- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
এ কথা কি সত্য?
রহিম মোল্লার খুনের জন্য কাজী সাহেবের সূক্ষ্ম বিচারে আমার এক বৎসরের জন্য কয়েদ হইল। আমার দণ্ড হইল বটে, কিন্তু যে প্রকার ছেলেখেলা প্রমাণ সংগ্রহ ক’রে ও আগাগোড়া মিথ্যা সাক্ষীর এলোমেলো কথার উপর নির্ভর করে আমার সাজা হইল তাহাতে আমি বিস্মিত হইলাম। আমি অপরাধী বলিয়া আদালতে প্রমাণিত হইলাম, তাহা স্মরণপথে উদয় হওয়ায় সেই বিপদের সময়ও আমি না হাসিয়া থাকিতে পারিলাম না। আমি মনে মনে বুঝিয়া দেখিলাম যে, বিদেশী বিধর্ম্মী রাজারা দেশেতে বিচার বিতরণের পরিবর্ত্তে বিক্রয় করে থাকেন, উচ্চ মূল্যে বাজারে যেমন উত্তম জিনিষ মিলে, তেমনি অর্থ ব্যয় করিতে পারিলে, মনের মতন বিচার লাভও হ’য়ে থাকে। কেবল বোকা ভোলাবার জন্য বাজার সরগরম রাখিবার অভিপ্রায়ে ন্যায়ের ভাণ দেখাইয়া বিচারের নামে এ প্রকার অদ্ভুত হাস্যোদ্দীপক প্রহসনের অভিনয় হয়। সামান্য স্বার্থের জন্য চতুরে ন্যাকা সাজে এবং দয়া, ধৰ্ম্ম কি মনুষ্যত্বের সহিত পৃথক হ’য়ে এই বিবেক সম্পন্ন শ্রেষ্ঠজীব মানব, একেবারে পশুর অধম হ’য়ে পড়ে।
কি আশ্চর্য্য, যার নাম ধর্ম্মাধিকরণ, যেখানে সকল সময়ে ধৰ্ম্ম বর্ত্তমান, ন্যায় ধর্ম্ম ও সত্যের সেই পবিত্র স্থানে এ প্রকার প্রেতের হাট ও মিথ্যা কথার এতদূর প্রাদুর্ভাব। টাকা খরচ করতে পারলেও যোগাড়ের গুণে রহিম মোল্লার খুনী মোকদ্দমার ন্যায় আরও শত শত মামলা যে নিষ্পত্তি হ’তে পারে, উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে যায়, রাম শ্যামের হ’য়ে যে সাজা পায়, তাতে আর কোন সন্দেহ নাই। লেখাপড়া শিখে ভদ্রলোক হ’য়ে উকীলেরা সাক্ষীকে যখন অনর্গল মিথ্যা কথা শিখাইয়া দিতে লজ্জা বোধ করেন না, বিচারপতি বিচারাসনে বসিয়া যখন ন্যায়ের মস্তকে পদাঘাত করেন, প্রকৃত সত্যকথা পৰ্য্যন্ত শুনিতে ইচ্ছা করেন না, তখন বিচারের নামে যে এ প্রকার বিড়ম্বনা ঘটিবে তাহার আর বিচিত্র কি? বোধ হয় এই ঘোর কলিকালে মুসলমান অত্যাচার সন্দর্শনে ধৰ্ম্ম ইহধাম ত্যাগ করিয়া অন্যত্রে পলায়ন ক’রেছেন। সেইজন্য যে ব্যক্তি প্রকৃত খুন করিল আদালতে তাহার নামোল্লেখ পর্য্যন্ত হইল না; আর আমি কোন অপরাধ না করিয়াও এক বৎসরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলাম। ধৰ্ম্ম থাকিলে কখনই এ প্রকার বিসদৃশ বিপরীত ঘটনা ঘটিত না।
মুহূৰ্ত্ত মধ্যে এই সন্দেহ মেঘটুকুন আমার অন্তরাকাশে উদয় হইল, কিন্তু শিশির পতনে কমলদল যেমন ছিন্ন ভিন্ন হ’য়ে যায়, তেমনি সেই দেবপ্রতিম তত্ত্বজ্ঞানী ব্রাহ্মণের সদুপদেশ ও লছমীপ্রসাদবাবুর সারত্ব পূর্ণ জ্ঞানগর্ভ কথাগুলি স্মরণপথে উদয় হওয়ায় আমার চিত্তাকাশ পুনরায় সুনিৰ্ম্মল হইল, কাজেই এক প্রকার অব্যক্ত সাহসে আমার হতাশ হৃদয় সুদৃঢ় হইয়া উঠিল।
লছমীপ্রসাদবাবু আমাকে ইতিপূর্ব্বে বলিয়াছিলেন যে, “লোকে রঙ্গ দেখিবার জন্য যেমন রঙ্গালয়ে গমন করে, তেমনি তুমিও বিবিধ রঙ্গ দেখিবার অভিপ্রায়ে সংসার রঙ্গভূমে প্রবেশ করেছ; তবে অতি শীঘ্র তোমার দেখা শোনা শেষ হবে।” এখন দেখছি লছমীপ্রসাদবাবুর একটী কথাও মিথ্যা নহে, প্রকৃতপক্ষে আমি এই অবস্থা বিপর্য্যয়ে পতিত হ’য়ে অনেক রঙ্গ দেখিলাম, অনেক লোককে চিনিলাম, তবে তাঁর কথামত কবে আমার এরূপ দেখা শোনা শেষ হবে, তাহা অনুমানে স্থির করিবার ক্ষমতা আমার নাই।
ফলকথা এই জেলখানায় এসে আমি জগদম্বার অপার মহিমার সুস্পষ্ট নিদর্শন প্রাপ্ত হইলাম। নিরুপায়ের উপায়ের জন্য পদানত ভক্তদের রক্ষা করিবার অভিলাষে সেই কৃপাময়ী যে পাষাণকে আর্দ্র ক’রে দেন, কূপে কমল ফোটান, মরুভূমির মধ্য দিয়া স্নিগ্ধ সলিলা নদী বহান তাহা যথার্থ। পূর্ব্বে সেই ব্রহ্মচারী মহাশয়ের নিকট এই পরম তত্ত্বটী শুনেছিলাম, এক্ষণে কাৰ্য্য জগতে এই সকল সারগর্ভ কথার সার্থকতা দেখিতে লাগিলাম।
এক বৎসরের জন্য কারাদণ্ড হওয়ায় আমার প্রাণে যথেষ্ট ভয়ের সঞ্চার হ’য়েছিল; কিন্তু কারাধ্যক্ষ মহাশয়ের ব্যবহার দেখে ও কথাবার্ত্তা শুনে আমার অন্তরের সেই ত্রাসটী অনেক পরিমাণে নিরাকৃত হইল, অপিচ অপার বিস্ময় নীরে নিমগ্ন হইলাম। মনে করিলাম এ সব সেই জগদম্বার খেলা। এই অধমের কষ্টহরণের জন্য সেই কষ্টহারিণী মা সাপের মুখ দিয়েই কালকূটের বদলে অমৃত বাহির করিলেন।
এই কাৰ্য্যাধক্ষ মহাশয়ের নাম মির্জ্জাআলি খাঁ, বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ বৎসরের অধিক হইবে না। সুন্দরীর-ভালে খদির তিলকে যেমন শোভা বিস্তার করে, তেমনি নবীন ভ্রমর কৃষ্ণ গোঁফরাজীতে তাহার শ্রীমুখের সৌন্দৰ্য্য শতগুণ বৃদ্ধি ক’রেছে। খাঁসাহেব লোকটা ছিপ্ছিপে একহারা, বর্ণ টুকুন কষিত কাঞ্চনের ন্যায় গৌর; নাসিকাটী সমুন্নত ও তাঁহার সুন্দর মুখের অনুরূপ, চক্ষুদ্বয় আকর্ণবিস্তৃত সমুজ্জ্বল ও উৎসাহব্যঞ্জক, দৃষ্টি স্থির নিম্নগামী ও কুটীলতা পরিশূন্য। ফলতঃ সংসারজ্ঞানহীন কলুষবর্জ্জিত বালকের ন্যায় তাঁহার সুন্দর মুখখানি সরলতা মাখানো, দেখিলেই সকলের ভালবাসিতে ইচ্ছা করে।
মানুষের মনের ভাব, হৃদয়ের পরিচয় অনেকটা তাহার মুখমণ্ডলে প্রতিভাত হ’য়ে থাকে, সেইজন্য এক এক জনকে দেখিলে অন্তরার্ণব প্রীতি-পবনে উদ্বেলিত হ’য়ে উঠে, সৰ্ব্বস্ব দান ক’রে তার আনুগত্য স্বীকার করতে ইচ্ছা হয়, আবার অনেকের মূর্ত্তি নেত্রপথের পথিক হ’লে কেমন এক প্রকার ক্রোধ ও ঘৃণায় অন্তরাকাশ সমাচ্ছন্ন হ’য়ে থাকে। সে কখন কোন অপকার করে নাই সত্য, কিন্তু তথাপি বিষবৎ তাহার সংসর্গ পরিত্যাগ করতে বাসনা হয়। ফলকথা জগতে সুচেহারা, প্রফুল্ল বদন যে অনেকটা দৈবানুগ্রহে ঘটিয়া থাকে তাহা নিশ্চয়।
খাঁসাহেব জাতিতে মুসলমান সত্য, কিন্তু তাঁহাকে দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ বলিয়া আমার জ্ঞান হইল। কারণ তিনি হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষপরিশূন্য, সদালাপী, উদার হৃদয় ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন, বিশ্বস্রষ্টা পরমপুরুষের প্রতি তাঁহার অটল বিশ্বাস ছিল, তুচ্ছ অর্থের জন্য দয়াধর্ম্মকে পদদলিত করতে কি মনুষ্যত্বকে বলী দিতে নারাজ ছিলেন। ফলকথা প্রথম দিনে তাঁহার সহানুভূতিসূচক দু-চারটি কথা শুনেই, এই মুসলমান যুবককে একজন সহৃদয় ভদ্রলোক ব’লে বোধ হইল। আমার উপর তিনি আশার অতীত অনুগ্রহরাশি বরিষণ করিয়াছিলেন।
সুদৃঢ় লৌহের কপাটযুক্ত প্রস্তরে নির্ম্মিত প্রকাণ্ড ফটকের পাশে মির্জ্জাসাহেবের সেরেস্তা ঘর, সেপাহীরা আমাকে সেইখানে লইয়া গেল।
মির্জ্জাসাহেব সেই সিপাহীদের নিকট হ’তে রুচুকারিখানি পাঠ ক’রে, একবার আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন ও সহাস্য আস্যে কহিলেন, “ভাই, তুমি যে নরহত্যা করিবে, তাহা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নহে। প্রকৃত পক্ষে তুমি যে কোন অপরাধ কর নাই, তাহার প্ৰমাণ আমি পাইয়াছি, এক্ষণে ব্যাপারখানা কি তাহা আমার নিকট অকপটে প্রকাশ কর। আমার দ্বারায় তোমার উপকার ভিন্ন অপকার হইবে না।”
কারাধ্যক্ষ মহাশয়ের ঈদৃশ সহানুভূতি-সূচক কথা শুনে আমার সাহস অনেকটা বৃদ্ধি পাইল, কাজেই রহিম মোল্লার খুনের আগাগোড়া সমস্ত বৃত্তাত্ত ও কাজী সাহেবের অদ্ভূত বিচারপ্রণালী অকপটে তাহার নিকট প্রকাশ করিলাম। তাঁহার মুখের ভাব দর্শনে আমার স্পষ্ট প্রতীত হইল যে, আমার একটি কথাও তাঁহার অবিশ্বাস হয় নাই।
আমার কথা শেষ হ’লে মির্জ্জাসাহেব গম্ভীরভাবে কহিলেন, “যে রাজ্যে ন্যায়ের সম্মান নাই, বিচারের নামে এ প্রকার ব্যভিচার ঘ’টে থাকে, নিরীহ ব্যক্তি অপরাধীর পরিবর্ত্তে দণ্ডভোগ করে, ক্ষয়িতমূল বৃক্ষের ন্যায় অচিরকাল মধ্যে সে রাজ্যের পতন অবসম্ভাবী। নিপীড়িত নিরীহ ব্যক্তিদের অশ্রুজল ও তপ্তোশ্বাসেই সাম্রাজ্যের মূলভিত্তিকে নিতান্ত শিথিল ক’রে দেয়। অল্প দিনের মধ্যে মুসলমান রাজত্বের নাম ধরা পৃষ্ঠ হতে সম্পূর্ণরূপে অপনীত হবে; ক্ষুদ্র একদল বণিক রাজ্যেশ্বর হ’য়ে প’ড়বে, সেইজন্য দেশের মধ্যে এতদূর অনাচার ও অত্যাচারের প্রাবল্য পরিলক্ষিত হ’চ্ছে। বিশ্বাসঘাতক মির্জ্জাফর ও তোমার স্বজাতি জনকয়েক অদূরদর্শী বাঙ্গালী নালা কাটিয়া স্বগৃহে কুমীর আনিয়াছেন, প্রমোদ উদ্যান মধ্যে মহিষ ছাড়িয়া দিয়াছেন। মূর্খ মির্জ্জাফর শীঘ্র তাহার কুকর্ম্মের ফলভোগ করবে ও অনেক পুরুষ পর্য্যন্ত বাঙ্গালীরা তাহাদের পদতলে নিষ্পেষিত হবে। কারণ অনভিজ্ঞ অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিরা পরিণামে কখনই সুখী হ’তে পারে না। তুমি যে কেবলমাত্র বদলোকের ষড়যন্ত্রে ও হাকিমের অদ্ভূত বিচারের মাহাত্মে এরূপ বিপদে পতিত হ’য়েছে এবং আমার নিকট একটাও মিথ্যা কথা বল নাই, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। কারণ মিথ্যা কথা কখনই তোমার মুখ হ’তে বাহির হ’তে পারে না, তুমি যে সাধারণ ছোকরা নও, তাহার স্পষ্ট প্রমাণ আমি পাইয়াছি।”
আমি একটু বিস্মিতভাবে কহিলাম, “আপনি কি প্রমাণ পেয়েছেন?”
মির্জ্জাসাহেব একটু হাসিয়া কহিলেন, “তাহা শুনিয়া তোমার কোন লাভ নাই। তবে এখানে যত দিন থাকিবে, তোমার কিছুমাত্র কষ্ট হইবে না, আমি তোমার সকল বিষয়ের বন্দোবস্ত করিয়া দিব। আমার ক্ষমতার অধীন হ’লে তোমাকে এখনি ছাড়িয়া দিতাম। তোমাদের ন্যায় ভাগ্যবান ব্যক্তিদের সেবায় জীবনকে উৎসর্গ করতে পারলে, অনায়াসে জগৎপিতার প্রসন্নতা লাভ করতে পারা যায়। কেন না ভগবান তোমাদের ভাবনা ভেবে থাকেন।”
আমি তাহার এই সকল কথার প্রকৃত মৰ্ম্ম বুঝতে না পেরে, উদাসভাবে একদৃষ্টে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। মির্জ্জাসাহেব ঈষৎহাস্যে কহিলেন, “বোধ হয় আমার কথার প্রকৃত মর্ম্ম বুঝিতে পার নাই, সেইজন্য নিতান্ত বিস্মিত হইয়াছ, অন্য আর এক সময় তোমাকে সব কথা বুঝাইয়া বলিব; এক্ষণে আহারাদি কর। তোমাকে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে তাহাদের রান্না ভাত খাইতে হইবে না। রামলাল তেওয়ারি নামে একজন কণোজি ব্রাহ্মণ জেল রক্ষক আছে, সে তোমার জন্য ভাত ও রুটী প্রস্তুত করিয়া দিবে, আমি পূৰ্ব্ব হ’তেই সব বন্দোবস্ত ক’রে রেখেছি।”
আমি বিস্মিতভাবে কহিলাম, “আপনি পূৰ্ব্ব হ’তে কিরূপে বন্দোবস্ত করিলেন, আমি যে এক বৎসরের জন্য আজ এখানে আসিব, তাহা তো আপনার জানিবার কোন সম্ভাবনা ছিল না।”
আমার এই কথা শুনিয়া কারাধ্যক্ষ মহাশয় হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “পূর্ব্বে যে কথা তোমার নিকট অনাবশ্যক বোধে গোপন ক’রেছিলাম, তাহা এক্ষণে প্রকাশ করিতে হইল, কারণ তা না হ’লে তোমার প্রশ্নের উত্তর হবে না, কিংবা মনের সন্দেহ মিটিবে না। কাল শেষ রাত্রে আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম, তাতেই আমার স্থির বিশ্বাস হ’য়েছিল যে, তুমি এখানে আসিবে, সেইজন্য পূর্ব্ব হ’তেই সব ঠিক্ ক’রে রেখেছি। আমি নিতান্ত আবেগভরে কহিলাম, “আপনি কি স্বপ্ন দেখেছিলেন?”
মির্জ্জাসাহেব গম্ভীরভাবে উত্তর করিলেন, “আমি যে অদ্ভুত ব্যাপার দেখিয়াছি, তাহা স্বপ্ন কি সত্য তাহা এখনো ঠিক্ বুঝিতে পারি নাই। এরূপ অলৌকিক কাণ্ড এ জীবনের মধ্যে কখন আমার দৃষ্টিপথের পথিক হয় নাই। আমি দেখিলাম আমার শয়ন কক্ষের পালংয়ের ধারে গেরুয়া বসনধারী একটী ব্রাহ্মণ দাঁড়াইয়া আছেন। ব্রাহ্মণ যদিও শ্যামকায় কিন্তু তাঁহার দেহের মধ্য দিয়ে যেন তেজরাশি বহির্গত হ’চ্ছে। ব্রাহ্মণের ঈদৃশ তেজপুঞ্জ কলেবর ও সৌম্যমূৰ্ত্তি সন্দর্শনে রবিকরস্পর্শ তুষার রাশির ন্যায় আমার নীরস হৃদয় ভক্তিরসে বিগলিত হইল এবং তাঁহার পদপ্রান্তে মস্তক অবনত হইয়া পড়িল। ব্রাহ্মণ আমাকে আশীর্ব্বাদ ক’রে সহাস্য আস্তে কহিলেন, “বৎস একটু বিশেষ প্রয়োজনের জন্য আজ আমি তোমার কাছে আসিয়াছি। কাল হরিদাস নামে একটী ছোকরা কোন অপরাধ না ক’রে কেবলমাত্র কুলোকের ষড়যন্ত্রে প’ড়ে এক বৎসরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হ’য়েছে। সে যখন কোন অপরাধ করে নাই, তখন তুমি তাহার সহিত সাধারণ অপরাধীর ন্যায় ব্যবহার করিও না। ভগবানের পদানত সেই নিরীহ নিঃসহায় নিরপরাধের প্রতি সদয়ব্যবহার করলে, জগদীশ্বর তোমার মঙ্গল করবেন। গ্রহবিপর্য্যয়ে যদিও সেই বালক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হ’য়েছে, কিন্তু সে বড় সাধারণ বালক নয়। মেঘের আড়ে দিনকরের ন্যায় সে এখন প্রচ্ছন্নভাবে আছে, তবে একদিন নিশ্চয় মেঘ সরিয়া তাহার প্রকটমূর্ত্তি প্রকাশ হ’য়ে পড়বে। শত শত তাপীর তাপদগ্ধ হৃদয় তার স্নিগ্ধ করুণার ধারায় সুশীতল হবে; তুমি যদিও যবন, তথাপি তুমি পৰ্য্যন্ত সেই কৃপালাভে বঞ্চিত হবে না। এই কথা বলিয়াই চক্ষের নিমেষ ফেলিতে না ফেলিতে তিনি তিরোহিত হইয়া গেলেন। তখন আমার যেন চমক ভাঙ্গিল; আমি স্বপ্নঘোরে সেই ব্রাহ্মণকে দেখিলাম, কি প্রত্যক্ষে তিনি উপস্থিত হ’য়েছিলেন তাহা ঠিক্ বুঝিতে পারিলাম না, তারপর দেখিলাম যে, আমার শয়ন কক্ষের দ্বারের খিল পূর্ব্ববৎ বন্ধ আছে, সুতরাং স্বশরীরে কোন লোক যে ইহার মধ্যে প্রবেশ করবে, তাহা কিছুতেই সম্ভবপর নহে।
“কাজেই আমি স্বপ্ন ব’লে স্থির করলাম, কিন্তু এখনো সেই ব্রাহ্মণের তেজগৰ্ব্বিত সৌম্যমূৰ্ত্তিখানি আমার হৃদয়ফলকে চিত্রিত হইয়া আছে ও সুধাসিঞ্চিত সেই স্বরলহরী আমার কর্ণে প্রতিধ্বনিত হ’চ্ছে। তারপর তোমাকে দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, তোমার জন্য এই অধমকেই সেই মহাপুরুষ স্বপ্নযোগে দেখা দিয়েছিলেন। যা হোক্ তোমার কৃপায় প্রত্যক্ষে না হোক্ স্বপ্নে যথার্থ সাধু দর্শন ঘটিল।”
মুসলমানের মুখে ঈদৃশ ভক্তিরসে সিঞ্চিত সহানুভূতি-সূচক বাক্য শুনিয়া ও তাহার এই অদ্ভুত স্বপ্নের বিবরণ জ্ঞাত হইয়া আমি অপার বিস্ময়হ্রদে নিমগ্ন হ’লাম। বিশেষ আমার জিজ্ঞাসামত তিনি স্বপ্নদৃষ্টে সেই ব্রাহ্মণের যেরূপ রূপ বর্ণনা করিলেন, তাহাতে আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, হাবুজখানার সেই বামাচরণ ব্রহ্মচারী মহাশয় স্বপ্নযোগে ইহাকে দেখা দিয়েছেন। ব্রহ্মচারী মহাশয় যে একজন জগদম্বা জানিত মহাপুরুষ তাহাতে আর অণুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু এই অভাগার কষ্ট লাঘবের জন্য কেন তিনি এতদুর কষ্ট স্বীকার করলেন? তিনি তো পার্থিব মমতার কোন ধার ধারেন না, কার্য্যজগৎ হ’তে সম্পূর্ণরূপে পৃথক হ’য়েছেন, তাহ’লে আমার প্রতি এ প্রকার রূপা প্রকাশের কারণ কি?
আমি মনে মনে এই সকল কথা তোলাপাড়া করিতে লাগিলাম, কিন্তু স্পষ্ট কোন কথা বুঝিতে পারিলাম না। তবে সে ব্রহ্মচারী মহাশয় যোগবলে যে অসীম ক্ষমতা লাভ ক’রেছেন, এস্থানে তাহার আর একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ প্রাপ্ত হইলাম, কাজেই একপ্রকার অনাস্বাদিতপূর্ব্ব বিমল আনন্দে আমার অন্তরার্ণব উদ্বেলিত হইয়া উঠিল।
প্রকৃতপক্ষে মির্জ্জাসাহেব আমাকে সোণার চক্ষে দেখিলেন, নিতান্ত পরিচিত আত্মীয় ব্যক্তির ন্যায় আদর যত্ন করিতে লাগিলেন, সকল বিষয়ের সুবন্দোবস্ত করিয়া দিলেন, অন্য কোন কঠোর কাজ না দিয়া তাঁহার সেরেস্তার মুহুরির কাজে বাহাল করিলেন, কাজেই কোন বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট হইল না। এক স্থানে আটক থাকা ও কয়েদিদের নির্দ্দিষ্ট পরিচ্ছদ পরিধান ভিন্ন আমি যে কয়েদি তাহা বুঝিবার আর কোন কারণ ছিল না।
দিন যায়, সকলকার যায়, বিলাসী ধনীব্যক্তি নিজেকে অমর ভেবে সুন্দরী রমণীগণে পরিবৃত হ’য়ে পরমসুখে দিনপাত করছে, তারও সময় যাচ্ছে, আবার চিররোগী রোগের অসহনীয় যাতনা ভোগ করছে, প্রতিমুহূর্ত্ত বৎসরের ন্যায় বোধ হ’তেছে, তারও সময় যাচ্ছে, সময় কখন কাহার জন্য অপেক্ষা করে না, আপন গতিতে অনন্ত কালসাগরে মিশিতেছে, তবে যে বুদ্ধিমান, ভাগ্য যার প্রতি অনুকূল, সেই কেবল এই নিয়ত-প্রবাহমান সময়ের সদ্ব্যবহার দ্বারায় নিজের নশ্বর জীবনকে সার্থক করতে সমর্থ হয়।
আমারও সময় যেতে লাগলো, সাধারণ কয়েদিদের ন্যায় আমাকে কোনরূপ কষ্ট পাইতে হইল না, মির্জ্জাসাহেব আমার সুখের জন্য যথাসম্ভব সকল বিষয়ের উত্তম বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। দিনের মধ্যে তিন চার ঘণ্টা তাহার সেরেস্তায় মুহুরির কার্য্য করিতাম, বাকী সময় প্রশস্ত জেল-প্রাঙ্গনের মধ্যে বেড়াইয়া বেড়াইতাম। অন্যান্য কয়েদির সঙ্গে আমাকে শয়ন করিতে হইত না, মির্জ্জাসাহেব সেরেস্তা ঘরের পাশে একটী ক্ষুদ্র কক্ষ আমার জন্য নির্দ্দেশ ক’রে দিয়েছিলেন, তাহাতে একখানি খাটিয়া পাতা ছিল, আমি তথায় শয়ন করিতাম, রামলাল তেওয়ারি সেইখানে দিবসে অন্ন ও রাত্রিতে রুটী আনিয়া দিত। আমার উপর মির্জ্জাসাহেরের ঈদৃশ অনুগ্রহ দেখে জেলের আর আর রক্ষী ও সিপাহীরা পৰ্য্যন্ত আমাকে সম্মানের চক্ষে দেখিত, সাধারণ কয়েদির ন্যায় অবজ্ঞা করতে সাহসী হ’তো না। এইরূপে দেখতে দেখতে প্রায় ছমাস অতীত হ’য়ে গেল।
একদিন বৈকালে আমি, আমার সেই ক্ষুদ্র কক্ষটীর মধ্যে বসে আকাশ পাতাল ভাবছি, সম্মুখের ছোট জানালাটা খোলা আছে, এমন সময় সেইখান দিয়ে একদল কয়েদি সমস্ত দিনের কাজের পর ফিরে যাচ্ছে, সেই দলের মধ্যে এক বেটা কয়েদিকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারিলাম ও অপার বিস্ময়-হ্রদে নিমগ্ন হ’লাম।
যে ফরিকবেশী বদমাইসটা অভাগা রহিম মোল্লার শব গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ ক’রেছিল ও কর্ত্তার হুকুমমতে আমি যার সঙ্গে গিয়াছিলাম, সেই সাঁইজিকে দেখিলাম। এই ফকিরবেটা যে একজন উঁচুদরের বদমাইস তা আমি পূর্ব্ব হ’তেই জানতে পেরেছিলাম, কিন্তু বর্ত্তমানে কি অপরাধের জন্য যে এ বেটার জেল হ’য়েছে, তা জানার ইচ্ছা আমার মন মধ্যে নিতান্ত প্রবল হ’য়ে উঠলো। ভাবলাম যখন কিষণজিবাবুর সঙ্গে এ বেটার দহরমমহরম আছে, তখন মাঝে মাঝে তাঁহার সঙ্গে দেখা শুনা যে হয়, তাতে আর কোন সন্দেহ নাই। সুতরাং কর্ত্তার পারিবারিক অবস্থা ইহার নিশ্চয় জানা আছে, কাজেই যে কোন উপায়ে হোক্ ইহার সহিত একবার নির্জ্জনে সাক্ষাৎ করতে হবে।
পরদিন সেই দলের রক্ষীর সহিত আমি গোপনে দেখা করিলাম এবং আমার অভিপ্রায় তাহাকে জানাইলাম। মির্জ্জাসাহেবের এতাদৃশ অনুগ্রহের জন্য এই রক্ষীটা আমাকে বিশেষ খাতির করিত বটে, কিন্তু আমার প্রস্তাবে সম্মত হ’তে সাহসী হইল না।
তবে পাছে আমি দুঃখিত হই, এইজন্য মিনতির সহিত কহিল, “আমরা সামান্য সিপাহীমাত্র, এরূপ বেআইনি কাজ যদি প্রকাশ হ’য়ে পড়ে, তাহ’লে আমার চাকুরী যাবে। কাজেই এ কাজ করতে আমার ভয় হয়। তার চেয়ে আপনি খাঁসাহেবকে আপনার প্রাণের কথা খুলে বলুন, তিনি আপনাকে যেরূপ খাতির করেন, তাতে নিশ্চয় রাজী হবেন। একবার খাঁসাহেব আমাকে হুকুম দিলেই আমি ও বেটাকে রাত্রিতে আপনার কামরায় এনে হাজির ক’রে দোব। খাঁসাহেবের হুকুম থাকলে, কোন বেটা চুক্লি ক’রে কিছু করতে পারবে না। তাই বল্ছি আপনি খাঁসাহেবকে একবার খুলে বলবেন। তাঁকে ছাপিয়ে এ কাজ করতে আমার সাহসে কুলায় না। আপনি খাঁসাহেবকে বলবেন যে, ২৯শে তারিখে আলেক্সাঁই ফকির ব’লে যে বেটা তিন বৎসরের জন্য— আজ পাঁচ দিন এসেছে, তার সঙ্গে একবার দেখা করতে ইচ্ছা করি।”
আমি তাহার কথা যুক্তিসঙ্গত ব’লে বোধ করলাম। বিশেষ আমার তুচ্ছ কৌতুহল তৃপ্তির জন্য যে একটা লোক বিপন্ন হয়, ইহা আমার অভিপ্রেত ছিল না, কাজেই তাহার উপদেশমত মির্জ্জাসাহেবকে এই কথা বলা যুক্তিসঙ্গত ব’লে বোধ করলাম।
পরদিন সন্ধ্যার একটু পূর্ব্বে খাঁসাহেবকে অনেকটা প্রফুল্লিত দেখে ও একাকী পেয়ে, আমার অভিলাষ অকপটে তাঁহার নিকট প্রকাশ করলাম। আমার এই কথা শুনিবামাত্র বিস্ময়ের লক্ষণ তাহার মুখমণ্ডলে প্রকটিত হইল, এবং সহসা কোন উত্তর না দিয়ে একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমি আভাষে তাহার মনের ভাব বুঝিয়া ঈষদাস্যে কহিলাম, “এই ফকির বেটার ন্যায় বদমাইসের সঙ্গে আমার কিরূপে আলাপ হ’লো এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার আমার প্রয়োজন বা কি, এই সন্দেহ আপনার মনে প্রবল হ’য়েছে, কিন্তু আগাগোড়া সব কথা শুনলে, আমি কেন যে ইহার সঙ্গে একবার সাক্ষাতের জন্য ব্যস্ত হ’য়েছি, তাহা স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, কাজেই মনের সন্দেহটুকুন তখন নিরাকৃত হবে। বোধ হয় আপনার স্মরণ আছে, সেই হতভাগ্য মুসলমানের লাশ গঙ্গায় ফেলার জন্য কিষণজিবাবু একজন লোক নিযুক্ত ক’রেছিলেন। সে বেটা ঠিক গঙ্গায় ফেলে কি না তাই দেখবার জন্য আমি কেবল তাহার সঙ্গে সঙ্গে গিয়াছিলাম। কৰ্ত্তা এই ফকির বেটাকে এই কাজের জন্য বাহাল ক’রেছিলেন, আমি জীবনের মধ্যে কেবল সেই একদিন মাত্ৰ ইহাকে দেখিয়াছিলাম। তবে কর্ত্তার সঙ্গে এ বেটার যে বেশ জানা শুনা আছে, সৰ্ব্বদা দেখা সাক্ষাৎ হ’য়ে থাকে, তাহা বুঝিতে আমার বাকী ছিল না। আজ প্রায় ছয় মাসের অধিক হইল, আমি এখানে আটক আছি, ও বেটা সম্প্রতি আসিয়াছে, যদি ইহার দ্বারায় কর্ত্তার বাড়ীর কোন সংবাদ পাই, এই জন্য উহার সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছা হ’য়েছিল,” মির্জ্জাসাহেব একটু মুচ্কে হেসে কহিল, “কর্ত্তার বাড়ীর কয়জন পরিবার?”
আমি। কর্ত্তা তাঁহার স্ত্রী ও এক কন্যা ভিন্ন আর কেহই আপনার লোক নাই, –
মির্জ্জা। কন্যাটির বয়স কত?
আমি। তের বৎসর হবে।
মির্জ্জা। বিবাহ হ’য়েছে?
সহসা কোথা হ’তে লজ্জা আসিয়া আমার স্বর রুদ্ধ করিবার উপক্রম করিল। আমি সাধ্যানুসারে সে ভাবকে গোপন ক’রে অবনত মস্তকে অপেক্ষাকৃত নম্র-স্বরে কহিলাম, “তাহা আমি ঠিক জানি নাই। অনেক দিন হ’লো আমি তাহাদের আশ্রয় ত্যাগ করিয়া আসিয়াছি।”
মির্জ্জাসাহেব একবার হো হো ক’রে হেসে উঠে কহিলেন, “হাঁ, তাহ’লে তোমার জানবার বিশেষ দরকার আছে। প্রাণের একটু টান না থাকলে মানুষের পরের খপর জানবার কখন গরজ হয় না।”
মির্জ্জাসাহেবের এই কথায় আমি নিতান্ত লজ্জিত হ’লাম, কি যে বলি তাহা স্থির করিতে পারিলাম না, কাজেই নীরবে ঘাড় হেঁট করিয়া রহিলাম। সুতরাং মির্জ্জাসাহেব হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “আমার কাছে লজ্জিত হবার কোন কারণ নাই, কেন না আমা হ’তে তোমার উপকার ভিন্ন অপকার হবে না। যাই হোক্, আমি রামদীন জমাদারকে বলিয়া দিব, সে রাত্রিকাল সে বেটাকে তোমার কামরায় এনে হাজির ক’রে দেবে। তোমার যাহা জানিবার আবশ্যক স্বচ্ছন্দে সে বেটাকে জিজ্ঞাসা করিও। আমি এখনি তাহার বন্দোবস্ত ক’রে দিচ্ছি।”
এই কথা ব’লে মির্জ্জাসাহেব অন্যত্রে গমন করিলেন, আমি আমার কক্ষের মধ্যে সেই খাটিয়াখানির উপর বসিয়া গভীর চিন্তাকূপে নিমগ্ন হইলাম।
রামলাল যথাকালে রুটী ডাল আনিয়া দিল, আমি আহারাদি শেষ ক’রে সাঁইজির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম, কাজেই শয্যার উপর শয়ন করতে আদৌ ইচ্ছা হইল না।
রাত্রি আন্দাজ দশটার সময় রামদীন সাঁইজিকে সঙ্গে ক’রে হাজির হ’লো ও তাকে ঘরের মধ্যে রেখে দরজাটি ভেজিয়ে দিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করতে লাগলো।
সাঁইজি বেটা ফ্যাল্ ফ্যাল্ ক’রে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার মুখের ভাবে বোধ হইল যে, সে আমাকে ঠিক চিনিতে পারে নাই। কাজেই আমাকে প্রথমে মুখ খুলিতে হইল। আমি সাঁইজিকে আদর ক’রে সেই খাটিয়ার উপর বসিয়ে কহিলাম এবং বলিলাম, “দাতাসাহেব, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না? সেই কিষণজিবাবুর বাসা হ’তে সে রাত্রে আমি তোমার সঙ্গে গিয়েছিলাম, কিন্তু ভাই কি আশ্চর্য্য আমি খুন করি নাই, তবু কি না আমাকে খুনদায়ে এক বৎসরের জন্য কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে হ’লো।”
সাঁইজির তখন চমক ভাঙ্গলো, আমি যে কে তাহা স্পষ্ট চিনিতে পারিল, কাজেই হাসি হাসি মুখে কহিল, “আরে ভেইয়া, খুন্ করনেসে সাজা হোতা তো, মেরা হাড্ডি আবি কবরমে মাট্টি হো যাতা। লেকিন্ তোম্ ভেইয়া হক্নাহক ফাঁস গিয়া। এ দুনিয়ামে রূপেয়ামে সব হোতা।”
আমি আমার নিজের কথা চাপা দিয়ে খুব মোলামভাবে কহিলাম, “আমি নেহাৎ গরিব, টাকা কড়ি নাই, সেইজন্য এ দায়ে প’ড়ে গেলুম, কিন্তু তোমার এ দশা কেন হ’লো? তোমার তো সহায় সম্পদের অভাব ছিল না।”
অতীব তাচ্ছিল্যভাবে সাইজি উত্তর করিল, “ঐ ফিরিঙ্গি শালারা হাম্কে ও আর চার আদমিকে ফাঁসায় দিয়া। কাজী টোকিখাঁ কা সাং মেরা বহুৎ জান পছান থা, বেসখ হাম্লোক খালাস হো যাতা। লেকিন খোদ সুবেদারসাব ফিরিঙ্গি লোক কা ডরমে কাঁপতা, সুবেদার সাব কা সুপারিস মে হাম্লোক্কা সাজা হুয়া, কাজীসাব, বেকসুর ছোড়নে সেকা নেই।”
আমি। ইংরাজ বাহাদুরেরা তোমার শত্রু হ’য়ে উঠলো কেন? আর খোদ সুবেদার সাহেব কি জন্য তোমাকে সাজা দিবার অভিপ্রায়ে কাজীকে সুপারিস করলেন?
সাঁই। আরে ভেইয়া, আজীমগঞ্জমে ঐ শালা লোক্কা এক্ঠো বাবু থা, কোন্ শালা আকোচমে ঐ বাবুকে খুন করকে ভাগা, হাম্লোক ঐ শালাকে বাড়ী ডাকাতি করনেকো আস্তে গিয়া থা, লেকিন্ কুচ্ মিলা নাই, ঝুট্ট্ এই ফ্যাঁসাদমে গিরা।
পাপিষ্ঠ সাঁইজির কথা শুনে এক রকম স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, ইহারা নরাধম মাণিকলালের বাটী ডাকাতি করতে গিয়াছিল; কিন্তু একটা কথায় আমার সন্দেহের উদয় হইল। কারণ আমি বেশ জানি যে, কৃপণ-প্রধান নরপ্রেত তুল্য মাণিকলালের হাতে তো অনেক টাকা আছে, তাহ’লে পাপাত্মা সাঁইজি কেন বলে “কুচ, মিলা নাই, ঝুট্ট্ এই ফ্যাসাদমে গিয়া।”
আমি আমার এই মনের সন্দেহ মিটাইবার জন্য কহিলাম, “আজীমগঞ্জে বার্লো সাহেবের কুটীর বড়বাবু মাণিকলাল সরকার, বাঙ্গালীদের মধ্যে বড় মানুষ, তার হাতে ৫/৬ লক্ষ নগদ টাকা আছে।”
আমার কথায় বাধা দিয়া সাইজি কহিল, “ও সব ঝুাৎ, শালাকা মরমে এক্ঠো কৌড়ি বি হ্যায় নাই। যো কুচ্, থা ও শালাকা বহু সব মাল লেকে ভাগ, গিয়া।”
আমার মনের সন্দেহ অনেকটা মিটিল। আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, কর্ত্তার মৃত্যুর পর পাপিয়সী কুমুদিনী উপযুক্ত অবসর পেয়ে সর্ব্বস্ব নিয়ে গুণের সাগর সেই খানসামার সঙ্গে পালিয়েছে। এখন মোহিতবাবুর যদি কোন উদ্দেশ পাই, এই আশয়ে পুনরায় কহিলাম, “আচ্ছা ভাই! কর্ত্তার সেই ছেলেটী ডাকাতির সময় কোথায় ছিলেন, তার কি কোন সন্ধান জান?”
পাপিষ্ঠ সাঁইজি আমার কথায় কোন উত্তর না দিয়ে, কেবল কট্মট্ ক’রে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহার এই চাহনির অর্থ বুঝিতে পারিলাম। পাপিষ্ঠ যে মাণিকলালের বাড়ী ডাকাতি ক’রেছিল, তিনি যে আমার পরিচিত ব্যক্তি, তাহা পূর্ব্বে স্মরণ ছিল না, সেইজন্য অকপটে সব কথা বলিতেছিল। এক্ষণে আমার এই প্রশ্নে তাহার চমক ভাঙ্গিল, কাজেই তখন প্রাণের কপাটে চাবি বন্ধ ক’রে আমাকে নিরস্ত করিবার জন্য কহিল, “তা ভেইয়া হাম্ জান্তা নেই, আজীমগঞ্জকা ক’ই আদমিকা সাৎ মেরা জানপছান্ থা নেই। গোয়েন্দাকা খপ্পরমে হাম্লোক ডাকাতি করনে গিয়া।”
আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, পাপাত্মা সাবধান হ’য়েছে, আর এ সম্বন্ধের কোন কথা পাপাত্মার মুখ দিয়া বাহির হইবে না। এক্ষণে কিষণজিবাবুর বাড়ীর যদি কোন সন্ধান জানতে পারি, এই আশা কহিলাম, “আচ্ছা তাই! কিষণজিবাবু এখন কোথায়?”
সাই। ও শালাবি সহর ছোড় কে ভাগ, গিয়া।
আমি। কোথায় গিয়াছেন তা জান?
সাই। কুচ, জান্তা নেই। ও শালা পাক্কা বদমাইস।
আমি। আচ্ছা, বাবুর স্ত্রী ও মেয়ে কি তার সঙ্গে গিয়াছে।
পাপিষ্ঠ অম্লান বদনে কহিল, “নেই, ও দোনো জানেনা কসবি হো গিয়া।”
এই কথা শুনিয়া সহসা আমার মাথা যেন ঘুরিয়া গেল। সাঁইজিকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হইল না, কাজেই তাকে বিদায় দিলাম।
সাঁইজি দৃষ্টিপথের অতীত হইল, আমার মনমধ্যে মহাবিপ্লব উপস্থিত হইল। আমি একমনে ভাবিতে লাগিলাম, পাপিষ্ঠ সাঁইজির এই কথা কি সত্য? বাস্তবিক কি সেই সরলা নির্ম্মলার এতদূর শোচনীয় পরিণাম হ’য়েছে? দেবীর উচ্চাসন হ’তে পরিভ্রষ্ট হ’য়ে একেবারে শূকরীর অধমা হ’য়ে পড়েছে? হায়! কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই যে, পদ্মের মধু ভেকের উপভোগ্য হবে, সোণার পিঞ্জরে জঘন্য বায়স বাসা নেবে; যজ্ঞীয় পবিত্র হবি নীচ কুকুরে স্পর্শ করবে। অনেকদিন পূর্ব্বে সেই খাঁ সাহেবের আখড়া নামক বদমাইসদের আড্ডায় শুনেছিলাম যে, মোহিত বাবু ৫০৲ টাকা দিয়ে একটা মাল টপকে আবার জন্য দুজন পাকা বদমাইসকে সহরে নিয়ে গেছেন। কথাটা শুনেই মনে একটা খটকা হ’য়েছিল, কিন্তু তলিয়ে কিছু বুঝি নাই। এখন বোধ হ’চ্ছে দেবীপ্রসাদের যোগে নিৰ্ম্মলার সর্ব্বনাশ করবার জন্য পাপাত্মা মোহিতবাবু সেই ফাঁদ পাতিয়াছিলেন; কিন্তু এ কি সম্ভব? পশু বলে কেহ কি কখন সতীর সর্ব্বনাশ করতে পারে? নিৰ্ম্মলা যে প্রকার সুশীলা ও ধর্ম্মপ্রাণা তাতে নিশ্চয় ধর্ম্ম তাহার ধর্ম্ম রক্ষা করবেন; কিন্তু তাহ’লে এ লোকটা এমন কথা কেন বলে? আমার সাক্ষাতে এরূপ মিথ্যা কথা বলার কারণ কি—তাতে কি ওর কি স্বার্থ সাধিত হবে?
এই সকল কথা আমার মনে তোলাপাড়া হইতে লাগিল, আমি কিছুতেই অস্থির অন্তরকে সুস্থির করিতে পারিলাম না। কেবল আমার মনে উদয় হইতে লাগিল “এ কথা কি সত্য?”