- হরিদাসের গুপ্তকথা
- প্রথম পরিচ্ছেদ : কিসের মন্ত্রণা?
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : এরা কে?
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল!
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আজব চিঠি!
- পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বাবু দেবীপ্রসাদ।
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ভয়ানক ব্যাপার!
- সপ্তম পরিচ্ছেদ : বিষম সন্দেহ।
- অষ্টম পরিচ্ছেদ : আলেকসাই ফকির।
- নবম পরিচ্ছেদ : পীরের দরগা।
- দশম পরিচ্ছেদ : মোহিত বাবু।
- একাদশ পরিচ্ছেদ : ভূঁড়ো-কর্ত্তা।
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : গুণের খানসামা।
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : মাষ্টার মহাশয়।
- চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : গোমিস্ সাহেব।
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : আখড়া।
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ : গ্রেপ্তার।
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : দারোগা সাহেব।
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : হাজত বা হাবুজখানা।
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : কূপে-কমল।
- বিংশ পরিচ্ছেদ : হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
- একবিংশ পরিচ্ছেদ : আমার বিচার।
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বিচারালয়।
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ : এ কথা কি সত্য?
- চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ : ব্রহ্মচারী মহাশয়।
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ : গুপ্তকথা।
- ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ : পাপের পরিণাম।
- সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ : নবাব বাহাদুর।
- অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ : নীলমণি বসাক।
- ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ : উদ্যোগপৰ্ব্ব।
- ত্রিংশ পরিচ্ছেদ : আশা মিটিল।
- একত্রিংশ পরিচ্ছেদ : দীক্ষা।
- দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ : লক্ষ্মীনারায়ণ বাবু।
- উপসংহার
বিংশ পরিচ্ছেদ
হাজতে দ্বিতীয় রাত্রিবাস।
এই মহাপুরুষের আজ্ঞায় শয়ন করিলাম বটে, কিন্তু নিদ্রাদেবী সহসা তাঁহার শান্তিময়কোলে আমাকে স্থান দিলেন না। পূর্ব্বে মোহিতবাবুর চিন্তা আমার মনমধ্যে নিতান্ত প্রবল হ’য়েছিল, খাঁ সাহেবের আড্ডায় সেই সকল কথা শুনিয়া একান্ত উৎকন্ঠিত হ’য়েছিলাম, তারপর হঠাৎ এইরূপ গ্রেপ্তার হ’য়ে যারপর নাই ভীত হইলাম, কিন্তু এক্ষণে সে সকল ভাবনা ও ভয় সম্পূর্ণরূপে আমার অন্তর হ’তে অন্তর্হিত হ’য়ে গেল; আমি একমনে কেবল এই দেবপ্রতিম ব্রাহ্মণের কথা ভাবিতে লাগিলাম। ইনি প্রথমে আমাকে বাপু ব’লে সম্বোধন করলেন, কিন্তু পরে আমার পরিচয় শুনে, অথচ আমার মা বাপের নাম না জেনে, আমাকে বরাবর ভাই ভাই ব’লে ডাকতে লাগলেন, এর কারণটা কি? তারপর আমার কথা শুনে ঈষৎ হাস্যের রেখা তাঁহার অধরদেশে প্রকটিত হ’য়েছিল ও কিয়ৎকাল বিমনা হ’য়ে কি ভেবেছিলেন। আমি তখনি তাহা লক্ষ্য ক’রেছিলাম, তবে কারণ জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয় নাই; কিন্তু এখন বেশ বোধ হ’চ্ছে এই ত্রিকালজ্ঞ ব্রাহ্মণ সব জানেন, আমি কে, কার পুত্ত্র, কি সূত্রে কিষণজি বাবুর আশ্রয়ে আছি, তাহা যোগবলে জানিতে পারিয়াছেন, তবে কি জন্য জানি না, আমাকে কোন কথা স্পষ্ট করিয়া বলিলেন না। আমি ও সে সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করি নাই, কিন্তু একবার অবসর বুঝিয়া বিশেষরূপে অনুরোধ করিব। তাহ’লে এই দয়াশীল ব্রাহ্মণ কখনই আমাকে নিরাশ করিবেন না।
আমি মনে মনে এই যুক্তি স্থির করিয়া রাখিয়া এই ব্রাহ্মণ ও সদাশয় লছমীপ্রসাদ বাবুর কথা ভাবিতেছি এমন সময় ঊষার সুশীতল সমীরণ স্পর্শে আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম।
প্রভাতে উঠিয়া দেখিলাম, সেই ব্রাহ্মণ সেইখানেই নয়নদ্বয় মুদ্রিত করিয়া যোগাসনে বসিয়া আছেন ও তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ দিয়ে যেন একপ্রকার জ্যোতিঃ নিসৃত হ’চ্ছে। আমি সেই সময় এই মহাত্মার মুখের প্রসন্নভাব দেখে স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, ইহার হৃদয়ার্ণবে যে আনন্দের লহরী ক্রীড়া করছে, এই পাপতাপময় সংসারে মানুষের পক্ষে তাহা নিতান্ত দুর্ল্লভ। ফলকথা, ইনি যে এইরূপ স্বর্গীয় আনন্দে সমস্ত রজনী অতিবাহিত ক’রেছেন, একবারও শয্যায় শয়ন করেন নাই, তাহা আমি তাঁহার ভাব গতিক দেখে বুঝিতে পারিলাম।
আমি প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন ক’রে পুনরায় সেই ঢিপির উপর আসিয়া বসিলাম। সদানন্দ ব্রাহ্মণ হাসি হাসি মুখে কহিলেন, “কেমন ভাই! নিদ্রার তো কোন ব্যাঘাত হয় নাই?”
আমি উত্তর করিলাম, “আজ্ঞে, কষ্ট ত দূরের কথা, গতরাত্রি আমি যেরূপ মনের সুখে কাটিয়েছি, আমার ক্ষুদ্রজীবনের মধ্যে তেমন মনের সুখে একটী রাত্রিও অতিবাহিত হয় নাই। কিন্তু আপনি কি একবারও শয়ন করেন নাই, সমস্ত রজনী কি এইরূপ জাগ্রতভাবে কাটিয়েছেন, তাইত, একটু নিদ্রা না গেলে যে দেহ অসুস্থ হবার সম্ভাবনা।”
আমার এই কথা শুনিয়া সেই মহাপুরুষ গম্ভীরভাবে কহিলেন, “ভাই হরিদাস! মানুষে না বুঝে ভ্রমবশতঃ সোণা, হীরে, মণি, মুক্তা প্রভৃতি অসার বস্তুকে মূল্যবান্ ব’লে বোধ ক’রে থাকে, কিন্তু এই সংসার মধ্যে মানুষের পক্ষে সময়ের তুল্য মূল্যবান পদার্থ আর নাই। কারণ জগতে অর্থের বিনিময়ে সকল জিনিষ পাওয়া গিয়া থাকে, কিন্তু সময় একবার হারালে কুবেরের ভাণ্ডার ব্যয় করলেও আর ফিরে পাওয়া যায় না। মানুষ যদি মুহূৰ্ত্ত মাত্র সময় বৃথা কাজে অপব্যয় না ক’রে, বিষয় নির্বাচনপূর্ব্বক মনকে নিয়োগ করতে পারে, তাহ’লে তাহার এই ভবে আসা সার্থক হয়, কারণ তার উপর দুরন্ত কৃতান্তের পর্য্যন্ত আর কোন অধিকার থাকে না। ফলকথা, মানবের উন্নতি অবনতির প্রধান কারণ এই সংসারে সময়ের ব্যবহারের দোষে ও গুণে সংঘটিত হ’য়ে থাকে। মানুষে সামান্য দিনের জন্য সীমাবিশিষ্ট সময় নিয়ে এই সংসার রঙ্গভূমে প্রবেশ ক’রে থাকে, বৃথা নিদ্রায় সেই বহুমূল্য সময় অপব্যয় না ক’রে যতটুকুন নিজের ইষ্ট চিন্তা করতে পারি, চঞ্চল মনের চাঞ্চল্য নষ্ট করতে সক্ষম হই, তা ছাড়বো কেন? আমি পূর্ব্বে তোমাকেই ব’লেছি যে, এই সংসারে সকল বস্তুই সাধন-সাপেক্ষ, অভ্যাস ও সাধন প্রভাবে এই মানুষ যাবতীয় অসাধ্য সাধনে সমর্থ হ’য়ে থাকে, সুতরাং আহার নিদ্রা প্রভৃতি নিতান্ত সঙ্কোচসাধনও সেই অভ্যাসের সুধাময় ফল। আমরা অভ্যাসের গুণে তিন দিন পর্য্যন্ত অনাহারে থাকতে পারি, যদি এই তিন দিন মধ্যে জগদম্বা কোন ব্যবস্থা না করেন, তাহ’লে বুঝবো, কারাগারে অপবিত্র অন্নগ্রহণ করা সে বেটীর অভিপ্রেত, কাজেই তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবো।”
আমি। আজ ত আপনার তিন দিন পূর্ণ হবে, এখনও ত মুক্তির কোন সম্ভাবনা নাই, তাহ’লে আপনি কি করবেন?
ব্রাহ্মণ। ভাই, কি যে করবো, কি যে হবে, তা তো আমার বলবার ক্ষমতা নাই। সূত্রে আবদ্ধ পুত্তলিকা নৃত্যকারীর ইচ্ছামত যেমন নৃত্য করে, রশ্মিসংযুক্ত অশ্ব যেমন চালকের ইঙ্গিতে পরিচালিত হয়, তেমনি যাঁহার অভয় পাদপদ্মে জন্মের মতন আত্মবিক্রয় করেছি, সে বেটী আমাকে দিয়ে যা করাবেন, আমি তাই করবো, সেই জন্য ভবিষ্যতের দিকে আদৌ লক্ষ্য না ক’রে, যাতে এই বৰ্ত্তমানটা বৃথা কাজে অপব্যয় না হয়, তার জন্য চেষ্টা ক’রে থাকি।
এইরূপ কথাবার্ত্তা হইতেছে এমন সময় হঠাৎ সেই কক্ষের দ্বার উদ্ঘাটিত হইল এবং একখানি কাগজ হাতে ক’রে হাসি হাসি মুখে লছমীপ্রসাদ বাবু প্রবেশ করিলেন। তাহার মুখের প্রফুল্ল ভাব দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি কোন সুসংবাদ আনিয়াছেন।
লছমীপ্রসাদ বাবু একগাল হেসে কহিলেন, “প্রভুদের লীলা বোঝা ভার, বাস্তবিক আপনারা মার ছেলে বটে, মাও আপনাদের জন্য ভেবে থাকেন, সেই জন্য পাষাণের মধ্য দিয়ে স্নিগ্ধসলিলরাশি নিসৃত হ’লো, সাপের মুখ দিয়ে সুধা ঝরিল। তার সাক্ষ্য পারসী হ’তে অনুবাদিত এই হুকুমনামাখানা শুনুন।
“সুবেদার নিজামউলমুল্লুক নবাব মিরজাফর খাঁ বাহাদুরের হুকুম হইল যে, অত্রসহরে মিরপোটার কালীবাড়ীর কাফের মোল্লা বামাচরণ ব্রহ্মচারী নামে যে কাফের এনসাফের লেগে আটক আছে, তেনাকে বিনা এনসাফে ফেলফৌর খালাস দেওয়া হয়। ইতি ১৭ শ্রাবণ, ২১৭৫ হিজরি।
হজরতআলির হুকুমমতে ইব্রাহিম আলি সেখ।
মীর মুন্সী, দাওয়ান খাস
এই হুকুমনামার নিম্নে কাজী সাহেব লিখিয়াছেন।
“হুকুম হইল যে, কাফের বামাচরণ ব্রহ্মচারীকে এখনি হাবুজখানা হ’তে খোলসা দেওয়া হয়। ইতি ১৮ই শ্রাবণ।
মহম্মদ টোকী খাঁ কাজী।
এই হুকুমনামা শুনিয়া ব্রাহ্মণের কিছুমাত্র ভাবান্তর হইল না, আনন্দ বা উদ্বেগের কোন লক্ষণ প্রকাশ পাইল না, পূৰ্ব্ববৎ নিশ্চলভাবে বসিয়া রহিলেন; কেবল দুই চক্ষু দিয়ে অবিরলধারে অশ্রুজল গড়াইতে লাগিল, আমরা দুইজনে অবাক্ হ’য়ে তাঁর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম।
অল্পক্ষণ পরে ব্রাহ্মণ চক্ষের জল মুছে কাঁদ কাঁদ স্বরে কহিল, “দেখ ভাই, সে বেটীকে কেউ চৰ্ম্মচক্ষে দেখিতে পায় না, কিন্তু কাজেতে সে বেটী নিজেই হাতে-হাতে ধরা দেয়। মন ঠিক থাকলে, বিশ্বাসের খেই না ছাড়লে, মানুষের কোন বিষয়ই অপ্রাপ্য হয় না। তার সাক্ষ্য দেখ ভাই, রোজ যেমন প্রসাদ পাই, তেমন হ’লে তবে খাব, না হয় উপবাসে মরবো ব’লে কোট্ করলাম, মা আমার দু’দিন উপবাসে রেখে আর থাকতে পারলেন না। এই অধমের জন্যেও দয়াময়ীর দয়ার নদী উৎলে উঠলো, এ অধমের ক্ষুদ্র প্রাণ রক্ষার জন্যও ব্যস্ত হ’তে হ’লো। ভাই, শারদীয় জ্যোৎস্না যেমন প্রাসাদ ও কুটীরে সমানভাবে পতিত হয়, তেমনি সকল সন্তানের প্রতি মার স্নেহ সমান। তাঁকে যে ডাকে তাকে তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। অতএব ভাই, তুমিও এক মনে সেই বিপদবারিণীকে ডাক, তাহ’লে নিশ্চয় তুমিও এই বিপদ হতে উদ্ধার হবে।
আমার হরিষে বিষাদ উপস্থিত হ’লো কারণ এই মহাপুরুষের সঙ্গে যদি চিরকাল এইখানে আবদ্ধ থাকি, কুটীল সংসারের সঙ্গে যদি সকল সম্বন্ধ ছিন্ন হ’য়ে যায়, তাহ’লেও আমার মনে বিন্দুমাত্র কষ্টের উদয় হয় না, বরং অপেক্ষাকৃত প্রসন্নচিত্তে সময়ক্ষেপ করিতে পারি, কিন্তু এই মহাত্মার অভাবে একাকী এখানে বাস করা নিতান্ত কষ্টকর হইবে। সাধু সংসর্গের সুধাময় ফল যে অনিবার্য্য, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, কারণ একদিনের মধ্যে আমার মন যতদূর উন্নত হ’য়েছে, প্রাণে যতদূর শান্তির উদয় হ’য়েছে, অন্যস্থানে শত বৎসর থাকিলেও আমার মলিন অন্তরের এতদূর পরিবর্ত্তন হইত না। কাজেই এই মহাপুরুষের মুক্তির সংবাদে আমি নিতান্ত মৰ্ম্মাহত হইলাম। এই জগতে মানুষ মাত্রই স্বার্থপর হ’য়ে থাকে, যথার্থ পরার্থপরতা একমাত্র ঈদৃশ মহাপুরুষদের নিজস্ব সম্পত্তি, সেইজন্য এই শুভ সংবাদে আমি আনন্দিত না হ’য়ে নিতান্ত বিষণ্ণ হ’য়ে প’ড়লাম।
লছমীপ্রসাদবাবু কহিলেন, “ভক্তের বোঝা যে ভগবান বয়, এ কথাটা অভ্রান্ত সত্য, আজ আমি এ কথাটার স্পষ্ট প্রমাণ প্রাপ্ত হ’লাম। প্রবল বন্যায় গ্রাম ধ্বংস হ’লেও পলি-প’ড়ে পরিণামে ভূমির উর্ব্বরতা শক্তি বৰ্দ্ধিত হয়, তেমনি মুসলমানদের অধীনে আমার এই চাকুরী গ্রহণ, আমার সৌভাগ্যের নিদান ব’লে বোধ করছি। কারণ তা না হ’লে তো ভবদীয় শ্রীচরণ দর্শন ক’রে কৃতার্থ হ’তে পারতাম না। যাই হোক্, আপনি প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত হউন, আমি খাতায় আপনার মুক্তির কথা লিখিগে।”
লছমীপ্রসাদবাবু এই কথা বলিয়া সেই কক্ষ হইতে প্রস্থান করিলেন। আমি তখন ব্রাহ্মণের দুটী পায়ে জড়াইয়া ধরিয়া কহিলাম, “দয়াল প্রভো! এ জীবনের মধ্যে আর যে, আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিতে সক্ষম হইব তাহার সম্ভাবনা নাই; সুতরাং কৃপা ক’রে এই সময় আমার মনের সন্দেহ মিটাইয়া দিন। আমি বেশ বুঝেছি যে, যোগবলে কি অন্য কোন দৈব ক্ষমতার প্রভাবে আমার সম্বন্ধের সমস্ত কথা জানিতে পারিয়াছেন, অতএব দয়া ক’রে আমাকে সে সকল কথা বলুন। আর আপনি আমাকে বাৎসল্যরসে সিঞ্চিত বাপু সম্বোধনের পরিবর্ত্তে ভাই বলিয়া ডাকেন কেন তাহাও বলুন?”
ব্রাহ্মণ সযত্নে আমাকে তুলিয়া অত্যন্ত স্নেহস্বরে কহিলেন, “ভাই উঠ! আমি নিশ্চয় বলছি যে, তোমার সহিত আমার সাক্ষাৎ হবে; সেই সময় আমি তোমার মনের সকল সন্দেহ দূর করিব। এখন সে সকল কথা জানিবার কোন আবশ্যক নাই, তাহাতে তোমার বিন্দুমাত্র লাভ হইবে না; বরং অধিকতর উৎকণ্ঠিতভাবে কালযাপন করিতে হইবে, কোন কর্ত্তব্য কাৰ্য্যে মনোনিবেশ করিতে পারিবে না। কাজেই এখন যেরূপ অন্ধকারে আছ, সেইরূপভাবে আরও কিছুদিন থাক, তারপর সুসময়ের সমাগমে তোমার অভীষ্ট পূর্ণ হবে। এখন তোমার বয়ঃক্রম ঊনিশ বৎসর, কিন্তু বাইশ বৎসর বয়সের সময়, তোমার সকল সন্দেহ মিটিবে এবং তুমি নবজীবন লাভ করিয়া এক ভিন্ন জীব হইয়া পড়িবে। আর তোমাকে পাপাত্মা কিষণজি, কি নরাধম মাণিকলালের পাপ অন্ন গ্রহণ করতে হবে না। তুমি এখান হইতে মুক্ত হইয়া মীরঘাটার কালীবাড়ীতে যাবে, সেইখানে আমার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হবে। এই অধমকে সকলে বামাচরণ ব্রহ্মচারী বলিয়া ডাকে, সেইজন্য মীরাঘাটায় গিয়ে ব্রহ্মচারী মহাশয়ের কালীবাড়ীর কথা যাহাকে বলিবে, সেই তোমাকে দেখিয়ে দিবে; মীরঘাট এখান হইতে এক ক্রোশের অধিক হইবে না। এখান হইতে মুক্ত হ’য়ে, তুমি কোথাও না গিয়া আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবে, তাহ’লে আর তোমার কোন ভর ও ভাবনা থাকিবে না, তুমি সম্পূর্ণরূপে নূতন মানুষ হইয়া পড়িবে। তোমার কর্ম্মান্তিকে যেটুকু ভোগ আছে তাহা অগ্রে ভুগিয়া লও, তারপর অগ্নিশোধিত স্বর্ণের ন্যায় দ্বিগুণ প্রভায় প্রভান্বিত হবে। এক্ষণে ভাই, আমাকে বিদায় দাও, মনে ঠিক জেনো যে, অতি অল্পদিনের মধ্যে আমরা পুনরায় মিলিত হইব, এক্ষণে বৃথা ভয় ও ভাবনাকে অন্তর হইতে বলপূর্ব্বক দূর করিয়া দাও এবং যাঁর চরণের নিকট জন্মেরমত তোমার মস্তক বিক্রিত হ’য়ে আছে, তাঁহার পাদপদ্ম মনে মনে চিন্তা কর। যদি কিয়ৎ পরিমাণে মনের চাঞ্চল্যকে দমন করিতে না পার, তাঁরই পবিত্র নাম জপমালা কর, তাহ’লে ক্ষুধা তৃষ্ণাতেও তোমাকে সহসা কাতর করিতে পারিবে না। সেই নামের এমনি আশ্চর্য্য গুণ যে, মৃত্যুর অধীন স্বার্থের দাস এই মানব একবার তন্ময় হ’তে পারলে সকলপ্রকার অভাবের কবল হ’তে মুক্ত হ’য়ে যায়, তখন তার উপর দুরন্ত কৃতান্তের কোন অধিকার থাকে না। তারপর এ জগতে যার কেউ নাই, নিশ্চয় তিনি সেই অনাথের নাথ হ’য়ে থাকেন। আমার এই কথাটী ভাই রাত্রিদিন স্মরণ রাখবে, এক দণ্ডেরজন্য ও বিস্মৃত হইও না।
সেই দেবপ্রতিম তত্ত্বজ্ঞানী ব্রাহ্মণ এই সকল জ্ঞানগর্ভ কথা বলিয়া আর উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া ধীরপদবিক্ষেপে সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। আমি সেই ঢিপির উপর বসিয়া আকাশ পাতাল ভাবিতে লাগিলাম।
বেলা নয়টার সময় সেই দেবীসিংহ পূর্ব্বদিনের ন্যায় ফুলার তৈল, কাপড়, গামছা আনিয়া দিল, আমি গোসলখানাতে গিয়া স্নান করিলাম। দেবীসিং পঞ্চ ব্যঞ্জন সমেত অন্ন আনিয়া দিল, আমি পরিতোষে আহার করিলাম। অনেক দিনের পর বোকড়া চালের পরিবর্ত্তে সরু চালের অন্ন ও ঘৃত মসলা সংযুক্ত উপাদেয় তরকারি দ্বারায় উদরদেবকে পূজা করিলাম। ভূঁড়ো কর্ত্তার বাড়ীর সেই একঘেয়ে চাউলে জীবটা একরকম হেজে গিয়েছিল, আজ এই রাজভোগে যেন সেই জীবের পঙ্কোদ্ধার হ’য়ে গেল।
আমি লছমীপ্রসাদবাবুর ব্যবহারে নিতান্ত বিস্মিত হইলাম; কারণ আমি তাহার কোন আত্মীয় হওয়া দূরে থাক, স্বজাতী পৰ্য্যন্ত নহে। তিনি হিন্দুস্থানী, আর সম্ভবতঃ আমি বাঙ্গালী; পূৰ্ব্ব হ’তে কোন জানা শোনা ছিল না, হঠাৎ অপরাধীরূপে ইহার কাছে আমি আছি, তাহ’লে ইনি আমাকে এরূপ জামাই আদর করবেন কেন? সকল আসামীর প্রতি ইনি যে এত সদয় ব্যবহার করেন, তাহা কিছুতেই সম্ভব নহে, তবে বোধ হয় এর মধ্যে কোন রহস্য আছে।
লছমীপ্রসাদবাবু নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন, কাজেই আমার সঙ্গে তাহার আর সাক্ষাৎ হয় না। আমি একাকী আমার চিত্তাসহচরীকে লইয়া সেই ঘরে রহিলাম।
ক্রমে দিনমণি পশ্চিমগগনে আশ্রয় লইলেন। তাঁহার সেই সৰ্ব্বজনভীতিকর রুদ্রমূর্ত্তি এখন রম্যরূপে পরিণত হ’য়েছে। প্রকৃতি সতী ভাবুকজন মনলোভা অপূৰ্ব্ব সজ্জায় সজ্জিত হ’য়ে সন্ধ্যাসখীর জন্য অপেক্ষা ক’চ্ছে। কুসুমকুল হাস্যমুখে রসিক পবনের সহিত মাথা নেড়ে নেড়ে মনের কথা বলাবলি ক’চ্ছে। গগনগবাক্ষ খুলে দুই একটী তারা উঁকী মেরে এই রঙ্গ দেখছে, শীতল সমীর ধীরে ধীরে প্রবাহিত হ’য়ে যেন অমৃত বর্ষণ ক’চ্ছে, পক্ষীগণ বিভুগুণ গান করতে করতে স্ব স্ব শাবকের জন্য নীড় উদ্দেশে যাত্রা ক’চ্ছে। পতির অবর্ত্তমানে পাছে পরপুরুষের মুখ দেখতে হয়, এই ভয়ে লজ্জাশীলা পদ্মিনী সতী ঘোমটায় চাঁদমুখখানি ঢেকে ফেলেছে ও বেহায়া কুমুদিনী লজ্জাহীনা নারীর ন্যায় ঘোমটা খুলে হো হো ক’রে হাসছে।
দিবা ও সন্ধ্যার সন্ধি সময় প্রদোষ ব’লে অভিহিত হ’য়ে থাকে। এই সময় স্বভাবসুন্দরী তাপদগ্ধ জীবের ন্যায় নিজের শোভার ভাবান্তর খুলিয়া দেন; কিন্তু এই মধুর সময় যে কতদূর মনোরম, কিরূপ প্রীতিপ্রদ ও মন প্রাণ স্নিগ্ধকারী, তাহা বৎসরের মধ্যে এই কাল ভিন্ন অন্য সময় অনুভূত হয় না; কারণ শীতকালে এই মধুর প্রদোষের অস্তিত্ব পৰ্য্যন্ত থাকে না। তবে জীবের সুখ সৌভাগ্যের ন্যায় স্বভাবখানির এই সৰ্ব্বজনপ্রীতিকর মধুর-মূর্ত্তি অধিকক্ষণ স্থায়ী থাকে না। তবে সারল্যের প্রতিরূপ পলকে চক্ষে জল ও মুখে হাসি যেমন নিতান্ত মনোরম হয়, তেমনি এই সময় এক গগনে চন্দ্র ও সূর্য্যের উদয় একান্ত নয়নরঞ্জন হ’য়ে থাকে; কিন্তু স্বভাবের অকাট্য নিয়মবশে সকল বস্তুই পরিবর্ত্তনশীল, কিছুই চিরস্থায়ী হয় না, কাজেই দেখিতে দেখিতে প্রকৃতি সতীর এই এই মন-প্রাণ বিমোহনকারী মধুর-মূর্ত্তি তিরোহিত হইল ও দুষ্ট অন্ধকার এসে ধরাতলকে আচ্ছাদিত করিয়া ফেলিল।
সন্ধ্যার পর একজন ভৃত্য আসিয়া আলো জ্বালিয়া দিল ও কহিল, “একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এসেছে।”
এই সংবাদে আমি অপার বিস্ময়হ্রদে নিমগ্ন হইলাম। এই হাবুজখানায় কে যে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এসেছে, তাহা অনুমানে কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না; কিন্তু অধিকক্ষণ আমাকে উৎকণ্ঠিত অবস্থায় থাকিতে হইল না, কারণ অল্পক্ষণের মধ্যে দেবীপ্রসাদ আসিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত হইল।
পাপিষ্ঠ দেবীপ্রসাদ আমার নয়নপথের পথিক হইলে ক্রোধ ও ঘৃণার যুগপৎ আক্রমণে আমার অন্তর সমাক্রান্ত হইল; কারণ এ বেটাই যে, আমার এই দুর্দ্দশার প্রধান নায়ক, তাহা আমি অনেকটা অনুমানে বুঝিতে পারিয়াছিলাম; কিন্তু এ বেটা কি অভিপ্রায়ে আবার আমার নিকট এসেছে, তাহা জানিবার জন্য আমার মনের প্রকৃত ভাবকে গোপন করিলাম, বাহ্যিক কোনপ্রকার ক্রোধ প্রকাশ করিলাম না।
নরাধম দেবীপ্রসাদ আমার পার্শ্বে আসিয়া বসিল ও তাহার স্বভাবসিদ্ধ কর্কশ স্বরকে সাধ্যমত মোলাম ক’রে কহিল, “তাই তো ভাই, তুমি তো আচ্ছা ফ্যাসাদে প’ড়ে গেছো। আহা! ছেলেমানুষ, এই হাবুজখানায় না জানি কত কষ্ট পাচ্ছ। যাই হোক্, আমাদের কাণে কথাটা পৌঁছেচে, এখন তোমাকে বাঁচাবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিব, টাকাকে টাকা জ্ঞান করিব না। তুমি যাই কেন ভাব না, আমরা তোমাকে পর ভাবি না; সেইজন্য তোমার বিপদের কথা শুনেই আর থাকিতে পরিলাম না, হাতের সব কাজ ফেলে রেখে ছুটে এলাম, নেহাৎ পর ভাবিলে প্রাণের একটু টান না থাকিলে, এতদূর কষ্ট করে আসিবার কি গরজ ছিল?”
আমি পাপিষ্ঠকে উত্তমরূপে চিনিয়াছি, কাজেই এই ডাইনের মায়াতে মুগ্ধ হইলাম না; কেবল এ বেটার মতলবখানা ও এখানে আসিবার প্রকৃত উদ্দেশ্য জানিবার জন্য নেহাৎ ন্যাকা সেজে কহিলাম, “আচ্ছা বক্সীমশায়, আমি যে এই বিপদে প’ড়েছি, তা আপনি কি করিয়া জানিতে পারিলেন?”
আমার এই কথা শুনিয়া পাপিষ্ঠ এক গাল হেসে কহিল, “আরে, এ কথা কখন কি চাপা থাকে, একেবারে সহরময় গোল হ’য়ে প’ড়েছে।”
আমি এই ফাঁকা কথায় নিরস্ত না হ’য়ে পুনরায় কহিলাম, “তবু আপনি কি ক’রে বুঝিলেন যে, আমাকে গ্রেপ্তার ক’রেছে? প্রায় দুই মাস অতীত হইল, আপনি তো আমার কোন সংবাদ রাখেন নাই, তাহ’লে আজ আমার এই বিপদের কথা কিরূপে জানিতে পারিলেন?”
পাপাত্মা ঘোর মিথ্যাবাদী পিশাচের অবতার দেবীপ্রসাদ অল্পক্ষণ কি ভেবে উত্তর করিল, “আমি দুপুর বেলায় বাজারে এসেই শুনিলাম যে, গঙ্গা হ’তে যে মুসলমানের লাস পাওয়া গিয়াছে ও যাকে রহিম মোল্লা বলিয়া সকলে সনাক্ত করেছে, সেই মুসলমানকে যে খুন ক’রেছে, সেই আসামী গ্রেপ্তার হ’য়েছে। কথাটা শুনেই আমার প্রাণে কেমন একটা খট্কা লাগিল, আমি তখনি কোতয়ালিতে গিয়ে দারোগাকে দুটাকা নজর দিয়ে জানিতে পারিলাম, হরিদাস নামে এক ছোকরাকে খুনে বলিয়া গ্রেপ্তার করা হইয়াছে।”
আমি। আচ্ছা, আমি যে সেই রহিম মোল্লাকে খুন করিয়াছি বা আমার নাম হরিদাস তাহা কোতয়ালিতে কে বলিয়া দিল, তারপর কে আমাকে নিসিন্দি করিয়া দিল?
দেবী। কোতয়ালির গোয়েন্দারা ঠিক সন্ধান করেছিল, বিশেষ তুমি যে সাঁইজির সঙ্গে সে রাত্রে গিয়াছিলে, তা অনেকে দেখেছিল। তারাই এই মামলার গাওয়া হ’য়েছে, এখন কিছু টাকা খাইয়ে তাদের ভাঙ্গাতে হবে।
পাপিষ্ঠ দেবীপ্রসাদ যে আগাগোড়া মিথ্যা কথা কহিবে, তাহা বুঝিতে আমার বাকী রহিল না। তবে কি জন্যে, কি মতলবে এখানে এসেছে, তাহা জানিবার অভিপ্রায়ে আর অধিক জেরা না ক’রে কহিলাম, “তাহ’লে বক্সীমশায় এখন আমার উপায় কি হবে?” আমার এই কথা শুনিয়া, পাপাত্মা অনেকটা প্রসন্নভাবে মুরুব্বিয়ানা ধরণে কহিল, “তুমি যদি আমার কথামত চল, আমি যা বলি তা শুন, তাহ’লে এখন বাঁচাতে পারি; টাকা খরচ করিলে এই রাজ্যে হয়কে নয় করিতে পারা যায়।”
আমি। আমার তো একটী পয়সাও নাই, আমি টাকা কোথায় পাব?
দেবী। আরে তুমি তো নেহাৎ ছেলেমানুষ, তোমার টাকা নাই র’ইলো, তাতে আর ক্ষতি কি? এতদিন যে তোমাকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ ক’রেছে, সে কি আর তোমাকে এই বিপদের সময় দু-পাঁচহাজার টাকা খরচ ক’রে বাঁচাতে পারিবে না? তুমি তার বাড়ী ছাড়িয়াছ বলিয়া, তোমার ন্যায় তাঁর কি দয়া মায়া নাই?
আমি নেহাৎ ন্যাকা সেজে কহিলাম, “তাহ’লে কিষণজিবাবুও কি এই কথা জানেন?”
দেবী। জানেন বইকি, আমি এই খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁকে বলেছিলাম।
আমি। এ কথা শুনে তিনি কি বলেন?
দেবী। বলিবেন আর কি, অনেক দুঃখ করিতে লাগিলেন। উকীলের বাড়ী গিয়ে তোমায় বাঁচাবার মতলব ক’রে আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আহা, ছেলের মত যাকে ভালবাসিতেন, তার বিপদের কথা শুনে কখন কি স্থির থাকিতে পারেন, যাই হোক্ একটা মায়া আছে ত।
পাপাত্মার এই সকল মনভোলান কপটতামূলক অসার কথা শুনিবার ইচ্ছা আদৌ ছিল না, কাজেই আমি তাহার কথায় বাধা দিয়া কহিলাম, “কিষণজিবাবু কি ব’লেছেন সেই কথা আমাকে বলুন।”
দেবী। আরে, আমি সেই কথাই তো বলছি। তবে সব কথা খুলে না বলিলে, তুমি বুঝিতে পারিবে কেন? তুমি না বুঝে, পরের কুমতলব শুনে তার বাড়ী ছেড়েছ বটে, কিন্তু তোমার উপর তার ভালবাসার টান যায় নাই; তিনি তোমাকে বাঁচাবার জন্য জলের মত টাকা খরচ করিতে স্বীকৃত আছেন। এখন তুমি যদি আমাদের মতলবে চল, উকীলেরা যে কথা বলিতে বলিয়াছে, যদি কাজী সাহেবের কাছে সেই কথা বল, তাহ’লে নিশ্চয় এ মামলা ফেঁসে যাবে।
সাপের মুখ দিয়ে যেমন বিষ ছাড়া সুধা ক্ষরণ হয় না, তেমনি নরপ্রেত সদৃশ এই সকল পাপাত্মাদের মতলব কখনই কু-ছাড়া যে সু-হ’তে পারে না, তাহা বুঝিতে আমার বাকী ছিল না। তবে পাপাত্মাদের দৌড়খানা বুঝিবার জন্য, মনের প্রকৃত ভাবকে চাপা দিয়া কহিলাম, “বক্সীমশায়! আমার তো কোন সহায় সম্পত্তি নাই, এই সংসারের মধ্যে তোমরাই আমার একমাত্র আত্মীয় ও আপনার জন; এখন যাহাতে এই বিপদ হইতে আমি রক্ষা পাই, তার উপায় করুন। তারপর আপনি তো জানেন কে খুন করেছে? আমার তো তাহাতে কোন দোষ নাই, আমি কেবল কর্ত্তার কথামত সাইজির সঙ্গে গিয়াছিলাম মাত্র; কিন্তু সাইজিকে না ধরিয়া আমায় ধরিল কেন, আমার বিশেষ অপরাধ কি?”
পাপাত্মা দেবীপ্রসাদ আমার এই কথা শুনিয়া হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল, আমি তার মুখের দিকে চেয়ে রহিলাম। অল্পক্ষণ পরে হাসির বেগ থামিলে, পাপিষ্ঠ নিজের বাহাদুরি দেখাইবার জন্য কহিল, “কসুর করিলে যদি সাজা হইত, তাহ’লে এই গুজরত খোদ আজ গোঁফে তেল দিয়ে বাবুরমত বাইরে বেড়াতে পারতো না, কোনকালে জেলখানায় গিয়ে মাটী কিনতো। বাজারে বেশী পয়সা খরচ করলে যেমন ভাল জিনিষ পাওয়া যায়, তেমনি টাকা ছড়ালে এখানে ভালরকম বিচার কিনিতে পাওয়া যায়। তোমার হ’য়ে কেবল তোমাকে বাঁচাবার জন্য যখন একজন ভদ্রলোক টাকা খরচ করিতে সম্মত আছে, তখন তোমার আর ভয় কি? ভাল ভাল উকীল খাড়া ক’রে দিলে, তারা তিন কথায় মামলা ফাঁসিয়ে দেবে। সাইজি বেটা ফেরার হয়েছে, সেই জন্য তাকে ধরিতে পারে নাই; এখন আর বাজে কথার কোন দরকার নাই, তোমার মরণ বাঁচন এখন তোমার উপর নির্ভর ক’চ্ছে। তুমি মনে করিলে, আমাদের পরামর্শ মত চলিলে, বেকসুর খালাস হ’তে পার; এখানে টাকা খরচ করিলে সব পাওয়া যায়; যোগাড়ের গুণে, অর্থের জোরে হয়কে নয় করা কিছুতেই অসম্ভব নহে। সুতরাং আমাদের মতলব মত চলিলে যাহা শিখিয়ে দিব, কাজী সাহেবের কাছে তাহা বলিলে তুমি নিশ্চয় বেঁচে যাবে।”
আমি শান্ত শিষ্ট বালকের ন্যায় খুব বিনীতভাবে কহিলাম, “আপনারা যখন আমার একমাত্র মুরুব্বি, তখন আপনাদের কথা শুনবো না তো কার কথা শুনবো। আপনি এই বিপদের কথা শুনে যখন এত কষ্ট ক’রে এতদূর এসেছেন, তখন আমার উপর মহাশয়ের যে বিশেষ কৃপা আছে, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই।”
এইবার আমার কথা শুনিয়া দেবীপ্রসাদ একেবারে গলে গেল। আমাকে নেহাৎ একোবেকো বলিয়া মনে স্থির করিল, কাজেই বিপুল আনন্দে অধীর হ’য়ে গোঁফে তা দিতে দিতে মুরুব্বিয়ানা ধরণে কহিল, “তোমার জন্য একজন ভাল উকীল খাড়া ক’রে দিব। কাজী সাহেবকে ভেট পাঠাব, কাজেই মামলা ফেঁসে যাবে, তোমার কোন ভয় নাই; কিন্তু কাজী সাহেবের কাছে কোনরকম ছেলেমানুষি করো না; যা বলতে হয়, তা তোমার হ’য়ে সেই উকীল বলবে, তোমাকে কোন কথা বলতে হবে না, কেবল সেলাম ঠুকে পাথরের মুরদের মত দাঁড়িয়ে থাকবে।”
আমি তখন বালক, কাজেই দেশের কোন আইনের ধার ধারি না। এই সংসার-চিড়িয়াখানায় উকীল নামধেয় লোকেরা যে কি প্রকার জীব তাহাও জানি না; কখন তাহাদের সঙ্গে আলাপ করিবার অবসর ঘটে নাই, সুতরাং দেবীপ্রসাদের কথায় আমার প্রাণে একটা খট্কা লাগিল। কারণ আমি অপরাধী, আমার মুখের কথা না শুনিয়া উকীলের কথা প্রমাণে কিরূপ বিচার করিবেন এবং সেটা কিরূপ অদ্ভুত বিচার প্রণালী তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। কেন না উকীল তো নিজ হ’তে কোন কথা বলিবেন না, আমার মনের ভাব, প্রাণের কথা হাকিমের কাছে বুঝাইয়া বলিবে, তাহ’লে বিচারপতি প্রকৃত তথ্য জানিবার জন্য আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না কেন,—ইহাতে কি তাঁহার ন্যায় বিচারের পথ সঙ্কুচিত হবে না? ভাল, দেবীপ্রসাদকে এই কথা জিজ্ঞাসা করে দেখি ও বেটা কি উত্তয় দেয়।
আমি এই কথা মনে মনে স্থির ক’রে দেবীপ্রসাদকে কহিলাম, “আচ্ছা বক্সীমশায়! আমার যখন বিচার হবে, তখন হাকিম আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করবেন না কেন? আর উকীল আমার প্রাণের কথা তো হাকিমকে বুঝিয়ে দিবে, সুতরাং, আমাকে জিজ্ঞাসা ক’রে, সব কথা জেনে লইলে তো বিচারপতির বিচারের সুবিধা হইতে পারে?”
দেবীপ্রসাদ নিতান্ত বিরক্তভাবে উত্তর করিল, “আরে না তা হয় না; কি কথায় কি দাঁড়াবে, তা কি তুমি বুঝতে পারবে? শেষে একটা বেফাঁস কথা ব’লে সব মাটি ক’রে দেবে। উকীলের আইন বোধ আছে, তারা আইন বাঁচাইয়া কথা কইতে জানে, সেই জন্য মুটো মুটো টাকা দিয়ে তাদের নিযুক্ত করা। তাহারা মুখের জোরে হয়কে নয় করিতে পারে, তাদের অদ্ভূত ক্ষমতার তুলনা হয় না।”
দেবীপ্রসাদ বীরদর্পের সহিত উকীল মহাশয়দের গুণ বর্ণনা করিতে আরম্ভ করিল, কিন্তু সে সব কথার প্রকৃত মর্ম্ম বুঝিতে পারিলাম না, মনে কেমন একটা বিষম খটকা উপস্থিত হইল। আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম যে, বিদ্বান আইনজ্ঞ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ওকালতি ক’রে থাকেন, কিন্তু দেবীপ্রসাদ যেরূপ ধরণের কথা কইলেন, যে সকল গুণের উল্লেখ করিলেন, তাতে বেশ বোধ হইল যে, তাদের তুল্য নরাধম আর কেহ আছে কি না সন্দেহ। কারণ উচ্চাঙ্গের লেখাপড়া শিখে শেষে যখন স্রোতের ন্যায় অনর্গল মিথ্যাকথা বলতে হ’লো, মিথ্যাকে সত্য ও সত্যকে মিথ্যা বলিয়া প্রতিপন্ন করা পেশার মধ্যে দাঁড়াইল; মিথ্যাকথা, প্রতারণা, জুয়াচ্চুরি অঙ্গের ভূষণ হ’য়ে পড়িল, তখন প্রাণপাত ক’রে, বহু অর্থ ব্যয়ে সে শিক্ষালাভের আর কি গৌরব রহিল? যে শিক্ষায় মনুষ্যত্বের বিকাশ হয় না, হৃদয় উন্নত ও অন্তর মালিন্যপরিশূন্য হয় না, সতত বিমলাত্ম-প্রসাদ লাভের লালসা জন্মায় না, কেবল অন্তরে কতকটা গর্ব্বের উদয় হয়, সে প্রকার অপশিক্ষা কখনই প্রকৃত শিক্ষাপদবাচ্য হ’তে পারে না। বরং বিদেশী বিধর্ম্মীর নিকট হ’তে প্রাপ্ত এ প্রকার গর্ব্বমূলক, অন্তসারশূন্য কিঞ্চিৎ অর্থকরী অপশিক্ষার প্রাবল্য নিবন্ধন সমাজের মূল শিথিল ও মানুষ ঘোর স্বার্থপর আত্মসুখপ্রিয় অর্থপিশাচ ও কপট হ’য়ে প’ড়েছে।
আমি মনে মনে এই সব কথা ভাবিতেছি, এমন সময় দেবীপ্রসাদ আমাকে কহিল, “কেমন হে, আমার কথা বুঝতে পেরেছ ত? দেখো যেন বেফাঁস কোন কথা বলিয়া নিজের পায়ে নিজে কুঠার আঘাত করিও না। উকীল মাথা ঘামিয়ে যে মতলব ঠিক ক’রেছ ও তোমাকে যে কথা বলতে বলবে, তুমি তা ছাড়া আর কোন কথা বলিও না। আহা, ছেলেমানুষ, পাছে কোন বিপদে পড় এই জন্য দয়া ক’রে আমরা এতটা কচ্ছি, টাকাকে টাকা ব’লে জ্ঞান ক’চ্ছি না, তুমি এ ধর্ম্ম রেখো!”
আমার একবার মনে হ’ল যে, পাপাত্মাকে দশকথা শুনাইয়া দিই। আমি যে নেহাৎ বোকা নই, তাহাকে চিনিয়াছি, তার মতলব জানিয়াছি, তাহা প্রকাশ করিয়া বলি; কিন্তু আবার ভাবিলাম, তাহ’লে পাপাত্মা ক্রোধভরে এ স্থান হ’তে প্রস্থান করবে, আর কোন প্রাণের কথা মনের মতলব ভাঙ্গিবে না। কাজেই এ বেটার কতদূর দৌড় তাহা আগে দেখিয়া লই, তারপর আমার মনে যাহা আছে তাহাই করিব।
আমি এই উদ্দেশ্যের বশবর্ত্তী হইয়া তখনকারমত আমার মনের প্রকৃত ভাবকে গোপন করিয়া রাখিলাম। এই পাপিষ্ঠের প্রাণের মতলব জানিবার জন্য, দৌড়খানা বুঝিবার অভিপ্রায়ে, কোন রকম কড়া কথা না বলিয়া, শিষ্টবালকের ন্যায় খুব মোলামভাবে কহিলাম, “আমার উপর মহাশয়ের যে এতদূর দয়া আছে, তা আগে জানিতাম না। আমি না বুঝিয়া একটা কুকাজ ক’রেছি ব’লে কিষণজি বাবু যেন রাগ না করেন, আমাকে এ যাত্রা যেন মাপ করেন, আপনি আমার হ’য়ে বাবুকে দুকথা বলবেন।”
পাপিষ্ঠ দেবীপ্রসাদ পেঁচার ন্যায় গম্ভীর ভাবে মুরুব্বিয়ানাধরণে কহিল, “সে জন্য তোমার কোন ভয় নাই, বাপ মা কি কখন ছেলের দোষ ধরে। আমি তোমার হ’য়ে বাবুকে ভাল ক’রে দশকথা বলবো; আর তিনিও তোমাকে প্রাণের চেয়ে ভালবাসেন, সেইজন্য তোমার বিপদের কথা শুনে আর স্থির থাকিতে পারিলেন না, আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন, তা ছাড়া তোমাকে বাঁচাবার জন্য একশত টাকা খরচ ক’রে একজন ভাল উকীল খাড়া ক’রে দিবেন। সে তিন কথায় মামলা ফাঁসিয়ে দেবে, না হয় দু-দশ টাকা জরিমানা হবে। টাকার জন্য তোমার কাজ আটকাবে না, তবে তুমি নেমকহারামি ক’রো না। উকীল তোমাকে যেমন তালিম দেবেন, তুমি ঠিক সেই পথে চলিবে, নিজে ছেলেমানুষি ক’রে কোন কথা বলিও না।”
আমি এক “যে আজ্ঞে” বলিয়া তাহার সকল কথার উত্তর দিলাম। পাপিষ্ঠ আর কোন কথা না বলিয়া অনেকটা প্রসন্নচিত্তে বিদায় হইল, আমি সেইখানে বসিয়া আকাশ পাতাল ভাবিতে লাগিলাম। এমন সময় দেবীসিং একখানি থালায় ক’রে লুচি তরকারি ও মিষ্টান্ন আনিয়া দিল। আমি পরিতোষপূর্ব্বক উদরদেবকে পূজা করিয়া সেই ঢিপির উপর শয়ন করিলাম। একদল মশা আমার মনোরঞ্জনের জন্য শ্রুতিমধুর গান আরম্ভ করিল ও কতকগুলি উপবাসী ছারপোকা আমার সেবায় প্রবৃত্ত হইল। আমি আঃ উঃ প্রভৃতি আনন্দধ্বনি ক’রে গায়ক ও পরিচায়ক দলকে বাহবা দিতে লাগিলাম; এইরূপে হাবুজাখানায় আমার দ্বিতীয় রাত্রি অতিবাহিত হইল।