- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
বিচারালয়।
আমাকে পুনরায় দেখিয়া সদাশয় লছমীপ্রসাদ বাবুর মুখমণ্ডল আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল, তিনি হাসি হাসি মুখে আমাকে ব্যাপারখানা কি জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি কাজী সাহেবের বিচার পদ্ধতির যে নমুনাটুকু পাইয়াছিলাম, তাহা অকপটে বর্ণনা করিলাম। দেবীপ্রসাদ যে আমার ভালোর জন্য মোবারকআলি সেজে সাক্ষ্য দেবে, তাহাও বলিতে ভুলিলাম না।
আমার কথা শুনিয়া লছমীপ্রসাদ বাবু একটু গম্ভীরভাবে কহিলেন, “তেতুল দুগ্ধে পড়িলে যেমন দুগ্ধের গুণ তখনি বিনষ্ট হ’য়ে যায়, তেমনি এই সকল নরপিশাচদের অযোগ্য হস্তে গুরুভার ন্যস্ত হওয়ায় ধার্ম্মাধিকরণের পবিত্রতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হ’য়েছে। কেবল বাহিরের লোককে সুশাসনের ভাণ দেখাবার জন্য ও বাজার সরগরম রাখবার অভিপ্রায়ে বিচারের নামে এ প্রকার হাস্যোদ্দীপক বিচিত্র গ্রহসনের অভিনয় হ’য়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে সত্যে সম্মান, কি ন্যায়ের মৰ্য্যাদা সংরক্ষিত হয় না। কূটতর্কের্ প্রভাবে, দুর্ব্বোধ্য জটিল আইনের কল্যাণে, সুচিত্র রজত খণ্ডের মহিমায় সত্য মিথ্যা এবং মিথ্যা অভ্ৰান্ত সত্যরূপে পরিণত হ’য়ে থাকে। যে স্রোতের ন্যায় অনর্গল মিথ্যা কথা বলতে পারবে, বেমালুম বহুরূপী সাজতে সক্ষম হবে, সেই আদালতে নিতান্ত বুদ্ধিমান ব’লে সমধিক সম্মান লাভ করবে। সকলেই আগ্রহের সহিত তাহার পরামর্শ গ্রহণ করবে, সুতরাং সত্যবাদী ধর্ম্মভীরুদের অপেক্ষা তাহার আয়ের পথ যে প্রশস্ত হবে, বিষয়ী বুদ্ধিমান ব’লে জনসমাজে খ্যাতি লাভ করবে, তাহা বলাই বাহুল্য। পরিণামে মঙ্গলের জন্য সেই মঙ্গলময় বিবিধ অবস্থা বিপর্য্যয়ে পুরুষকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ ক’রে থাকেন, আমাদের ততটা তলিয়ে বোঝবার ক্ষমতা নাই ব’লে, আমরা কখন কখন তাতে বিস্মিত ও বিরক্ত হই এবং মনের দৌর্ব্বল্যনিবন্ধন তাঁর উপর দোষারোপ করি এবং নিজের অদৃষ্টকে ধিক্কার দিই, কিন্তু ভাই মনে ঠিক্ জেনো যে, অকারণ কথন একটী শুষ্কপত্রও বৃক্ষচ্যুত হয় না, সুতরাং তাঁর প্রত্যেক কার্য্যের কোন না কোন নিগূঢ় রহস্য নিহিত থাকে। তবে সেই উদ্দেশ্যের প্রকৃত তাৎপর্য্য উপলব্ধি করা মানব ক্ষমতার অতীত ও কল্পনার বহির্ভূত। যেমন কোন একটা কুম্ভ দৃষ্টিগোচর হ’লে একজন কুম্ভকারের অস্তিত্ব সুস্পষ্ট অনুভূত হ’য়ে থাকে, তেমনি এই বৈচিত্র্যময় সংসারের এই সকল বিচিত্র কার্য্যাবলীতেও ঘটনাপরম্পরা সামঞ্জস্য সন্দর্শনে সেই সৃষ্টিকর্ত্তার সত্ত্ব উপলব্ধি হ’য়ে থাকে। ভবিষ্যতে তোমার প্রচুর উপকার সংসাধিত হবে ব’লে, সেই কৃপাময় তোমাকে এরূপ অবস্থার নিক্ষেপ ক’রেছেন। পূর্ব্বে নিশ্চয় তোমার মনের ধারণা ছিল যে, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য করগ্রাহী রাজা বিচারালয়ের প্রতিষ্ঠা ক’রেছেন এবং নিরীহ প্রজাদের মঙ্গলের অভিপ্রায়ে বিবিধ আইন প্রণয়ন ক’রে থাকেন, কিন্তু কাৰ্য্যকালে সেই সকল লোকহিতকর আইনের কিরূপ সম্মান রক্ষা হয়, ন্যায়নিষ্ট বিচারক কিপ্রকার পদ্ধতিতে ন্যায় বিচার ক’রে থাকেন, তাহা তুমি এইবার প্রত্যক্ষ করবে, কাজেই সংসার সম্বন্ধে প্রচুর অভিজ্ঞতা লাভ করতে সক্ষম হবে, সুতরাং তোমার ঈদৃশ বিড়ম্বনা ভোগ পরিণামে যে সুফলরাশি প্রসব করবে তাহাতে আর অণুমাত্র সন্দেহ নাই। এক্ষণে সেই পূৰ্ব্বনিৰ্দ্দিষ্ট কুঠরিতে গিয়ে বিশ্রাম করগে, সমস্ত দিন দাঁড়িয়ে থেকে নিশ্চয় অত্যন্ত কষ্ট হ’য়েছে।”
লছমীপ্রসাদ বাবু আমাকে এই সকল কথা ব’লে, দেবীসিংকে সময়োচিত দুএকটা আদেশ করলেন। আমি পূর্ব্বেকার কুঠরির দিকে গমন করিলাম, তিনিও নিজের কাজকর্ম্মে মনযোগী হলেন।
বাবুর বন্দোবস্ত মতন রাত্রিতে দেবীসিং থালায় ক’রে লুচি তরকারি ও বরফি আনিয়া দিল, আমি প্রায় সকলগুলিকে ধ্বংসপুরে পাঠালাম ও সেই ঢিপির উপর শয়ন করিয়া অকুলপাথার ভাবিতে লাগিলাম।
মুহূর্ত্তমধ্যে আমার জীবনের অতীত ঘটনাবলী একে একে স্মৃতিপথে আসিয়া উদয় হইল, নিৰ্ম্মলার নিৰ্ম্মল বদনখানি হৃদয়দর্পণে দেখা দিল, কাজেই ক্ষণেকের জন্য আমি একটু বিমনা হইয়া পড়িলাম ও ইন্ধনপ্রাপ্ত অগ্নির ন্যায় আমার অন্তরের অন্তস্থলের লুকান অগ্নিটুকুন জ্বলিয়া উঠিল।
মনের ভাব প্রাণের কথা অকপটে প্রকাশ করলে সকলে তাকে পাগল ব’লে থাকে, সেইজন্য বোধ হয় সংসারে সকলে প্রাণের কপাটে তালা বন্ধ ক’রে রাখে, অন্তর মধ্যে সহসা কাহাকেও প্রবেশ করতে দেয় না; কেবল নিজেকে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ভেবে, মুখের কথায় অন্য সকলকে বঞ্চনা করতে সাধ্যমতে চেষ্টা করে। কিন্তু দুর্ব্বলমনা মানবের অন্তরে মাঝে মাঝে যে ভাবের উদয় হয়, বাসনা-পবন তাহার হৃদয় মধ্যে যে প্রকার বিপ্লবের সৃষ্টি ক’রে তুলে, তাহা জানিবার জন্য তার গলায় ছুরি বসাইলেও জগতে সে কাহার নিকট সে কথা প্রকাশ করতে পারে না। তবে যার হৃদিভাণ্ডারে মনুষ্যত্বরূপ মহারত্ন সঞ্চিত আছে, অন্তররাজ্য সম্পূর্ণরূপে শয়তানের অধিকারভুক্ত হয় নাই, তিনি স্বীয় প্রজ্ঞাবলে সে ভাবকে দমন ক’রে ফেলেন, আর অন্তসারশূন্য লঘুচেতারা তাতে প্রমত্ত্ব হ’য়ে ক্রমে ক্রমে কলুষসাগরে নিমগ্ন হ’য়ে পড়ে।
আমি অতিকষ্টে আমার অন্তরের এই উচ্ছ্বলিত আবেগকে দমন করিলাম। পাছে লোকে পাগল বলে, উপহাস করে, এই ভয়ে প্রাণের কথা স্পষ্ট ক’রে বলিলাম না, মনের ভাব মনমধ্যে লুকাইয়া রাখিলাম।
আমি প্রজ্ঞা খোঁটায় প্রবোধ-রজ্জুর সাহায্যে আমার বিপথগামী চঞ্চল মনকে বাঁধিলাম বটে, কিন্তু চিন্তাকাশ সম্পূর্ণরূপে নিৰ্ম্মল হইল না, নানাপ্রকার চিন্তামেঘে সমাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল।
আমি সেই ঢিপির উপর শয়ন করিয়া, নরপ্রেত কৃপণপ্রধান মাণিকলালের পরিণাম, মোহিতবাবুর বোকামো, দেবীপ্রসাদের শঠতা, আদালতের অদ্ভুত বিচারপদ্ধতি প্রভৃতির কথা মনে মনে তোলাপাড়া করিতে লাগিলাম, কাজেই নিদ্রাদেবী এ অভাগাকে পরিত্যাগ ক’রে অন্য কোন ভাগ্যবানের আশ্রয় গ্রহণ করলেন।
পরদিন বেলা আন্দাজ এগারটার সময় দুজন সেপাহীর সঙ্গে আদালতে উপস্থিত হইলাম। সেদিন আমাকে অধিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হ’লো না, কারণ কাজী সাহেব সকাল সকাল আদালতে আসিয়াছেন, সুতরাং সেপাহীদ্বয় আমাকে একেবারে হুজুরআলির সামনে খাড়া করিয়া দিল।
আমি সেই কাঠগড়ার মধ্যে গিয়া কাজী সাহেবকে কেতামত একটী লম্বাগোচের সেলাম করিলাম, তিনি মাথা নাড়িয়া আমার সেলামটি ফিরাইয়া দিলেন কি একবার ঝিমাইয়া লইলেন, তাহা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না।
ক্ষণপরে কাজী সাহেব আদালতের মূল্যবান সময় অপব্যয় না ক’রে কাজে মন দিলেন, কাজেই আমার মোকদ্দমা আরম্ভ হইল।
ন্যায়নিষ্ঠ কাজী সাহেব প্রমাণ ভিন্ন আমাকে খুনে ব’লে স্থির করবেন না, কাজেই প্রমাণ আবশ্যক, সেইজন্য সাক্ষ্য দিবার জন্য একটা পশ্চিমদেশীয় বেঁটে মুসলমান সাক্ষীদের কাঠগড়ায় আসিয়া হাজির হইল।
পেশকার মহাশয়ের প্রশ্নে সেই লোকটা এইরূপ জবানবন্দি দিল যে, “আমি এই সহরে দরজির কায ক’রে থাকি। গত ২১শে কি ২২শে চৈত্র রাত্রি আন্দাজ ১০টা কি ১১টার সময় আমি কাজকৰ্ম্ম শেষ করে দোকানের সম্মুখে খাটিয়া পেতে শয়ন ক’রে আছি, এমন সময় দেখি যে, এই ছোক্রা একটা বস্তা মাথায় ক’রে গঙ্গার দিকে যাচ্ছে। সেদিন রাত্রে যদিও আঁধার ছিল, কিন্তু সে সময় আমি তামাক পিতেছিলাম; ছিলামে গুলের আগুন দপ্ দপ্ করতে ছিল, কাজেই আমি ছোকরার মুখখানা ঠিক্ দেখেছিলাম, খোদাতাল্লা জানে মুই ঝুট বাত বলি নাই।”
কাজী সাহেব ঝিম্ আওয়াঝে কহিলেন, “মুসলমানের ছেলে, কোরাণ ছুয়ে যখন কসম খেয়েছে, তখন সে কখনই, ঝুটবাত বলবে না। তাহ’লে যে কাফের বনে যাবে।”
কাজী সাহেবের মুখের কথা শেষ হ’তে না হ’তেই অমনি শত শত কণ্ঠ হ’তে “শোভানআল্লা, কেয়াখুব, জিতারহ” প্রভৃতি শব্দ উচ্চারিত হ’তে লাগলো, কাজেই খানিকক্ষণের জন্য আদালত গৃহ পল্লীগ্রামের কোন একটী হাটে পরিণত হ’ল। তবে এই সত্যবাদী সাক্ষীর কল্কের আগুনে আমার মুখ চেনার কথা শুনিয়া আমি আর হাসির বেগকে দমন করতে পারিলাম না, পাছে কেহ দেখিতে পায়, এই ভয়ে মুখে চাদর দিয়া রহিলাম।
গোল একটু থামিলে উকীল মহাশয় জেরা করিতে উঠিলেন, তাহাতে এইরূপ প্রশ্নোত্তর হইল।
প্র। তুমি কি ঠিক এই ছোকরাকে বস্তা নিয়ে যেতে দেখেছিলে?
উ। হাঁ, ঠিক এই ছোকরাকে দেখেছিলাম।
প্র। সে রাত্রে কি চাঁদনি ছিল?
উ। না আঁধার ছিল, লেকিন মুই খাটিয়া নিয়ে বাহিরে শুয়েছিলাম, সামনে গুড়গুড়ি ছিল, তার উপর বড় কল্কেয় তাওয়া দেওয়া তাহাতে দশ বারোটী গুল জ্বলতেছিল, তারপর এই ছোকরা তামাকপিনার তরে আমার নজরদিকে খাড়া হ’য়েছিল, আমি ছিলাম দিয়েছিলাম, আসামী বস্তা নামিয়ে হাতে ছিলাম ধ’রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাক পিয়েছিল, তাইতে এই ছোকরাকে আমি ঠিক চিনেছিলাম।
প্র। আচ্ছা সেই বস্তাটা আসামীর মাথায় ছিল কি ঘাড়ে ছিল?
উ। পহেলা মাথায় ক’রে আনেছিল, মোর নজরদিকে এসে ঘাড়ে করলে, তারপর গোড়েরপর নেমিয়ে রেখে তামাক পিলে, তারপর বস্তাটা ধরে মাথায় চড়িয়ে দিলুম।
প্র। আচ্ছা সেই বস্তাটা হাল্কা না ভারি ছিল?
উ। খুব ভারি ছিল, মুই তুলে দিতে হেঁপিয়ে প’ড়েছিলুম।
প্র। বস্তায় কি আছে তা কি তুমি আসামীকে জিজ্ঞাসা ক’রেছিলে?
উ। হাঁ, মুই পুচ্ ক’রেছিলুম, তাতে আসামী জবাব দিলে যে, ইহার অন্দরে পিতল কাঁসার অনেকগুলি বাসন আছে, বাজার হ’তে কিনে মনিবের বাড়ী নিয়ে যাচ্ছি।
প্র। তুমি যখন বস্তা মাখার তুলে দাও, তখন বাসনের কোন রকম আওয়াজ হ’য়েছিল?
উ। তা আমার খেয়াল নাই।
প্র। আচ্ছা এত রাত্রে সে কেন বাসন কিন্লে, আর তার মনিবের বাড়ী কোথায় তা কি জিজ্ঞাসা ক’রেছিলে?
উ। হাঁ পুছ্ করবার এরাদা মোর দেলে এসেছিল, লেকিন্ মোর মুখের বাত ফুটতে না ফুটতে আসামী বস্তা নিয়ে সাঁ সাঁ ক’রে চ’লে গেল। তাইতে তখুনি আমার দেলে এটা খট্কা হ’য়েছিল। তারপর ফজরে যখন জেলের জালে ওঠা সে বস্তার ভিতর লাশ দেখলাম, তখুনি সমজে নিলুম যে, রাতের সেই ছোকরা এই কাম ক’রে লাশ ফেলে দিয়েছে।
কাজী সাহেব ঝিম্ আওয়াজে কহিলেন, “ব্যাস বহুৎ হ’য়েছে, আর জেরা ক’রে গাওয়াকে দিক্ করবার দরকার নাই। গাওয়া বেচারা সাচ্চা বাত ক’য়েছে।”
আমি কিন্তু গাওয়ার সাচ্চা বাত শুনে একেবারে অবাক্ হলাম। মনে করিলাম একি ব্যাপার, এইরূপ মিথ্যা প্রমাণের উপর নির্ভর ক’রে বিধর্ম্মী শাসনকর্ত্তারা কি বিচার কার্য্য সমাধা ক’রে থাকেন? সাক্ষীটা তো ভুলেও একটী সত্য কথা বলিল না, অথচ কাজী সাহেব গাওয়ার কথাগুলি সত্য ব’লে বিশ্বাস করলেন। এতে তো বেশ বোধ হ’লো যে, পূর্ব্ব থেকেই কাজী সাহেবের সঙ্গে এ সম্বন্ধে একটা বন্দোবস্ত হ’য়েছিল। তার উপর উকীল বেটা যে রকম জেরা করলে তাতে মকদ্দমা হাল্কা হওয়া দূরে থাক্, বেশ পাকিয়ে তুলে; তাহ্’লে আমাকে বিপদে ফেলবার জন্য যোগাযোগে যে একাজ হ’য়েছে, তাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। এখন দেখা যাক্, এই অদ্ভুত মকদ্দমার বিচার ফলে আমার ভাগে কি ঘটে।
আমি মনে মনে এই স্থির ক’রে কাঠের পুতুলের ন্যায় নীরবে সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম, স্রোত মুখের তৃণের ন্যায় ঘটনাসাগরে ভাসিলাম, ভাল মন্দ সকল বিষয় ভাগ্যের উপর নির্ভর ক’রে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হ’লাম। এমন সময় দেখি দেবীপ্রসাদ ওরফে মোবারকআলি সেজে সাখ্য দেবার জন্য কাঠরায় এসে দাঁড়াল। পাছে তাহার মুখের দিকে চাহিলে হাসি পায়, এই ভয়ে ঘাড় হেঁট করিলাম, কিন্তু বেটার কথা শুনার জন্য কাণ খাড়া ক’রে রহিলাম।
যথারীতি হলফের বাঁধাগৎ আওড়ে সে বেটা এই জবানবন্দি দিলে,— “আমার নাম মোবারকআলি, আজ প্রায় তিন বরষ হ’লো আমি লক্ষ্ণৌ হ’তে এখানে এসে বাস করছি। আমি এই সহরের একজন ওস্তাদজি, অর্থাৎ বাইজিদের সঙ্গে সারেং বাজাই ও গান শিখাইয়া থাকি। আমি আসামীকে চিনি, ইহার নাম হরিদাস, ঠাকুরসাহেবের আখড়ায় ইহাকে জুয়া খেলিতে দেখিয়াছি, বাড়ী ঘর কোথায় বা কি কাজকৰ্ম্ম করে তাহা জানি না। বস্তার মধ্যে যাহার লাশ পাওয়া গিয়াছিল, তাহার নাম রহিম মোল্লা, সে সম্পর্কে আমার মেজো খালার ছোট ফুপুর বোনায়ের চাচাতো ভাই, কাজেই আমার নেহাৎ আপনার জন। আমি রহিম মোল্লার সাথে খাঁসাহেবের আখড়ায় হরদম্ যাইতাম। আজ প্রায় মাস দুই হ’লো এক দিন দুপুর বেলায় সলুই খেলতে খেলতে এই আসামীর সহিত রহিম মোল্লার কেজিয়ে বেধে খুব গালিগালাজ চলে, শেষে মারামারি করতে দুজনেই তৈয়ার হয়, আমি তখন সেখানে হাজির ছিলাম, আমি ও গোলাপ মাড়োয়ারি নামে একজন ভদ্রলোক মাঝখানে প’ড়ে দুজনকে ছাড়িয়ে দেই, সেইজন্য মারামারি বন্ধ হয়; কিন্তু এই আসামী রেগে ব’লেছিল, “আচ্ছা শালা নেড়ে এখন বড় বেঁচে গেলি, এরপর যখন তোকে বাগে পাব, তখনি গুলি মেরে একেবারে খুন ক’রে ফেলবো।” আমরা সকলে আসামীর এই কথা শুনিয়াছিলাম, তবে রাগের ঝোঁকে বল্ছে ব’লে আমরা তা গ্রাহ্য করি নাই। কিন্তু এ ঘটনার দুদিন পর হ’তে আর রহিম মোল্লাকে দেখা গেল না। কোথায় যেন গায়েব হ’য়ে গেল, আমরা অনেক খুঁজেও তাকে দেখতে পেলাম না। তারপর গুজব শুনলাম, জেলের জালে একটা লাশ পাওয়া গিয়াছে। আমি কোতয়ালিতে গিয়ে লাশ দেখেই রহিম মোল্লা ব’লে সনাক্ত করলাম ও দারোগা সাহেবকে সব হাল বুঝিয়ে বল্লাম, তাতেই তিনি শুভো ক’রে আসামীকে গ্রেপ্তার ক’রেছেন।
উকীল মহাশয় দাঁড়াইয়া জেরা আরম্ভ করলেন।
উকীল। আচ্ছা, আসামীর কাছে কখন তুমি পিস্তল কি বন্দুক দেখেছ?
সাক্ষী। না, তা দেখি নাই, তবে আসামী নিজেই ব’লেছিল যে, আমার মনিবের বাড়ী পিস্তল আছে, তাই এনে তোকে খুন করবো।
উকীল। আসামীর মনিব লোকটা কে তা তুমি জান?
সাক্ষী। না তা জানি না।
উকীল। কত দিন হ’লো তুমি এই আসামীকে চিনিয়াছ?
সাক্ষী। বড় জোর তিনমাস হবে।
উকীল। ঠাকুরসাহেবের আখড়া ছাড়া আর কোথাও কি তুমি ইহাকে দেখেছিলে?
সাক্ষী। রাস্তা ঘাটে দু-একবার দেখিয়া থাকিব, তাহা ভিন্ন আখড়ার মধ্যে হর্দ্দম দেখিয়াছি।
উকীল। আচ্ছা এই ছোকরা যে রহিম মোল্লাকে খুন ক’রেছে, তা তুমি কি ক’রে বুঝলে?
সাক্ষী। গতিক দেখে মালুম হ’লো। তারপর রহিম মোল্লা বড় ইয়ারবাজ আমি, সকলে তাকে পেয়ার করতো, এই আসামী ছাড়া আর কেউ তার দুষমন ছিল না, আর কারুর সঙ্গে তার কখন কেজিয়ে হয়নি, কাজেই এই আসামী ছাড়া আর কে তাকে খুন করবে?
উকীল। আচ্ছা আসামীকে খুন করতে তো তুমি চোখে দেখ নাই?
সাক্ষী। না তা দেখি নাই, মোরা তো আর কাফের নয় যে না দেখে ঝুট্ বাত বলবো।
কাজী সাহেব চ’খের অর্দ্ধেকটা ঝাপ্ ফেলে খুব ঝিম্ আওয়াজে কহিল, “হাঁ গাওয়া ওয়াজিবি বাত ব’লেছে, লোকে ছিপায়ে খুন করে থাকে, কাজেই সহজে কেউ দেখতে পায় না, কেবল আবহাওয়া বুঝে সাবুদ নিয়ে মামলা কিনারা করতে হয়। এ মামলার আর প্রমাণ নেবার দরকার নাই। মামলা কায়েম হ’য়েছে, এখন তুমি সওয়াল জবাব কর।
কাজী সাহেবের এই আদেশ শুনিয়া সাক্ষী কাঠরা হইতে নামিয়া গেল, অনাবশ্যক বোধে বাকী সাক্ষী গোলাপ মাড়োয়ারিকে আর হাজির করা হইল না, কারণ এই সকল অকাট্য প্রমাণর দ্বারা মালা কায়েম হইয়া গিয়াছে স্থির হইল।
এইবার আমার হিতৈষী উকীল মহাশয় উত্তমরূপে গোঁফ জোড়াটিতে তা দিয়া, বার দুই গলা খ্যাকার দিয়া ও এক পলা কাসিয়া লইয়া সওয়াল জবাব আরম্ভ করিলেন, “ধর্ম্মাবতার, এই আসামী ছোকরা, যদিও বেয়াদব বদমাইস ও বখা, কিন্তু তবু যে এ খুন ক’রেছে, তা কিছুতেই বোধ হয় না। কারণ এ ছোরার ততদূর সাহস কি বুকের পাটা হওয়া অসম্ভব। বিশেষ যে তিনজন গাওয়া সাক্ষ্য দিল, তাহারা কেহই আসামীকে খুন করিতে চক্ষে দেখে নাই, কেবল অনুমানের উপর নির্ভর ক’রে আসামীকে খুনে ব’লে সাব্যস্ত ক’রেছে। তারপর মৃতব্যক্তি যে গুলির দ্বারায় নিহত হ’য়েছে, তাহা সর্ব্বসম্মতিক্রমে আদালতে প্রমাণ হ’য়ে গেছে, কিন্তু হুজুর এই গরিব ছোকরা যে খাসামাগিরি ক’রে দিনপাত করে, সে পিস্তল কি বন্দুক কোথায় পাবে, আর গুলি মৃতব্যক্তির যেরূপ মর্ম্মস্থানে বিদ্ধ হয়েছে, তাতে বেশ বোধ হ’চ্ছে যে, কোন হাতচোস্ত খেলোয়াড় লোকে বন্দুক ছুড়েছিল, কোন বেটা আনাড়ি অমন অব্যর্থ লক্ষ্যে গুলি ছুঁড়তে পারে না। কাজেই হুজুর এই আসামী যে নিজের হাতে গুলির দ্বারায় খুন ক’রেছে, তাহা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নহে, কারণ কোন গাওয়াই স্বচক্ষে আসামীকে খুন করতে দেখে নাই।
“দ্বিতীয় সাক্ষী হিম্মত মিয়া বস্তা মাথায় ক’রে ছোকরাকে গঙ্গার দিকে যেতে দেখেছিল, কিন্তু সেই বস্তার মধ্যে যে লাশ ছিল, তাহারই বা প্রমাণ কি? আর এই ছোকরা যে একলা লাশ বস্তায় পুরে মাথায় ব’য়ে নিয়ে যাবে, তাহাও সম্ভবপর ব’লে বোধ হয় না। তৃতীয় সাক্ষী মোবারক মিয়া আসামীর সঙ্গে মৃত রহিম মোল্লার কেজিয়ে হ’তে শুনেছিল, কিন্তু খুন করতে কি বন্দুক ছুঁড়তে দেখে নাই। সুতরাং ধর্ম্মাবতার আসামী যে স্বহস্তে গুলির দ্বারায় হতভাগ্য রহিম মোল্লাকে খুন ক’রেছে, তাহা অগ্রে আদালতে নিঃসংশয়রূপে সপ্রমাণ হয় নাই। কাজেই আমার মক্কেলকে ইচ্ছাপূর্ব্বক নরহত্যা অপরাধে অপরাধী করা যুক্তি সঙ্গত নহে। এই মামলা গাওয়ার দ্বারায় যে প্রকার প্রমাণ হ’য়েছে, তাতে আমার মক্কেল খুনেদের উপযুক্ত সাজা পেতে পারে না। আদালত দয়া ক’রে আসামী বেচারাকে বেকসুর খোলসা দিলেও দিতে পারেন।”
উকীলবাবু বক্তৃতা শেষ ক’রে পুনরায় আসন গ্রহণ করলেন এবং রুমালকে পাখার একটীং দিয়ে হাওয়া খেতে লাগলেন। এমন সময় কাজী সাহেব একবার অতি কষ্টে চেঁচিয়ে চেয়ে স্বভাবসিদ্ধ ঈষৎ বাজখেয়ে ঝিম্ আওয়াজে কহিতে আরম্ভ করিলেন, “যখন বস্তার মধ্যে একজন মুসলমান ভ্রাতার লাশ পাওয়া গিয়াছে, তখন কেহ যে আকোচবশে তাহাকে খুন ক’রে এই উপায়ে লাশ ছাপিয়েছে তাহা অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ নাই; তাহ’লে একটা খুন যে হ’য়েছে, তাহা নিশ্চয়। সহরের মধ্যে একজন মুসলমান যখন খুন হ’য়েছে, তখন তার জানের তরে কাহাকেও সাজা না দিলে খোদাতাল্লার কাছে আমার গুণা হবে, আর সুবেদার সাহেব কম্বক্তা বলিয়া নিন্দা করিবেন; কাজেই আইনের মান্য রাখবার জন্য একজনকে সাজা দেওয়া উচিত। যদিও আসামীকে খুন করতে কেউ দেখে নাই, কিন্তু গাওয়ার দ্বারায় যে প্রকার প্রমাণ হ’লো তাতে আসামী ছাড়া যে আর কেউ রহিম মোল্লাকে খুন ক’রেছে তা অসম্ভব। আসামী নিজের হাতে কি অন্য লোক দ্বারায় যদিও খুন করিয়াছে বলিয়া ঠিক সপ্রমাণ হয় নাই, তবু এই খুনের মধ্যে যে আসামী আছে, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই, কারণ গাওয়ার কথা দ্বারা তাহার প্রমাণ হ’য়ে গেল; কোনকালে কোন খুনি মামলায় ইহার অধিক প্রমাণ হয় না; কারণ কেহ কখন লোক দেখাইয়া, গাওয়া খাড়া করিয়া খুন করে না, নির্জ্জনে রাত্রিতে সাবধানে এই সব কাজ ক’রে থাকে। কেবল আবহাওয়া দেখে, সাক্ষীদের মুখে অবস্থা বুঝে বিচার করতে হয়।
“এই মামলায় তিনজন সাক্ষীর মধ্যে একজন কাফের ও দুইজন মুসলমান। মুসলমানের ছেলে কোরাণ সরিফের কিরে ক’রে কখন ঝুটবাত বলবে না; আমার বিশ্বাস এই মালায় সকলেই সাচ্চা কথা ক’য়েছে, কাহার কথায় কিছুমাত্র গরমিল হয় নাই। তিনজনেই খাসা জবানবন্দী দিয়ে মামলাকে কায়েম ক’রে দিয়েছে।
“যদিও মামলা এক রকম কায়েম হ’য়েছে বটে, কিন্তু আসামীকে কেহ খুন করতে দেখে নাই, তার উপর আসামীর এই ছোকরা বয়স, সেইজন্য আসামীকে খুনের উপযুক্ত দণ্ড না দিয়ে কেবলমাত্র এক বৎসরের জন্য ফাটক দিলাম।”
এই দণ্ডাজ্ঞা শুনিয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল, চতুর্দ্দিকে যেন অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া ছল্ছল্ নেত্রে যুক্তকরে কাজী সাহেবকে কহিলাম, “ধর্ম্মাবতার! আগাগোড়া মিথ্যা প্রমাণের উপর নির্ভর ক’রে, ভ্রম-প্রযুক্ত আমাকে এই দণ্ড প্রদান করলেন। প্রকৃতপক্ষে আমি সম্পূর্ণরূপে নিরপরাধী, আমি খুন করি নাই, আমা হ’তে খুনের কিছুমাত্র সহায়তাও হয় নাই। তবে এই খুন সম্বন্ধে অনেক কথা আমি জানি। আপনি যদ্যপি সব সত্যকথা শুনতে ইচ্ছা করেন— ”
আমি এই পৰ্য্যন্ত ব’লেছি, এমন সময় সেই পেশকার মহাশয় একটা বিরাশিসিক্কা ওজনের ধমক্ মেরে কহিল, চোপরাও বেয়াদব কাফের, হজরত আলি মেহেরবাণি ক’রে তোর জান বেঁচিয়ে দিয়েছেন, আবার কথা ক’চ্ছিস্ বেয়াদব পাজি!”
আমার মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল, কাজেই এই খুনের প্রকৃত বিবরণ কাজী সাহেবকে আর বলা হ’লো না। এমন সময় দুজন সেপাহী আমার হাত ধ’রে হিড়হিড়, ক’রে টেনে কাঠরা হ’তে বাহির করিয়া আনিল এবং পেশকার মহাশয়ের নিকট হইতে একখানি কি কাগজ নিয়ে জেল উদ্দেশে যাত্রা করিল।