» » হরিদাসের গুপ্তকথা

বর্ণাকার

একবিংশ পরিচ্ছেদ

আমার বিচার।

ঘোর কপট নরপ্রেত বিশেষ পাপাত্মা দেবীপ্রসাদকে আমি চিনিয়াছি। সে বেটা যে কিরূপ প্রকৃতির লোক, তাহাও আমার জানিতে বাকী নাই, সুতরাং সে বেটা যে আমার উপকারের জন্য আসে নাই; তাহার মনমধ্যে যে অন্য একটা মতলব আছে, তাতে আর আমার কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না। আমি পাপাত্মাদের দৌড়খানা দেখিবার জন্য, প্রাণের মতলবটা বুঝিবার অভিপ্রায়ে, বেটাকে চটাইলাম না। আমি খোকার মত তাহার সকল কথায় সায় দিয়া গেলাম; আমার এপ্রকার ব্যবহারে ও কথায় পাপাত্মা যে নিতান্ত পরিতুষ্ট হ’য়েছে ও আমার মনের প্রকৃতভাব যে বুঝিতে পারে নাই, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। এখন দেখা যাক্, কি উদ্দেশ্যের বশবর্ত্তী হ’য়ে আজ এ বেটা এখানে এসেছে, আমার প্রতি তাহার সহসা এতদুর কৃপা প্রকাশের প্রকৃত কারণ কি?”

প্রাতঃকালে লছমীপ্রসাদবাবু আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ ক’রে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কল্য তোমার সঙ্গে কোন বাবু সাক্ষাৎ করতে এসেছিল?”

আমি ঈষৎ হাস্যে কহিলাম, “ঐ বেটার নাম দেবীপ্রসাদ, কিষণজিবাবুর ডাইনের দোহার, আজ আমার ভাল করবার জন্য এখানে দয়া ক’রে এসেছিলেন।”

আমি ইতঃপূর্ব্বে আমার সম্বন্ধের সকল কথা লছমীপ্রসাদবাবুকে খুলে বলেছিলাম, কাজেই দেবীপ্রসাদের গুণ তাহার অপরিজ্ঞাত ছিল না। লছমীপ্রসাদবাবু ঈষৎ হাস্যে কহিলেন, “এখন সব কথা বুঝা গেল, এই বেটারা নিজেদের নিরাপদের আশয়ে তোমাকে এই খুনদায়ে ফেলেছে। যাই হোক্, তোমার হিতৈষী বন্ধুটি তোমাকে কি ব’লে গেল?”

আমি। নিশ্চয় পাপাত্মারা কোন একটা মতলব হাসিল করিবার জন্য এখানে এসেছিল, আমার কাছে ডাইনের ন্যায় মায়া জানিয়ে গেল। আমার হাতে একেবারে আকাশের চাঁদ আনিয়া দিল। আমাকে বাঁচাবার জন্য টাকা খরচ ক’রে একজন ভাল উকীল নিযুক্ত করবে ব’লে আশা দিয়ে গেল। তবে বেটাদের কতদূর দৌড় তা দেখবার জন্য আমি সব কথায় সায় দিয়ে গেলাম, বেটাকে চটাইলাম না, বা কোন কথায় অধিক জেরা করিলাম না। পাপিষ্ঠ আমাকে নিতান্ত নির্ব্বোধ মনে ক’রে আগাগোড়া অনর্গল মিথ্যা কথায় আমাকে স্তোক দিল। কিন্তু পাপাত্মার কথায় আমার বিশ্বাস হইল না; কারণ ওবেটা যে কিরূপ দরের লোক, কিরূপভাবে জীবন যাপন করে, তাহা আমি বিশেষরূপে জানিয়াছি। আমার ভালর কথা যে কেবল ছলনা মাত্র, অন্তর মধ্যে অন্য কোন কুমতলব লুকান আছে, তাহা আমি অনুসন্ধানে স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়াছি। তবে পাপিষ্ঠের একটা কথার মর্ম্ম ঠিক বুঝিতে পারি নাই, সেইজন্য মনে বিষম সন্দেহ ও ভয়ানক খটকা জন্মেছে।

লছমী। কি কথায় তোমার মনে সন্দেহ হ’য়েছে?

আমি। দেবীপ্রসাদ বেটা বলিল যে, তোমার জন্য একজন উকীল খাড়া ক’রে দিব, সে তিন কথায় তোমার মামলা ফাঁসিয়ে দেবে। বা বলিতে হয় আইন মোতাবক সেই বলিলে, তোমাকে কোন কথা বলিতে হইবে না। এ কথার মানে কি? আর আমার মুখে প্রকৃত ব্যাপার না শুনে, উকীল নিজের মনগড়া কথা কি ক’রে বিচারপতির কাছে বলিবে? উকীল হ’লেই কি কোন দৈব ক্ষমতা জন্মায়, সেই ক্ষমতার প্রভাবে তারা কি অপরাধীদের মনের কথা জানিতে পারে?

আমার কথা শুনে লছমীপ্রসাদবাবু হো হো ক’রে হেসে উঠলে, আমি অবাক্ হ’য়ে তার মুখের দিকে চেয়ে র’ইলাম, অল্পক্ষণ পরে হাসির বেগকে রোধ ক’রে লছমীপ্রসাদবাবু গম্ভীরভাবে কহিলেন, “ভাই, ম্লেচ্ছদের রাজত্বকালে বিচারের নামে যে কি প্রকার অদ্ভুত প্রহসনের অভিনয় হয়, তা তুমি এখন জান না, সেইজন্য তোমার অন্তরে এ প্রকার সন্দেহের উদয় হ’য়েছে। দেশের শান্তি রক্ষার জন্য বিধর্ম্মী কর্ত্তারা গোলকধাঁধা বিশেষ এ প্রকার জটিল আইন প্রণয়ন ক’রেছেন, যে সরলচিত সাধারণ প্রজারা তাহার মর্ম্ম কিছুতেই বুঝতে পারে না, সেইজন্য বিচারের সুবিধার আশয়ে, উকীল নামে এক প্রকার নূতন জীবের সৃষ্টি হ’য়েছে। পূর্ব্বে এ জিনিষ আমাদের দেশে ছিল না, ম্লেচ্ছদের অধিকারকালে নূতন আমদানি হ’য়েছে। যেমন দেবতাদের বাহন থাকে, তেমনি মুহুরি ও মোক্তার নামে ইহাদের দুটী বাহন আছে। ফৌজদারি জেলের মধ্যে কি যমরাজার রৌরব নরকে এই বাহনদের ন্যায় নীচকর্ম্মা লোক আছে কি না সন্দেহ। কারণ যাহাকে কখন জীবনের মধ্যে দেখে নাই, কিছু পয়সা হাতে দিলেই সেই সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিকে শপথ ক’রে সুপরিচিত বলতে কুণ্ঠিত হয় না, আবার পয়সা না পেলে নিজের জন্মদাতাকেও চিনতে পারে না। মিথ্যাকথা প্রবঞ্চনা জাল জুচ্চরি তাদের অঙ্গের ভূষণ ও সরল বিশ্বাসী লোকদের ঠকান ও মানুষের গলায় ছুরি বসান তাহাদের একমাত্র পেশার মধ্যে পরিগণিত হ’য়ে থাকে। তবে এদের মনিব ধনে মানে শ্রেষ্ঠ, বিদ্যায় সুপণ্ডিত আইনে অভিজ্ঞ উকীল মহাশয়েরা বাহনদের ন্যায় ছিটকে চুরি পছন্দ করেন না, ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে ভালবাসেন না। শীকার পেলে ময়ালসাপের মতন একেবারে গিলে ফেলেন, এমন কি পরিপাক শক্তির তেজে কাঁটাটি পৰ্য্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না, সমস্তটা বেমালুম হজম হ’য়ে যায়। এই অর্থ পিশাচদের কবলে পতিত হ’য়ে কত সুখের সংসার যে শ্মশানে পরিণত হ’য়েছে, কত ভদ্রপরিবার যে একেবারে পথের ভিখারী হ’য়ে প’ড়েছে তাহার আর ইয়ত্তা নাই। ইহারা প্রথমে একেবারে আকাশের চাঁদ হাতে দেয়, ভুলেও সত্যকথা বলে না। যতক্ষণ পর্য্যন্ত একফোঁটা রস থাকে, ততক্ষণ অবধি জোঁকের ন্যায় চুষিতে আরম্ভ করে; তারপর সম্পূর্ণরূপে ছোবড়া হ’লে, তবে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বকের দলে সারস পক্ষীর ন্যায় ইহাদের মধ্যেও ধর্ম্মভীরু সদাশয় ভদ্রলোক দু-একটী আছেন, পরের উপকার সাধন, বিপন্নের বিপদোদ্ধার তাঁদের পুণ্যময় জীবনের প্রধান কর্ত্তব্যের মধ্যে পরিগণিত, তবে তাঁহারা সংখ্যায় অতি অল্প বলে গণনার মধ্যে আসে না।

লছমীপ্রসাদবাবুর নিকট উকীল নামধেয় জীবের গুণের কথা শুনে আমি নিতান্ত বিস্মিত হ’লাম। যারা মনুষ্য হ’য়ে ধর্ম্মের ধার ধারে না, তুচ্ছ অর্থের জন্য মনুষ্যত্বকে বলি দেয়, মিথ্যাকথা ছলনা কি কাপট্য ব্যবহারকে পাপ ব’লে স্বীকার করে না, যে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করা যাদের জীবনের একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য, তারা যদি ভদ্রলোক হয়, তাহলে আর অভদ্র কে? মনের দৌর্ব্বল্য নিবন্ধন মানবের সহসা কোন প্রকারে পদঙ্খলন হ’লে, অনুতাপের দ্বারায় সে পাতক কথঞ্চিৎ লাঘব হ’তে পারে, কিন্তু তুচ্ছ স্বার্থের জন্য জেনে শুনে সজ্ঞানে কোন পাপে লিপ্ত হ’লে, কিছুতেই সেই জ্ঞানকৃত মহাপাতকের মোচন হয় না। অনন্তকাল নরকভোগ ভিন্ন সেই সকল মহাপাপীদের আর কোন গত্যন্তর নাই।

আমি মনে মনে এই সকল কথা তোলাপাড়া করছি, এমন সময় লছমীপ্রসাদবাবু হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “আর তোমার ভাবনা কি? তোমার দয়ারসাগর মুরুব্বিরা যে উকীল খাড়া ক’রে দেবে, সেই তিন কথায় তোমাকে খালাস ক’রে আনবে।”

আমি। আচ্ছা তাই যেন হ’লো, কিন্তু হাকিমের কাছে, আমাকে কোন কথা বলতে বারণ করলে কেন?

লছমী। তুমি ছেলেমানুষ, তার উপর সরলচিত্ত, সংসারের চাতুরী এখনও শিক্ষা কর নাই, সেইজন্য পাপাত্মের মতলব বুঝতে পার নাই। এই পাপাত্মারা নিজেদের মনের মতন একজন উকীলকে তোমার স্বপক্ষে নিযুক্ত করবে, সে বেটা তোমার উপকারের দিকে লক্ষ্য না ক’রে, ঐ বেটাদের নিরাপদের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করবে। ঐ পাপাত্মারা আগাগোড়া মিথ্যাকথায় এই মামলা যেরূপভাবে সাজিয়েছে, উকীল বেটা তাই বজায় রেখে কথা কইবে, কাজেই তাদের কাহার উপর কোন আঁচ লাগবে না। পাছে তুমি সত্য কথা কহিলে, তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়, হাকিমের মনে খট্‌কা জন্মায়, সেইজন্য তোমাকে কোন কথা কহিতে নিষেধ করিল। নিশ্চয় কোন গাছতলার বব্বুলে উকীল এই মামলায় নিযুক্ত হ’য়েছে, কারণ জলে তেলে যেমন মিশ খায় না, তেমনি বদমাইস ভিন্ন কোন ভদ্রলোকের সহিত কখনই এদের মিলন হ’তে পারে না।

লছমীপ্রসাদবাবুর প্রমুখ্যাৎ এই সকল কথা শুনে আমি উত্তর করিলাম, “তা হোক, আমি কিন্তু সত্য ভিন্ন মিথ্যা বলিব না, অকপটে সকল কথা প্রকাশ করিয়া বলিব, তাহাতে আমার ভাগ্যে যা থাকে তাই হবে।”

আমার কথা শুনে সদাশয় লছনীপ্রসাদ হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “ভাই! ম্লেচ্ছদের ধর্ম্মাধিকরণে সত্যের সম্মান নাই, এখানে অর্থ ও যোগাড়ের গুণে নিতান্ত অসম্ভব ব্যাপারও সম্ভবে পরিণত হ’য়ে থাকে। সুতরাং সত্য কথা বলিলেই যে তুমি এই বিপদ হ’তে মুক্ত হবে বা বিচারপতি তোমার কথা বিশ্বাস করবেন, ইহা আমার বিশ্বাস হয় না। যাই হোক, তুমি কিছুতেই হতাশ হইও না, সেই দেবপ্রতিম ব্রাহ্মণের কথা সৰ্ব্বদা স্মরণ রাখিবে, মনে বিশ্বাস রাখবে যে ভক্তের বোঝা ভগবান বহন ক’রে থাকেন। মানুষ পোড় না খেলে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে না, বোধ হয় সেইজন্য আজ তুমি এরূপ দশায় পতিত হয়েছ, অপরাধ না ক’রেও অপরাধীর স্থান অধিকার ক’রেছো। সংসারে নানা ভোলধারী কপট লোকের সঙ্গে মিশে ম্লেচ্ছদের আইনের মাহাত্ম্য ও বিচার প্রণালী দেখে নিশ্চয় এই অল্প বয়সেই তুমি বহুদর্শীত্ব লাভ করবে। কাজেই সংসারী জীবের উপর একপ্রকার বিজাতীয় ঘৃণার উদ্রেক হবে, তাদের সঙ্গে কোন প্রকার সম্বন্ধ রাখিতেও আর তোমার স্পৃহা হবে না। পাছে সংসারের বাহ্য চাক্‌চিক্য দেখে বালসুলভচাপল্যনিবন্ধন তাহাতে আকৃষ্ট হও, কি কোনপ্রকার মায়ার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হ’য়ে পড়, সেইজন্য মাখাল-ফল-বিশেষ সংসারের অভ্যন্তর ভাগটা সেই কৌশলময় কৌশলে তোমাকে দেখাইলেন। তুমি নিশ্চয় একজন ভাগ্যবান পুরুষ, তোমার অদৃষ্ট ভিন্ন উপকরণে গঠিত, সেইজন্য তোমার উপর তাঁর লক্ষ্য প’ড়েছে। বোধ হয় অল্পদিনের মধ্যে তোমার ছেলেখেলা শেষ হ’য়ে যাবে, তাই এই অল্পবয়সেই তোমাকে তুফানে ফেলেছেন। এখন এই মহাত্মার কথামত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসের খেই ধ’রে থাক, তাহ’লে সকল তরঙ্গ কাটিয়ে পরপারে পাড়ি জমাতে পারবে।

লছমীপ্রসাদ বাবু এই কথা ব’লে প্রস্থান করলেন, আমি একাকী সেইখানে ব’সে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম।

এইরূপে পাঁচদিন সেই হাবুজখানার মধ্যে অতিবাহিত হইল, তবে লছমীপ্রসাদবাবুর কৃপায় আমার কোন বিষয়ের বিন্দুমাত্র কষ্ট হইল না; একমাত্র এক স্থানে আটক থাকা ভিন্ন আমি যে অপরাধী তাহা বুঝিবার কোন উপায় ছিল না। কেন না প্রত্যহ্ ফুলাল তৈল মাখিয়া স্নান করিতাম, আহারাদিরও বিশেষ পরিপাট্য ছিল; হাবুজখানার সিপাহীরা খানসামার ন্যায় হুকুমে চলিত, সুতরাং ষষ্ঠীবাটার নিমন্ত্রণে সমাগত নূতন জামাইবাবুর ন্যায় প্রচুর আদর অপ্যায়নে আমার এই কটা দিন বেশ কাটিয়া গেল।

ক্ষুৎপিপাসায় কাতর কোন ব্যক্তিকে উত্তম পৰ্য্যঙ্কে দুগ্ধফেননিভ সুকোমল শয্যায় শয়ন করালে ফোন তাহার সুনিদ্রা হয় না, তেমনি এতো আদর যত্নে, আহারের ঈদৃশ পারিপাট্যে আমার প্রাণে শান্তি কি মনে বিন্দুমাত্র সুখ ছিল না। কেমন একপ্রকার অব্যক্ত ত্রাস ও উৎকণ্ঠায় অন্তরাকাশ রাত্র দিন সমাচ্ছন্ন থাকিত। বিশেষ এই সদাশয় লছমীপ্রসাদবাবু সম্বন্ধে একটা খট্‌কা আমার অন্তরে উদয় হ’য়েছিল। কারণ আমার প্রতি ঈদৃশ সদয় দেখে, একদিন অবসর বুঝে তাঁহার পারিবারিক সম্বন্ধের সকল কথা খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা ক’রেছিলাম। তাহাতে তিনি আমাকে ব’লেছিলেন, “ভাই হরিদাস! তোমার নিকট মিথ্যা কথা কহিলে নিশ্চয় জগদম্বার কোপে পতিত হ’তে হবে, অথচ সরল সত্য কথা বলিবার উপযুক্ত সময় এক্ষণে আসে নাই; সুতরাং এক্ষণে তোমার মনের কৌতুহলকে তৃপ্ত করতে পারলাম না। তজ্জন্য আমি তোমার নিকট সানুনয়ে ক্ষমা ভিক্ষা ক’চ্ছি। তবে এখন এইমাত্র বল্‌ছি যে, আমি কোন উদ্দেশ্যের বশবৰ্ত্তী হ’য়ে এক্ষণে সম্পূর্ণরূপে আত্মগোপন ক’রে ছদ্মবেশে ভ্রমণ করছি। যেদিন আমার সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে, আমার জীবনের মহাব্রতটির উদ্‌যাপন হবে, সেই দিন এই ছদ্মবেশ ত্যাগ ক’রে জগতে আমার প্রকৃত মূৰ্ত্তি প্রকাশ করবো। তুমি ভাই নিশ্চয় যেন তোমার সঙ্গে আমার আবার সাক্ষাৎ হবে, তবে সম্ভবতঃ সে সময় উভয়েরই অবস্থার পরিবর্ত্তন ঘটবে। এরূপ বেশে আমাকে আর দেখতে পাবে না।”

এই সকল কথা শুনে আমি অপার বিস্ময়-কূপে নিমগ্ন হইলাম। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল যে, সংসারে ঘোর অপকর্ম্মা বদমাইসরা নিজেদের নিরাপদের জন্য, কি লোক ঠকাবার অভিপ্রায়ে সংসারে ছদ্মবেশ ধারণ ক’রে থাকে, পিতা মাতা প্রদত্ত প্রকৃত নাম গোপন ক’রে জনসমাজে ভিন্ন নামে পরিচিত হয়, কিন্তু লছমীপ্রসাদবাবুর ন্যায় ধর্ম্মভীরু সদাশয় ব্যক্তি কিজন্য এ প্রকার নীচপথের পথিক হ’লেন? নিশ্চয় ইহার মধ্যে কোন গূঢ় রহস্য আছে, তা না হ’লে ইহার ন্যায় মহৎ ব্যক্তি যে রাজদণ্ডের ভয়ে আত্মগোপন ক’রে লোকের চক্ষে ধূলি প্রদান করবেন, তাহা কিছুতেই সম্ভবপর নহে। কারণ এই কয়েকদিনে লছমীপ্রসাদ বাবুর অন্তরের যে প্রকার পরিচয় পেয়েছি, তাতে ইনি যে কোনরূপ গুরুতর অপরাধ ক’রে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করবেন ইহাও সহসা বিশ্বাস হয় না, ইনি ত আমাকে স্পষ্ট বলেন যে, কখন যদি আমার জীবনের ব্রত উদ্‌যাপন হয়, তাহ’লে জনসমাজে আমার প্রকৃত মূর্ত্তি প্রকাশ করবো। ইহাতে ত স্পষ্ট প্রতীত হ’চ্ছে যে, ইনি কোন বিশেষ উদ্দেশ্যের বশবর্ত্তী হ’য়ে এই ছদ্মবেশ ধারণ ক’রেছেন।

লছমী প্রসাদবাবু সম্বন্ধে এই সকল কথা আমার মনে তোলাপাড়া হ’তে লাগলো, ভদ্রতার অনুরোধে তাঁকে বিশেষ পেড়াপেড়ি করতেও সাহস হ’লো না, কাজেই তখনকার মতন আমাকে নিরস্ত হ’তে হ’লো।

ষষ্ঠ দিন প্রাতঃকালে লছমীপ্রসাদবাবু আমাকে কহিলেন, “অদ্য তোমার বিচারের দিন স্থির হ’য়েছে, কাজেই বেলা এগারটার পর তোমাকে কাজী সাহেবের এজলাসে হাজির হ’তে হবে। আজই তুমি মুসলমান শাসনকর্ত্তাদের প্রবর্ত্তিত আইনের মাহাত্ম্য বুঝবে ও অদ্ভুত বিচার প্রণালী প্রত্যক্ষ করবে; তবে কিছুতেই ভীত হইও না, মনে ঠিক্ যেন যে, এই সংসারে যার কিছুমাত্র সহায়সম্পত্তি নাই, তাঁর উপর যার চিরনির্ভর থাকে, সেই অগতির গতি শ্রীপতি স্বীয় শান্তিময়কোলে সেই তাপিত জনকে আশ্রয় দিয়ে থাকেন। সেইজন্য ভক্তেরা আদর ক’রে তাঁকে ভক্তবৎসল ব’লে ডাকে। যাই হোক্‌ তুমি প্রস্তুত হ’য়ে থাক, আদালত হ’তে সিপাহী আসিলে তাহাদের সঙ্গে তোমাকে যেতে হবে।”

লছমীপ্রসাদবাবু এই কথা ব’লে প্রস্থান করিলেন। যদিও এক্ষণে আমার আহারাদির কোনপ্রকার কষ্ট হয় নাই, কিন্তু তথাপি এরূপ অলসভাবে সময়ক্ষেপ করা আমার পক্ষে নিতান্তই কষ্টকর হয়েছিল, কাজেই এই সংবাদে আমি মনে মনে আনন্দিত হইলাম। রাত্রদিন উৎকণ্ঠিতভাবে দুর্ভাবনার সেবা করা অপেক্ষা, ভালমন্দ যা হোক্‌ একটা মীমাংসা হওয়া আমার নিতান্ত অভিপ্রেত হ’য়ে উঠেছিল। বিশেষ কাজী সাহেবের বিচারপ্রণালী দেখবার ইচ্ছা আমার মন মধ্যে নিতান্ত প্রবল হ’য়েছিল, দেখি না তিনি কিরূপ প্রমাণ বলে আমাকে খুনে ব’লে স্থির করেন।

বেলা নয়টার পর দেবীসিং আহারের যোগাড় ক’রে দিল, আমি পরিতোষে উদরদেবকে পূজা করিলাম, মনে হইল এরূপ রাজভোগ আবার যে করে জুটিবে তাহার কোন স্থিরতা নাই। আগাগোড়া সব সত্য কথা কহিলে, পাছে কিষণজি বাবুর কোন বিপদ ঘটে, পাপাত্মাদের বিদ্যা প্রকাশ হ’য়ে পড়ে, এই ভয়ে দেবীপ্রসাদ বেটা এখানে এসে বৃথা স্তোকবাক্যে আমার মুখ বন্ধ করিয়া গেল, খরচ ক’রে উকীল নিযুক্ত করবে ব’লে লোভ দেখাইল, ফল কথা কেবলমাত্র নিজেদের নিরাপদের আশয়ে কিষণজি বাবুর সঙ্গে পরামর্শ এঁটে ওবেটা যে এসেছিল, তাতে আর অণুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু মোহিতবাবুও কি এই ষড়যন্ত্রের ভিতর আছেন? তিনিও কি আমাকে বিপদে ফেলবার জন্য পাপাত্মাদের সঙ্গে মিলিত হ’য়েছেন? কিষণজি কি দেবীপ্রসাদ তাঁহার কিরূপ দরের সুহৃদ, তাহা আমি তাঁহাকে উত্তমরূপে বুঝিয়ে দিয়েছি, এত শীঘ্র তিনি কি আমার সেই সব কথা বিস্তৃত হ’য়ে পুনরায় পাপাত্মাদের ছলনাজালে আবদ্ধ হবেন? হ’লেও হ’তে পারে, কেন না অর্থপিশাচ পিতার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য বড় মানুষের ঘরে আস্তো মা ভগবতীসদৃশ যে সকল পুত্ত্ররত্ন জন্মায়, তারা প্রায় বিদ্যার কুকি, সভ্যতায় সাঁওতাল ও বুদ্ধিতে হাবা তাঁতির পিতামহ হ’য়ে থাকেন, সুতরাং নিরেট মুর্খ, নিতান্ত নির্ব্বোধ মোহিতবাবু যে পাপাত্মাদের মোহিনী মন্ত্রে মুগ্ধ হ’য়ে আমাকে বিপদে ফেলার জন্য যে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে, তাহার আর বিচিত্র কি? আমার বেশ বোধ হ’চ্ছে যে মূর্খ মোহিত বাবু ইহাদের কবলে পুনরায় পতিত হ’য়েছে এবং বানর যেমন বেদেদের ইঙ্গিতক্রমে তালে তালে নাচে, তেমনি এদের কথার ঘুরছে ফিরছে। যাই হোক্ আবার যদি দেবীপ্রসাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তাহ’লে মোহিতবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করবো, দেখিনা বেটা কি উত্তর দেয়। পাপাত্মা দেবীপ্রসাদ যে আমাকে সত্য কথা বলবে, তাহা কিছুতেই সম্ভবপর নহে। তবে আমি কোন কথা গোপন করবো না, কি একটী কথাও মিথ্যা বলবো না, অকপটে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করবো, দেখিনা বিচারপতি আমার কথা শুনিয়া কিরূপ বিচার করেন।

আমি মনে মনে এই স্থির ক’রে প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হ’য়ে রইলাম। বেলা প্রায় সাড়ে দশটার পর লছমীপ্রসাদবাবু আমাকে তাহার সেরেস্তার ঘরে ডাকাইয়া পাঠাইলেন, আমি তথায় গিয়া দেখিলাম যে, দুইজন সিপাহী আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

লছমীপ্রসাদবাবু একখানি পত্র লিখিয়া তাহাদের হাতে দিলেন ও ছল ছল নেত্রে আমাকে কহিলেন, “ভাই! ইহাদের সঙ্গে তোমাকে আদালতে যেতে হবে। তুমি যখন সম্পূর্ণ নিরপরাধ, তখন তোমার বিন্দুমাত্র ভীত হবার কারণ না থাকিলেও এখানে যখন সত্যের সম্মান নাই, তখন তুমি চাইকি আইনের মাহাত্ম্যে, অর্থের প্রভাবে, যোগাড়ের গুণে দণ্ডিত হ’লেও হ’তে পার, কিন্তু তাতে পরিণামে তোমার উপকার ভিন্ন অপকার হবে না। লোকে রঙ্গ দেখবার জন্য যেমন রঙ্গভূমে প্রবেশ ক’রে থাকে, তেমনি তুমিও এই সংসার মধ্যে এসেছো, তবে অতি অল্পদিনের মধ্যে তোমার দেখা শুনা শেষ হবে, এক্ষণে অবিচলিত চিত্তে মন প্রাণ সেই মদনমোহনের পাদপদ্মে রেখে প্রশান্ত মনে এ রঙ্গ দেখ, মনে ঠিক জেনো যে, মহীলতা মৃত্তিকা মধ্যে বাস ক’রেও যেমন মৃত্তিকা স্পর্শ করে না, তেমনি তুমিও সংসার মধ্যে অবস্থান ক’রে সংসারের কলুষ-কলাপে অভির্ভূত হবে না। মেঘমুক্ত সূর্য্যের ন্যায় পুনরায় দ্বিগুণপ্রভায় প্রভান্বিত হবে, এক্ষণে মনে মনে দুর্গানাম স্মরণ ক’রে কাজী সাহেবের আদালতে গমন কর, সুসময় সমাগত হ’লে পুনরায় আমরা আবার মিলিত হবো।”

লছমীপ্রসাদবাবু বিরত হ’লে, আমি সেপাহীদের সঙ্গে হাবুজখানা হ’তে বহির্গত হ’লাম ও তাহাদের সঙ্গে আদালত উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।

তদানিন্তন কেল্লার মধ্যে স্বতন্ত্র একটী বাটীতে কাজী সাহেবের ফৌজদারি আদালত ছিল। প্রহরীরা আমাকে বৃহৎ ফটকযুক্ত, ইসলামিকেতনে শোভিত সেই বাড়ীটার মধ্যে নিয়ে গেল এবং সিঁড়ির ঠিক নীচের একটা ছোট কুটুরির ভিতর প্রবেশ করাইয়া বাহির হ’তে চাবি বন্ধ করিয়া দিল ও দরজার কাছে একটা ত্রিভঙ্গ ভাঙ্গা টুলে অতি সাবধানের সহিত সন্তর্পণে বসিয়া রহিল।

সেই ঘরের মধ্যে একখানি ছোট তক্তপোষ ছিল, আমি সেইখানির উপর বসিলাম ও এক মনে আমার ভাগ্যের কথা ভাবিতে লাগিলাম। প্রায় আধ ঘণ্টাটাক পরে দেবীপ্রসাদ আসিয়া দেখা দিল। কিন্তু এখন তাহার সম্পূর্ণরূপ ভোল ফিরিয়াছে, আমি কখন এপ্রকার আমিরালি পোষাকে পাপাত্মা দেবীপ্রসাদকে দেখি নাই, কাজেই তাহার ধরণধারণ ও পোষাক পরিচ্ছদের কায়দা দেখে নিতান্ত বিস্মিত হ’লাম, মনে মনে বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, পাপাত্মা কোন মতলব হাসিল করবার জন্য এ প্রকার বেশ পরিবর্ত্তন ক’রে এসেছে।

আমি দেখিলাম যে, দেবীপ্রসাদ পুরোদস্তুর পশ্চিমা মুসলমান সেজেছে, চাপকানের বোতামগুলিও মুসলমানি কায়দার, এমন কি হাতের তেলোতে মেদিপাতার রং ও আঙ্গুলে ঝুটো পাথর বসান গোটা কয়েক রূপার আংটী পর্য্যন্ত পরিতে ভুল করে নাই।

এখন মালকোচা মারা ধুতির স্থানে খুব চোস্ত রেশমী পাজামা অধিকার ক’রেছে, শ্রীঅঙ্গে একটী ফুলকাটা সাটীনের চাপকানের উপর কালাবার্ত্তুর কাজকরা কাল রঙ্গের মখমলের ফতুয়া শোভা পাচ্ছে, মাথায় উত্তম মসলিনের লাট্টুদার পাগড়ি, পায়ে একজোড়া মুখ উচু জরির লপেটা জুতো সুবৃহৎ নাগরা বেচারীকে বেদখল ক’রে শ্রীপদ যুগলে বসবাস করছে। ফল কথা পাপাত্মা দেবীপ্রসাদ একেবারে পুরোদস্তুর বেমালুম মুসলমান সেজেছে, কাজল পরা খোকার ন্যায় দুই চক্ষে সুর্ম্মা পরেছে, কাণে তুলাশুদ্ধ এক ফায়া আতর ও গালে এক গাল ছাচি পান রয়েছে, এবং ছাগলে যেমন পাতা খায় সেইরূপ ভাবে সেই পানগুলি চিবুচ্ছে। আমি তার এই মুসলমানী কায়দা ও ভাবভঙ্গি দেখে একটু না হেসে থাকতে পারলাম না।

পাপাত্মা দেবীপ্রসাদ এইরূপে ভোল ফিরিয়ে সেই দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো এবং প্রহরীর হাতে একটা সিকি দিল, অমনি সেই প্রহরী-কুল-তিলক লম্বাগোচের একটা সেলাম ক’রে, তখনি চাবি খুলিয়া দিল, কাজেই দেবীপ্রসাদ হাসি হাসি মুখে আমার কাছে আসিয়া বসিল।

এই অবস্থা বিপর্য্যয়ে আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, মুসলমানদের পবিত্র আদালত গৃহের টিকটিকিটা পর্য্যন্ত হাঁ করিয়া আছে, পয়সা খরচ ভিন্ন এখানে কোন উপায় নাই, কাজেই আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য যে দেবীপ্রসাদের কিঞ্চিৎ ব্যয় হইবে তাহার বিচিত্র কি?

দেবীপ্রসাদ আমার পাশে সেই তক্তপোষের উপর ব’সে একটু মৃদুস্বরে কহিল, “সব ঠিক ক’রেছি, কিষণজি বাবুর প্রায় ২০০৲ শত টাকা খরচ হ’য়ে গেছে, মামলার খাসা তদ্বির হ’য়েছে, তোমায় কোন কথা বলতে হবে না, তুমি উকীলের উপর সব নির্ভর ক’রো, তিনি আইন মোতাবেক সওয়াল জবাব ক’রে মামলাটা ফাঁসিয়ে দেবেন। আমরা তোমার জন্য মাতব্বর গাওয়া খাড়া ক’রেছি, তারা হয়হবু সব কথা বলবে, তুমি কেবল কোন কথার জবাব দিও না, উকীল জেরা করে তাদের দমিয়ে দেবে। তুমি তো জান সাক্ষী না-হ’লে মাম্‌লা হয় না, কেন না আদালত প্রমাণের বাধ্য, কাজেই আগে পাকা পাকা গাওয়া যোগাড় করা খুব দরকার। তাই তোমাকে বাঁচাবার জন্য আমি নিজে হলফ ক’রে গাওয়া দিব, আর যাতে মামলা ফেঁসে যায়, আগাগোড়া সেই রকম ভাবের কথা বলবো। এমন উকীলের বেটা উকীল নেই যে, আমাকে টলাতে পারে, আমি তিন কথায় মামলা ফাঁসিয়ে দোব; তবে আমি মোবারিক আলি হ’য়ে গাওয়া দোব, কারণ তা না হ’লে তেমন জোর দাঁড়াবে না, তোমার ভালর জন্য আমরা মামলা যেরূপ ভাবে তদ্বির করবো, তাতে তুমি কোন কথা কোও না। কেন না তদ্বির করতে পারলে নেহাৎ পচা মামলাও জেতা যায়, আবার তদ্বির অভাবে সাচ্চা মকদ্দমাও হার হ’য়ে থাকে। আমরা যখন টাকা খরচ ক’রে ভাল উকীল লাগিয়ে নিজে সাক্ষ্য দিয়ে, তোমার মামলার তদ্বির করছি, তোমার খালাসের যোগাড়ে আছি, তখন তোমার মতন ছেলেমানুষের এতে কি কথা কওয়া উচিত?

আমি পাপাত্মার এই সকল কথা শুনে অবাক্ হ’য়ে গেলাম, কি যে বলি তাহা হঠাৎ স্থির করতে পারলাম না। ইতঃপূৰ্ব্বে লছমীপ্রসাদবাবু যে পরোয়ানা পাঠ করেছিলেন, তাতে তিনটে সাক্ষীর মধ্যে মোবারিক আলি নামে একজন সাক্ষী ছিল, এখন দেখছি পাপিষ্ঠ দেবীপ্রসাদই মোবারিক আলি সেজে সাক্ষ্য দেবে, সেইজন্য বেটা পুরো দস্তুর মুসলমান সেজেছে। ওঃ এ জগতে এ বেটাদের পক্ষে কোন অকাৰ্য্য নাই, যে কাজে শয়তানের প্রাণ কাঁদে, পিশাচের সাহসে কুলায় না, স্বার্থের স্বম্ভাবনা থাকলে সেইরূপ কাজ মানবরূপ এই সকল প্রেতেরা অনায়াসে সম্পন্ন করতে পারে।

ফল কথা, আমার মনে বিন্দুমাত্র ত্রাসের সঞ্চার হইল না, কেমন এক প্রকার অব্যক্ত সাহসে হৃদয় সুদৃঢ় হইয়া উঠিল। এখন কেবল প্রহসনের ন্যায় হাস্যোদ্দীপক এই অদ্ভুত বিচারপ্রণালী দেখবার একটা কৌতুহল আমার অন্তর মধ্যে প্রবল হইয়া উঠিল। আমি বুঝিয়া দেখিলাম, এখন আমার প্রাণের কথা প্রকাশ করলে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। কাজেই পূর্ব্বের ন্যায় ন্যাকা সাজিয়া রহিলাম, পাপাত্মা দেবীপ্রসাদকে স্পষ্ট কোন কথা কহিলাম না, তবে মোহিতবাবুর কথাটা জানিবার সাধ হৃদয় মধ্যে নিতান্ত প্রবল হ’য়ে উঠেছিল, সেইজন্য শিষ্ট বালকের ন্যায় অতি মোলামভাবে কহিলাম, “আপনারা আমার মঙ্গলের জন্য যখন এতদূর পরিশ্রম করছেন, তখন আমি কখন আপনাদের অবাধ্য হ’য়ে চলবো না। আপনারা যা বলবেন, আমি তাই করবো, কিন্তু একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছি, আপনি অনুগ্রহ ক’রে সত্যকথা বলবেন কি?”

আমার এই কথা শুনে দেবীপ্রসাদ বুঝতে পারল যে, ঔষধ ধরিয়াছে, কাজেই বিপুল আনন্দে অধীর হ’য়ে, বিরাট গোঁফজোড়াটিতে তা দিতে দিতে একটু গম্ভীরভাবে মুরুব্বিয়ানা ধরণে কহিল, “কি জিজ্ঞাসা করবে কর, সত্য ভিন্ন মিথ্যা বলা আমার আদৌ অভ্যাস নাই।”

আমি অতি কষ্টে হাসির বেগকে দমন ক’রে কহিলাম, “আচ্ছা মোহিতবাবুর কোন সংবাদ আপনি জানেন কি?”

দেবীপ্রসাদ ফিক্ ক’রে একটু হেসে কহিল, “খুব জানি, খাসা জানি, আমি আর মোহিতবাবুর খবর জানি না, তাকে যে হাতে ক’রে মানুষ ক’রে দিলাম।”

আমি। তাহ’লে তিনি এখন কোথায়?

দেবী। গুলজার বাড়ীওয়ালির বাড়ীতে হরদম মজা মারছে, এতদিনের পর তার পড়তা একেবারে খুলে গেছে, কাজেই সে এখন সাতরাজার ধন এক মাণিক বনে গেছে।

আমি পাপাত্মার কথার মর্ম্ম বুঝতে না পেরে কহিলাম, “কিসে তার পড়তা খুলে গেল?”

দেবী। এতদিন তার ইয়ারকিরূপ-স্রোতের মুখে যে জগদল পাথরখানি ছিল, সেখানি এতদিনের পর স’রে গেছে, কাজেই বাছাধন এখন পুরো তেজে স্ফূর্ত্তির ফোয়ারা ছোটাচ্ছে।

আমি বল্লুম, “আপনি স্পষ্ট ক’রে বলুন যে, মোহিতবাবুর কিসে পড়তা খুলে গেল?”

দেবী। এ আর বুঝতে পারলে না, আজ তিন দিন হ’লো তার কৃপণ বাপ বেটা শিঙে ফুকেছে, কাজেই সে এখন ১০/১২ লক্ষ টাকার মালিক, তাই এখন কাচা গলায় দিয়ে হরদম মজা ওড়াচ্ছে।

আমি এই কথা শুনে নিতান্ত বিস্মিতভাবে কহিলাম, “কি ক’রে কর্ত্তার মৃত্যু হ’লো? এরমধ্যে কর্ত্তার এমন কি ব্যায়রাম হ’য়েছিল?”

দেবী। ব্যারাম হয় নাই, এক বেটা তাকে খুন ক’রেছে।

আমি নিতান্ত ব্যগ্রভাবে কহিলাম, “কি বলছেন, ভূড়োকৰ্ত্তাকে খুন ক’রেছে, কে কিরূপ সুবিধায় তাকে খুন করলে, আসামী কি ধরা প’ড়েছে?”

দেবী। না শালা বেমালুম ছুরি মেরে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে প’ড়ে পালিয়েছে, কেউ তাকে ধরতে পারে নাই। তবে লোকে কানাকানি করছে যে, ও বেটা যে তাঁতিদের সর্ব্বনাশ করেছে, বোধ হয় তাদের বংশের কেউ একাজ ক’রেছে।

প্রকৃতপক্ষে কর্ত্তাকে যে কে খুন ক’রেছে, তা বুঝতে আমার অধিক বিলম্ব হ’লো না, কিন্তু এত শীঘ্র যে পাপাত্মার পাপের ফল ফলবে, সেই হতভাগ্য উন্মাদ যুবক যে নিজের বিষম প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে সক্ষম হবে, তাহা আশা করি নাই। কাজেই এই সংবাদে আমি নিতান্ত বিস্মিত হ’লাম, তবে প্রকৃত ব্যাপারখানা জানিবার জন্য পুনরায় জিজ্ঞাসা করলাম, “কর্ত্তা সাহেবদের একজন বড় আম্‌লা, বাহিরে যেতে আসতে হ’তে তাঁর সঙ্গে সাহেবের লোকজন থাকে, তাহ’লে তাকে কি ক’রে খুন করলে?”

দেবী। ঠিক সন্ধান রেখেছিল, তাই ঝাঁ ক’রে কাজ গুছিয়ে ফেলতে পারলে; চেষ্টা করলে কি না হয়, মানুষ আর কদিন সাবধান হ’য়ে থাকতে পারে?

আমি। তবু সে কি সুবিধায় খুন করলে, আপনারা তা শুনেছেন ত?

দেবী। হাঁ শুনেছি বৈকি, লোকটা বেশ কায়দায় কাজ হাসিল ক’রেছে। বুড়ো বেটা পাল্কী চ’ড়ে আফিসে যাওয়া আসা করতো, পাল্কীর সঙ্গে প্রায় দু-একজন সরকারি আরদারি থাক্‌ত, এক দিন সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় কৰ্ত্তা বেটা পাল্কীতে শুয়ে আসিতেছিল, সঙ্গে কোন লোকজন ছিল না, এই সুবিধা পেয়ে সে বেটাও বাঘের মতন এক লাফে বেটার ভূঁড়িতে ছুরি বসিয়ে দেয় ও গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে প’ড়ে পালিয়ে যায়, কাজেই কেউ খুনেকে ধরতে পারে নাই। বেটা মনের রাগে একেবারে নির্ঘাত ছুরি বসিয়েছিল, কেন না তারি পরদিন কর্ত্তা মরে যায়, সাহেবরা অনেক চেষ্টা ক’রেছিল, কিন্তু কিছুতেই বাঁচাতে পারল না।

আমি। আচ্ছা মোহিতবাবু সে সময় বাড়ী ছিল?

পাপাত্মা দেবীপ্রসাদ একবার আমার মুখের দিকে কট্‌ট্‌ ক’রে চেয়ে উত্তর করিল, “তা আমি ঠিক জানি না। আমাকে রাতদিন নিজের ধান্দায় ঘুরতে হয়, কাজেই পরের তত খবর রাখবার আমার তেমন ফুরসুৎ নাই। যাই হোক্ মোহিতবাবু এখন একখানা উঁচুদরের জিনিস হ’য়ে দাঁড়িয়েছে। এখন যে তাকে ছুঁতে পারবে, সেই লাল হ’য়ে যাবে। এখান হ’তে তোমাকে খালাস ক’রে মোহিতবাবুর সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিব, তুমি ভরপুর মজা মারতে পারবে এখন আমি যা ব’লে গেলাম ঠিক সেই রকম কাজ কর, তোমার সব দিকে সুবিধা হবে। আর আমি দেরী করতে পাচ্ছি না, কাজী সাহেব এলেই পহেলা কাছারিতে তোমার ডাক হবে। আমি এখন চল্লাম, আমার কথাগুলো স্মরণ রেখ।”

এই কথা ব’লে পাপাত্মা দেবীপ্রসাদ ওরফে মোবারিক আলি সে স্থান হ’তে প্রস্থান করিল। আমি একাকী সেইখানে বসিয়া পাপাত্মা অৰ্থপিশাচ মাণিকলালের পরিণামটা ভাবতে লাগলাম। এই সংসারে সাধনা করলেই যে সিদ্ধিলাভ হ’য়ে থাকে একথা কিছুতেই মিথ্যা নহে। সেইজন্য নিঃসহায় সেই উন্মাদ যুবক মাণিকলালের ন্যায় ধনে মানে শ্রেষ্ঠ একজন প্রতাপশালী লোককে অনায়াসে খুন করতে সক্ষম হ’লো। বোধ হয় পাপী মাণিকলালের রক্তে যুবকের রোষাগ্নি নির্ব্বাপিত হ’তে পারে, তজ্জন্য তাহার প্রকৃতিস্থ হওয়ার নিতান্ত সম্ভাবনা, তারপর আমি সেই মহাত্মাকে তাহার সংবাদ দিয়াছি, তিনি নিশ্চয় সন্ধান করবেন, এবং যাতে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হ’য়ে পুনরায় সংসারী হয় তারও উপায় ক’রে দেবেন। পাপীর দণ্ড, পুণ্যবানের পুরস্কার যখন সংসারের সাধারণ ধর্ম্ম, তখন শেষে এই তাপিত যুবক যে পত্নী নিয়ে সুখী হবে তাহা নিশ্চয়; কিন্তু দশ লক্ষ টাকার অধিপতি হইয়াও মোহিতবাবু কখনই সংসারে সুখী হ’তে পারবে না। কারণ তার জীবনের প্রিয়সঙ্গিনী, পার্থিব সুখের নিদানভূতা ধৰ্ম্মপত্নী বিপথগামিনী ও পরপুরুষতা, তিনি নিজেও মূর্খ, অপরাধী এবং নীচ আমোদপ্রিয়, কাজেই তিনদিনেই তাকে পথের ফকির হ’তে হবে। অশ্ব দুষ্ট হ’লে সুচালকের গুণে যেমন সুপথে পরিচালিত হয়, অগ্নি পরশে অঙ্গার যেমন মলিনমূর্ত্তি পরিত্যাগ করে, তেমনি গুণবতী পতিব্রতা পত্নীর গুণে নিতান্ত পাষণ্ডেরও সংশোধন হ’য়ে থাকে, কিন্তু আমি কুমুদিনীর চরিত্রের যে প্রকার পরিচয় পেয়েছি, তাতে হতভাগ্য মোহিতবাবুর সে আশা আদৌ নাই; আমার বেশ বোধ হ’চ্ছে, কর্ত্তার মৃত্যুতে পাপিনী কিছু টাকা সংগ্রহ ক’রে সেই অকৃতজ্ঞ খানসামার সঙ্গে পলায়ন করবে, পাঁচজন ধূৰ্ত্ত বদমাইসে কর্ত্তার পাপার্জ্জিত অর্থগুলি লুটে নেবে, মূর্খ মোহিতবাবু কিছুতেই পিতৃধন রক্ষা করতে পারবে না।

মোহিতবাবু যদিও চরিত্রহীন উন্মার্গগামী যুবক কিন্তু তথাপি একেবারে হৃদয়হীন পাষণ্ড নহে। কেবলমাত্র কুসংসর্গে পতিত হ’য়ে তাহার এ প্রকার অধঃপতন হ’য়েছে। আমি তাহার অন্তরের অনেক সদ্‌গুণের পরিচয় পেয়েছিলাম, বোঝালে বুঝিবার ক্ষমতা তাহার আছে। আমি এ সময় তাহার কাছে থাকিলে অনেকটা উপকার হ’তো, কারণ অসৎ সঙ্গে তাহাকে মিশিতে দিতাম না; কিন্তু এখন তাহাকে সাবধান করবার কি সদুপদেশ দেবার লোক কেহই নাই, সকলেই নিজেই জঘন্য স্বার্থসাধনের তরে তাকে পাপকার্য্যে যথেষ্ট উৎসাহ দেবে, সুতরাং অল্পদিনের মধ্যে তাকে যে সৰ্ব্বস্বান্ত হ’তে হবে, তাতে অণুমাত্র সন্দেহ নাই।

আমি একাকী ছোট তক্তপোষখানির উপর ব’সে মনে মনে এই সকল কথা ভাবছি, এমন সময় সেই কুটুরির দ্বার পুনরায় উদ্ঘাটিত হ’লো, এবং একজন বরকন্দাজ প্রবেশ ক’রে নিতান্ত রুক্ষস্বরে কহিল, “চলবে চল্, হজরত আলির কাছে চল, তোর এনসাফ হবে।”

যদিও আমার প্রাণে বিশেষ কোন ভয়ের সঞ্চার হয় নাই, এই অদ্ভুত বিচার-প্রণালী দেখবার একটা প্রবল কৌতুহল জন্মেছে, কিন্তু তথাপি এই কথা শুনে আমার বুকটা যেন গুর গুর করিয়া উঠিল, হাঁটু কাঁপিতে লাগিল ও ঘর্ম্মজলে সৰ্ব্বাঙ্গ আর্দ্র হইয়া পড়িল। আমি বলপূর্ব্বক আমার এই চিত্তবিকারকে দমন করিয়া ও নীরবে কলের পুতুলের ন্যায় সেই লোকটার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। লোকটা আমার হাতখানি ধ’রে সেই সোপানাবলী অতিক্রম করিল ও কাজী সাহেবের ডানদিকের কাটারার মধ্যে আমাকে প্রবেশ করাইয়া দিল।

আমি বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে সেই আদালতের চারিদিক দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম যে, কক্ষটি বেশ প্রশস্ত, ঠিক মধ্যস্থলে উচ্চ মঞ্চের উপর একখানি গদি আঁটা কেদারার উপর কাজী সাহেব বসিয়া আছেন ও আধুনিক ইংরাজি কায়দাসম্মত একটী মর্ম্মর প্রস্তর শোভিত টেবিল তাহার সম্মুখে শোভা পাচ্ছে। কাজী সাহেবের মঞ্চের একটু নীচের তক্তপোষের উপর ঢালা বিছানায় বড় বাক্সো কোলে ক’রে দু-জন লোক মুখোমুখি হ’য়ে বসে আছে। তাদের এক পৈটে নীচে মেজের উপর খানকয়েক কেদারা র’য়েছে ও সামলা মাথায় দিয়ে নকিব সেজে জনকয়েক লোক বসে আছে, তাদের পশ্চাতে দর্শকদের জন্য খানকয়েক বড় বড় বেঞ্চি পাতা র’য়েছে।

কাজী সাহেবের বয়স প্রায় ৬০ বৎসরের কাছাকাছি হবে, কিন্তু দেহের মাংস ততদূর লোল হয় নাই, কাজেই স্বাস্থ্যের পূর্ণলক্ষণ তাহার শ্রীঅঙ্গে বৰ্ত্তমান আছে।

কাজী সাহেবের বর্ণ টুকুন ফিট্ গৌর, মাথায় কার্ত্তিকের ন্যায় পাকা চুলের বাবরি ও তস্য উপর একটী সাচ্চার টুপি একবগ্‌গা হ’য়ে শোভা পাচ্ছে।

কাজী সাহেব লোকটা ছিপ্‌ছিপে একহারা, কাজেই একটু ঢেঙ্গা, মুখখানি ঠিক বাঙ্গালা পাঁচের মতন, চক্ষু দুটী ক্ষুদ্র ঈষৎ কোঠরগত ও সুন্মায় শোভিত, তবে তাহার তারা দুটি কাল কি কটা তাহা বর্ণনা করা দুঃসাধ্য, কারণ অহিফেন প্রসাদে রাত্রদিন ঝাঁপ পড়িয়া আছে, কাজেই লোকচক্ষুর সম্পূর্ণ অগোচর। কাজী সাহেবের নাকটী বেশ ঠিকালো, ঠোঁট দুখানি পাতলা ও তাম্বুলরাগে রঞ্জিত, নিদ্রার সময় ব্যতীত আর সকল সময় মসলাযুক্তা পান তাহার গালে থাকিত, হঠাৎ দেখিলে বোধ হইত যেন ছাগলে পাতা চিবাইতেছে।

পুরুষের মুখের প্রধান শোভা গোঁফ দাড়ির সহিত কাজী সাহেবের বড় সম্বন্ধ নাই, একপ্রকার মাকুন্দ বলিলেও চলে, কেবল রামছাগলের অনুরূপ তামার সলার ন্যায় ফাঁক ফাঁক দুচারগাছি দাড়ি, খোদার নুরস্বরূপ বর্ত্তমান আছে।

কাজী সাহেব নিজের পদমর্য্যাদার উপযুক্ত বেশভূষায় ভূষিত হ’য়ে বিচারাসনে ব’সে আছেন, ছেলেদের হাতে যেনন চুষি থাকে, তেমনি তাঁর বাঁহাতে সটকার নল শোভা পাচ্ছে, তিনি এক একবার সেইটে নিয়ে মুখের ভিতর পুরে নিঃশব্দে টানছেন ও চোখ দুটি বুজিয়ে মাঝে মাঝে যেন ধ্যানস্থ হ’য়ে প’ড়ছেন।

আমি সেই কাঠরার মধ্যে গিয়া কাজী সাহেবকে একটী লম্বাগোচের সেলাম করিলাম, তিনি অতি কষ্টে চক্ষের ঝাঁপ তুলে একবার ফিরে চেয়ে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। মুসলমান রাজত্বে যে কি প্রকার অদ্ভুত বিচার প্রণালী, তাহা আমি থানায় অনেকটা পেয়ে থাকলেও এক্ষণে আদালতে কিরূপ হয় তাহা দেখবার জন্য কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

আমার মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, মূর্খ ধনীদের বৈঠকখানায় মোসাহেব নামে এক প্রকার নিকৃষ্ট জীব সতত অবস্থান করে। বাবুর তোষামদ করা তাদের একমাত্র কর্ত্তব্যের মধ্যে পরিগণিত, কিন্তু এখন দেখছি যে মুসলমানদের ধর্ম্মাধিকরণেও এ প্রকার জীবের অবাধে গতিবিধি আছে। কারণ কাজী সাহেবের শ্রীমুখ হ’তে কোন একটা কথা বহির্গত হইলেই, “সোভানআল্লা” “কেয়া খুব” “বহুত আচ্ছা” প্রভৃতি শব্দ চারিদিক্‌ হ’তে উত্থিত হয় ও বাহবার ধূম প’ড়ে যায়।

আমি কাঠগড়ার ভিতর দাঁড়িয়ে এই সকল রঙ্গ দেখছি, এমন সময় কাজী সাহেব বাজে কথা ছেড়ে দিয়ে কাজে মন দিলেন, কাজেই আমার বিচার আরম্ভ হ’লো।

কাজী সাহেবের এজলাসের একটু নীচে যে দুজন লোক বাক্স কোলে ক’রে ব’সে ছিল, তাদের মধ্যে যিনি পেশকার তিনি দাঁড়িয়ে উঠে একখানা কাগজ নিয়ে খুব চেঁচিয়ে প’ড়তে আরম্ভ করলেন। পূর্ব্বে লছমীপ্রসাদ বাবু আমাকে যে পরোয়ানাখানি প’ড়ে শুনিয়েছিলেন এখানি তাহারই প্রতিলিপি, আমার অপরাধ স্বাব্যস্থ করবার জন্য কাজী সাহেবের কাছে পেশ করা হ’য়েছে।

কাগজ পড়া শেষ হ’লে কাজী সাহেব গম্ভীরভাবে নিমীলিত নেত্রে কহিলেন, “আদালত প্রমাণের বাধ্য, কাজেই গাওয়ার দ্বারায় প্ৰমাণ না হ’লে কখনই কাহাকেও দণ্ড দেওয়া যায় না। অগ্রে তজবিজ না ক’রে সাজা দিলে খোদাতাল্লার কাছে গুণা হবে।”

কাজী সাহেবের মুখের কথা শেষ হ’লেই অম্‌নি চারিদিকে অজস্র বাহবা বৃষ্টি হ’তে লাগলো, আমি কেবল অতি কষ্টে মুখে চাদর দিয়ে হাসির বেগকে দমন করিলাম।

বাহবার গোল থামিলে বিচার আরম্ভ হ’লো, তবে কাজী সাহেব আমাকে কোন্ কথা জিজ্ঞাসা করা সঙ্গত ব’লে বোধ করিলেন না, কেবল পাছে অবিচার হয় এই ভয়ে প্রমাণ প্রার্থনা করিলেন। আমি উপযাচক হ’য়ে কোন কথা বলতে সাহস করিলাম না, কেবল কাঠের পুতুলের ন্যায় নীচের সেই কাঠগড়ার মধ্যে দাঁড়াইয়া রহিলাম।

এমন সময় সেই পেশকারের ইঙ্গিতক্রমে একটা লোক সাক্ষ্য দেবার জন্য সেই ছোট কাটগড়াঠার মধ্যে প্রবেশ করিল। আমি জীবনের মধ্যে কখন তাহাকে দেখি নাই, তবে লোকটা যে কোন ইতর জাতীয়, তাহা তাহাকে দেখিয়াই আমি বুঝিতে পারিলাম। এক্ষণে এ লোকটা কি বলে তাহা স্থির কর্ণে শুনিতে লাগিলাম।

পেশকার মহাশয়ের প্রশ্নে লোকটা বলিতে আরম্ভ করিল, “আমার নাম সার্থক জেলে, পিতার নাম হৃদয়নাথ জেলে, নিবাস বালুচর, আমি মাছ ধরিয়া দিনপাত ক’রে থাকি। গত চৈত্রমাসে, তারিখ ঠিক স্মরণ নাই, আমি মাছ ধরিবার জন্য গঙ্গায় জাল ফেলিতেছিলাম, হঠাৎ আমার জাল ভারি হওয়ায় আমি উপরে তুলিয়া দেখি তাহার মধ্যে একটা বস্তা রহিয়াছে। আমি বস্তা খুলিয়া দেখি, তাহার মধ্যে একটা মুসলমান যুবকের লাশ র’য়েছে। আমি নিতান্ত ভীতভাবে সেই বস্তা লইয়া কোতয়ালিতে চলিলাম, পথে তিন চার জন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তাহারা কহিল যে, গত রাত্রে একটী ছোকরা এই বস্তা ঘাড়ে ক’রে গঙ্গার দিকে যেতেছিল। তারা সেই ছোকরার যে প্রকার চেহারা বর্ণনা করিয়াছিল তাহার সহিত এই কাঠগড়ার ছোকরার চেহারার ঠিক্ মিল হ’চ্ছে, তাহ’লে নিশ্চয় এই বালক আকোচ ক’রে গুলির দ্বারায় সেই মুসলমানটাকে খুন ক’রেছে।”

সাক্ষীটা সাক্ষ্য দিতে এসে এক’ রকম রায় দিয়ে গেল, কেবল দণ্ডাজ্ঞাটা প্রকাশ করা বাকী রহিল। ফলকথা এই সত্যবাদী সাক্ষীর জবানবন্দি শুনিয়া আমি আর হাসি রাখিতে পারিলাম না, কিন্তু পাছে আদালতে বেয়াদবি প্রকাশ হয়, কাজী সাহেব চটে যান, এই ভয়ে মুখের ভিতর চাদর দিয়ে অতি কষ্টে হাসির বেগকে দমন করিলাম।

সাক্ষীর জবানবন্দি দেওয়া শেষ হ’লে, কাজী সাহেব চোখ দুটী বুজিয়ে ঝিম্ আওয়াজে কহিল, “এ গাওয়াকে কেউ কি কিছু জেরা করবে?”

কাজী সাহেবের এই কথা শুনে, সাম্‌লা মাথায় দুষমন চেহারার একটা লোক উঠে দাঁড়াল, আমি মনে করিলাম বোধ হয় এই বেটাই আমার পক্ষে উকীল নিযুক্ত হ’য়েছে, নিশ্চয় বদমাইস বেটারা এই বব্বুলে উকীলটাকে তাদের মনের মতন কথা বলতে শিখিয়ে দিয়েছে, কাজেই এ লোকটা সেই রকম পথ ধরবে, এখন দেখা যাক্, এ বেটা কি জেরা করে।

সেই উকীলটা উঠে কেতামত কাজী সাহেবকে কুর্ণিস ক’রে কহিল, “খোদাবন্দ, এই গাওয়াকে বেশি জেরা করা চলে না, কারণ কে যে বস্তা ফেলেছে, তাহা নিজের চখে দেখে নাই, কেবল লোকের মুখে শুনে বালকটাকে সুভো ক’রেছে মাত্র। কাজেই শুনা কথা আদালতে গ্রাহ্য হ’তে পারে না। আইনে ইহার হাজার নজীর আছে।”

কাজী সাহেব অতি কষ্টে খানিকটা চ’খের ঝাঁপ তুলে খুব মিহি আওয়াজে কহিল, “এ ওয়াজিবি বাত, এ গাওয়ার কথায় বালকের কসুর পাক্কা হ’তে পারে না, দোস্‌রা গাওয়া চাই, লেকিন আজ ওক্ত ব’য়ে গেছে, কাল এই মামলা শেষ করবো।” এই কটী কথা ব’লে কাজী সাহেব আবার ধ্যানস্থ হ’য়ে প’ড়লেন, কিন্তু ঘরের চারিধার হ’তে তাঁহার এই অদ্ভুত ন্যায়পরতা ও বুদ্ধিমত্তার জন্য সুখ্যাতির স্রোত প্রবাহিত হ’তে লাগলো।

বেলা প্রায় তিনটার সময় আমার মোকদ্দমার ডাক হইয়াছিল, তখন প্রায় ছয়টা বাজিয়া গিয়াছে, কাজেই আজকার মত মামলা মুতুবি রহিল। নীচেকার আমলাদ্বয় পাত্তাড়ি গুড়াইয়া ফেলিল, উকীল ও বেকার দর্শকদল ক্রমে ক্রমে আদালত গৃহ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। কাজেই আমিও কাঠগড়া হ’তে নামিলাম, দুজন সেপাহী আমার আগে পিছে যাইতে আরম্ভ করিল ও আমাকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় সেই হাবুজখানায় রাখিয়া আসিল।