের ধর্ম্মকে আলিঙ্গন ক’রে আছেন, পরিণামে ধর্ম্ম কি তাঁকে রক্ষা করবেন না?”

মির্জ্জা সাহেব আমাকে এই কথা ব’লে নৌকা ছাড়তে অনুমতি দিলেন। কাজেই তখুনি নোঙ্গর তুলিয়া পাল খাটানো হইল, বায়ুর বলে নৌকাগুলি গঙ্গার তরঙ্গরাশি ভেদ ক’রে নক্ষত্রবেগে পশ্চিম মুখে ছুটিল।

নিঃসহায় কয়েদি অবস্থায় যে মহাত্মা আমার উপর অজস্র অনুগ্রহরাশি বরিষণ ক’রেছিলেন, আদর অপ্যায়নের ত্রুটী করেন নাই, আজ সহকারীরূপে আমাকে পাইয়া তিনি যে আমার সঙ্গে সহোদর ভ্রাতার ন্যায় সদয় ব্যবহার করবেন, তাহার আর বিচিত্র কি? যদিও আমার বাসের জন্য স্বতন্ত্র একখানি নৌকা নির্দ্দিষ্ট ছিল, কিন্তু এক আহারের সময় ব্যতীত আর এক দণ্ডের জন্য কখন আমরা পরস্পর পরস্পরের কাছ ছাড়া হইতাম না। দুজনে পরমসুখে একত্রে বাস করিতাম।

আমাদের সঙ্গে দুইশত সিপাহী ছিল, ভৃত্যেরা রসদ বাহির করিয়া দিত, আমি কেবল তাহার হিসাব রাখিতাম, ইহা ভিন্ন আর আমার বিশেষ কোন কাজ ছিল না। ফলকথা মির্জ্জা সাহেবের ন্যায় সহৃদয় ভদ্রলোককে সঙ্গী পাইয়া পরম সুখে বিবিধ সদালাপে সময় কাটাইতে লাগিলাম।

একদিন কথায় কথায় মির্জ্জা সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “নবাববাহাদুরের বাহাল নামার ‘হরিদাস ঠাকুর’ এই নাম লেখা আছে, তাহ’লে নিশ্চয় ঠাকুর তোমার উপাধি?”

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “আমি নিজে কুকুর অপেক্ষা অধম, তাহ’লে এই ঠাকুর উপাধি যে কোথা হ’তে আসিল, কে প্রদান করিল, তাহা আমি আদৌ জানি না। আমার সম্বন্ধে আমি যাহা জানিতাম, তাহা পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি, তাহা ভিন্ন আর আমি কিছুমাত্র অবগত নহি। তবে ব্রহ্মচারী মহাশয়ের ঠাকুর বাড়ীতে একজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হ’য়েছিল, কিন্তু কোন কথাবার্ত্তা হয় নাই, কারণ সহসা তিনি সে স্থান হ’তে অদৃশ্য হ’লেন, তারপর ব্রহ্মচারী মহাশয়ের প্রমুখাৎ জ্ঞাত হ’লাম যে, এই মহাত্মাই আমাকে কৃষ্ণনাম গোস্বামী নামে শান্তিপুর নিবাসী একজন ভদ্রলোকের নিকট প্রতিপালনের জন্য রাখিয়াছিলেন। সেই কৃষ্ণনামবাবু কিষণজি বাজপাই নামে ছদ্মবেশে মুরশিদাবাদে বাস করিতেন।”

মির্জ্জা। কেন তিনি এরূপ নাম ভাঁড়িয়ে ছদ্মবেশে ছিলেন?

আমি ব্রহ্মচারী মহাশয়ের নিকট যে সকল কথা শুনিয়াছিলাম, তাহা অকপটে বর্ণনা করিলাম, একটী কথাও গোপন করিলাম না।

কৃষ্ণনামবাবুর গুণের কথা শুনে মির্জ্জা সাহেব কহিলেন, “এ সংসারে মানুষ চেনা ভার, মেষচর্ম্মাবৃত ব্যাঘ্রের ন্যায় অনেক কপট কপটতাজালে আচ্ছন্ন হ’য়ে বিচরণ ক’রে থাকে, তবে চিরকাল কেহ কখন পাপ ক’রে পরিত্রাণ পায় না। তোমাদের কর্ত্তার ন্যায় পাপীমাত্রেই সকলকার পরিণাম নিতান্ত শোচনীয় হয়। এই সংসারে সঙ্গদোষে নিতাত্ত নিৰ্ম্মলচিত্ত সাধু ব্যক্তিরও পতন হ’য়ে থাকে। তুমি পাপীর পাপান্ন ভক্ষণ ক’রেছিল ব’লে, তাহার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তোমাকে সেরূপ কৰ্ম্মভোগ করতে হ’য়েছিল। তা না হ’লে কোন অপরাধ না ক’রে তোমাকে এক বৎসরের জন্য কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে কেন?”

আমি। আপনার কৃপায় আমাকে বিন্দুমাত্র যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয় নাই, আমি পরমসুখে এক বৎসর কাল কাটাইয়াছিলাম। বিষম বন্যায় দেশ ভাসিয়া গেলে যেমন জমির উর্ব্বরতাশক্তি বৃদ্ধি পায়, তেমনি আমার সেই বিপদকে এখন সৌভাগ্যের নিদান ব’লে বোধ করছি, কারণ তা না হ’লে তো আপনার ন্যায় মহাত্মাকে বন্ধুরূপে পাইতাম না।

এদিকে সুবাতাস পাওয়ায় আমাদের নৌকাগুলি পালভরে তীরবেগে ছুটিতে লাগিল। দাঁড়িদের আর পরিশ্রম করিতে হইল না, কেবল অলসভাবে বসিয়া গুড়ুকের বংশ ধ্বংস করিতে লাগিল।

পাঁচদিনের দিন প্রাতঃকালে আমরা কলিকাতায় পৌঁছিলাম, মিরবহরের ঘাটে আমাদের নৌকা নোঙ্গর করা হইল। মির্জ্জা সাহেব নবাববাহাদুরের আবেদন পত্র ও উপহার সহ কেল্লার ডিরেক্‌টারদের নিকট গমন করিলেন। আমি কলিকাতা কখন দেখি নাই, কাজেই সহর দেখিবার জন্য আমিও নৌকা হইতে নামিলাম।

অজানিত স্থানে কোথায় যে যাই, তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই, পথঘাট চিনি নাই, কাজেই আমি গঙ্গাতীরের রাস্তা ধরিয়া বরাবর দক্ষিণদিকে চলিলাম।

বেলা তখন ন’টার অধিক হবে না, কাজেই রাস্তায় বেশ ভিড় হইয়াছে, ধুতি চাপকানে শোভিত পরামাণিকদের ন্যায় হাতে গড়া পাগড়ি মাথায় শত শত বাবু ব্যতিব্যস্তভাবে কৰ্ম্মে যাচ্ছে, মোট মাথায় মুটেরা হৈ হৈ করতে করতে ছুটেছে, মাঝে মাঝে বোঝাই পূর্ণ গরুর গাড়ী গুরু-গম্ভীরচালে অগ্রসর হ’চ্ছে, দড়ির লাগামে শোভিত, ঘিয়ে ভাজা গোছের দুর্ব্বল অশ্বদ্বয়যোজিত ছক্করেরা ধুলা উড়াইয়া ও হেট হেট রব উত্থিত করিয়া চলিতেছে। ফলতঃ ঈদৃশ জনতাপূর্ণ রাজপথ আমি পূর্ব্বে কোথায় দেখি নাই, কাজেই বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে চারিদিক দেখিতে দেখিতে মৃঢ়পদবিক্ষেপে অগ্রসর হইতে লাগিলাম।

খানিক দূর গিয়া আমি একটা স্নানের ঘাটের নিকট উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম যে সহস্র সহস্র নরনারী তথায় স্নান করিতেছে। তীরের উপর বড় বড় গোলপাতার ছাতা পুতিয়া উড়ে বামুনেরা ঠাকুরের চরণামৃত ও চন্দনাদি নিয়ে ব’সে আছে। অনেক নরপ্রেত ও ডাকিনীরা গঙ্গাস্নানে গত রাত্রির সমস্ত পাপ ধুয়ে ফেলে, সর্ব্বাঙ্গে চন্দনের ছাপ মেরে একেবারে তুলসীবনের কেঁদোবাঘ সেজে, ধর্ম্মের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ঘরমুখো হ’তেছে। তবে পতিতপাবনী সুরধনীর দুর্দ্দশা দেখিয়া আমার প্রাণে বড় কষ্ট হইল। কারণ প্রায় প্রত্যেক স্নানার্থী নাকে কাপড় দিয়া গরু কি মানুষের শব ও বিষ্ঠারাশি সরাইয়া অতি কষ্টে ডুব দিতেছে। অনেকেই তীরে উঠিয়াও আবার স্নান করিতে বাধ্য হইতেছে।

আমি ঘাটের উপর দাঁড়াইয়া এই সকল দেখিতেছি, এমন সময় গামছা মাথায় স্নানার্থে একটি ভদ্রলোক আমার নয়নগোচর হইল। আমি তাহাকে চিনিতে পারিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে লক্ষ্য না ক’রে গঙ্গায় নেমে গেলেন।

তাহাকে দেখিয়া বিপুল কৌতূহলে আমার হৃদয় পরিপূর্ণ হইল, আমি এই ভদ্রলোকের সঙ্গে দুই একটি কথা কহিবার জন্য সেইখানে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।

স্নান করিয়া তিনি যেমন বাড়ীর দিকে ফিরিবেন, অমনি আমি তাঁহার সম্মুখে গিয়া একেবারে কহিলাম, “নীলমণিবাবু, ভাল আছেন তো?”

লোকটী উদাসভাবে অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে চাহিয়া ক্ষীণস্বরে কহিলেন, “কই মহাশয়, আপনা’কে আমি তো চিনি না, আমার যে এই নাম, তাহা আপনাকে কে বলিল?”

আমি ঈষৎ হাস্যে কহিলাম, “আমি আপনাকে বিশেষভাবে চিনি, আপনিও আমাকে দেখিয়াছেন, তবে তখন মহাশয়ের কিঞ্চিৎ মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটিয়াছিল ব’লে, আপনার স্মরণ হইতেছে না। আমি পূৰ্ব্বে আজিমগঞ্জে মাণিকলাল সরকারের বাটীতে ছিলাম।”

আমার এই কথা শুনিয়া নীলমণিবাবু অনেকটা ভীতভাবে কহিলেন, “বলি এখনো কি সাধ মিটে নাই, তাই আবার বিপদে ফেলার জন্য এতদূরেও অনুসরণ ক’রেছেন?”

আমি লজ্জিত ভাবে কহিলাম, “আপনি জগতে পাষণ্ডদের নিকট যেরূপ ভাবে নির্য্যাতন সহ্য করিয়াছেন, তাহাতে আপনার মনে এ প্রকার সন্দেহ হইতে পারে; কিন্তু আমাকে আপনি একজন অকপট বন্ধু বলিয়া জ্ঞান করিবেন। মীরঘাটার ব্রহ্মচারী মহাশয় এক রকম আমার গুরুদেব, আমি তাহার প্রমুখাৎ আপনার সম্বন্ধের সকল কথা শুনিয়াছি। বোধ হয় আপনি জানেন না যে, পাপী মাণিকলালের পাপার্জ্জিত সেই ভিটায় এখন ঘুঘু চরিতেছে, তাহার পুত্ত্রবধূ সর্ব্বস্ব লইয়া একটা খানসামার সঙ্গে কোথায় পলায়ন ক’রেছে, তারপর যা কিছু ছিল, ডাকাতে লুটে নিয়ে গেছে, কাজেই তাহার পুত্ত্র মোহিতবাবু এখন একেবারে পথের ভিখারী হইয়া পড়িয়াছেন। পাপকার্য্যের পরিণাম সর্ব্বত্র এইরূপই হইয়া থাকে, আর আপনি ধৰ্ম্মপথে অবস্থান ক’রেছিলেন বলে শেষকালে সুখ সূর্য্যের উদয় হ’লো; কিছুতেই পাপাত্মাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হ’লো না। যাই হোক্‌ আজ আপনাকে দেখিয়া আমি নিতান্ত প্রীত হ’লাম। ব্রহ্মচারী মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছিলাম যে, তিনি তাঁহার এক শিষ্যকে একখানি পত্র লিখিয়া আপনাকে কলিকাতায় পাঠাইয়াছেন, তিনি নাকি আপনার প্রতিপালনের ভার গ্রহণ করিবেন।”

নীলমণিবাবু আমার এই সকল কথা অনেকটা আশ্বস্ত হ’য়ে কহিলেন, “সেই মহাত্মা চিরদিনের জন্য আমার দুঃখ মোচন করিয়া দিয়াছেন। আমি জীবনের মধ্যে ও প্রকার মুক্তহস্ত দাতা কদাচ দেখি নাই। বিপন্নের বিপদ‌্দুদ্ধার সেই বদান্যবর মহাত্মার পুণ্যমন্ত্র জীবনের একমাত্র কর্ত্তব্যের মধ্যে পরিগণিত। প্রত্যহ শত শত অত্যক্ত ব্যক্তি তাঁহার ঠাকুরবাড়ীতে পরিতোষে আহার ক’রে থাকে। ইহা ব্যতীত আমার ন্যায় কত অভাগা তাঁহাকে আশ্রয় ক’রে পরমসুখে দিতপাত করছে। দয়ারসাগর ব্রহ্মচারী মহাশয় আমাকে একেবারে কল্পতরু দেখাইয়া দিয়াছেন। তিনি আমাকে দুই শত টাকা পুঁজি দিয়া হাটখোলায় একটী আড়ত ক’রে দিয়াছেন। ঈশ্বরেচ্ছায় ইহার মধ্যে কারবারে উন্নতি হ’য়েছে। ফলতঃ সেই সব মহাত্মার পুণ্যফলে এখনও ধরণী ধ্বংস দশায় উপনীত হয় নাই। আমি এরূপ পরদুঃখকাতর উদারহৃদয় মহাত্মা কখন চক্ষে দেখি নাই।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে মহাত্মার নাম কি?”

নীলমণিবাবু উত্তর করিলেন, “তাঁহার নাম গৌরিনাথ সেন। এই সহরের মধ্যে তিনি একজন বিখ্যাত দাতা বলিয়া পরিচিত। শত শত দেনদারকে টাকা দিয়ে জেল হ’তে মুক্ত ক’রে দিয়েছেন। তাঁহার নিকট কেহ কখন কোন প্রার্থনা ক’রে বিমুখ হয় নাই। আমার নিকট আগাগোড়া আমার দগ্ধভাগ্যের কথা শুনিয়া তিনি কাঁদিয়াই আকুল হইলেন, আমাকে আর কোন কথা বলিতে হইল না। আমি এক্ষণে আহিরীটোলায় একটা বাসা ভাড়া করিয়া পরিবার লইয়া বাস করিতেছি। বদান্যবর সেনজা মহাশয় চিরদিনের জন্য আমার দারিদ্রতা মোচন করিয়া দিয়াছেন। বোধ হয় ব্রহ্মচারী মহাশয়ের সহিত এই মহাত্মার পূর্ব্ব হ’তে জানা শোনা ছিল। একমাত্র ব্রহ্মচারী মহাশয়ের কৃপায় আমি এই সুখ ও উন্নতির মুখ দেখিতে পাইয়াছি। তিনিই আমার অভাগিনী পত্নীর জাতিকুল বাঁচাইয়া জীবিতা রাখিয়াছিলেন, কাজেই, আমার মস্তক সেই মহাপুরুষের নিকট চিরদিনের জন্য বিক্রিত হ’য়ে আছে। আপনি যখন সেই মহাত্মার শিষ্য, তখন আপনি আমার সহোদর ভ্রাতার ন্যায় আত্মীয়। পূর্ব্বে না জানিয়া মহাশয়ের সঙ্গে অনেক কুব্যবহার করিয়াছিলাম, তাহার জন্য এক্ষণে ক্ষমা ভিক্ষা করিতেছি।”

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “ঘরপোড়া গরু সিঁন্দুরে মেঘ দেখলেই ভয় পেয়ে থাকে। আপনি জগতের পাষণ্ডদের নিকট হ’তে যে প্রকার নিপীড়িত হ’য়েছেন, তাতে এ প্রকার সন্দেহ মনে উদয় হওয়াই স্বাভাবিক। বড় রাগেই আপনি মহাপাপী মাণিকলালকে খুন ক’রেছিলেন, বোধ হয় বিধাতা একাজে মহাশয়ের সহায় ছিলেন, কারণ তা না হ’লে আপনার তুল্য নিঃসহায় ব্যক্তির দ্বারায় এরূপ দুরূহ কাজ সম্পন্ন করা কঠিন হইত। যাই হোক্ আ’র পূর্ব্ব কথা স্মরণ ক’রে মনকে ক্লিষ্ট করবার আবশ্যক নাই; পরমেশ্বর আপনার প্রতি যে মুখ তুলে চেয়েছেন, ইহাই সমধিক আনন্দের বিষয়।”

নীলমণিবাবু আমাকে এখানে আসিবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন আমি সংক্ষেপে তাঁহাকে মির্জ্জা সাহেবের সঙ্গে আসিবার প্রকৃত উদ্দেশ্য বর্ণনা করিলাম, কিন্তু আমার সম্বন্ধের কোন গুপ্তকথা তখন তাহাকে কিছুমাত্র বলিলাম না।

নীলমণিবাবু তাহার বাসায় আমাকে লইয়া যাইবার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করলেন, আমিও তাহাতে সম্মত হলাম, কেন না সেই পরদুঃখকাতর বদান্যবর মহাত্মাকে দেখিবার সাধ আমার মনমধ্যে উদয় হ’য়েছিল।

আমি বসাকমহাশয়ের সঙ্গে খানিকটা আসিয়া পূর্ব্বদিকের একটা অল্প প্রশস্ত রাস্তা দিয়া যাইতে লাগিলাম এবং খানিকদূর আসিয়া বসাকমহাশয়ের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

নীলমণিবাবু মাসিক সাত টাকা ভাড়ায় একটী ছোট একতলা বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলেন এবং একটী ঝি রাখিয়া পত্নীসহ তথায় পরমসুখে বাস করিতেছেন।

আমাকে তিনি যথেষ্ট আদর যত্ন করিলেন ও রসুই করিবার উদ্‌যোগ করিয়া দিলেন। আমি স্বপাকে রন্ধন করিয়া আহার করিলাম ও বাসকমহাশয়ের বাহিরের ঘরে বিশ্রাম করিতে লাগিলাম।

বৈকালে নীলমণিবাবু আমাকে সঙ্গে করিয়া সেনজা মহাশয়ের বাটীতে লইয়া গেলেন। তিনি আমাকে দেখিয়াই নীলমণিবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ ভদ্র সন্তানটি কে, কোনরূপ বিপদে পড়িয়া কি এখানে আসিয়াছেন?”

নীলমণিবাবু উত্তর করিলেন, “ইনি নবাব সরকারে চাকুরী করিয়া থাকেন, কেবল মহাশয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার জন্য আসিয়াছেন।”

সেনজামহাশয় আমাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “বাবা, আমি অতি অধন, আমাকে আর কি দেখিবে? বরং দেখা দিয়ে আমাকে বিশেষরূপে অনুগৃহীত করলে।”

আমি তাঁহার শিষ্টাচারে নিতান্ত পরিতুষ্ট হ’লাম, দেখিলাম তাঁহার বিমল অন্তরে গর্ব্বের লেশমাত্র নাই, সেইজন্য অপরের কোনপ্রকার দুঃখ দেখিলে, সহজে তাঁহার নয়নে অশ্রুধারা বিগলিত হ’য়ে থাকে। ফলতঃ যাহার হৃদিহ্রদ হ’তে দয়ার উৎস উৎসারিত হ’য়ে সমগ্র সংসারকে প্লাবিত করে, এই পাপতাপময় সংসারে তিনিই যথার্থ ঈশ্বরের স্বরূপ, মানবজন্ম ধারণ তাহারি পক্ষে সার্থক হ’য়ে থাকে। এই মহাত্মা সেনজামহাশয় নিশ্চয় এইরূপ ধাতুর লোক। অতি শুভক্ষণে এই সংসারে প্রবেশ ক’রেছেন। যদি সৎকার্য্যের পুরস্কার থাকে, তাহ’লে কখনই এই মহাত্মাকে আর কঠোর জঠর যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না।

বেলা আন্দাজ পাঁচটার সময় আমি সেই মহাত্মার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম, বসাকমহাশয় খানিকদূর সঙ্গে এলেন, যদি থাকা হয়, তাহ’লে পুনরায় কল্য সাক্ষাৎ করিব, এই কথা ব’লে তাঁহাকেও বিদায় দিলাম এবং নৌকায় আসিবার জন্য পশ্চিমমুখে চলিলাম।

আমি সবেমাত্র দু’চার পা অগ্রসর হ’য়েছি, অমনি মির্জ্জা সাহেবের একজন আর্দালির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হইল। সেই লোকটা আমাকে দেখিয়াই কহিল, “খাঁসাহেব আপনাকে খুঁজিবার জন্য চারিদিকে লোক পাঠিয়েছেন, কারণ আজ রাত্রের জোয়ারে নৌকা ছেড়ে যেতে হবে।”

আমি এই কথা শুনে অনেকটা বিস্মিত হ’লাম, কারণ এত শীঘ্র যে আমাদের কলিকাতা ত্যাগ করতে হবে, তাহা কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই। আমি আর সেই লোকটাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না ক’রে দ্রুত পদ সঞ্চারে ঘাটের দিকে অগ্রসর হ’লাম।

আমি গিয়াই দেখি, প্রস্থানের উদ্‌যোগের ধূম পড়িয়া গিয়াছে। সকলেই পুনর্যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। আমাকে দেখিয়াই সকলে আনন্দিত হইল এবং তখনি বিগল বাজাইয়া স্বপক্ষীয় লোকেদের আহ্বান করিল।

আমি বরাবর মির্জ্জা সাহেবের কামরায় গেলাম ও এত শীঘ্র প্রস্থানের কারণ কি তাহা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিলাম।

মির্জ্জা সাহেব কহিলেন, “আর এখানে বিলম্ব করা নিরর্থক, এখন যত শীঘ্র মুঙ্গেরে নবাব বাহাদুরের সঙ্গে মিলিত হ’তে পারি, তাহাই আমাদের পক্ষে কর্ত্তব্য। তুমি আমার নিকট বসে সব কথা শুন। তাহ’লে স্পষ্ট বুঝতে পারবে যে, কেন আমি আজ এখন যেতে প্রস্তুত হ’য়েছি। এখন তুমি কোথার সমস্ত দিনটা ছিলে, তাহা আমাকে বল, আমি তোমার জন্য বিশেষ উৎকণ্ঠিত হ’য়েছিলাম।”

আমি আগাগোড়া সমস্ত সত্যকথা বলিলাম, মির্জ্জা সাহেব নিতান্ত বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “কি আশ্চর্য্য বাঙ্গালীর মধ্যে এমন কল্পতরু বিশেষ দাতা আছে! নিঃস্বার্থভাবে এককালীন দুই হাজার টাকা দান, একজন গৃহীর পক্ষে বড় সহজ কথা নহে। আহা তেমন মহাপুরুষকে দেখিলেও পুণ্য আছে, যাহা হউক তুমি সাধু দর্শন করিয়া কৃতাৰ্থ হইয়াছ। এক্ষণে এত শীঘ্র এখান হইতে যাইবার কারণ যে কি সন্ধ্যার পর তোমাকে বলিব, এখন প্রস্থানের উদ্‌যোগ করা যাক্‌।”

মির্জ্জা সাহেব এই কথা বলিয়া বাহিরে গেলেন এবং জোয়ারের মুখে নৌকা খুলিতে মাঝিদের আজ্ঞা দিলেন।