» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

গুপ্তকথা।

সেই ঠাকুর বাড়ীতে যে আর দুখানি মেটে ঘর ছিল, তাহার মধ্যে একখানিতে ব্রহ্মচারী মহাশয় শয়ন করিতেন, আর যেখানির রকে ব’সে আহার ক’রেছিলাম সেইখানি ভোগঘর স্বরূপ ব্যবহার হইত। ব্রহ্মচারী মহাশয় স্বহস্তে রন্ধন করিতেন, তবে অন্যান্য কাজের জন্য দুইজন সৎশূদ্র ভৃত্য ছিল।

রাত্রি প্রায় এগারটার সময় ব্রহ্মচারী মহাশয়ের জপ শেষ হইল। তিনি আমাকে সঙ্গে লইয়া সেই শয়ন ঘরে আসিলেন এবং কিঞ্চিৎ জলযোগ করতে অনুরোধ করিলেন। সুধাসম জগদম্বার প্রসাদ আমি পরিতোষে আহার করিয়াছি, সুতরাং আমার ক্ষুধার উদ্রেক হয় নাই, কিন্তু তথাপি তাঁহার আজ্ঞামত সামান্য কিঞ্চিৎ জলযোগ করিলাম। ব্রহ্মচারী মহাশয় পাশাপাশি দুখানি কম্বল পাতিয়া শয্যা রচনা করিলেন, আমি তাঁহার নির্দ্দেশমত একখানি অধিকার করিলাম, কিন্তু কিছুতেই নিদ্রাদেবীর শরণাপন্ন হইতে আদৌ ইচ্ছা হইল না। আজ কিষণজিবাবুর প্রকৃত পরিচয় জানতে পারবো, নিৰ্ম্মলা যাহা বলে নাই, বা সে নিজে যাহা জানে না তাহা শুনিব, এই কৌতুহলই আমার মনে নিতান্ত প্রবল হইয়াছিল। কাজেই আমি শয্যার উপরে শয়ন করিয়াই কিষণজি বাবুর কথা পাড়িলাম এবং যাহা আমার জানিবার ইচ্ছা হইয়াছিল, তাহা অকপটে এই দেবপ্রতিম ব্রাহ্মণের কাছে নিবেদন করিলাম। ব্রহ্মচারী মহাশয় বলিতে আরম্ভ করিলেন।

“বঙ্গদেশে গঙ্গাতীরে শান্তিপুর নামক গণ্ডগ্রামে জহরলাল গোস্বামী নামে একজন সম্পন্ন বারেন্দ্রশ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন, পূর্ব্বে তাঁহার অবস্থা ততদূর উন্নত ছিল না, তিনি জীবিকার জন্য জন্মভূমি ত্যাগ ক’রে সুদূর মৃজাপুর তহশিলের ফৌজদার কলজকরিমখাঁর অধীনে ১২৲ বার টাকা বেতনে একটী মুহুরির কার্য্য করিতেন। তবে তখনও শস্য সকলের মূল্য এত মহার্ঘ্য ছিল না, সেইজন্য মিতব্যয়ী গোস্বামী মহাশয়ের এই ১২৲ বার টাকার মধ্য হইতেও কিছু কিছু সঞ্চয় হইত।

গোস্বামী মহাশয় উদর-পোষণের জন্য ইংরাজদের অধীনে চাকরী করিতেন বটে, কিন্তু স্বধর্ম্মের উপর তাঁহার প্রগাঢ় আস্থা ছিল এবং হৃদয়ের নিভৃতস্থলে বিমল ভক্তির-লহরী ক্রীড়া করিত। সেইজন্য তিনি কাজকৰ্ম্ম হ’তে অবসর পেলেই জগদম্বা বিন্দুবাসিনীর মন্দিরে গমন করতেন ও সরলভাবে শিশুর ন্যায় প্রাণের যাতনা মাকে জানাইতেন।

একদিন অভ্যাসমত বিন্দুবাসিনীর মন্দিরে আসিয়া দেখিলেন যে, তেজপুঞ্জ কলেবর এক সন্ন্যাসী নিকটস্থ একটা বৃক্ষতলে বসিয়া আছেন। এই সন্ন্যাসীকে দেখিবামাত্র তাঁহার অন্তরে ভক্তির প্রবাহ খুব খরভাবে ছুটিল, কাজেই তিনি যাইয়া সেই মহাপুরুষের পদতলে প্রণত হ’লেন ও তাঁহার সঙ্গে বিবিধ তত্ত্ব কথায় প্রবৃত্ত হ’লেন।

অতি শুভক্ষণে সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে গোস্বামী মহাশয়ের সাক্ষাৎ হইল, কারণ তাঁহার ভক্তি সন্দর্শনে ও বিনয়-নম্র বচন শ্রবণে সন্ন্যাসী ঠাকুরও নিরতিশয় প্রীতি হ’লেন এবং তাঁহার বাসায় আসিয়া সে রাত্রি অতিবাহিত ক’রে পরদিন প্রত্যুষে স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।

এইরূপে সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে গোস্বামী মহাশয়ের আলাপ হইল এবং মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ হইতে লাগিল। এদিকে মহাপুরুষের আশীর্ব্বাদে দিন দিন তাঁহার উন্নতি হইতে লাগিল, খোদ ফৌজদার অবধি তাঁকে সোণার চক্ষে দেখিতে লাগিলেন এবং এক বৎসরের মধ্যে তখনকার খুব উচ্চপদ ৫০৲ পঞ্চাশ টাকা বেতনে মীরমুন্সির পদে উন্নীত করিয়া দিলেন।

একমাত্র এই মহাপুরুষের কৃপায় ও আশীর্ব্বাদে গোস্বামী মহাশয়ের যে এতাদৃশ আশার অতীত উন্নতি হইয়াছে, তাহা বুঝিতে তাঁহার বাকী রহিল না, কাজেই এই মহাপুরুষকে দেবতার ন্যায় দেখিতে লাগিলেন, সন্ন্যাসী ঠাকুরও তাঁহাকে পুত্ত্রের ন্যায় স্নেহ করিতে আরম্ভ করিলেন।

এইরূপে কিছুদিন গত হ’লে সন্ন্যাসী ঠাকুর জহরলাল বাবুর ভক্তিতে তুষ্ট হ’য়ে তাঁহাকে মন্ত্র প্রদান পূর্ব্বক শিষ্য করিলেন এবং লাহোরে নিজের মঠে প্রস্থান করিলেন।

সন্ন্যাসী ঠাকুর জহরলাল বাবুর গুণগ্রামের পরিচয় পেয়ে তাঁহার ন্যায় গৃহীকে শিষ্য করিয়াছিলেন। ফলকথা, মহীলতা মৃত্তিকার মধ্যে বাস ক’রেও যেমন মৃত্তিকা স্পর্শ করে না, তেমনি তিনি সংসার মধ্যে অবস্থান করেও কোন কলুষ-কলাপে বিমোহিত কি মায়াশৃঙ্খলে সম্যরূপে আবদ্ধ হন নাই। কেবলমাত্র কর্ত্তব্যবোধে সংযমী পুরুষের ন্যায় অতীব পবিত্রভাবে সংসার-যাত্রা নির্ব্বাহ করিতেন এবং শ্রমার্জ্জিত অর্থে দুঃখীর দুঃখমোচন ক’রে অসার সংসারের সার বিমল আত্মপ্রসাদ লাভে কৃতার্থ হইতেন। সুচতুর কৃষক ভূমির শক্তি বুঝে তাতে যেমন যত্নসহকারে বীজ বপন করে, তেমনি ত্রিকালজ্ঞ তত্ত্বদর্শী এই মহাপুরুষ জহরলালকে যোগ্যপাত্র জ্ঞান ক’রে তাঁহাকে আশ্রমবাসী গৃহীশিষ্য করিয়াছিলেন।

যদিও জহরলাল বাবু ন্যায়নিষ্ট ধর্ম্মভীরু মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন, অন্যায় ভাবে একটী পয়সাও উপার্জ্জন করিতেন না, কিন্তু তথাপি ধৰ্ম্মপথে থেকেও দশ বার বৎসরের মধ্যে প্রায় ৫০/৬০ পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকা তাহার সঞ্চয় হইল।

গোস্বামী মহাশয় আর বিদেশে না থাকিয়া সপরিবারে দেশে ফিরিয়া আসিলেন এবং খানকয়েক মহল কিনিয়া অতি সুখে স্বচ্ছন্দে দিনযাপন করিতে লাগিলেন।

পশ্চিমে জহরলাল বাবুর দুটী পুত্ত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। তিনি জ্যেষ্ঠটীর নাম কৃষ্ণ ও কনিষ্ঠটীর নাম হরি রাখিয়াছিলেন। পশ্চিমে উপযুক্ত পাত্রীর অভাবে পুত্ত্রদের বিবাহ দিতে পারেন নাই। এক্ষণে দেশে আসিয়া একসঙ্গে দুটী পুত্ত্রের বিবাহ দিলেন, গোস্বামী মহাশয়ের নয়নানন্দদায়ক পুত্ত্র-বধূদ্বয় গৃহে আসিল, কিন্তু সংসারের সকল বিষয়ে কাহাকেও সুখী করা সর্ব্বজন পূজিত বিধাতার অভিপ্রেত নহে। মধুর বসন্তের পর দারুণ বর্ষার ন্যায় সুখ দুঃখ বিপদ সম্পদ দেহীমাত্রেই পৰ্য্যায়ক্রমে উপভোগ করতে বাধ্য হ’য়ে থাকে। কেহই জগতে মানবদেহ ধারণ ক’রে নিরবচ্ছিন্ন সুখ দুঃখ ভোগ করে না।

এই সাধারণভোগ্য অকাট্য ঐশ্বরিক নিয়ম মহানুভব গোস্বামী মহাশয়ের ভাগ্যেও অন্যথা হইল না; অর্থাৎ এই শুভবিবাহের এক বৎসর পূর্ণ না হ’তেই তাঁহার হরি নামক কনিষ্ঠ পুত্ত্র সুদারুণ বসন্তরোগে অকালে কালগ্রাসে পতিত হইল।

গোস্বামী মহাশয় যদিও একপ্রকার মুক্তপুরুষ, সংসারের শুভাশুভ সেই পরমপুরুষের পাদপদ্মে সমর্পণ ক’রে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন; মায়ারবন্ধনকে অনেকটা শিথিল ক’রে এনেছিলেন, কিন্তু তথাপি দারুণ পুত্ত্রশোক অম্লান-বদনে সম্বরণ করা রক্তমাংসবিশিষ্ট ভৌতিক-দেহধারী মানবের পক্ষে বড় সহজসাধ্য নহে; কাজেই বৃদ্ধ বয়সে অকস্মাৎ এই শোক পাইয়া অল্পদিনের মধ্যে তাঁহার স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইয়া গেল। সময় পেয়ে জ্বরা এসে তাঁহার দেহযষ্টি আক্রমণ করিল, কাজেই প্রায় বিরাশি বৎসর বয়সে গোস্বামী মহাশয় সজ্ঞানে গঙ্গাতীর ভৌতিক-কায়া পরিবর্ত্তন করিলেন।

গোস্বামী মহাশয় গ্রামের মধ্যে একজন সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন, কাজেই খুব সমারোহের সহিত তাঁহার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন হইল এবং কৃষ্ণনাম বাবু কৰ্ত্তা হইয়া অতি সুশৃঙ্খলে সংসার চালাইতে লাগিলেন।

কর্ত্তার মৃত্যুর এক বৎসর গত হইলে স্বামীজি তোমাকে লইয়া শান্তিপুরে উপস্থিত হইলেন, তখন তোমার বয়ঃক্রম দেড় বৎসরের অধিক হইবে না। কৃষ্ণনাম বিশেষরূপে জানিতেন যে, এই মহাপুরুষের কৃপায় তাহাদের ঈদৃশ উন্নতি হইয়াছে, কাজেই মহাপুরুষকে পাইয়া দেবতার ন্যায় ভক্তি করিতে লাগিলেন। স্বামীজি তোমাকে কৃষ্ণনাম বাবুর হস্তে সমর্পণ করিয়া কহিলেন, “বৎস! আমার একটী অনুরোধ তোমাকে প্রতিপালন করতে হবে। আমি এই ছেলেটীকে তোমার কাছে রাখিয়া যাইতেছি, তুমি ইহাকে পুত্ত্রের ন্যায় প্রতিপালন করিবে এবং ভদ্রসন্তানের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করাইবে। যখন এই বালকের বাইশ বৎসর বয়ঃক্রম হইবে, সেই সময় তুমি যেখানেই থাক না, সেইখান হ’তে ইহাকে লইয়া যাইব। যদিও এই বালকটি ব্রাহ্মণ কুমার, কিন্তু তথাপি কোন কারণ বশতঃ তুমি ইহার উপনয়ন দিবে না; আমি লইয়া গিয়া যাহা করিতে হয় করিব।

কৃষ্ণনাম বাবুর তখন দেহবৃক্ষে কোন ফল ফলে নাই, কাজেই স্বামীজির এই প্রস্তাবে অতীব আনন্দ প্রকাশ করিল এবং আদরের সহিত তোমাকে গ্রহণ করিল।

এইরূপে সন্ন্যাসী মহাশয় তোমাকে শান্তিপুরে কৃষ্ণনাম বাবুর করে সমর্পণ করিয়া প্রস্থান করিলেন, কৃষ্ণনাম বাবু ও তাহার পত্নী তোমাকে পুত্ত্রের ন্যায় লালনপালন করিতে লাগিলেন।

এই ঘটনার কিছুদিন পরে কৃষ্ণনাম বাবুর পত্নী গর্ভবতী হইলেন এবং যথাকালে একটী কন্যা প্রসব করিয়া সূতিকারোগে সেই সূতিকা ঘরেই প্রাণত্যাগ করিলেন।

পত্নীবিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে কমলা হতভাগ্য কৃষ্ণনাম বাবুকে পরিত্যাগ করিলেন, কাজেই তার ঘোর মতিচ্ছন্ন উপস্থিত হইল, হিতাহিতজ্ঞান ও মনুষ্যত্ব সহসা অদৃশ্য হইয়া গেল এবং খোদ পিশাচ আসিয়া তাহার হৃদয়রাজ্য অধিকার করিয়া বসিল।

কৃষ্ণনামের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হরিনামের রূপলাবণ্যবতী এক বিধবা ভাৰ্য্যা ছিল, তাহার নাম ভবতারিণী দেবী, পাপিয়াসী পূড়োর জমিদার কৃষ্ণকমল রায়ের ভ্রাতৃকন্যা, কিন্তু পাপিয়াসী বিধবা হইয়া পিত্রালয়ে না থাকিয়া এই শান্তিপুরে বাস করিত।

একমাত্র কৃষ্ণনামের পতিব্রতা ধৰ্ম্মপুত্নীর বিরহে তাহার শান্তিময় সংসারে যেন প্রেতের হাট বসিল, কিছুমাত্র শৃঙ্খলা রহিল না। কারণ ধর্ম্মের ঘরে পাপ ঢুকিয়াছে, নরাধম কৃষ্ণনামের সঙ্গে ডাকিনী তুল্য ভবতারিণীর অবৈধ পাপ প্রণয় হইয়াছে।

এই সংসারে পাপী যতই গোপনে পাপকাজ করুক না, বুদ্ধি খরচ ক’রে যতই প্রচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করুক না, কিন্তু কোথা হ’তে কি সূত্রে তার যে সেই সাবধানতার জাল ছিন্ন হ’য়ে যায়, মুখে মুখে জগতে পাপকথা প্রকাশ হ’য়ে পড়ে, তাহা স্থির করিবার ক্ষমতা কাহারো নাই। এই জগতে সকলেই চতুর, সকলেই বুদ্ধিমান, আত্মগোপন করতে সকলেই সমান যত্নবান, কিন্তু ধর্ম্মের নিকট কাহারও চাতুরী খাটে না, মানবের সমস্ত ক্ষীণচেষ্টা সম্যরূপে ব্যর্থ হ’য়ে থাকে।

এই চিরপ্রচলিত নিয়মটা নরাধম কৃষ্ণনামের ভাগ্যে অন্যথা হইল না। ক্রমে কাণাকাণি আরম্ভ হইল, যে যাহার কিঞ্চিৎ বিশ্বাসের পাত্র কি আত্মীয়স্বজন, তাহাকেই সে এই কথা বলিত, ও পাছে না প্রকাশ হয়, তার জন্য নিবারণ করিত কিন্তু ফলে এইরূপ মুখে মুখে বিশ্বাসী লোকের দ্বারায়ই কথাটা গ্রামময় প্রচার হইয়া পড়িল। শেষে এমন গোলমাল হইয়া উঠিল যে, দেশে আর কৃষ্ণনামের মুখ দেখানো ভার হইল।

কৃষ্ণনাম খুব তাড়াতাড়ি সস্তাদরে মহল কয়খানি বিক্রয় করিয়া ফেলিল এবং যতদূর পারিল নগদ টাকা সংগ্রহপূর্ব্বক পাপিনীকে ও ভ্রাতৃকন্যাটিকে এবং তোমাকে লইয়া দেশ হইতে পলায়ন করিল। ভবতারিণীর ভ্রাতারা এই দুঃসংবাদে নিতান্ত মৰ্ম্মাহত হইল, বিশেষরূপ অপমান বোধ করিল এবং পাপাত্মা কৃষ্ণনামকে এই পাপকার্য্যের জন্য উপযুক্ত দণ্ড দিতে কৃতসঙ্কল্প হইল। কিন্তু পাপিনীর উপযুক্ত ভ্রাতা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়, অনেক চেষ্টা করিয়াও পাপাত্মার সন্ধান করিতে পারিল নাই। কারণ পাপিষ্ঠ কিষণলাল বাজপাই কণোজি ব্রাহ্মণ সাজিয়া অতি সাবধানে মুরশিদাবাদে বাস করিতে লাগিল, সেইজন্য আজও লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু প্রতিহিংসা প্রবৃত্তিকে নিবৃত্ত করতে পারেন নাই, কিন্তু একদিন নিশ্চয় তাহার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে। কারণ পাপ ক’রে কেহ কখন চিরকাল পরিত্রাণ পায় নাই। সিংহের ঔরসে যেমন শৃগাল জন্মায়, হীরের খনি হ’তে যেমন কয়লা উঠে, তেমনি জহরলাল বাবুর বংশে এমন কুলাঙ্গার কুপুত্ত্র জন্মিয়াছে। পাপাত্মা অমন সোণার সংসার ছারেখারে দিল, কেবল তোমাকে ও তাহার ঔরসজাত কন্যা নির্ম্মলাকে লইয়া জন্মের মতন দেশত্যাগী হইল, পাপিনী ভবতারিণীও বিষ্ঠার ন্যায় সর্ব্বাঙ্গে কলঙ্কের কালিমা মাথিল।”

আমি সাধ্যানুসারে আমার অশান্ত অন্তরকে শান্ত করিয়াছি বটে, বলপূর্ব্বক ভুলিবার চেষ্টা করিয়াছি সত্য, কিন্তু আজ নির্ম্মলার নাম শুনিয়া তাহার মোহিনীমূর্ত্তি সহসা আমার হৃদয় দর্পণে প্রতিফলিত হইল, আমি মানসনেত্রে সেই অপরূপ রূপমাধুরী দেখিতে লাগিলাম, কাজেই একটু বিমনা হইয়া পড়িলাম।

আমাকে অন্যমনস্ক দেখিয়া সেই ত্রিকালজ্ঞ ব্রহ্মচারী মহাশয় হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “ওকি ভাবিতেছ, ওসব অনিত্য চিন্তাকে অন্তর হ’তে অন্তর্হিত কর, কারণ একমাত্র মনকষ্ট ভোগ ভিন্ন আর উহাতে কোন লাভ হইবে না। তোমাদের দুজনারি ভাগ্য একসূত্রে গ্রথিত, কাহারও বাসনা পূর্ণ হইবে না। তোমার জীবনস্রোত ভিন্ন পথ দিয়া প্রবাহিত হইবে, আর কণ্টকবৃক্ষের সেই গোলাপ ফুলটি বিকশিত হবার পূর্ব্বেই বিশুষ্ক হইয়া যাইবে, তাহার সৌরভ গ্রহণ কাহারও ভাগ্যে ঘটিবে না।”

ব্রহ্মচারী মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমি যথেষ্ট লজ্জিত হইলাম, কারণ আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, যোগবলে আমার প্রাণের সমস্ত কথা উনি জানিতে পারিয়াছেন। তাহ’লে সম্ভবতঃ নিৰ্ম্মলা এক্ষণে কোথায় কিরূপ অবস্থায় আছে, তাহা এই মহাপুরুষের পরিজ্ঞাত থাকা সম্ভব। ইনি ভিন্ন আমার মনের সেই বিষম খটকা আর কেহ মিটাইতে পারিবে না। আমি মনে মনে এই স্থির ক’রে অতীব মিনতির সহিত কহিলাম, “প্রভো! এই জগতে ভূত ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান, এমন কি কপট মনুষ্যের গূঢ় হৃদয়াভ্যন্তর অবধি যে প্রভূর জ্ঞানচক্ষুর আয়ত্বাধীন, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। আপনি সব জানেন, সুতরাং এক্ষণে কৃপা ক’রে আমাকে বলুন যে, সেই নিৰ্ম্মলা এক্ষণে কোথায় কিরূপ অবস্থায় আছে। আমি প্রভু সমক্ষে শপথ ক’রে বলছি যে, সামান্য কৌতুহল পরিতৃপ্তের জন্য, কি কোন উদ্দেশ্যের বশবর্ত্তী হ’য়ে আপনাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করছি না। আমি সেই বালিকার সম্বন্ধে বিশেষ কোন অমঙ্গলের সংবাদ শুনিয়াছি।”

আমার প্রকৃত কথার উত্তর না দিয়ে ব্রহ্মচারী মহাশয় কহিলেন, “তুমি কি অমঙ্গলের সংবাদ শুনিয়াছ?”

আমি। কয়েদখানায় এক বেটা মুসলমান্ বদমাইসের সহিত আমার দেখা হয়েছিল, ছদ্মবেশী কিষণজি বাবুর একদলের লোক, বোধ হয় সংসার সম্বন্ধেও জানাশুনা ছিল, সম্ভবতঃ সদাসর্ব্বদা দেখা সাক্ষাৎও হইত। সেই বেটা আমাকে কহিল যে, “কিষণজি বাবুর কন্যা বেশ্যা হইয়াছে।”

ব্রহ্মচারী মহাশয় জীব কাটিয়া কহিলেন, “মহাভারত, একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, কার সাধ্য যে, সেই পবিত্রাকুমারীর পবিত্র অঙ্গে হস্তার্পণ করে, সে বেটা তোমাকে মিথ্যা কথা কহিয়াছে। নিৰ্ম্মল-নিৰ্ম্মলার জাতিকুল অব্যাহত আছে, সেজন্য তুমি বিন্দুমাত্র উৎকণ্ঠিত হইও না। তবে এক্ষণে নিৰ্ম্মলা কোথায় ও কি অবস্থায় আছে, তাহা তোমার জানিবার কোন আবশ্যক নাই। ভবিষ্যতে যখন কিছুতেই আশা পূর্ণ হবে না, তখন আর মিছে পরের ভাবনা ভেবে নিজের মনকে ক্লিষ্ট ক’রে কি লাভ হবে? তবে এই মাত্র জেনে রাখ যে নির্ম্মলার হৃদয়-রাজ্যে কেহ অধীশ্বর হবে না, কুমারী অবস্থায় সে ইহধাম হ’তে প্রস্থান করবে। কেবলমাত্র তোমার প্রমত্ত মনকে প্রবোধ দিবার অভিপ্রায়ে এই গুপ্তকথা ব্যক্ত করিলাম। তারপর আর যে কথা শুনিবার তোমার সাধ আছে, তাহা তুমি উপযুক্ত সময়ে শুনিবে। সেই সময় তোমার মনের সকল সন্দেহ ভঞ্জন হবে ও প্রকৃত ব্যাপার স্পষ্ট বুঝিতে পারিবে। তোমার সেই সুসময় আসিতে আর দু’বৎসরমাত্র অবশিষ্ট আছে। এই দুই বৎসর সম্ভ্রান্ত বড় লোকদের সঙ্গে মিশে তাদের আচার ব্যবহার, কাণ্ডকারখানা দেখ, তাহ’লে তুমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিবে যে, টাকা থাকলেই সংসারে মানুষে সুখী হ’তে পারে না।

যদিও ব্রহ্মচারী মহাশয় আমাকে প্রকারান্তরে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে বারণ করিলেন, কিন্তু তথাপি মনের আবেগ প্রযুক্ত পুনরায় আমি কহিলাম, “পরের কথা জানিবার কোন আবশ্যক নাই, আমি সে সন্ধানের কোন কথা জিজ্ঞাসা করিব না। তবে এক্ষণে বলুন সেই মহাপুরুষ আমাকে কি সূত্রে কোথায় পাইলেন, আর আমার পিতা মাতা কে?”

ব্রহ্মচারী মহাশয় হাসিয়া কহিলেন, “আর কিছুদিন তোমার এই কৌতুহলকে দমন করিয়া রাখ, কারণ সে সব কথা শুনিবার এখন উপযুক্ত সময় আসে নাই। তোমার আরো উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি হবে ব’লে সেই মহাত্মা সে সব কথা বলতে আমাকে নিষেধ ক’রেছেন। কাজেই তোমাকে আরও দুই বৎসর অপেক্ষা করিতে হইবে।

আর অধিক পেড়াপিড়ি করিতে আমার সাহস হইল না, কাজেই নিরস্ত হ’তে হ’লো, ও সম্বন্ধের আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। আমি কেবল মনে মনে নরাধম কৃষ্ণনাম বাবু ওরফে কপট কিষণজি ও ডাকিনী তুল্য গিন্নির কথা ভাবিতে লাগিলাম এবং এইরূপ কিছুক্ষণ চিন্তার পর সর্ব্বসন্তাপহারিণী নিদ্রাদেবী তাঁহার শাক্তিময়কোলে আমাকে স্থান দান করিলেন।