- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
নবাব বাহাদুর।
বাটীতে আসিয়াই চাকরদের মুখে শুনিলাম যে, দাওয়ানজি মহাশয় আমাকে খুঁজিয়াছেন ও আমার জন্য বৈঠকখানায় অপেক্ষা করিতেছেন, কাজেই আর ক্ষণবিলম্ব না করিয়া কর্ত্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার জন্য বৈঠকখানার দিকে অগ্রসর হইলাম।
আমাকে দেখিয়াই দাওয়ানজি মহাশয় হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “আমি তোমার চাকরীর কথা নবাব বাহাদুরকে বলিয়াছি, তিনি তোমাকে একবার দেখিতে চাহিয়াছেন, সুতরাং কল্য প্রভাতে তোমাকে নবাব বাহাদুরের হুজুরে হাজির করিয়া দিব।”
দাওয়ানজি মহাশয় এই কথা বলিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, আমি আমার চিরস্থায়ী চিন্তাদেবীর সঙ্গে সেই কক্ষেই বসিয়া রহিলাম।
কত অভিনব আশা, কত উৎকট বাসনা আমার অন্তরার্ণবে ভাসিয়া বেড়াইতে লাগিল। কল্পনাপ্রসূত কত সুখময় ছবি হৃদয়দর্পণে দেখা দিল, কাজেই সে রাত্রে আমার আদৌ সুনিদ্রা হইল না, কেমন একপ্রকার উদ্বেগে সেই রজনী অতিবাহিত হইল।
পরদিন বেলা প্রায় আটটার সময় দরবারি বেশ ভূষায় ভূষিত হ’য়ে, দাওয়ানজি মহাশয়ের সঙ্গে নবাববাড়ী উদ্দেশে যাত্রা করিলাম। আমাদের গাড়ী পৌঁছিবামাত্র সেলামের ধূম পড়িয়া গেল, দাওয়ানজি মহাশয় নিজের পদমর্য্যাদায় উপযুক্ত গম্ভীরভাবে প্রাসাদ মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন, আমিও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম।
দিল্লীর অনুকরণে কৈসয়বাগ নামক প্রাসাদে নবাবসাহেব ছিলেন; দাওয়ানজি মহাশয় আমাকে লইয়া সেই কক্ষে প্রবেশ করিলেন।
আমি দেখিলাম যে, সেই কক্ষটি বেশ প্রশস্ত ও উৎকৃষ্ট মারবেল পাথরে মণ্ডিত, তবে তাহাতে কোন বিশেষ্য আসবাবের পরিপাট্য ছিল না। কেবল মধ্যস্থলে মখমলের গদি-আঁটা সোফার উপর নবাব সাহেব বসিয়াছিলেন ও তাহার সম্মুখে আরো কয়েকখানি চেয়ার পাতা ছিল। ইহা ব্যতীত সোফার পাশে একটী সোণার পিক্দানী ও মার্বেলের একটী ছোট টেপায়ার উপর অশেষ কারুকার্য্য সম্পন্ন উড়িষ্যার প্রবীণ শিল্পীর রূপার কল্কে যুক্ত একটী গুড়গুড়ী ভিন্ন তথায় আর কোন বস্তু ছিল না।
নবাবসাহেবের বয়স ৩০/৩২ বৎসরের অধিক হইবে না, কাজেই যৌবনের ভীম তরঙ্গে তাঁহার সর্ব্বাঙ্গের সম্যক্ উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছে এবং স্বাস্থ্যের পূর্ণ লক্ষণ সকল বৰ্ত্তমান আছে।
নবাবসাহেবের বর্ণ বেদানার দানার অনুরূপ, চক্ষুদ্বয় আকর্ণবিস্তৃত সমুজ্জ্বল তেজপূর্ণ ও উৎসাহ ব্যঞ্জক, ললাটদেশ প্রশস্ত ও মধ্যস্থলে রাজদণ্ড চিহ্ন স্বরূপ বিখ্যাত শিরা প্রকটিত রহিয়াছে। প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর ভ্রমর বসিলে যেরূপ বাহার খোলে, সেইরূপ ভ্রমরকৃষ্ণ নবীন গোফরাজীতে তাঁহার শ্রীমুখের সৌন্দর্য্য শতগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে।
নবাব বাহাদুরের আকার অনতি দীর্ঘ, বক্ষঃস্থল বিশাল ও বীরের লক্ষণ স্বরূপ সুদৃঢ় বাহুযুগল অজানুলম্বিত ছিল। ফলতঃ তাঁহার জ্ঞানগর্ব্বিত বদনমণ্ডলের প্রশান্তভাব ও গাম্ভীর্য্য সন্দর্শন করলে তাঁহাকে বিশেষ কোন প্রতিভাবান পুরুষ ব’লে বোধ হ’য়ে থাকে।
তবে নবাব বাহাদুরের পোষাকের কিছুমাত্র পরিপাট্য ছিল না, সাধারণ মুসলমান ভদ্রলোকের ন্যায় সাদা কাপড়ের একটা পাজামা পরিধান করিয়াছেন এবং গায়ে খুব পাতলা লিনুর আলখেল্লা শোভা পাইতেছে। কাজেই অন্য সময় অন্য স্থানে তাঁহাকে দেখিলে নবাববাহাদুর ব’লে চিনিবার কোন উপায় ছিল না। তবে তাঁহার ললাটদেশ কুঞ্চিত ও চিন্তারেখায় পরিপূর্ণ ছিল, দেখিলেই বোধ হয় তাঁহার অন্তরাকাশ নিৰ্ম্মল নহে, নিশ্চয় চিত্তকুসুমে কোন বিষম চিন্তাকীট প্রবেশ করিয়াছে।
দাওয়ানজি মহাশয়ের উপদেশমত দ্বারের কাছ হতে আমরা কেতামত কুর্ণিস করতে করতে প্রবেশ করিলাম। নবাব বাহাদুরের চমক ভাঙ্গিল। তিনি খাতির ক’রে দাওয়ানজি মহাশয়কে সম্মুখের একখানি কেদারার উপর উপবেশন করাইলেন, আমি তাঁহার পাশে দাঁড়াইয়া রহিলাম।
শিষ্টাচারের পাশা শেষ হ’লে দাওয়ানজি মহাশয় কহিলেন, “এই ছোকরার কথা হুজুরকে ব’লেছিলাম, এক্ষণে ইহার প্রতি হুজুরের যাহা হুকুম হয়।”
নবাব বাহাদুর ঈষৎ নম্রস্বরে কহিলেন, “হাঁ, রসদবিভাগের দারোগার সহকারীর পদ ইহাকে প্রদান করিলাম, কিন্তু ইহাকেও শীঘ্র মুঙ্গেরে যাত্রা করিতে হইবে। কারণ আমি বেশ বুঝিয়াছি যে, ইংরাজদের একটু চ’খের আড়ালে না গেলে আমার কোন কাজের তেমন সুবিধা হবে না।
দাওয়ানজি মহাশয় একটী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “তাহ’লে নিশ্চয় রাজধানী পরিত্যাগ করবেন? ”
নবাব। তার আর সন্দেহ আছে, কারণ আপাততঃ ইহা ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। আমি মানুষ হ’য়ে কখনই কাঠের পুতুলের ন্যায় মসনদে সমাসীন থাকিব না। রাজা হ’য়ে যখন রাজক্ষমতা সঞ্চালনে অপারগ হ’লাম, অত্যাচারীগণের কবল হ’তে নিরীহ দুর্ব্বলকে রক্ষা করতে পারলাম না, জাতিধর্ম্ম নির্ব্বিশেষে ন্যায় বিচার বিতরণে অক্ষম হ’লাম, তখন যাত্রার সংয়ের ন্যায় এই সুবেদারি সাজে সজ্জিত থাকাই বিড়ম্বনার আতিশয্য। আমি এভাবে এই উচ্চপদের অবমাননা করতে ইচ্ছা করি না। ধৰ্ম্মতঃ দিল্লীর বাদসাহ আমার প্রভু, কিন্তু কালবশে সেই বাদসা এক্ষণে সিংহাসন হারাইয়া ভিক্ষুকবেশে ভ্রমণ করছেন। সুতরাং বাঙ্গালা বিহার উড়িষ্যা সুবাদারের স্বাধীন রাজ্য, আমি রাজসিংহাসনে ব’সে যদি রাজ কর্ত্তব্য পালনে পরান্মুখ হই, অত্যচারীকে দণ্ড দিতে না পারি, প্রজারঞ্জনে অক্ষম হই, তাহ’লে সুবাদার নাম গ্রহণে প্রয়োজন কি? আমার অকর্ম্মণ্য শ্বশুর তাঁদের স্পর্দ্ধা বাড়িয়ে দিয়েছেন, সেই জন্য তাঁরা দেশের শাসনকর্ত্তাকে আর গ্রাহ্যের মধ্যে আনছেন না। বন্ধনশূন্য বলদের ন্যায় উদ্দামগতিতে ভ্রমণ করছেন এবং আমার পতন কিরূপে হয় তাহার চেষ্টায় আছেন। তাদের এই সকল অমানুষিক অত্যাচার হ’তে আমাকে যদি রক্ষা করতে না পারি, তাহ’লে আমার এই সুবেদারি পদ গ্রহণ করাই নিরর্থক। আরও দেখ বাদসা সাজাহানের আমল হইতে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বিনা শুল্কে ব্যবসা করবার অধিকার পাইয়াছে, কিন্তু এখন তাহা চলিবে না, কেন না রাজকোষে অর্থের অভাব, তাহা সংগ্রহ করিতে হইলে কিছু কিছু বাণিজ্য শুল্ক গ্রহণ করিতেই হইবে, বিশেষতঃ যখন ইংরাজ কোম্পানীরা বাণিজ্যের যথেষ্ট প্রসার করিয়া লাভবান হইতেছেন,তখন কেন শুল্ক দিবেন না, পূর্ব্বের নিয়ম দেখাইলে এখন আর তাঁহাদের চলিবে না, কারণ তখন দেশ খুব সুখের ছিল, আর এখন যতদূর দুঃখের হইতে হয় তাহাই হইয়াছে। আমি এই দুঃসময়ে প্রজাদের অর্থ যতদূর শোষণ করিতে পারি বা না পারি ইংরাজ কোম্পানীর নিকট হইতে কিছু লইবই লইব, বিশেষতঃ এক্ষণে যখন তারা লাভবান হইতেছেন।
এখন দেখছি কোম্পানীর অনেক কর্ম্মচারী গোপনে নিজেরা ব্যবসা চালাচ্ছে, অধিকন্তু কোম্পানীর নিশান তুলিয়া স্বচ্ছন্দে বিনা মাশুলে মাল নিয়ে আসছে। আমি বিশেষরূপে জেনেও তাদের এই প্রবঞ্চনার কোন প্রতিকার করতে পারছি না, সেইজন্য আমি মনস্থ করেছি যে, মাল আমদানীর মাশুল কিছু কিছু লইবই লইব।
এরূপ কার্য্য করিলে ইংরাজদের সঙ্গে আমার যে, বিবাদ উপস্থিত হইবে তাহা আমি জানি, সেইজন্য আমি পূর্ব্ব হ’তেই মুঙ্গেরে গিয়া প্রস্তুত হইব এবং বল সংগ্রহ করিব।”
দাওয়ানজি মহাশয় একটী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “জাহাপনা, প্রাতঃস্মরণীয় মহামতি আলাবর্দিখাঁর পরেই আপনি যদি সুবেদারের মসনদে বসিতেন, তাহ’লে মুসলমানের রাজলক্ষ্মী চিরকাল অচলাভাবে অবস্থান করিতেন; কিন্তু এক্ষণে আর উপায় নাই। কারণ তাঁহারা অনেকটা শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছেন, সুতরাং এ অবস্থায় তাঁহাদের নিরস্ত করা কখনই সহজসাধ্য হইবে না। বিশেষতঃ আপনার শ্বশুরের দুর্ব্বলতায় তাঁরা এতদূর এগিয়ে পড়েছেন। তিনি অপরিণামদর্শী বলিয়া এতদূর ঘটিয়াছে, এক্ষণে আপনি চেষ্টা করিলে যে কিছু করিতে পারিবেন তাহা আমার বিশ্বাস হয় না।
নবাববাহাদুর ঈষৎ উত্তেজিতভাবে কহিলেন, “হাঁ, প্রভুদ্রোহী দুরাশা বাতিকগ্রস্ত ঘোরকৃতঘ্ন আমার সেই মূর্খ শ্বশুরের সুদারুণ পাপের উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করিতে হবে। ষড়যন্ত্রকারী বাঙ্গালীদের আমি ততো দোষী বোধ করি না, কারণ পশুপ্রকৃতি নীচ-আমোদপ্রিয় সিরাজদ্দৌলার অত্যাচারে জর্জ্জরিত হ’য়ে তারা সেই কুটিল-পথের পথিক হ’য়েছিলেন। তবে তাদের দূরদর্শীর কি বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করতে পারি না; কারণ চার পাঁচশ বৎসর যাদের সঙ্গে বসবাস ক’রেছে, যাদের আচার ব্যবহার বিশেষরূপে জানা আছে, তাদের ত্যাগ ক’রে অজ্ঞাতকুলশীল সম্পূর্ণ বিদেশীদের এতদূর বিশ্বাস করা ভাল হয় নাই। যাই হোক আমার শ্বশুর যে স্বধর্ম্মী প্রতিপালক প্রভুকে বঞ্চনা ক’রে একপ্রকার রাজলক্ষ্মীকে তাড়াইয়া দিয়াছে, তাহার জন্য অনন্তকাল তাহার নাম সকলের কণ্ঠে ঘৃণার সহিত উচ্চারিত হবে। ইংরাজেরা আমার রাজ্যপ্রাপ্তি সম্বন্ধে অনেকটা সহায়তা করিয়াছে সত্য, কিন্তু তাহাতে আমার সুবিধা যে কি তাহা ত বুঝিতে পারিতেছি না, বরং আর্থিক অনেক অসুবিধাতেই পড়িতেছি। আহুতি পেলে অগ্নি যেমন প্রবল হ’য়ে থাকে, তেমনি তাদের বাণিজ্যের আশাও দিন দিন বৰ্দ্ধিত হ’চ্ছে এবং তজ্জন্য দেশের অর্থের শোষণ হইতেছে। আমি দেশের শাসনকর্ত্তা হ’য়ে কি জন্য বণিকদের ঈদৃশ আনুগত্য স্বীকার করবো? আমার করে রাজদণ্ড থাকতে কেন না অত্যাচারীদের উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করবো? সিংহাসন লাভ ক’রে যদি প্রকৃত রাজক্ষমতা সঞ্চালন করতে না পাই, তাহ’লে অমন ভোয়া রাজ্যপদ আমি চাহি না। আমি এমন কাপুরুষ নই যে, এতদূর হীনতা স্বীকার করবো। আমি বরং শুষ্ক কাষ্ঠ খণ্ডের ন্যায় ভগ্ন হইব, কিন্তু তথাপি লতিকার ন্যায় কাহার পদানত হইব না। সমস্ত বাধা বিঘ্নকে অগ্রাহ্য ক’রে জীবনের শেষ মূহূর্ত্ত পর্য্যন্ত নিজের প্রতিজ্ঞা-পথে বিচরণ করবো।
দাওয়ানজি মহাশয় গম্ভীরভাবে উত্তর করিলেন, “ধর্ম্মাবতার! এ প্রকার বীরোচিত বাক্য আপনার মুখেই শোভা পায়, কিন্তু এ সাধনার সিদ্ধিলাভ যে কতদিন পরে হবে, তাহা ভবিষ্যতের অন্ধকার গর্ভে নিহিত।”
নবাব বাহাদুর কহিলেন, “দাওয়ানজি! আমি সিদ্ধিলাভ কি জয় পরাজয়ের দিকে আদৌ লক্ষ্য না ক’রে কর্ত্তব্য পালনের জন্য নশ্বর জীবনকে উৎসর্গ করবো। কারণ এরূপভাবে অবস্থান করা আমার পক্ষে নিতান্ত কষ্টকর ও অপমানজনক হ’য়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে সঙ্কট-পথের পথিক হ’তে মনস্থ ক’রেছি, তাহা যদিও নিতান্ত বিপজ্জনক, কিন্তু আমার মতে আপাততঃ ইহা ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। কারণ সামদান অবলম্বনে ইষ্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানীকে আর নিরস্ত করা নিতান্ত অসম্ভব; কাজেই এখন দণ্ডনীতি গ্রহণ ভিন্ন আর কোন উপায়ান্তর নাই। আমি এই তিন সুবার প্রধান প্রধান রাজা ও জমিদারদের নিকট সাহায্যপ্রার্থী হ’য়ে পত্র লিখেছি এবং মুঙ্গেরের কেল্লা রীতিমত মেরামত করতে আজ্ঞা দিয়াছি। ইংরাজদের নজরের বাহিরে সেই মুঙ্গেরে গিয়া রীতিমত বল সংগ্রহ করবো এবং সৈন্যদের ইউরোপীয় প্রণালীতে শিক্ষিত করিয়া প্রস্তুত হইয়া থাকিব। কারণ আমি মনে মনে বেশ বুঝিয়াছি যে, আমাদের সম্মান রক্ষার জন্য প্রস্তুত হ’য়ে থাকা কৰ্ত্তব্য। কেমন, আমার এই অভিপ্রায় তুমি কি সঙ্গত ব’লে বোধ কর না?”
দাওয়ানজি মহাশর কহিলেন, “জাহাপনা! আমি সর্ব্বান্তকরণে আপনার এই অভিমত সমর্থন করছি। কারণ উপস্থিত ক্ষেত্রে ইহা ভিন্ন আর কোন উপায় নাই। প্রবল বিকারে সর্প-বিষই একমাত্র মহৌষধ। তবে জোয়ার ভাঁটা, উত্থান পতন, সেই লীলাময় বিধাতার ইচ্ছার উপর নির্ভর, সেইজন্য ভয় হয় যে, না জানি ইহার পরিণাম ফল কিরূপ দাঁড়াইবে।”
নবাববাহাদুর উত্তর করিলেন, “পরিণাম ভাবিবার তত আবশ্যক বা অবসর আমার নাই। বর্ত্তমানে যাহা কৰ্ত্তব্য, আমি কেবল তাহা প্রতিপালনের জন্য প্রাণপণ করবো। এই সংসারে মানুষ মাত্রই মৃত্যুর অধীন, কালের পরাক্রমকে ব্যর্থ করবার যখন কাহার ক্ষমতা নাই, তখন কি জন্য তুচ্ছ জীবনের মায়ায় কাতর হ’য়ে কর্ত্তব্য পথ হ’তে বিচলিত হব? যে মূর্খ ভাগ্যের উপর নির্ভর ক’রে নিশ্চেষ্টতা অবলম্বন ক’রে, পণ্ডিতেরা তাকে কাপুরুষ ব’লে নিন্দা ক’রে থাকেন। উদ্যোগী সৎপুরুষেরা অধ্যবসায়ের প্রভাবে অনেক সময়ে অসাধ্য সাধনে সমর্থ হ’য়ে থাকেন। হৃদয়ের একাগ্রতা না থাকলে, জীবনকে তুচ্ছ না ভাবলে সংসারক্ষেত্রে কেহই কীৰ্ত্তি-বৃক্ষ রোপণ করতে পারে না। মৃত্যুর পর যাহার নাম লোকের স্মৃতিমন্দিরে বিগ্রহরূপে বিরাজ করে, তাহারি ভবে আসা সার্থক। সেইজন্য আমি এই বীরব্রত গ্রহণ ক’রেছি, যতক্ষণ আমার দেহে এক বিন্দু রক্ত থাকবে, ততক্ষণ পর্য্যন্ত আমি আমার কার্য্যোদ্ধারের জন্য চেষ্টা করবো।
দাওয়ানজি মহাশয় বেশ গম্ভীরভাবে কহিলেন, “ধর্ম্মাবতার আপনি যে ভয়াবহ সঙ্কট পথের পথিক হ’তে মনস্থ ক’রেছেন, যথার্থ বীরপুরুষদের তাহাই একমাত্র গন্তব্য সুপথ, জগতে বিমল যশ লাভের ইহাই প্রকৃষ্ট উপায়। তবে রাজনীতি-বিশারদেরা নিজের অবস্থা ও বলাবল অগ্রে বিশেষরূপে পর্য্যালোচনা ক’রে তবে কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হ’য়ে থাকেন। সহসা কোন হটকারিতার পরিচয় দেন না।”
দাওয়ানজি মহাশয়ের কথায় বাধা দিয়ে নবাববাহাদুর কহিলেন, “রায়জি! তোমার কথার মর্ম্ম আমি বুঝেছি। তুমি আমা অপেক্ষা ইংরাজদের অধিক বলশালী বলিয়া বোধ কর, তাই তোমার অন্তরে ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে। আমি বেশ বুঝেছি যে, সমগ্র হিন্দুস্থান ইংরাজদের করতলগত হবে, কেহই তাহাদের উন্নতির-স্রোতকে রোধ করতে পারবে না, কিন্তু তথাপি আমি আমার কর্ত্তব্য পথ হ’তে কিছুতেই বিন্দুমাত্র বিচলিত হব না। নশ্বর জীবনের বিনিময়ে সৎপুরুষ মাত্রের স্পৃহনীয় অবিনশ্বর যশ ও গৌরবলাভ করতে বিশেষরূপে চেষ্টিত হবো। ইংরাজদের অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষী হ’য়ে গৌরবময় সুবেদারি পদের অপমান করতে ইচ্ছা করি না। কারণ তাহ’লে সকলেই আমাকে নিতান্ত কাপুরুষ বলে নিন্দা করবে। সেইজন্য দীপ্ত দীপ-শিখায় পতঙ্গবৃত্তি অবলম্বন করতে মনস্থ ক’রেছি। আমি বেশ জানি বিধাতা এক্ষণে ইংরাজদের প্রতি একান্ত সানুকুল, যে কেহ এক্ষণে তাহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, তাহারি জীবনরক্ষা করা নিতান্ত দুর্ঘট হবে। কিন্তু আমি সে সব বিঘ্ন বিপত্তিকে আদৌ গ্রাহ্য করি না; কেন না একদিন নিশ্চয় যখন সংসার ত্যাগ করতে হবে; কালের পরাক্রমকে ব্যর্থ করা যখন মানব ক্ষমতার অতীত, তখন রোগের অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ ক’রে, কাপুরুষের ন্যায় গৃহে মরা অপেক্ষা শত্রু হনন করতে করতে বীরশয্যায় শায়িত হওয়া সহস্রাংশে শ্রেয়ঙ্কর ও গৌরব-জনক। তোমাদের শাস্ত্রে বলে যে, সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ দিলে তার স্বর্গলাভ হ’য়ে থাকে। এ প্রকার হীনতা-স্বীকার পূর্ব্বক বিষহীন সর্পের ন্যায় নামে সুবেদার থাকা অপেক্ষা বীরের ন্যায় বীরশয্যায় শায়িত হওয়া সমধিক গৌরব-জনক, কারণ তাহ’লে আমার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খোদিত থাকবে। কালের ভীম-তাড়নে তাহা বিন্দুমাত্র পরিম্লান হবে না।”
দাওয়ানজি মহাশয় কহিলেন, “ধর্ম্মাবতার! আর আপনাকে আমি বাধা প্রদান করবো না, যদি উদ্যোগী-সৎপুরুযের অভিষ্ট সিদ্ধ হয়, পুরুষ্কারের জয় হ’য়ে থাকে, তাহ’লে নিশ্চয় আপনিও কৃতকাৰ্য্য হবেন। এক্ষণে যাতে আপনার এই বীরব্রত উদ্যাপন হয়, তাহার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করুন। তারপর সর্ব্বনিয়ন্তা পরমেশ্বরের মনে যাহা আছে, কিছুতেই তাহার অন্যথা হবে না।”
নবাববাহাদুর একটী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “সেই ইচ্ছাময়ের যাহা ইচ্ছা হয় তাহা কিছুতেই অন্যথা হয় না, তবে আমি একবার শেষ অবধি দেখবো, অলস প্রকৃতি ভীরুজনের ন্যায় কিছুতেই উদ্যমহীন হবো না।”
সম্প্রতি আমি যা মনস্থ ক’রেছি তা শুন। আমি মুঙ্গেরের কেল্লার ভিতর সমরসাজে সজ্জিত হবো, চারিদিক হ’তে প্রচুর রসদ তথায় সংগ্রহ ক’রে রাখবো। আমি ইতঃমধ্যেই তাহার বিশেষ উদ্যোগ করিয়াছি এবং রাজধানী ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হ’য়ে আছি, অথচ আমার প্রাণের মতলব, তুমি রজবখাঁ, মির্জ্জা আলি ও দেবনারায়ণ সিং ব্যতীত জগতের মধ্যে যেন আর কেহ না জানে। আমি ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে শিকার করিতে যাইতেছি এই কথাই প্রচার করিয়াছি। তাহ’লে তুমি এক্ষণে মুরশিদাবাদে থাক, আমি কিছু সৈন্য লইয়া স্থলপথে যাত্রা করবো, এ দিকে জলপথে দুই শত সৈন্য সহ রসদ বোঝাই লইয়া আঠারখানি নৌকা জলপথে রওনা হবে। মির্জ্জা আলি কলিকাতায় গিয়া সেখানকার ডিরেক্টারদের নিকট আমার অভিযোগাদি আবেদনপত্র পেশ করিবে এবং তাহাদের উত্তর লইয়া বরাবর মুঙ্গেরে আমার সহিত মিলিত হইবে। যদি ইংরাজেরা আমার ন্যায়ানুমোদিত অভিযোগে কর্ণপাত না ক’রে, তাহ’লে আমি আমার সাধ্যমত তাদের দমন করতে চেষ্টা করবো, তাতে আমার অদৃষ্টে যা হয় তাই হবে। ইংরাজেরা দেখুক বাঙ্গালা বেহার উড়িষ্যার সুবেদার কাঠের পুতুল নয়, বীর-রক্ত তাহারও ধমনীতে প্রবাহিত হ’য়ে থাকে। যাই হোক্ আপাততঃ তোমার এই ছোকরাকে মির্জ্জা সাহেবের সহকারিপদে নিযুক্ত করলাম। ইনি কেবল সিপাহীদের রসদ বিলি করিয়া দিবেন ও আবশ্যকমত দ্রব্য বাজার কিম্বা জমীদারদের নিকট হ’তে যথামূল্যে ক্রয় করিবেন। তারপর কলিকাতা হ’তে মুঙ্গেরে আসিলে আমি ইহার বেতনাদি বন্দোবস্ত করিয়া দিব। ছোকরাটির চেহারা দেখিয়া বেশ বুদ্ধিমান ও সুশীল ব’লে বোধ হ’চ্ছে, সুতরাং কোন দায়িত্বপূর্ণ কার্য্যের ভার অনায়াসে ইহার উপর অর্পণ করা যেতে পারে। যাই হোক্ তুমি ইহাকে প্রস্তুত করিয়া রাখিবে, কারণ বোধ হয় এক সপ্তাহের মধ্যে মির্জ্জা সাহেব যাত্রা করিবে। তুমি একবার রাত্রে আসিয়া আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তোমার সঙ্গে বিশেষ একটা পরামর্শ আছে।”
দাওয়ানজি মহাশয় উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং কেতামতন কুর্ণিস করতে করতে বাহিরে আসিলেন। আমিও তাঁহার অনুকরণ করিলাম ও ফটকের নিকট গাড়িতে আসিয়া উঠিলাম। কোচোয়ান চাবুকের শব্দ করিল, কাজেই গাড়িখানি নক্ষত্রবেগে দাওয়ানজি মহাশয়ের বাড়ীর দিকে ছুটিল।