» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ

ব্রহ্মচারী মহাশয়।

পাপিষ্ঠ সাঁইজির নিকট হ’তে এই দুঃসংবাদ শুনে অবধি, আমার মনের সেই প্রশান্ত ভাবটুকুন রবিকরস্পর্শে নীহার বিন্দুর ন্যায় অদৃশ্য হ’য়ে গেল। রাত্রদিন এই কথাই জপমালা হইল, কাজেই কাজ কৰ্ম্মে তেমন আর মন লাগিল না, প্রায় সকল সময়ে বিমনা হইয়া থাকিতাম।

সুচতুর মির্জ্জা সাহেব আভাষে আমার এই চিত্তচাঞ্চল্যের বিষয় পরিজ্ঞাত হইলেন, কিন্তু তিনি ঠিক ব্যাপার বুঝিতে পারিলেন না, তাঁহার ধারণা হইল যে, সেই কুমারী অন্য পাত্রের অঙ্কশায়িনী হ’য়েছে, তাই আশাভঙ্গে এরূপ বিমনা হ’য়ে প’ড়েছে।

মির্জ্জা সাহেব এই মনে ক’রে আমাকে প্রবোধ দিবার ছলে দু-একটা ঠাট্টা করতে ছাড়লেন না, কিন্তু আমি তাহাকে প্রকৃত ব্যাপার প্রকাশ করিয়া বলিলাম না, প্রাণের যাতনা, মনের উদ্বেগ সাধ্যানুসারে গোপন করিলাম। কাজেই আশাভঙ্গে আমি যে ঈদৃশ মৰ্ম্মপীড়িত হ’য়েছি, এই ধারণাই মির্জ্জা সাহেবের মনে বদ্ধমূল হইল।

শ্রাবণ মাসের শেষে আমার জেল হইয়াছিল, দেখতে দেখতে পুনরায় শ্রাবণ মাস এলো, কাজেই আমার এক বৎসর মিয়াদ পূর্ণ হইয়া গেল।

খালাসের দিন প্রাতঃকালে মির্জ্জা সাহেব হর্ষভরে আমাকে কহিলেন, “ভাই হরিদাস, আজ তুমি খালাস হইবে, তোমার কর্ম্মভোগ শেষ হ’য়েছে, আর তোমাকে এই পাপপুরীতে অন্ন গ্রহণ করতে হবে না। কিন্তু এ অধমকে একেবারে ভুলিও না, মনে ঠিক জেনো এ দেখাই আমাদের শেষ দেখা নয়, কোন না কোন সময়ে আমরা দুজনে পুনরায় মিলিত হবো।”

আমি মনের আবেগ ভরে কহিলাম, “আপনি আমাকে চিরকৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করিয়াছেন। আপনার বিপুল ঋণ আমি ইহজন্মে কিছুতেই পরিশোধ করতে পারবো না। মহাশয়ের এই অসীম অনুগ্রহ কোনকালেও বিস্মৃত হ’তে পারবো না। আপনার কৃপায় এই পাপপুরীতে এক বৎসরকালে পরমসুখে কাটাইলাম, কোন বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট নাই। আমি হিন্দু, আপনি মুসলমান, কিন্তু তথাপি আমার প্রতি আপনার ঈদৃশ কৃপা, মহাশয়ের অসীম মহত্ত্ব ও উদারতার পরিচায়ক। ফলকথা আমি যতদিন জীবিত থাকিব, ততদিন আপনার মোহন-ছবিখানি আমার স্মৃতিমন্দিরে বিগ্রহরূপে বিরাজ করিবে।

মির্জ্জা সাহেব সস্নেহে উত্তর করিলেন, “ভাই, মানুষের যাহা কর্ত্তব্য, আমি কেবলমাত্র তাহাই করিয়াছি, সুতরাং তার জন্য তোমাকে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হ’তে হবে না। তুমি এক বৎসরের জন্য এখানে আটক ছিলে, কিন্তু এই এক বৎসরের মধ্যে জগতে কত পরিবর্ত্তন হ’য়েছে। সম্প্রতি আর একজন নূতন সুবেদার বাঙ্গালার মসনদে বসেছেন।

আমি। কেন, পুরাতন সুবেদার সাহেবের কি মৃত্যু হ’য়েছে?

মির্জ্জা। না, তিনি রাজকার্য্যে অনুপযুক্ত ব’লে তাকে সরিয়ে তার স্থানে তার জামাতা নবাব হ’য়েছে।

আমি। এই হিন্দুস্থান মধ্যে এমন শক্তিশালী পুরুষ কে, যাঁর কথায় বাঙ্গালা বেহার উড়িষ্যার সুবেদার বাহাল বরতরফ হয়?

মির্জ্জা। ইংরাজ, লোকে যেমন নিজের হাতে-গড়া পুতুল অনায়াসে ভেঙ্গে ফেলতে পারে, তেমনি ইংরাজেরা এই অকর্ম্মণ্য বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরকে বাঙ্গালার মসনদে বসিয়েছিলেন, এখন আবার সেই ইংরাজ তাকে কাণে ধ’রে নামিয়ে, তার জামাই মিরকারিসকে নবাব ক’রেছে।

আমি। ইংরাজের যখন এতদূর ক্ষমতা তখন আর এরূপ পুতুল নিয়ে খেলা করা কেন? সকলকে তাড়িয়ে নিজেরা বলেইতো সব গোল চুকে যায়।

মির্জ্জা। তার অধিক দেরি নাই। তবে ইংরাজেরা অতীব চতুর, সহসা হটকারিতার পরিচয় দেন না, তিন চাল ভেবে তবে একটি বড়ে টেপেন, তবে মিরকাসিম পূর্ব্ব নবাবের ন্যায় অপদার্থ নহেন, তিনি শক্তিশালী ন্যায়নিষ্ঠ উন্নতমনা পুরুষ, শাসনকর্ত্তার অনেক গুণ তাঁহার আছে, বোধ হয় কিছুদিনের জন্য তিনি তাঁহার অধিকার বজায় রাখতে পারবেন। যাহা হউক তুমি এক্ষণে কোথায় যাইবে স্থির করিয়াছ?

আমি। এই সংসারে আমার নির্দ্দিষ্ট স্থান নাই, স্রোতের মুখে তৃণের ন্যায় ভাসছি, তবে ভাগ্যক্রমে এক মহাপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হ’য়েছিল, তিনি রূপা ক’রে আমাকে তাঁর ঠিকানা ব’লে দিয়েছেন, ‘আমি এখান হ’তে সেইখানে যাব মনে মনে স্থির ক’রেছি।

মির্জ্জা। ঠিক্ কথা, সম্ভবতঃ স্বপ্নযোগে সেই মহাপুরুষই আমাকে দেখা দিয়েছিলেন এবং তোমাকে যত্নে রাখতে অনুরোধ ক’রেছিলেন। যাই হোক্‌ সেই মহাপুরুষ কোথায় থাকেন এবং তাহার নাম কি?

আমি। মিরঘাটার কালীবাড়ীতে তিনি থাকেন, তাঁর নাম বামাচরণ ব্রহ্মচারী। লোকে পথের মাঝে যেমন অমূল্য নিধি কুড়িয়ে পায়, তেমনি আমি হাবুজখানার মধ্যে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইয়াছিলাম। নমাজের সময় শঙ্খঘণ্টা ধ্বনি ক’রেছিলেন ব’লে তিনি ধৃত হ’য়েছিলেন, কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য! তিন দিনের দিন খোদ সুবেদার সাহেব তাঁহার মুক্তির জন্য অনুরোধ ক’রেছিলেন। এই তিন দিনের মধ্যে তিনি জল পর্য্যন্ত গ্রহণ করেন নাই; অথচ তাঁহার মুখ শুষ্ক কি চিত্তের বিন্দুমাত্র অবসাদ ঘটে নাই।

মির্জ্জা। তিনি নিশ্চয় একজন মহাপুরুষ ও ঈশ্বরজানিত ব্যক্তি। এ সংসারে যে ভগবানের যথার্থ ভক্ত, তাঁহার নিকট প্রতাপশালী সম্রাটকেও মস্তক অবনত করতে হয়। কিন্তু কৰ্ম্মজগৎ হ’তে অপসৃত এরূপ মহাপুরুষ যখন তোমার মঙ্গলের জন্য লালায়িত ও সুখস্বচ্ছন্দের জন্য ব্যস্ত, তখন ভাই, তুমি কখনও সামান্য ব্যক্তি নও। কেন না, সারবান বৃক্ষ ব্যতীত মলয়-মারুত-স্পর্শে অন্য কোন তরুতে চন্দন হয় না। যাই হোক্, এ জগতে সঙ্গগুণে সাধনহীন অধম মানবও কৃতার্থ হ’য়ে থাকে; সুতরাং কুসুম পরশে তৈল যেমন সুরভিত হয়, সেইরূপ আমি অধম যবন হয়েও স্বপ্নাবস্থায় সাধু দর্শন ক’রে চরিতার্থ হ’য়েছি, যদি ভাগ্যে থাকে তাহ’লে একদিন না একদিন প্রত্যক্ষে সেই মহাপুরুষের শ্রীচরণ দর্শন করবো।”

মুসলমানের মুখে ঈদৃশ ভক্তিরসে সিঞ্চিত অদ্বৈতভাবপূর্ণ সদর্থযুক্ত মধুর বাক্য শ্রবণে নিতান্ত বিস্মিত হ’লাম। আমি পূৰ্ব্ব হ’তেই এই মুসলমান যুবকের অনেক সদ্‌গুণের, উদার ভাব ও মহত্বের পরিচয় পেয়েছিলাম, সুতরাং আমার স্পষ্ট প্রতীত হইল যে, এই বৈষম্যময় সংসারে কিছুই বিচিত্র নহে। বিধাতার ইচ্ছা হ’লে সাপের মুখ দিয়েও সুধাক্ষরণ হ’তে পারে, কয়লার খনিতে হীরক জন্মায় ও মরুপ্রদেশে শতদল বিকশিত হ’য়ে থাকে।

যাহা হউক, সহৃদয় মির্জ্জা সাহেব ছলছল নেত্রে আমাকে বিদায় দিলেন। আমি যমপুরী সদৃশ কারাগার হ’তে বহির্গত হ’লাম ও সেই মহাত্মার নির্দ্দেশমত মীরঘাটার দিকে যাত্রা করিলাম।

ক্রমে আমি সহরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম এবং অপার বিস্ময়হ্রদে নিমগ্ন হইলাম। কারণ আজ মুর্শিদাবাদ নগরী বিবিধ সাজে সজ্জিতা হ’য়ে বসন্ত সমাগমে বলস্থলি, কি স্বামী আগমনে সালঙ্কারা কামিনীর ন্যায় পরিদৃশ্যমান হচ্ছে। রাজপথের উভয় পার্শ্বস্থ অট্টালিকাশ্রেণী বিবিধ পত্র, পুষ্প ও পল্লবে শোভিত, নাগরিকেরা উৎসবে উন্মত্ত, সকলেই বিচিত্র বেশভূষায় ভূষিত হ’য়ে নগর ভ্রমণে বহির্গত হ’চ্ছে, স্থানে স্থানে রাস্তার উপর চাঁদোয়া খাটিয়ে আসর হ’য়েছে এবং তয়ফাদারদের নাচ গান হ’চ্ছে, দলে দলে মাতালেরা কাণ্ডজ্ঞানকে গলা ধাক্কা দিয়ে রীতিমত মদের মহিমা প্রকাশ করছে ও খোদ পিশাচকে এনে যেন কণ্ঠে বসিয়েছে।

আমি এই সকল তামাসা দেখতে দেখতে ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হ’তে লাগলাম, কিন্তু কিসের জন্য যে এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়েছে, কেন যে নগরবাসীরা আনন্দসাগরে ভাসছে, তাহা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না; কাজেই নিতান্ত সন্দেহাকুলিতচিত্তে আমার গন্তব্য স্থানের দিকে যাইতে লাগিলাম।

খানিকদূর গিয়া ভদ্রবেশধারী একজন মুসলমানকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সাহেব! কিসের জন্য সহরে এরূপ উৎসবের আয়োজন হ’য়েছে?”

তিনি একবার আমার মুখের উপর খরদৃষ্টিপাত ক’রে উত্তর করিলেন, “তুমি কি সহরের লোক নও, কোথা হইতে আসিতেছ?”

আমি ঈষৎ অপ্রভিত হ’য়ে মিনতির সহিত কহিলাম, “আজ্ঞে! আমি অন্য অন্য স্থান হ’তে এখানে এসেছি, সেইজন্য ভদ্রলোক দেখে আপনাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করলাম।”

সেই ভদ্রলোকটী হাসিতে হাসিতে কহিলেন, “বাঙ্গালা বিহার উড়িষ্যার নূতন সুবেদার বাহাল হইল, তাঁহার মান্যর জন্য এই উৎসবের অনুষ্ঠান হইয়াছে এবং ইহার জন্য রাজকোষ হ’তে দুই লক্ষ টাকা বরাদ্দ হ’য়েছে। কিন্তু এদিকে দেশের একপ্রান্ত হ’তে অন্য প্রাস্ত অবধি দুর্ভিক্ষ রাক্ষসী করাল বদন বিস্তার করিয়াছে। যে আপদ এদেশে কখন ছিল না, কেহ কখন কর্ণেও শুনে নাই নূতন বন্দোবস্তের গুণে সেই আপদ এক্ষণে প্রত্যক্ষ উপস্থিত হ’য়েছে। বিধাতার কৃপার শস্য শ্যামলা উর্ব্বর ভূমি এই বঙ্গদেশে কেহ কখন অনাহারে মরে নাই, কিন্তু হায়! বলতে হৃদয় বিদীর্ণ হয়, এখন সেই বঙ্গদেশের লক্ষ লক্ষ লোক উদর জ্বালায় কাতর হ’য়ে পশুদের ন্যায় শাক পাতা ভক্ষণ করছে, একমুষ্টি অন্নের জন্য হৃদয়পুত্তলি সদৃশ পুত্ত্রকে বিক্রয় করতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। অথচ এখনও পুরো তেজে রাজস্ব আদায় চলিতেছে এবং দুর্ভিক্ষ-পীড়িত অনাহারি প্রজার হৃদয়ের শোণিততুল্য অর্থ এরূপ তামসিক ব্যাপারে জলের ন্যায় খরচ হ’চ্ছে। মীরকাসিম একজন হৃদয়বান পুরুষ সত্য, শাসনকৰ্ত্তা হবার যোগ্য ব্যক্তি বটে, কিন্তু তাহার পরমহিতৈষী, নিতান্ত উপকারী ইংরাজ বাহাদুরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে পারবেন না। তারা ইচ্ছামত কামধেনু দোহন করবে, তাতে কথা কইলেই নবাব বাহাদুরের মান থাকবে না?”

সেই ভদ্রলোকটী এই সকল কথা ব’লে আর উত্তরের প্রতীক্ষা না ক’রে বাঁ দিক্‌কার একটা গলির মধ্যে প্রবেশ করিলেন ও মুহূৰ্ত্তমধ্যে অদৃশ্য হইয়া পড়িলেন। যেন স্বরে কাক কি কোকিল বুঝিতে পারা যায়, তেমনি কথা শুনিলেই লোকটা ভদ্র কি অভদ্র, সহৃদয় কি নিষ্ঠুর, তাহার অনেকটা আঁচ পাওয়া গিয়া থাকে। সুতরাং এই ভদ্রলোকটা জাতিতে মুসলমান হইলেও মির্জ্জা সাহেবের ন্যায় ধর্ম্মভীরু ও উচিতবক্তা যে তাহাতে আর অণুমাত্র সন্দেহ নাই। অনেক সৰ্প যেমন সুন্দর ও মনোরম, তেমনি অনেক বদমাইস অভদ্র ব্যক্তি ভদ্রভাবে সজ্জিত হ’য়ে থাকে, কাজেই বেশভূষা দেখে ভদ্র অভদ্র ঠিক্ বুঝতে পারা যায় না, কিন্তু যথার্থ পরদুঃখ-কাতর সহৃদয় ভিন্ন কোন ক্ষুদ্রচেতা স্বার্থপরের অন্তর হ’তে এ প্রকার উচ্ছ্বাস কিছুতেই বহির্গত হ’তে পারে না। তাহ’লে মুসলমানদের মধ্যেও যে অনেক পরদুঃখ-কাতর মহানুভব ব্যক্তি বর্ত্তমান আছেন, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই।

এই মুসলমান ভদ্রলোকটীর এই সকল কথা শুনিয়া আমার অন্তরের যথেষ্ট ভাবান্তর ঘটিল, রাস্তার উপর বাইজিদের গান শুনতে ও ভাঁড়েদের ভাঁড়ামো দেখতে আর ইচ্ছা হইল না। আমি একজন হিন্দু পথিককে মীরঘাটার রাস্তা জিজ্ঞাসা করিয়া দ্রুত পদসঞ্চারে সেই দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম।

বেলা আন্দাজ একটার সময় ঠিক্ সেই কালীবাড়ির সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখলাম সে স্থানটি বেশ মনোরম স্বভাবের সুদৃশ্যে শোভিত ও কলনাদিনী গঙ্গার ধারে অবস্থিত। সহর হ’তে এ স্থানটী তিন ক্রোশের কম হইবে না, পূর্ব্বে এ স্থানটী এক প্রকার জনমানব পরিশূন্য নির্জ্জন ছিল। সম্প্রতি জনকয়েক সম্ভ্রান্ত মুসলমান নিকটে বাগানবাড়ী নিৰ্ম্মাণ ক’রেছেন, সেইজন্যই ব্রহ্মচারী মহাশয় ওপ্রকার বিপন্ন হ’য়েছিলেন।

আমি দেখিলাম যে, সেখানে কোন মন্দির নাই, বোধ হয় পাছে উচ্চশির মন্দির দেখিলে হিন্দুদ্বেষীদের পাপদৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, এই ভয়ে এ প্রকার গুপ্তভাবে জগদম্বার মূর্ত্তি কোন মহাপুরুষ প্রতিষ্ঠা ক’রেছেন।

চারিদিকে আম কাঁঠাল প্রভৃতি ফলের বাগান, তাহার ঠিক মধ্যস্থলে একহারা একটা কুটুরিতে জগদম্বার প্রস্তরময়ী মূৰ্ত্তি বিরাজমানা আছে, কুটীরের দুয়ারে দুখানি উলুছাউনি মেটে ঘর শোভা পাচ্ছে ও চারিদিক্ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত আছে।

সদর দরজা খোলা ছিল, কাজেই আমি ভিতরে প্রবেশ ক’রে দেখলাম যে, উলুচালে আচ্ছাদিত সেই কুটীরের সেই রকের উপর কুশাসনে সেই ব্রহ্মচারী মহাশয় ও জটাজুটধারী তেজপুঞ্জ কলেবর আর একজন সন্ন্যাসী বসিয়া আছেন। বোধ হয় যেন ইতঃপূর্ব্বে আমারই কথা হইতেছিল, কারণ আমাকে দেখিয়াই ব্রহ্মচারী মহাশয় মৃদুহাস্যে কহিলেন, “ঐ দেখুন, এসে হাজির হ’য়েছে।”

আমি রকের উপর গিয়ে ভক্তিভরে ব্রহ্মচারী মহাশয়ের পদতলে প্ৰণত হ’লাম ও সেই সন্ন্যাসী মহাশয়ের পদধূলি গ্রহণ করিলাম। তিনি ইঙ্গিতে আমাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন, কিন্তু মুখে কোন কথা বলিলেন না, প্রস্তরে নির্ম্মিত মূর্ত্তির ন্যায় নিশ্চলভাবে সেইখানে বসিয়া রহিলেন। তবে ব্রহ্মচারী মহাশয় হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “বেলা অধিক হ’য়েছে, গঙ্গা হ’তে স্নান ক’রে এসো, অনেকক্ষণ জগদম্বার ভোগ হ’য়ে গেছে, আহারাদির পর অন্যান্য কথাবার্ত্তা হবে।”

ব্রহ্মচারী মহাশয়ের কথায় কোনরূপ প্রতিবাদ করতে আমার সাহসে কুলাইল না, কাজেই চাদরখানি সেইখানে রেখে স্নানার্থে গমন করিলাম।

মাতৃকোলে স্থান পেলে যেমন আনন্দের পরিসীমা থাকে না, তেম্‌নি অনেক দিনের পর পুণ্যসলিলা কলুষহারিণী ভাগিরথীর শীতল জলে অবগাহন ক’রে আমিও নিরতিশয় প্রীত হ’লাম। আমার অন্তরের মালিন্য রাশিও যেন বিধৌত হ’য়ে গেল, কাজেই অনেকটা প্রফুল্ল মনে আমি সেই ঠাকুর বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম।

আমি আসিয়া দেখি যে, মার গৃহের বামদিকের ছোট মেটে ঘরের দাওয়ার উপর কুশাসনে একখানি নূতন কাপড় ও সম্মুখে কলাপাতে অন্ন ব্যঞ্জন প্রস্তুত র’য়েছে। আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, তত্ত্বজ্ঞানী ব্রহ্মচারী মহাশয়, যোগবলে আমার আগমন পূর্ব্ব হ’তেই পরিজ্ঞাত হ’য়েছিলেন, সেইজন্য সব প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছেন।

ব্রহ্মচারী মহাশয়ের আজ্ঞামত আহারে বসিলাম, তিনিও স্বতন্ত্র একখানি কুশাসনে একটু অন্তরে উপবেশন করিলেন। আমি আহারে বসিয়া সেই গৃহমধ্যে ঘন ঘন দৃষ্টি সঞ্চালন করিতেছি, এমন সময় ব্রহ্মচারী মহাশয় হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “ঘরের মধ্যে কি দেখিতেছ?”

আমি যেন একটু অপ্রতিভ হ’য়ে কহিলাম, “আজ্ঞে, আপনি যে সেই তাঁতি মেয়েটার কথা বলেছিলেন, সে এখানে আছে কি না, তাই দেখিতেছিলাম।”

ব্রহ্মচারী মহাশয় গম্ভীরভাবে উত্তর করিলেন, “না জগদম্বা তাদের প্রতি প্রসন্না হ’য়েছেন। তাইতে সে এখন স্বামীগৃহে গিয়ে পুনরায় সুখের মুখ দেখতে পেয়েছে।”

আমি আগ্রহের সহিত কহিলাম, “তাহার স্বামী তো পাগল ছিল?

ব্রহ্ম। হাঁ, কিন্তু স্বহস্তে শত্রুকে খুন করবার পর হ’তেই তার পাগলামী সেরে যায়, এই সহরের মধ্যে এক তাঁতির বাড়ী লুকিয়ে থাকে। আমি কোন গতিকে জানতে পেরে তাকে এখানে আনি এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলন করিয়ে দিই। কিন্তু এখানে তাকে অধিক দিন রাখতে আমার সাহস হলো না, কাজেই আমার একজন সম্পন্ন শিষ্যকে একখানি পত্র লিখে তাকে কলিকাতার পাঠিয়ে দিয়েছি, সে এক্ষণে স্ত্রী সহ কলিকাতায় বাস করিতেছে। সুতরাং আমি একটা মহাদায় হ’তে মুক্ত হ’য়েছি।

এই সংবাদে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হইলাম এবং সেই যুবকের আরও সঠিক সংবাদ শুনিবার আশায় তাঁহাকে কহিলাম, “সেই যুবকের নাম কি? এবং কিরূপে সে নিঃসহায় হ’য়ে শত্রুকে খুন করতে সমর্থ হ’লো?”

ব্রহ্ম। তার নান নীলমণি বসাক, সে রামসদয় বসাকের পৌত্র, তার পিতা ও খুল্লতাত সাহেবদের কয়েদখানার মারা যায় এবং সর্ব্বস্ব নিলামে বিক্রয় হইয়া যায়, শেষে বাকী টাকার জন্য তাহার পত্নীকে ধরিরা আটক করিয়া রাখে। মাণিকলাল সরকার নামে এক বেটা বাঙ্গালীর সাহায্যে ও সন্ধানে এই সব কাজ হ’য়েছে ব’লে তার উপরই যুবকের জাতক্রোধ জন্মায় ও খুন করবার মতলব করে। এ জগতে সাধলেই সিদ্ধ হ’য়ে থাকে, জগদম্বা অসহায়ের সহায় হ’য়ে থাকেন, সুতরাং এই নিঃসহায় যুবক যে সুবিধামতে নিজের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে তাহার আর বিচিত্র কি? যাই হ’ক্, পাপিষ্ঠ মাণিকলালের রক্তে নীলমণির প্রতিহিংসানল প্রশমিত হইয়াছে ও সেই সঙ্গে তাহার পাগলামিও সারিয়া গিয়াছে। সে ব্যবসায়ীর ছেলে, বয়সও অল্প, সুতরাং ব্যবসায় দ্বারায় ক্রমে ক্রমে সে পুনরায় বড়মানুষ হইয়া উঠিবে, কিন্তু পাপিষ্ঠ মাণিকলাল অনেক লোকের সর্ব্বনাশ করে যে টাকা রোজগার ক’রেছিল, শেষে কিরূপে তা শেষ হয়, তাও জগতে সকলে দেখবে।”

আমি। আজ্ঞে, পাপের ফল ঠিক্ ফ’লেছে। মাণিকলালের মৃত্যুতে তার সংসার ছারখার হ’য়ে গেছে, আমি কয়েদখানায় এক বেটা বদ্‌মাইসের মুখে সব কথা শুনেছি, সে বেটাও সেই বাড়ীতে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা প’ড়ে জেল খাছে।

ব্রহ্ম। পাপার্জ্জিত অর্থ জগতে এইরূপেই নিঃশেষ হয়, তবে যিনি চতুর তিনি এই সব অকাট্য প্রমাণ পেয়ে পূৰ্ব্ব হ’তেই সাবধান হন্। তুচ্ছ অর্থের জন্য অনর্থপাতের সূত্রপাত করেন না।

কথায় কথায় অমৃতোপম জগদম্বার প্রসাদ আমি পরিতোষের সহিত আহার করিলাম। ব্রহ্মচারী মহাশয় পাশের ঘরখানি দেখাইয়া দিলেন, আমি তথায় একখানি কম্বল পাতিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম, পথশ্রমে ক্রমে আমার তন্দ্রার আবির্ভাব হইল।

আরতির শঙ্খঘণ্টা ধ্বনিতে আমি জাগ্রত হ’লাম, তখন সন্ধ্যা প্রায় অতীত হ’য়েছে, কাজেই আমি তাড়াতাড়ি জগদম্বার মন্দিরে গেলাম।

আমি দেখিলাম যে, মার মূর্ত্তির দুধারে ঘৃতের প্রদীপ জ্বলছে, ধুনার ধোঁয়ায় চারিদিক আমোদিত হ’য়েছে এবং ব্রহ্মচারী মহাশয় একটী পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে ভক্তিভাবে মার আরতি করছেন, অন্য সন্ন্যাসীটি তথায় নাই।

আমি সেই রকের উপর বসিয়া জগদম্বার আরতি দেখিতে লাগিলাম, কেমন এক প্রকার অনাস্বাদিতপূর্ব্ব অব্যক্ত আনন্দে চিত্তসাগর আলোড়িত হইতে লাগিল, সর্ব্বশরীর কণ্টকিত হইয়া উঠিল ও ক্ষণেকের জন্য মন প্ৰাণ যেন কৰ্ম্মজগৎ ত্যাগ ক’রে মানবুদ্ধির অতীত অন্য এক অভিনব শান্তিময় রাজ্যে প্রবেশ করিল।

ব্রহ্মচারী মহাশয় আরতি শেষ করিয়া আমার সঙ্গে কথাবার্ত্তায় প্রবৃত্ত হ’লেন। আমি প্রথমেই সেই জটাজুটধারী সন্ন্যাসীটি কোথায় জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি সহাস্যবদনে উত্তর করিলেন, “উনি একজন মহাপুরুষ, কৃপা ক’রে একদিনের জন্য আমার এখানে এসেছিলেন, অদ্য বৈকালে পুরীক্ষেত্রে গমন করিলেন।”

আমি এ কথায় নিরন্ত না হ’য়ে পুনরায় কহিলাম, “এ মহাপুরুষের নাম কি?”

ব্রহ্মচারীমহাশয় হাসিতে হাসিতে অম্লান বদনে কহিলেন, “অভয়ানন্দস্বামী।”

এই কথায় আমার চমক যেন ভাঙ্গিল, নির্ম্মলার সেই কথা আমার স্মরণ পথে উদয় হইল। নিৰ্ম্মলা আমাকে কহিয়াছিল, বাবার গুরুদেবের নাম অভয়ানন্দস্বামী, তিনি কাশীতে থাকেন, তিনিই আমাকে প্রতিপালনের জন্য কিষণজি বাবুর নিকট রাখিয়াছিলেন। তাহ’লে ইনিই কি সেই অভয়ানন্দস্বামী? আজ কি কাছে পাইয়াও ধরিতে পারিলাম না? কিন্তু কই তিনি তো আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না, ইহারই বা কারণ কি?

এই সব কথা আমি মনে মনে তোলাপাড়া করছি, এমন সময় সদানন্দময় ব্রহ্মচারী মহাশয় হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “যার ভাবনা তিনিই ভাবছেন, সুতরাং তোমার আর বৃথা ভাবিবার আবশ্যক কি? সুসময় এলে তোমার মনের সকল সন্দেহ মিট্‌বে, এমন কি সংসারে আর কোনরূপ অভাবের নামমাত্র থাকবে না। তবে ধার্য্য সময় অবধি অবশ্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, কারণ মানবের সুখ দুঃখ বিপদ সম্পদ উন্নতি অবনতি সমস্তই সময়সাপেক্ষ; সেই সময় অতিক্রম করবার ক্ষমতা কাহারও নাই। তুমি সংসারে চিরকাল বদমাইস কুলোকের সহবাসে থেকে কষ্টভোগ ক’রে আসছো, কখন সুখের মুখ দেখনি, এইবার দিনকয়েক বড়মানুষের সঙ্গে মিশে বড়নানুষি কর। কেন না সংসারে উচ্চ নীচ সকল সমাজে না মিশলে প্রকৃত অভিজ্ঞতা লাভ হয় না। কাজেই তুমিও দিন কয়েক জন্য সংসারের সম্ভ্রান্ত লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবে ও শীঘ্র নবাব সরকারে তোমার একটী ভাল চাকুরী হবে। তারপর ধার্য্যমত সময় সমাগত হ’লে তোমারও সকল পার্থিব বন্ধন একেবারে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে যাবে।”

আমি ব্রহ্মচারী মহাশয়ের কথার শেষভাগ ততদূর মনযোগের সহিত শুনিলাম না, কারণ তখন বিশেষ আবেগে আমার অন্তর পরিপূর্ণ, কাজেই তিনি বিরত হ’লে আমি অতীব মিনতির সহিত কহিলাম, “প্রভো! যোগবলে কি অন্য কোন প্রকার দৈব-বিদ্যার প্রভাবে আমার সম্বন্ধে যে সব কথা আমি জানি না, তাহা আপনি কিরূপে পরিজ্ঞাত হ’য়েছেন, এক্ষণে কৃপা ক’রে তাহা আমায় বলিয়া আমার অন্তরের কৌতূহলানলকে নির্ব্বাপিত করুন? আমি কিষণজি বাবুর কন্যার মুখে শুনিয়াছি যে, অভয়ানন্দ স্বামী নামে এক মহাপুরুষ বাইশ বৎসরের জন্য তাহার পিতার নিকট আমাকে রাখিয়া গিয়াছিলেন, আপনিও সেই সন্ন্যাসীর নাম অভয়ানন্দ স্বামী কহিলেন, এক্ষণে আমাকে বলুন ইনিই কি আমাকে কিষণজি বাবুর নিকট প্রতিপালনের জন্য দিয়া গিয়াছিলেন?”

আমার কথা শুনিয়া মধুর স্বরে ব্রহ্মচারী মহাশয় কহিলেন, “ভাই হরিদাস! তোমার অনুমান অভ্রান্ত, এই মহাপুরুষই পাপিষ্ঠ কিষণজির করে তোমাকে সমর্পণ ক’রেছিলেম, এক্ষণে তোমার সম্বন্ধে একটা বন্দোবস্ত করবার জন্য এদিকে এসেছিলেন। কারণ তোমার ঈদৃশ ভাগ্যবিপর্য্যয় ও মহাপাপী ছদ্মবেশী কিষণজির অধঃপতন তিনি যোগবলে পরিজ্ঞাত হ’য়েছিলেন, সেই জন্য বাঙ্গালা দেশে আসিয়াছিলেন।”

আমি নিতান্ত বিস্মিতভাবে কহিলাম, “আপনি যখন কিষণজি বাবুকে মহাপাপী ছদ্মবেশী ব’লে উল্লেখ করলেন, তখন কিষণজি বাবুর বিদ্যা ও গুণাবলী নিশ্চয় মহাশয়ের জানা আছে। কিষণজি বাবু যে একজন ঘোর অর্থপিশাচ ও বদমাইস দলভুক্ত, তাহা আমি পূৰ্ব্ব হ’তেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি যে লোকটা কে, কিজন্য মুর্শিদাবাদে এসে বাস ক’রেছেন, পূৰ্ব্বে দেশ কোথায় ছিল তাহা জানি নাই। এক্ষণে প্রকৃতপক্ষে লোকটা কে, সেই সন্ন্যাসী মহাশয়ের সঙ্গে তাঁর কি সম্বন্ধ, তাহা কৃপা ক’রে আমাকে বলুন? আপুনি ভিন্ন আর কেহই আমার অন্তরের এই সন্দেহ ভঞ্জন করতে পারবে না।”

ব্রহ্মচারী মহাশয় হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আচ্ছা কিষণজি বাবু প্রকৃতপক্ষে লোকটা যে কে, কিরূপ অবস্থায় প’ড়ে এখানে এসেছিল, তা তোমাকে খুলে বলবো; কিন্তু এখন নয়, রাত্রিতে তোমার কাছে সব কথা প্রকাশ করবো, এখন আমার অন্য একটু কাজ আছে।”

ব্রহ্মচারী মহাশয় আমাকে এই কথা বলিয়া, জগদম্বার সম্মুখের সেই কুশাসনের উপর পুনরায় উপবেশন করিলেন এবং নির্ম্মীলিত নেত্রে জপে প্রবৃত্ত হইলেন; আমি সেইখানে বসিয়া আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিলাম।