» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ

পাপের পরিণাম।

একটু বেলায় আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল, তখন প্রভাতের চারু শোভা অদৃশ্য হ’য়ে রৌদ্রে বাড়ী পরিপূর্ণ হ’য়ে উঠেছে। আমি তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া দেখিলাম যে, ব্রহ্মচারী মহাশয় আর একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা কাঁঠাল গাছের তলায় দাঁড়াইয়া কথাবার্ত্তা কহিতেছেন। আমি এই ভদ্রলোকটার বেশ-ভূষা ও অদূরে হস্তীর ন্যায় প্রকাণ্ড ঘোড়াযুক্ত গাড়ি দেখিয়া তাহাকে কোন বড় লোক বলিয়া অনুভব করিলাম।

ব্রহ্মচারী মহাশয় হাতছিনি দিয়ে আমাকে ডাকিলেন, আমি তাঁহাদের নিকট গেলাম, সেই ভদ্রলোকটী একবার আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া ব্রহ্মচারী মহাশয়ের কাণে কাণে চুপি চুপি কি বলিলেন, আমি তাহার বিন্দুমাত্র বুঝিতে পারিলাম না।

ব্রহ্মচারী মহাশর ঈষৎ হাস্যে আমাকে কহিলেন, “এই মহাত্মার নাম দাওয়ান নন্দকুমার রায়, ইনি নবাব বাহাদুরের দাওয়ান, আজ হ’তে ইনি তোমার প্রতিপালনের ভার গ্রহণ করলেন, তুমি ইহার আবাসে পরম সুখে দিনপাত করবে, কোন বিষয়ে তোমার বিন্দুমাত্র কষ্ট হবে না। বিশেষ তোমাকে অলসভাবে কালযাপন করতে হবে না, দাওয়ান বাহাদুর একটি তোমার উপযুক্ত চাকরী করিয়া দিবেন।”

দাওয়ানজি মহাশয় মিহিস্বরে ও খুব মোলামভাবে কহিলেন, “চাকরী করা না করা তোমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করিতেছে; কারণ তোমার চাকরী করিবার বিশেষ আবশ্যক নাই, তুমি পরমসুখে বাড়ীর ছেলের ন্যায় আমার বাড়ীতে থাকিবে। চাকর-বাকর সকলেই তোমাকে মনিবের ন্যায় মান্য করবে, কোন বিষয়ে কষ্ট হবে না। তবে যদি অলসে সময়পাত করতে তোমার কষ্ট হয়, ভ্রমণচ্ছলে ভিন্ন ভিন্ন দেশ দেখিবার সখ হয়, তাহ’লে নবাব সাহেবকে ব’লে তোমাকে সেই দিনেই একটি বেশ সম্মানের চাকরী করিয়া দিব। আমি যে বন্দোবস্ত করিব, নবাব সাহেব তাহার উপর আর হস্তক্ষেপ করিতে পারিবেন না; কারণ আমাকে তিনি যথেষ্ট অনুগ্রহ করিয়া থাকেন। যাই হোক্ এক্ষণে তুমি আমার সঙ্গে এসো, আর এখানে অপেক্ষা করিবার আবশ্যক নাই।”

ব্রহ্মচারী মহাশয় অনুকুল মত প্রদান করিলেন, কাজেই আমি প্রাতঃকৃত্যাদি শেষ করিয়া তখনি যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলাম ও ব্রহ্মচারী মহাশয়ের পদধূলি লইয়া গাড়ীতে উঠিলাম। দাওয়ানজী মহাশয় জগদম্বাকে দর্শন করিয়া গাড়ীতে উঠিলেন, গাড়োয়ান ঘোড়াকে চাবুকের ঘা দিল; কাজেই গম্‌ গম্ শব্দে মনিবের পদমর্য্যাদা প্রকাশ করতে করতে নক্ষত্রবেগে গাড়ীখানি ছুটিল।

প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যে বৃহৎ ফটকযুক্ত রাজবাড়ী তুল্য একখানি প্রকাণ্ড বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া গাড়ী থামিল, আমরা দুজনে নামিলাম। দেউড়ীর সিপাহিরা তখনি দাঁড়িয়ে অভিবাদন করিল, দাওয়ানজী মহাশয় একবার মাথাটা নেড়ে ইংরাজী কায়দায় সমস্ত সেলামগুলি ফিরিয়ে দিলেন ও গম্ভীরভাবে বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। জেলের পশ্চাতের হাঁড়ীর মত আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম।

দাওয়ানজী মহাশয় আমাকে উপরের বৈঠকখানায় বসাইয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমি গদি আঁটা একখানি কোচের উপর বসিয়া বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে চারিদিক দেখিতে লাগিলাম।

প্রকৃতপক্ষে আমার জীবনের মধ্যে ঈদৃশ দামী আসবাব দিয়ে বড় মানুষী ধরণের সাজানো বৈঠকখানা দেখি নাই। বৈঠকখানাটি আধা দেশী ও আধা বিলাতী ধরণে সাজানো; কারণ আজকালের দিনের ইংরাজ ঘেঁসা অনেক সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালী ও মুসলমানের গৃহে অনেকটা ইংরাজী কায়দা ইংরাজী ঢং প্রবেশ করেছে, সেই জন্য সেই ঘরের এক দিকে  একখানি গোল মার্বেল পাথর মোড়া টেবিল ও গদি আঁটা ভাল ভাল খানকয়েক কেদারা শোভা পাচ্ছে ও তিন চারিখানি মকমলের গদিযুক্ত সোফা পাতা র’য়েছে।

ঘরের দেয়ালগুলি কোন চিত্রকুশল চিত্রকরের তুলির দ্বারায় অঙ্কিত কাজেই দর্শকের পক্ষে নিতান্ত নয়ন-রঞ্জক হয়েছে। দুইপাশে অশেষ কারুকার্য্য সম্পন্ন দুখানি প্রকাণ্ড দর্পণ টাঙ্গানো আছে এবং রৌপ্য-খচিত যোড়া দেয়ালগিরি ও শিল্পীর শ্রমপ্রসূত খানকয়েক দেশী ও বিলাতি অলেখ্য শোভা পাচ্ছে।

ঘরটির প্রায় ছয় আনা ভাগ উৎকৃষ্ট গালিচে দিয়ে মোড়া, তার উপর গোটাকয়েক বড় বড় তাকিয়া ও তিন চারিটা রূপার ডাবর শোভা পাচ্ছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে কুড়ি ডেলে একটি ঝাড় ঝুলছে ও টানা পাখাখানি রসিক পুরুষের ন্যায় মানিনী ঝাড়সুন্দরীর পায়ে ধরে রাত্রদিন উপাসনা করছে। ঘরের এক পাশে পরীওয়ালা জোড়া বৈঠকের উপর এক জোড়া রূপায় বাঁধানো হুঁকা কল্‌কেরূপ পাগড়ি মাথায় দিয়ে ব’সে আছে ও পাথরের ব্রাকেটে একটি ঘড়ি টুক্‌টুক্‌ ক’রে শব্দ করছে।

আমি সেইখানে বসিয়া এই সব দেখছি, এমন সময় একজন খানসামা রূপার বাটী ক’রে ফুলাল তৈল ও গামছা লইয়া আসিল। আমি তাহাকে মাখাইয়া দিতে বারণ করিয়া নিজেই মাখিলাম, তবে সে ছাতেই জল আনিয়া আমাকে দিল, আমি স্নান করিলাম।

স্নানান্তে কোচানো একখানি উৎকৃষ্ট ঢাকাই ধুতি পরিধান করিলাম, পায়ে এক জোড়া জরির লপেটা শোভা পাইল, রূপার থালে রাজভোগ তুল্য অন্ন ব্যঞ্জন আনিয়া দিল; বৈঠকখানার পাশে একটী ছোট সাজানো ঘর আমার জন্য নির্দ্দিষ্ট হইল, আমার হুকুম তামিলের জন্য একজন খানসামা রাত্রদিন মোতায়েন রহিল, কাজেই সহসা আমি যেন রাজপুত্ত্র বনিয়া গেলাম। দাওয়ানজী মহাশয়ের কৃপায় আমার আর আদর যত্নের ত্রুটী রহিল না, এইরূপ ভাবে প্রায় দুই সপ্তাহ কাটিয়া গেল।

এই সংসারে মানুষেরা যাহাকে সুখ বলে বা যাহা লাভ করিবার জন্য সকলে লালায়িত হইয়া থাকে, দাওয়ানজী মহাশয়ের কৃপায় আমার সে বিষয়ে কিছুরই অভাব ছিল না; কিন্তু তথাপি আমি যে পরমসুখে দিনপাত করিতাম, এ কথা বলিলে সত্যের অপলাপ করা হয়। ফলকথা এখন আমি অনেকটা বুঝেছি যে, পালকের গদির উপর শুইলে, রূপার গেলাসে বেদানার সরবৎ পান করিলে, কি ঢাকাই কাপড় কুঁচিয়ে পরিলে মানুষ কখন সুখী হইতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে সুখ সন্তোষ বৃক্ষের সুধাময় ফল, হৃদি ভাণ্ডারের অমূল্য নিধি, নিতান্ত ভাগ্যবান ব্যতীত এ নিধি সকলে লাভ করিতে পারে না। সেইজন্য শ্রমপটু কৃষক শাকান্নমাত্র আহার ক’রে যে প্রকার সুখের অস্তিত্ত্ব অনুভব করিতে পারে দুরাশার দাস ধনী রাজভোগ আহার করিয়াও তাহার শতাংশের একাংশও লাভ করিতে পারে না। এই সংসারে যার চিত্তকুসুমে কোনরূপ চিন্তাকীট প্রবেশ করে নাই, যে উৎকট কামনার বশম্বদ নয়, যার অভাব জ্ঞান নাই, সন্তোষের বিমল-বিভায় যার অন্তর আলোকিত, সে ব্যক্তি কপর্দ্দক পরিশূন্য ভিখারী হইলেও সংসারে সেই যথার্থ সুখী, বিমল সুখাস্বাদনের সেই ভাগ্যবানই যোগ্যপাত্র। আমার মানস-সমুদ্র যখন রাত্রদিন উদ্বেলিত হ’চ্ছে, আমি কে, কার পুত্ত্র, কিরূপ অবস্থায় সন্ন্যাসীঠাকুর আমাকে পেয়েছেন, আর ছবৎসর পরে অর্থাৎ আমার বাইস বৎসর বয়সের সময় আমার কি হবে, এই সব ভাবনা যখন আমার অন্তরে প্রবল ছিল, তখন আমি কিরূপে সুখী হইব? তবে আমি আমার মনের অবস্থাকে সাধ্যানুসারে গোপন করিয়া রাখিয়াছিলাম, দাওয়ানজি মহাশয় আমার বাহ্যিক লক্ষণ দেখিয়া কিছুই বুঝিতে পারেন নাই।

দাওয়ানজি মহাশয় একজন বড়লোক ছিলেন সত্য, নবাব সরকারে সর্ব্বোচ্চ পদ অধিকার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাহার চেহারাটা তেমন জমকাল ছিল না। তিনি একটু বেঁটে ছিপ্‌ ছিপে একহারা চেহারা ছিলেন, দেখলেই তালপাতার সেপাহী ব’লে ভ্ৰম হ’য়ে থাকে। আহারের বিশেষ রকম পরিপাট্য থাকলে মানুষ যদি মোটা হইত, তাহ’লে দাওয়ানজি মহাশয়ের চেহারা ও রকম বৃষকাষ্ঠ নিন্দিত হ’তো না।

দাওয়ানজি মহাশয়ের বর্ণটুকুন ফিট্ গৌর; মুখখানি ঈষৎ লম্বা, মাথায় সোননুড়ির মতন ধপধবে পাকা চুলের বাবরি, নাকটা বেশ ঠিকালো ছিল, চক্ষুদুটী ক্ষুদ্র ছিল বটে, কিন্তু যুবাদের ন্যায় উজ্জ্বল ও উৎসাহ ব্যঞ্জক, দৃষ্টি স্থির গাম্ভীর্য্য পরিপূর্ণ ও মৰ্ম্মভেদী ছিল। দাওয়ানজি মহাশয়ের বয়স প্রায় ষাট বৎসরের কাছাকাছি হবে, কিন্তু এখনো পাকা গোঁক জোড়াটির মায়া ত্যাগ করিতে পারেন নাই, তবে অনেক চেষ্টা ক’রেও অবাধ্য দাঁতগুলিকে রাখতে পারেন নাই, সময়ের গুণে প্রায় সকল গুলিই ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, কাজেই খুঁটীহীন চালের ন্যায় অনেক আদরের গোঁফ জোড়াটী একটু নীচু হ’য়ে প’ড়েছে, চাঁদমুখের ততদূর বাহার খোলে নাই। যদিও দাওয়ানজি মহাশয় লোকটা খুব খেকুরে ও নেহাৎ একহারা, কিন্তু তথাপি কমলার প্রিয় পাত্র ব’লে সেই চেহারার উপর কেমন একটু লালিত্য বৰ্ত্তমান আছে।

ফলকথা আমার ন্যায় সম্পূর্ণ অপরিচিত সামান্য লোকের উপর দাওয়ানজি মহাশয়ের ঈদৃশ আদর আপ্যায়ন দেখিয়া আমার মনে স্থির বিশ্বাস হইল যে, ইহার মধ্যে কোন গূঢ় রহস্য নিহিত আছে, কারণ কোন প্রকার স্বার্থের সম্ভাবনা কি লাভের প্রত্যাশা না থাকলে স্বার্থের দাস মানুষ কখন পরকে ভালবাসে না, কি আদর যত্ন করতে অগ্রসর হয় না। কিন্তু আমার ন্যায় সামান্য লোকের দ্বারায় ধনে মানে শ্রেষ্ঠ, উচ্চপদস্থ দাওয়ানজি মহাশয়ের কি উপকার হবে? নিশ্চয় জগদম্বার প্রিয়পুত্ত্র ব্রহ্মচারী মহাশয় কি তত্ত্বজ্ঞানী সেই সন্ন্যাসীঠাকুরের অনন্য সাধারণ ক্ষমতা প্রভাবে আমার অবস্থার ঈদৃশ অভাবনীয় উন্নতি হ’য়ে থাকবে। আমি কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই, কল্পনায়ও আনি নাই যে, কয়েদখানা হ’তে বাহির হইয়াই একেবারে রাজপুত্ত্র বনিয়া যাইব, আমার হুকুর তামিল করবার জন্য চাকরে অপেক্ষা করবে। বোধ হয় এইজন্য তত্ত্বজ্ঞানী মনীষীরা ঐহিক বিভবকে ভোজের বাজী ব’লে নির্দ্দেশ ক’রে থাকেন। কারণ মুহূর্ত্ত মধ্যেই মানবের তা লাভ হ’য়ে থাকে, কুটীরবাসী দরিদ্র একেবারে রাজ্যেশ্বর হ’য়ে পড়ে, আবার দুঃসময়ের উদয়ে চক্ষের পলক না ফেলতে স্বপ্নলব্ধ রাজ্যের ন্যায় কোথায় অদৃশ্য হ’য়ে যায়।

দাওয়ানজি মহাশয়ের বাড়ীতে আমার কোন বিষয়ের বিন্দুমাত্র কষ্ট ছিল না, কিন্তু তথাপি এ প্রকার অলসভাবে সময়ক্ষেপ করা আমার পক্ষে নিতান্ত কষ্টকর হইয়া উঠিল। একদিন উপযুক্ত অবসর বুঝিয়া দাওয়ানজিকে আমার প্রাণের কথা প্রকাশ করিয়া বলিলাম, তাহাতে তিনি উত্তর করিলেন, “আচ্ছা, আমি চেষ্টায় রহিলাম, সুবিধা বুঝিলে তোমাকে একটি চাকরী করিয়া দিব। আমার এমন ইচ্ছা নয় যে, তুমি একটা সামান্য মুহুরি কি গোমস্তার কার্য্য কর, কারণ তাহাতে আমার পর্য্যন্ত সম্মানের হানি হইবে। তুমি আর অল্প দিন অপেক্ষা কর; তোমাকে একটি কোন সম্মানের পদ প্রদান করিব ও নবাব সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়া দিব।”

দাওয়ানজি মহাশয়ের এই কথাতেই আমাকে সম্মত হ’তে হ’লো, বিশেষরূপে পেড়াপিড়ি করতে আর সাহস হইল না, তবে নিতান্ত উৎকণ্ঠিত চিত্তে উপযুক্ত অবসরের অপেক্ষার রহিলাম।

প্রায় দুই সপ্তাহের অধিক হইল, আমি দাওয়ানজি মহাশয়ের বাটীতে আসিয়াছি, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে একদিনও সদর দরজা পার হই নাই। যদিও আমি তথায় পরমসুখে ছিলাম, কোন বিষয়ের বিন্দুমাত্র অভাব হয় নাই, কিন্তু তথাপি এরূপ কয়েদির ন্যায় একস্থানে অবস্থান করা আমার পক্ষে যেন কষ্টকর হইয়া উঠিল। সেইজন্য একদিন বৈকালে বড় মানুষি ধরণের কাপড় চোপড় প’রে, রূপা দিয়ে বাঁধানো একগাছি ছড়ি হাতে ক’রে খানিকটা বেড়াবার জন্য বাটী হইতে একাকী বহির্গত হইলাম।

কোথাও যাবার আমার বিশেষ কোন আবশ্যক ছিল না কাজেই গঙ্গার তীরের রাস্তা ধরিয়া লক্ষ্যশূন্যভাবে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। ক্রমে যে স্থানে দাঁড়িয়ে পাপিষ্ঠ সাঁইজি রহিম মোল্লার শব গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ ক’রেছিল, সেইস্থানে এসে উপস্থিত হলাম, অমনি আমার হৃদয়ে পূৰ্ব্বস্মৃতি জাগ্রত হ’য়ে উঠিল এবং মুহূর্ত্ত মধ্যে কিষণজি প্রমুখ খেলোয়াড়দের চিত্র চিত্তফলকে প্রতিফলিত হইল।

আমি আরও ক্রোশখানেক পথ অতিক্রম করিয়া, বাড়ীর দিকে ফিরিবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময় দেখি যে, পাশের একটা গলির মধ্য হ’তে ঝাঁকা মাথায় তাল গাছের ন্যায় বেঢপ ঢেঙ্গা একটা স্ত্রীলোক “মাজন, মিশি, চুড়ি নিবিগো” ব’লে হাঁক দিতে দিতে বহির্গত হ’লো।

আমি এই রমণী-রত্নকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারিলাম, তবে পূর্ব্বের অপেক্ষা একটু কৃশ হওয়ায় ইহাকে কিছু ঢেঙ্গা দেখাইতেছিল। ইহার হাতে মুসলমানিদের ন্যায় গাছকয়েক রূপার চুড়ি ও পরনে রংকরা শাড়ী ছিল। তদৃষ্টে আমার মনে সন্দেহ হইল যে, বোধ হয় এই স্ত্রীলোকটী সম্প্রতি ধর্ম্মান্তর গ্রহণ ক’রেছে, কিম্বা কোন গরজ হাসিল করবার অভিপ্রায়ে এ প্রকার ভোল ফিরাইয়াছে।

স্ত্রীলোকটি আমার সামনে আসিলে আমি কহিলাম, “কি গো ফুলকুমারী, ভাল আছ তো?”

আমার এই কথা শুনিয়া দেবীপ্রসাদের অবিদ্যা সেই ফুলকুমারী সুন্দরী উদাসভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, আমি যে কে, তাহা ঠিক্ চিনিতে পারিল না। কারণ সে আমাকে যে অবস্থায় দেখিয়াছিল, এখন তাহার অনেক পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে, কাজেই সহসা সে আমাকে চিনিতে পারিল না। তবে আমার মুখে তাহার নাম শুনিয়া ভয়ে মুখখানি যেন শুকাইয়া গেল ও বৃষকাষ্ঠের ন্যায় নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল।

এই সংসারে কুৎসিতকর্ম্মা পাপীদের অন্তরে ত্রাস সর্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রবল হ’য়ে থাকে। একটী শুষ্কপত্র বৃক্ষ হ’তে পতিত হ’লে, তারা দারুণ ভয়ে শিহরিয়া উঠে, কিছুতেই শান্তিলাভে সমর্থ হয় না, রাবণের চিতার ন্যায় চিরপ্রজ্জ্বলিত অনুতাপাগ্নিতে দগ্ধ হ’তে থাকে। সকলে বলে পাপ করলেই পরজন্মে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, কিন্তু জ্ঞানের উন্মেষে, বিবেকের তাড়নায় ইহজন্মে পাপীর যে অসনীয় যাতনা ও হৃদয় বিদারণক্ষম মনকষ্ট সহ্য করতে হয় তাহা বর্ণনাতীত, মৃত্যুর পর নরক-যন্ত্রণা কখনই তাহা অপেক্ষা ভীষণতর কষ্টপ্রদ ব’লে বোধ হয় না।

পাপিনী ফুলকুমারী যখন শত শত অপরাধের নায়িকা ও সহকারিণী তখন সে যে আমাকে দেখে ঈদৃশ ভীতা হবে তাহার আর বিচিত্র কি? এই পাপিনীর দ্বারায় যদি কিরণজি বাবুর কোন সন্ধান পাই, এই আশায় তাকে অভয় দিয়া কহিলাম, “ফুল! তোমার কোন ভয় নাই, আমার দ্বারায় তোমার উপকার ভিন্ন অপকার হবে না। আমাকে তুমি কি চিনতে পারছো না, আমি সেই কিষণজি বাবুর পত্র নিয়ে ঠাকুরসাহেবের আখড়ায় তোমাদের বাসায় একবার গিয়েছিলাম, বলি দেবী প্রসাদবাবু কেমন আছেন?”

আমার এই সকল কথা শুনে সেই রূপসীর চাক ভাঙ্গিল এবং আমি যে কে তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিল। কাজেই মাথার সেই বাজরাটি নামিয়ে রেখে কহিল, “বাবুজি! সেই হারামখোর পাজি নেমোখারাম বেটার নাম আর নেবেন না। এই দুনিয়ার বিচে সে বেটার মতন আদত শয়তান আর দু’টী নাই। আখেরে খোদাতাল্লার কাছে কি যে জবাব দেবে, তার ঠিক্ নেই, বেটা আদত বেইমান।”

ফুলকুমারী আমাকে এই কথা ব’লে দেবীপ্রসাদের স্বর্গগত পিতা পিতামহের উদ্দেশে কতকগুলো দুর্গন্ধময় জঘন্য জিনিষ আহারের ব্যবস্থা করিল।

আমি শ্রীমতীর ক্রোধের প্রকৃত কারণ বুঝতে না পেরে কহিলাম, “দেবীপ্রসাদকে এরূপ গাল দিচ্ছো কেন, সে তোমার কি ক’রেছে? আর কত দিন হ’ল তুমি মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্রহণ ক’রেছ?”

ফুলকুমারী মুলানিন্দিত বত্রিশটী দত্ত বিকাশপূর্ব্বক কহিল, “আজ্ঞে, আগে যা ছিলাম, এখনো তাই আছি, কেবল ঐ বেইমান বেটার দমে প’ড়ে দিনকয়েক হিন্দুর মেয়ে সেজে ঠাকুরসাহেবের আখড়ায় ছিলাম।”

আমি নিতান্ত বিস্মিতভাবে কহিলাম, “তাহ’লে দেবীপ্রসাদও কি জাতিতে মুসলমান?”

ফুল। আজ্ঞে হাঁ, কেবল কোতোয়ালির বরকন্দাজদের চ’খে ধূলো দিবার জন্য দেবীপ্রসাদ এই জাল নাম নিয়ে হিন্দু সেজেছিল। আমি ঐ বেইমান বেটার দমে প’ড়ে কুলে কালি দিই। তারপর ঐ বেটা কি না আমার সর্ব্বস্ব নিয়ে, পথের ফকির ক’রে একেবারে দেশছাড়া হয়েছে, বেটার এখন একবার দেখা পেলে, ঝাড়ু মেরে ওর বেইমানি ছুটিয়ে দিই।”

ফুলকুমারীর মুখে এই সকল কথা শুনিয়া, আমি অপার বিস্মরহ্রদে নিমগ্ন হইলাম। মনে করিলাম যে, সংসারে ধর্ম্মজ্ঞানশূন্য এই সকল পাপাত্মাদের অসাধ্য কিছুই নাই। নরাধম কপট হিন্দু সেজে কত লোকের জাত মজাইয়াছে, তাহার আর ইয়ত্তা নাই। বোধ হয় এই দলের লোক প্রাণের ইয়ার কিষণজি বাবু এই সকল গুপ্তকথা নিশ্চয় জানিত। যাই হোক্‌ শ্রীমতী যখন শ্রীমানের উপর এতদূর চটিয়াছে, তখন এখন আর কোন কথা গোপন করবে না, রাগের বশে অবশ্যই সব কথা প্রকাশ করিয়া ফেলিবে।

আমি মনে মনে এই স্থির ক’রে, শ্রীমতীকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা, তাহ’লে দেবীপ্রসাদের প্রকৃত নাম কি? কোথায় দেশ ছিল, আর এখনই বা তোমাকে ফেলে কোথায় পালিয়েছে?”

ফুল। ও বেটার আদত নাম রহমন খাঁ, বাড়ী বাখরগঞ্জে, সেখানে একটা ডাকাতের দলের সর্দ্দার ছিল। তারপর গোলমাল হওয়ায় প্রাণের ভয়ে সেখান হ’তে আমাকে নিয়ে এইখানে পালিয়ে আসে ও নাম ভাঁড়িয়ে ঠাকুরসাহেবের আখড়ায় থাকে, তারপর আমার সর্ব্বনাশ ক’রে এখন পিণ্ডিরদলে মিশিয়াছে।

আমি। পিণ্ডিরদল কাকে বলে?

ফুল। পশ্চিমে একটা ডাকাতের দল আছে, তাদের পিণ্ডিরদল বলে। তারা ঘোড়ায় চ’ড়ে, পাঁচহাতিয়ার নিয়ে গাঁকে গাঁ লুট করে। সেই দলে আমাদের সেই পোড়ারমুখো ও তোমাদের কিষণজি বাবু গিয়ে মিশেছে। শুনেছি তারা গোয়েন্দার দ্বারা সংবাদ লইয়া এই বঙ্গোপদেশে এসে লুটতরাজ করবে। তোমার কিণজিবাবু একটা কম ধড়িবাজ লোক নয়, তাইতে সেই বেইমান বেটার সঙ্গে তার দোস্ত হ’য়েছিল। শয়তান না হ’লে কখন শয়তানের সঙ্গে মেল হয় না।

ফুলকুমারী আমাকে এই কথা বলে বাজরাখানি মাথায় তুলিল এবং প্রস্থানোন্মুখী হইল, কিন্তু আমি তাহাকে বাধা দিয়া কহিলাম, “কিষণজি বাবুর স্ত্রী ও তাহার কন্যার কি হইয়াছে বল, সত্য কথা বলিলে তোমাকে বিশেষরূপে পুরস্কত করিব। এখন যে আমার অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হইয়াছে, তাহাতো তুমি বুঝিতে পারিতেছ, সুতরাং সত্য করিয়া সকল বল, তোমার কোন ভয় নাই।”

ফুলকুমারী পুনরায় বাজরাটি নানাইয়া কহিল, “বাবুজি, দুনিয়ার বিচে মানুষ চেনা ভার। তুমি যাকে কিষণজি বাবুর স্ত্রী বললে, সে তার বিধবা-ভাদ্রবৌ, দেশ থেকে বার ক’রে এনে নাম ভাড়িয়ে এখানে ছিল। কেউ কোন সন্ধান করতে পারে নাই। তারপর সেই মাগীর ভাই কোন রকমে খপর পেয়ে লোকজন নিয়ে সেই বাড়ীতে এসে হাজির হয়। কৰ্ত্তাবাবু কোন গতিকে পালিয়ে জান বাঁচান, কিন্তু মাগিটা সরমের খাতিরে গলায় দড়ি দিয়ে মরে।

আমি। আর তাদের সেই মেয়েটার কি হ’লো?

ফুলকুমারী ভাঁটার মতন চোখ দুটো একবার ঘুরিয়ে উত্তর করিল, “হাঁ বাবু, সে কিন্তু বাহাদুর মেয়ে বটে, তারিফ আছে, নিজের জানের পরোয়া রাখে না, একি কম আশ্চর্য্যের কথা। যাই হোক, কেউ তার কিছুই করতে পারে নাই, এখন সে তার মামার কাছে পরমসুখে আছে। মেয়েমানুষ নিজে যদি ঠিক্ থাকে, তাহ’লে কারুর বাপের সাধ্য নাই যে তাকে নোয়াতে পারে।”

আমি প্রকৃত ব্যাপারখানা বোঝবার জন্য কহিলাম, “তুমি সেই মেয়েটাকে অতো তারিফ করছো কেন, তাহার কি হইয়াছিল?”

ফুলকুমারী উত্তর করিল, “সেই বেইমান বেটার সঙ্গে কিষণজি বাবুর খুব দোস্তি ছিল, কিন্তু তবু কে এক বেটা বড় মানুষের ছেলেকে খুসী করবার জন্য, দুজন গুণ্ডা আনিয়ে মেয়েটাকে জোর ক’রে ধ’রে নিয়ে যায় ও জুম্মাপীরের দরগা ব’লে একটা আড্ডার মধ্যে নিয়ে আটক করে রাখে, কিন্তু খোদাতাল্লার কুদরতে সেই দিনে একটা ডাকাতি মোকদ্দমার তদ্বিরের জন্য দারোগাসাহেব ও কুড়ি পঁচিশজন বরকন্দাজ দরগা বাড়ীতে আসে, কাজেই বেটাদের সব বিদ্যা প্রকাশ হ’য়ে পড়ে। শুনেছি সেই মেয়েটীর মামা তাদের সঙ্গে ছিল, কাজেই সেই মেয়েটা এখন তার মামার কাছে আছে।

রমণীর প্রমুখাৎ সকল কথা শুনে আমার মনের সন্দেহ মিটিয়া গেল। পূর্ব্বে খাঁ সাহেবের আখড়ায় রহমন খাঁ এই নামটা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ ক’রেছিল এবং সে বেটা বেমালুম হিন্দু সাজিয়া আত্মগোপন করিয়া আছে তাহাও শুনিয়াছিলাম, কিন্তু তখন প্রকৃত ব্যাপার বুঝিতে পারি নাই। দৈবগতিকে ফুলকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ায় আজ স্পষ্ট বুঝিলাম মোহিতবাবুর জন্য পাপাত্মা ছদ্মবেশী দেবীপ্রসাদ সেই সরলা কুমারীর বিরুদ্ধে বিষম ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ সেই সরলার যে জাতিকুল রক্ষা হইয়াছে, ইহাই সমধিক আনন্দের বিষয়। পাপিয়সী ভবতারিণীর পরিণাম শুনিয়া আমি যথেষ্ট মৰ্ম্মহত হইলাম, কারণ সে হাজার মন্দ হোক্ কিন্তু আমাকে পুত্ত্রের ন্যায় স্নেহ করিতেন। যাই হোক্ পাপিনী শেষে আত্মহত্যা ক’রে তাপিত অন্তরকে সুশীতল করিয়াছে শুনিয়া কতকাংশে সুখী হইলাম এবং আমার জামার জেব হ’তে দুটী টাকা বাহির করিয়া ফুলকুমারীর হাতে দিলাম, রমণী নিতান্ত পরিতুষ্ট হইয়া আমার মস্তকে অজস্ৰ আশীৰ্ব্বাদ বরিষণ করিল ও ঝাঁকাটি পুনরায় মাথার উপর তুলিয়া প্রস্থান করিল, আমিও দাওয়ানজি মহাশয়ের বাড়ীয় দিকে ফিরিলাম।